১৮২০ সালের এক শীতের সকাল।
প্রচন্ড শীত চারিদিকে। প্রচুর কুয়াশা। এত কুয়াশা যে এক হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। পুরো ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের দখলে। ইংরেজরা ব্যবসা করতে এসে ভারতবর্ষ নিজের করে নিলো ক্ষমতা ও বুদ্ধির জোরে। কিছু কিছু জমিদার ইংরেজদের সাথে হাত মিলালো। ইংরেজরা যে সবাই খারাপ ছিলো তা না। বহু ইংরেজ ভারতবর্ষে এসে শিক্ষা বিস্তারে দারুন ভূমিকা নিয়েছেন। স্কুল কলেজ করেছেন। মিল ফ্যাক্টরী করেছেন। রাস্তাঘাট, হাসপাতাল করছে। কিন্তু ভারতবর্ষের লোকজন ধর্মীয় নেশায় বুঁদ। নানান রকম কুসংস্কারে তাঁরা বন্দী। স্বামী মারা গেলে, সাথে জীবিত স্ত্রীকেও আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হতো। নারীকে শিক্ষা দেওয়া হতো না। এদিকে ধনী সম্প্রদায় মদ ও নারী নেশায় মত্ত। আর গরীবেরা কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। ঠিক এমন সময় জন্ম নিলো এক মসিহ। যার নাম 'ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর'। তার অবদান ভারতবাসী কোনোদিন ভুলবে না।
ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই অন্য দশজন বালকের মতো ছিলেন না। খুব মেধাবী ছিলেন। সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতি তার লোভ ছিলো না। বরং নাস শেষে সে নিজের সেলারি থেকে যে টাকা পেতেন, সেই টাকা দিয়ে মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তিনি মনে করেন, একজন মানুষ অন্য একজন বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করবে এটা স্বাভাবিক। নিজের খাওয়া খরচ খুব সামান্য তার। খাওয়া বা জামা কাপড় নিয়ে তিনি কোনোদিন বিলাসিতা করেন নাই। নিজের রান্না নিজেই করতেন। খাদ্যদ্রব্যের অপচয় তিনি কোনোদিন করেন নি। একবার এক জমিদার ঈশ্বরকে দাওয়াত করতে হলেন। জমিদারের ছেলের হাতেখড়ি অনুষ্ঠান। ঈশ্বরচন্দ্র কে যেতেই হবে। বিনিময়ে তাকে টাকা দেওয়া হবে এবং পর্যাপ্ত খাওয়ানো হবে। ঈশ্বরচন্দ্র স্পষ্ট বলে দিলেন- আমি যেতে পারি। কিন্তু আপনি ছেলের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের জন্য আমি কোনো টাকা নিবো না। এবং পেট ভরে খাওয়াও সম্ভব না আমার পক্ষে।
ঈশ্বর চন্দ্র যে কলেজে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষাকতা করেছেন,
সে শিক্ষকদের কাছেই ঈস্বরচন্দ্র লেখাপড়া করেছেন একসময়। তার বেতন ছিলো পঞ্চাশ টাকা। একবার ছুটিতে ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামে গেলেন। সেখানে তার বাবা মা ভাইরা আছেন। তার বাবার নাম ঠাকুরদাস। মায়ের নাম ভগবতী। সাত ভাই বোনের মধ্যে ঈশ্বর সবার ছোট। কিন্তু লেখাপড়াতে সে ছিলো সবচেয়ে মেধাবী। তার সৃতিশক্তি ছিলো অত্যন্ত প্রখর। সাত বছর বয়সে লেখাপড়ার জন্য ঈশ্বর চন্দ্র কলকাতা যান। ছুটিতে গ্রামে গিয়ে ঈশ্বর তার গুরুজনদের খোজ খবর নিতেন। পাড়া প্রতিবেশীদের খোজ খবর নিতেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে কাঁদায় খেলতেন। হাডুডু খেলতে খুবই পছন্দ করতেন ঈশ্বর। সেই সময়- বুড়ো লোকরা ৬/৭ বছরের মেয়েদের বিয়ে করতো, এবং অনেক কিছু যৌতুক নিতো- এই বিষয়টা ঈশ্বর কে খুব কষ্ট দিতো। কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা একজন ব্রাহ্মণের কাছে নিজের মেয়ে বিয়ে দিতে পারলেই খুশি। হোক সে বরের ৫০ বা ৬০ বছর বয়স। অথবা আগে সে আরো ৩/৪ টা বিয়ে করেছে।
মাইকেল মধুসূদন এবং ঈশ্বরচন্দ্র তাদের দুজনের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ন বিপরীত।
এই লেখাতে আমি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে কে নিয়ে কোনো আলোচনায় যাবো না। ঈশ্বরচন্দ্র একটা বই লিখলেন। সুধীসমাজে সে বই খুব প্রশংসা কুড়ালো। ঈশ্বরচন্দ্র মনে প্রানে অনুভব করতে লাগলেন, নারী শিক্ষার প্রয়োজন আছে। নইলে সমাজ বদলাবে না। শুধু নিজের নাম লিখতে পারলেই হবে না। নারীর মুক্তি নেই শিক্ষা ছাড়া। ৬/৭ বছর বয়সে নারীদের বিবাহ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সবচেয়ে দুঃখজনক একজন ৬০ বছর বয়সী মানুষ একটা ৬/৭ বছরের মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পর লোকটা মরে যায়। বাকি জীবন বাচ্চা মেয়েটাকে বিধবা হয়ে থাকতে হয়। পেয়াজ, তেল ও মশলা ছাড়া খাবার খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে হয়। সমাজের এসব নিয়েম বন্ধ করতে হবে। এই চিন্তায় ঈশ্বরচন্দ্র একদিন তার কলেজের চাকরী ছেড়ে দিলেন। এই সমাজকে তিনি বদলাবেন। মানুষকে বুঝাতে হবে। সচেতন করতে হবে। নইলে ভারতবাসীর মুক্তি নেই।
ইংরেজ সরকারের অধীনে ঈশ্বরচন্দ্র চাকরী পেলেন।
পাঁচ শ' টাকা সেলারি। যেখানে একটা গাইগরুর দাম ৬/৭ টাকা। সে যাইহোক, ঈশ্বরচন্দের গ্রামের নাম বীরসিংহ। এই গ্রাম পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুরে। দরিদ্র গ্রাম। পুরো গ্রাম জুড়ে কাঁচা রাস্তা। বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া গতি নাই। গ্রামের মানুষ চাষবাস করে। এছাড়া তাঁরা আর অন্য কিছু করতে জানে না। একবার তার গ্রামের বাড়িতে ডাকাতি হলো। ডাকাত দল তার বাড়িতে যা পেয়েছে সব নিয়ে গিয়েছে। থালা বাটিও বাদ দেয় নি। কিন্তু কাউকে হত্যা করতে পারেনি। কারন বাড়ির সকলে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে প্রানে বেঁচেছেন। এই ডাকাত দলকে দেখে ঈশ্বরের স্ত্রী দীনময়ী খুব ভয় পেয়ে গেলেন। দীনময়ীর বয়স অল্প। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। দীনময়ী তার তিন বছরে পুত্র নারায়নকে নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে গেছেন। এই ঘটনার পর ঈশ্বরচন্দের পিতা ঠাকুরদাস বাড়িতে একজন লাঠিয়াল রাখলেন। লাঠিয়ালের নাম শ্রীমন্ত। দৈতের মতো চেহারা। কিন্তু ঠাকুরদাস শ্রীমন্তকে বেশি দিন বাড়িতে রাখলেন না। পাঠিয়ে দিলেন কলকাতা, ঈশ্বর চন্দের কাছে। একবার এক পুলিশ অফিসার ঠাকুরদাসের কাছে ঘুষ চাইলেন। ঠাকুরদাস বললেন, আমার ছেলের নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ইংরেজরা পর্যন্ত আমার ছেলেকে খাতির করে। আর তুমি আমার কাছে ঘুষ চাইছো! পুলিশ অফিসার ঠাকুরদাসের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন।
ঈশ্বরের পেছনে শত্রু লেগেছে।
কারন সে নারীদের শিক্ষার কথা বলেন, বিধবাদের বিয়ে দিতে চান। কলকাতার শিক্ষিত সমাজের অনেকেই ঈশ্বরের সাথে একমত। কিন্তু অনেকেই বিধবা বিয়ের বিরোধিতা করছেন। তাদের ধারনা বিধবাদের বিয়ে দেওয়া মানে পাপ। মহাপাপ। এই পাপ করলে স্বর্গে যাওয়া যাবে না। বিধবা মেয়েটি স্বর্গে যাবে না। সেই সাথে মেয়ের পিতামাতা থেকে শুরু অন্যান্য কেউ'ই স্বর্গ প্রাপ্তি হবে না। ঈশ্বরচন্দ্র সৎ মানুষ। তাই তার জিদ বেশি। তিনি যে করেই হোক, বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার আইন পাশ করবেই। তাই তিনি সমাজের প্রায় এক হাজার শিক্ষিত মানুষের সাক্ষর নিয়ে ফেললেন। এই সাক্ষর সংগ্রহ করতে ঈশ্বরকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে। তার স্বাস্থ্য ভালো। ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বর অনেক হাঁটতে পারতেন। একসময় ঈশ্বর নারী শিক্ষা নিয়ে মেতে ছিলেন। এখন সমাজের অনেকে পরিবারে নারীদের স্কুলে যেতে দিচ্ছেন। বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার আইন তিনি পাশ করাবেন। দেখা যায়, একটা মেয়ে ৬/৭ বছর বয়সে বিয়ে হয় এবং ৯/১০ বয়সে বিধবা হয়ে যায়। তারপর বাকি জীবন খেয়ে না খেয়ে পার করে দেয়। এটা কোনো ভালো কথা নয়। সমাজের এইসব ভুল ও কুসংস্কার তিনি দূর করবেন।
ঈশ্বরচন্দ্র নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বই লিখেছেন।
সে বই খুব প্রশংসা পেয়েছিলো শিক্ষিত সমাজে। এবার তিনি বিধবা বিবাহ নিয়ে একটা বই লিখে ফেললেন। এর ফলে তার পেছনে অনেক শত্রু লেগে গেলো। দূর থেকে শত্ররা তাকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। তার বাড়ির চালে মধ্যরাতে ঢিল ছুড়ে মারে। কিন্তু ঈশ্বর থেমে থাকেন নি। সে তার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন। ধর্ম নামক কুসংস্কার নারীদের কোনঠাসা করে ফেলেছে। একে তো ৬/৭ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাও বয়স্ক লোকদের সাথে। দেখা যায়, ১৫/১৬ বছর বয়সে মেয়ে গুলো বিধবা হয়ে যাচ্ছে। তারপর তাদের ভালো খেতে দেওয়া হয় না। ঘরের কোনে তাদের বাকিটা জীবন কাটাতে হয়। সামান্য পেঁয়াজ খাওয়া পর্যন্ত বিধবাদের খাওয়া নিষেধ। অথবা বিধবাদের কাশী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সারা জীবন ধর্মে কর্মে পার করে দেওয়ার জন্য। কাশী গিয়েও বিধবাদের শান্তি নেই। দুষ্টলোকদের নজরে পরে মেয়েদের পতিতা বানিয়ে দেওয়া হয়। অথবা ধনীদের রক্ষিতা হয়ে বাকি জীবন পার করে দিতে হয়।
(প্রথম পর্ব এখানেই সমাপ্ত।)
তথ্যসুত্রঃ
১। তৎকালীন বঙ্গ সমাজ- শিবনাথ শাস্ত্রী
২। কলিকাতার কথা- প্রমথনাথ মল্লিক
৩। বিদ্যাসাগর ও বাঙ্গালী সমাজ- বিনয় ঘোষ
৪। পিতাপুত্র- অক্ষয়চন্দ্র সরকার।
(প্রায় সব ব্লগাররা নানান রকম বিষয় ফিচার লিখছেন। সুন্দর সুন্দর সব ফিচার। এর মধ্যে 'চাঁদ' ও 'ভোদর' নিয়ে দুইজন ব্লগার দারুন ফিচার লিখেছেন। যা পরে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কেউ শাড়ি নিয়ে লিখেছেন, কেউ শিক্ষা নিয়ে লিখেছেন। যাইহোক, তাদের দেখাদেখি আমারও ইচ্ছা হলো ফিচার লিখতে। গত কয়েকদিন অনেক পড়ালেখা করলাম। দ্বিতীয় পর্ব খুব শ্রীঘই লিখে ফেলল ইনশাল্লাহ।)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৪২