আহাদ হোসেন আমার বন্ধু।
আমরা একই এলাকাতে থাকতাম। আহাদ অজপাড়া গা থেকে ঢাকায় এসেছে লেখাপড়া করতে। থাকে একটা মেসে। যেহেতু একই এলাকাতে থাকি, তাই আমাদের প্রতিদিনই দুই একবার করে দেখা হতো। একদিন আহাদের সাথে অনেক গল্প হলো। জানলাম, দরিদ্র ঘরের ছেলে আহাদ। তার বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। নিজের সামান্য জমি আছে, সেটা গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে বন্ধক আছে। তাই আহাদের বাবা এখন অন্যের জমি চাষ করে। আহাদের একটা ছোট বোন আছে। সে গ্রামে থাকে বাবা মায়ের সাথে। অভাবের সংসার আহাদের। যাইহোক, আহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলো। আসলে মনে জিদ আর তীব্র ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। আমার জীবনে আমি যেক'জন ভালো মানুষ দেখেছি তার মধ্যে আহাদ একজন।
আমি খেয়াল করে দেখলাম-
আহাদের মধ্যে তেজ আছে, সাহস আছে, আছে সততা। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই ছেলে অনেক দূর যাবে। আহাদ চারটা টিউশনি যোগাড় করে ফেলল। তার লেখাপড়ার খরচ সে নিজেই চালায়। এমনকি সে গ্রামে তার বাবা মাকে প্রতিমাসে সামান্য কিছু টাকা পাঠায়। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষদের আমি ভালোবাসী। আমার বাসায় কোনো অনুষ্ঠান থাকলে আমি জোর করে আহাদকে নিয়ে আসতাম। আমরা দুজন একসাথে খাওয়াদাওয়া করতাম। অনেক গল্প করতাম। এর মধ্যে আমি বেশ কয়েকবার আহাদের গ্রামের বাড়িতে গেলাম। গ্রামের নাম বাড়ই খালি। সুন্দর গ্রাম। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার গুলো দরিদ্র। এবং তাদের বেশির লোকের জমি চেয়ারম্যানের কাছে বন্ধক রয়েছে। সবারই অনেক টাকা সুদ জমে গেছে।
আহাদ অনার্সে ভালো রেজাল্ট করলো।
এরপর মাস্টার্স করলো। মাস্টার্স শেষ করে এমবিএ করলো। কখনও দেখি নাই, আহাদ সময় অপচয় করেছে। মন্দ লোকদের সাথে মিশেছে। সে তার লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে। রাস্তার মোড়ে কখনও আড্ডা দেয়নি। কোনোদিন তাকে চায়ের দোকানে দেখিনি। মাঝে মাঝে দেখতাম দোকান থেকে আলু, ডিম আর ডাল কিনতো। সেটা টানা ৬/৭ বছর শুধু আলু ডিম আর ডাল খেয়েছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান মাছ মাংস খাওয়ার টাকা ছিলো না। আমি মার্কেটে গেলে তাকে জোর করে শার্ট, প্যান্ট কিনে দিতাম। সে খুবই সংকোচ বোধ করতো। আহাদের কোনো বিলাসিতা ছিলো না। কোনো উচ্চা বাক্য ছিলো না। সে নিরবে শুধু তার পথে এগিয়ে গিয়েছে। আহাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রেম ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে। আহাদ সে পথে যায়নি।
লেখাপড়া শেষ করেই আহাদ ভালো একটা চাকরী পেয়ে গেলো।
অনেক টাকা সেলারি। টানা আড়াই বছর সে চাকরী করলো। এবং তারপর চাকরী ছেড়ে দিলো। আমি বললাম, এত ভালো চাকরী, ভালো সেলারি। তুমি চাকরী ছেড়ে দিলে কেন? আহাদ বলল, ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিলো আমার কৃষক হবো। আড়াই বছর চাকরী করেছি কারন, গ্রামে আমাদের অনেক টাকা ঋণ ছিলো। ঋণ পরিশোধ হয়ে গেছে। আমরা আমাদের জমি ফিরে পেয়েছি। এখন আমি গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ করবো। এবং অবশ্যই আমি একজন সফল কৃষক হবো। সত্যি সত্যি আহাদ চাকারী ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে গেলো। নিজের এবং অন্যের কিছু জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করলো। উন্নত দেশের কৃষকদের সাথে আহাদ অনলাইনে যোগাযোগ অব্যহত রাখলো। এবং সে খুব অল্প সময়ে সফলতার মুখ দেখলো।
আহাদের বাবা মা ভীষন রাগ করলো।
বলল, এত লেখাপড়া করে এখন তুই চাষবাস করবি! কত ভালো চাকরী করতি! গ্রামের মানুষেরাও খুব হাসাহাসি করলো। এরপর কয়েক বছর পার হয়ে গেলো। আহাদ এখন একজন সফল চাষী। এলাকার এমপি তাকে মেডেল উপহার দিয়েছে। সে চাকরী করে যে টাকা সেলারি পেতো এখন তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা সে ইনকাম করে। আহাদ আরো জমি কিনেছে। এর মধ্যে একবার চীন থেকে ঘুরে এসেছে। আধুনিক কিছু যন্ত্রপাতি কিনেছে। গ্রামের অন্য চাষীরা আহাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসে। পরামর্শ নিয়ে তাঁরা সফলতার মুখ দেখেছে। আহাদকে নিয়ে টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছিলো। আহাদ বলেছিলো- মাটি হচ্ছে খাটি। মাটিকে ভালোবাসতে হবে। মাটিকে ভালোবাসলে সফলতা আসবেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:৫৫