১৮২৪ সালের কথা।
তখন ধনীরা নারী ও মদে মত্ত। দরিদ্ররা কোনো রকমে বেঁচে আছে। জমিদারের পুত্ররা ইংরেজি শেখায় ব্যস্ত। পুরো ভারতবর্ষ শাসন করছে ইংরেজেরা। বাঙ্গালীরা কথা বলতো এয়েচেন, খেয়েচেন, দিয়েচেন, এয়েচি- এরকম ভাষায়। শিক্ষিত সমাজের মধ্যে হাতে গোনা দুই এক জন মানুষ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তিত। সেই সময়ের একজন ব্যবসায়ী দ্বারকানাথ। ভারতবর্ষের বাইরে তার দারুন সুনাম। জোড়াসাঁকো তে সুন্দর বাড়ি তৈরি করেছেন। তার ছেলে দেবেন্দ্রনাথের ব্যবসায় মন নেই। সে নতুন এক 'ধর্ম' সৃষ্টি করেছেন। সেই ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত। ছেলের কান্ড দেখে দ্বারকানাথ আবার ছুটলেন বিলেত। বিলেতে গিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করতে থাকলেন। একদিন তিনি বিলেতেই মারা গেলেন। মৃত্যুর পর দেখা গেলো- দ্বারকানাথ এক কোটি টাকার বেশি দেনা আছে। দ্বারকানাথের গল্প আরেকদিন করবো। আজ বলল, গ্রেট মাইকেল মধুসূদন দত্তের গল্প।
মাইকেল মধুসুদন দত্ত মদ খেতে খুব ভালোবাসতেন।
কলেজে পড়া অবস্থাতেই তার মদের খুব নেশা হয়ে গিয়েছিলো। এমন কি সে তার কলেজের বন্ধুদের বাসায় নিয়ে এসে নানান রকম মদ খেতে দিতো। মধুসুদন খেতে এবং খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন। তার বাড়িতে নানা রকম খাবার রান্না হতো। মদের সাথে কাবাব খুব পছন্দ ছিলো মদুসুদনের। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান বলেই- ছেলেবেলা থেকেই অনেক তেজ ছিলো মধুর। এজন্য তার পিতা রাজনারায়ন ছেলে অবাধ ছাড় দিতেন। ছেলে মদ কিনতো, বিল পরিশোধ করতো তার পিতা। জামা কাপড় থেকে শুরু করে যে কোনো কিছুতেই বিলাসিতা করতে পছন্দ করতেন মধুসুদন। আলমারি ভরতি থাকতো তার জামা কাপড়ে। বিশ্বের বড় বড় কবিদের লেখা পড়তে ভীষন পছন্দ করতেন। বাংলা পড়তে বা লিখতে পছন্দ করতেন না। বন্ধুদের অনুরোধে মাঝে মাঝে বাংলায় লিখেছেন। তার ইচ্ছা তিনি ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করে বিশ্বে অমর হয়ে থাকবেন।
ধনী পিতার সন্তান মধুসুদন।
একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মধুসুদন খিস্টান হয়ে গেলেন। নতুন নাম নিলেন 'মাইকেল'। খিস্টান তিনি নিজের বুদ্ধিতেই হয়েছেন। সেই সময় জাতপাত খুব কঠিন ভাবে মানা হত। মাইকেলের বাবা চিৎকার চেচামেচি শুরু করলেন। তিনি আর এই ছেলের মুখ দেখবেন না। যদি প্রাশ্চিত্ব না করে মাইকেল আবার হিন্দু না হয়। মাইকেলের মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। মধুসুদন খিস্টান হওয়ার কারন হচ্ছে- এখন সে বিদেশ চলে যাবে। ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করবে। মাইকেলের ধারনা বাংলা ভাষায় লেখালেখি করলে সাফল্য পাওয়া যাবে না। বাংলা হচ্ছে নীচু শ্রেণীর ভাষা। মাইকেলের বাবা ছেলের মুখ দেখবেন না বলে ঘোষনা দিয়েছে। কিন্তু ছেলেকে প্রতিমাসে একশ' টাকা দিবেন। যেহেতু তার সন্তান। টাকা না দিলে হয়তো তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। মাইকেল তার অসুস্থ মাকে দেখতে এসে বলল, মা আমাকে বড় হতে হবে। বড় হতে হলে আমাকে ইংরেজ সাহিত্যিকদের সাথে পাল্লা দিতে হবে। ওদের মতো করে চলতে হবে, লিখতে হবে। নইলে আমি বিখ্যাত হতে পারবো না। আমি হিন্দু না খিস্টান সেটা বড় কথা নয়।
মাইকেলের পিতা রাগে দুঃখে একের পর এক বিয়ে করে চলেছেন।
তার একটা ছেলে সন্তান চাই। সেই ছেলেকে সে নিজের মনের মতোন করে মানুষ করবেন। মাইকেলের মতো হতে দিবেন না কিছুতেই। অন্যদিকে মাইকেল খিস্টান হয়ে বিলেত চলে গেলো। বিলেত গিয়ে তিনি একটা বই লিখলেন। বইয়ের নাম- দ্য কেপাটিভ লেডী। তিনি সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান। তিনি সাহেবদের তুলনায় কম যান না। সমস্ত ইংরেজ কবিদের তিনি ছাড়িয়ে যাবেন। দু চারজন বাঙ্গালী মাইকেলের বইয়ের সামান্য প্রশংসা করলো। কিন্তু ইংরেজরা বলল, খুব ভালো লেখা নয়। তবু সে চেষ্টা করেছে এজন্য তাকে ধন্যবাদ। এই ছেলে মাইকেল নিজের ভাষায় না লিখে কেন অন্যের ভাষায় লিখতে গেলো? এই ছেলে বোকা। বোকা না হলে কেউ নিজের ভাষাকে অবহেলা করে? সে সময় পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে কলকাতা বেশ উন্নত ছিলো। কলকাতায় ছিলো বেশ কিছু ভালো স্কুল কলেজ। হিন্দু কলেজে পড়তো ধনীর ছেলেরা। পাশ করলেই চাকরী পেতে বেগ পেতে হতো না। অন্য দিকে সংস্কৃত কলেজে অন্যসব শেখানো হলেও শেক্সপিয়ার পড়ানো হতো না। মাইকেলের বিশ্বাস সাহিত্য রচনা করে তিনি হাজার বছর মানুষের মনে থাকবেন।
মাইকেল বিদেশে থাকাকালীন তার মা বাবা মারা গেলেন।
মার মৃত্যুর জন্য এক হিসেবে মাইকেলই দায়ী। মধুসূদন খিস্টান হলেন। এই শোকে তার মা মারা গেলেন। অন্যদিকে তার পিতা একের পর এক বিয়ে করলেন একটা পুত্র সন্তানের আশায়। ফলাফল শূন্য। তিনিও মারা গেলেন। মাইকেল বাবা মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেলেন এক বছর পর। মাইকেলের পিতা মাতা দুঃখ কষ্ট নিয়ে মারা গেলেন। অথচ মাইকেল কে নিয়ে তার বাবা মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিলো। ছেলে খিস্টান হয়ে বাবা মার মুখে চুনকালি লাগিয়ে দিলো। মাইকেলের বাবা রাগে দুঃখে আক্ষেপ করে বলতেন এরকম অবাধ্য, কুলাঙ্গার ছেলে যেন আর কারো না হয়। কোনো না কোনো ভাবে ধনীর সন্তানরা বখাটে হয়ে যায়। এই বখাটেরা যে দেশে জন্ম সেই দেশকে ভালোবাসে না। সেই দেশের ভাষা কে তুচ্ছজ্ঞান করে। সমস্যা হলো মাইকেল তার বাবা মায়ের মতো করে ভাবতে শিখে নি। বিলেতে মাইকেল সাফল্যের দেখা পাননি। সেখানে তাকে ব্যর্থতা ধরা দিয়েছে। টাকার অভাবে মন ভরে মদ পান করতে পারেন নি।
প্রায় দশ বছর পর মাইকেল কলকাতায় ফিরে এলেন জাহাজে করে।
শূন্য পকেটে তিনি কলকাতায় এলেন। বিলেতে বিশেষ সুবিধে করতে পারেন নি। বিয়ে করলেন এক বিদেশীনিকে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে জন্ম দিলেন। কিন্তু সেই সংসার তার টিকলো না। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো। মাইকেল আবার বিয়ে করলেন। নতুন সংসারেও শান্তি নেই। সংসারে অভাব। এক অফিসে কেরানির চাকরী করতেন। সেলারি খুবই সামান্য। মাইকেল ইংরেজি কবিতা লিখলেন, কিন্তু তা জনপ্রিয়তা পায়নি। মাইকেল এতদিন পর কলকাতা আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে- বাপের সম্পতি বিক্রি করা। নগদ টাকা যা পান সেসব নিয়ে আবার বিলেত চলে যাবেন। এদিকে মাইকেলের পিতা মাতা মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি আত্মীয়স্বজন দখল করে নিয়েছে। শুধু মাত্র টিকে আছে বাড়িটা। বাড়িটার অবস্থাও নড়বড়ে। সেই ভাঙ্গা বাড়িতে থাকেন মাইকেলের সৎ মা। মাইকেল যখন বাড়ি বিক্রির কথা তুললো- তখন সৎ মা কাঁদতে কাঁদতে মাইকেল কে বলল, তুমি এ বাড়ি বিক্রি করলে আমি কোথায় যাবো?
এক ধনী লোকের সন্তান মাইকেল।
এখন তার কলকাতায় থাকার জায়গা নেই। এমনকি কি খাবে সেই টাকাও নেই। স্কুল কলেজের বন্ধুরা তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। মাইকেলের বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম গৌরদাস। এই গৌরদাস মাইকেলের বিপদে আপদ সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মাইকেল বিলেত চলে গেলেও, গৌর দাসের সাথে চিঠি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিলো। মাইকেল তার লেখা বই বন্ধু গৌরদাসকে পাঠিয়েছে। সেই বই গৌরদাস শহরের গন্যমান্য ব্যাক্তিদের পড়তে দিয়েছেন। গৌরদাস সঠিক সময়ে লেখাপড়া শেষ করে- ইংরেজ সরকারের ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন। অনেক টাকা সেলারি তার। যাইহোক, মাইকেল অনেক কিছুই কলকাতায় প্রথম করেছেন। যেমন কলকাতায় তিনিই প্রথম বাঙ্গালী ব্যাক্তি যে টাই কোট পড়েছেন। বিদেশ থেকে আনা সিগারেট ফুঁকেছেন। বাংলা ভাষার বদমান করেছেন। বাঙ্গালীদের বদনাম করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিলেত গিয়ে তিনি সাফল্যের দেখা পাননি। মাইকেলের নেশাগ্রস্ত হলেও সাহিত্যে তার অবদান আছে। তবে সেই সময়- প্যারীচাঁদ মিত্র নামে এক যুবক 'আলালের ঘরের দুলাল' নামে এক উপন্যাস লিখে দারুন নাম করে ফেললেন। প্যারীচাদ মিত্র তখনও জানতেন না- তার লেখা উপন্যাসটি বাংলা ভাষার প্রথম সফল উপন্যাস হয়ে যাবে। মাইকেল 'আলালের ঘরের দুলাল' উপন্যাস পড়ে খুব নিন্দে করলেন। হাসাহাসি করলেন।
(প্রথম পর্ব এখানেই সমাপ্ত)
তথ্যসুত্রঃ
১। কলিকাতা দর্পন- রাধানাথ মিত্র
২। মাইকেল মধুসুদনের পত্রাবলি- সুশীল রায়
৩। মধুসৃতি- নগেন্দ্রনাথ।
(সবাই ফিচার লিখছেন। তাই আমারও স্বাদ হলো ফিচার লিখি। লিখলাম। অবশ্য এই ফিচার প্রতিযোগিতার জন্য নহে।)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ১২:৪৬