ইউরোপের রাজনৈতিক আকাশে তখন দুর্যোগের কালোমেঘের ছায়া যা সচেতন মানুষের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।ঠিক এ সময়ে 'গীতাঞ্জলি'র কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মানুষের জন্য আনেন বিশ্বাস, ভালোবাসা ও নির্ভরতার বাণী।সর্বশক্তিমানকে চিনিয়ে দেন ঘরের মানুষ হিসেবে। বলেন,ভালোবাসার মধ্য দিয়েই ঈশ্বর ও মানুষের পরস্পর নির্ভর সম্পর্ক ।'গীতাঞ্জলি'তে গভীর আত্মানুভূতির বাণী এমন সহজতম ভাষায় লিখিত যা কদাচিৎ দেখা যায় ।কবিয়াল বিজয়ের কণ্ঠ ধার করে গেয়ে উঠি—‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কে বলে আজ নেই/এই মহাদেশে পূর্ণ পৃথিবীর/দেখি তারে যেদিকে চাই॥’
রানু-রবীন্দ্রনাথ অথবা কাদম্বরী দেবী সম্পর্ক নিয়ে বা্ঙ্গালী সমাজের অস্বস্তি এতকাল পরও মিলিয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "বিলাতে রাস্তার দুষ্ট বালকেরা কৌতুক করিবার জন্য কুকুরের ল্যাজে ঝুমঝুমি বাঁধিয়া ছাড়িয়া দেয়। সে যেখানেই চলে, শব্দ হয় এবং তাহার পেছনে ভিড় জমিতে থাকে। আমার নামের পেছনে সেই রকমের একটা ঝুমঝুমি বাঁধা হইয়াছে। চলিতে গেলেই শব্দ হয় এবং লোকের দৃষ্টি পড়ে । রবীন্দ্রনাথ অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কেও এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যা রীতি্মতো শৈল্পিকগুণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ।এটা হচ্ছে যে কোনো বিষয়কে একটু আলাদাভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে 'রক্ত করবী' বিষয়ে উচ্চভিলাষী ছিলেন, রচনা হিসেবে একে বিশেষ গুরুত্ববহ মনে করেছিলেন তার পরিচয় মেলে যখন তিনি 'রক্ত করবী' রচনাকালেই এর ইংরেজী অনুবা্দের কাজ করেছিলেন । সম্ভবত নাটকের ষষ্ঠ খসড়া অবলম্বনে শুরু হয়েছিল অনুবাদের কাজ এবং খুব আশ্চর্যজনকভাবে, বাংলা ভাষ্য প্রকাশের আগেই বের হয় ইংরেজি অনুবাদ 'দি রেড অলেন্ডার্স। ১৯২৪ সালে বিলাতের ম্যাকমিলান্ অ্যান্ড কোম্পানি প্রকাশ করে ইংরেজি ভাষ্য ।আর বাংলায় 'রক্ত করবী' প্রকাশ পায় পরের বছর। ১৯২৩ সালে রক্ত করবী রচনা ও অনুবাদকালে জাপানি তরুণী টোসিকো ওয়াডার কাছে পত্রে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন যে, তিনি সম্প্রতি একটি নাটক লেখা শেষ করেছেন এবং অচিরেই তা ইংরেজিতে প্রকাশ পাবে ।
এই নাটক আমাদের সামনে মেলে ধরে পুরো পৃথিবীর এক সহজ স্বচ্ছ চিত্ররূপ ৷ যার মধ্যে একদিকে পরিস্ফুট ভারতীয় মানস ও তার মৌলিক দ্বন্দ্ব; অপর দিকে প্রকাশিত গোটা পৃথিবীর এক অভিনব মৌল দিক নির্দেশনা-যা ধাবমান আগামীর আগমনী গানের সঙ্গে, বর্তমানের অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের চলমানতায় ৷শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে দুর্বার আন্দোলনেই ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের এ-নাটকের পরিসমাপ্তি ৷ যদিও তার ভেতরে ছিল কৃষিনির্ভর সভ্যতায় ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা; তবু সে-আকাঙ্ক্ষায় ছিল না সামন্ততন্ত্রের আবেদন ৷ তাতে ছিল প্রকৃতির প্রাকৃতিক সরলতায় ফিরে গিয়ে মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধনের অঙ্গীকার ৷
রবীন্দ্রনাথের মত এত এত গল্প এবং এত উচ্চমানের গল্প যে আর কেউ লিখতে পারেননি সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই।রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত। দুই-একটা গল্প হয়ত আলাদা যেমন, পোস্টমাস্টার, বোস্টমী, কাবুলিওয়ালা।এই যে এভাবে নিজেকে… আত্মগোপন করে রাখা, এটা বলতেই হবে যে অসাধারণ একটা বিষয়। আর বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক উপন্যাস বলা হয় চোখের বালিকে এবং এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কোনো আধুনিক উপন্যাসের কথা বললে প্রথমেই চলে আসে চোখের বালি’র নাম।
"শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।/ বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।” শাস্ত্রে লেখা আছে প্রথমে 'নার্জিতং বিদ্যা, দ্বিতীয়ে নার্জিতং ধন, তৃতীয় নার্জিতং পুণ্য, চতুর্থ নার্জিতং কিং করিস্যতি'। এর অর্থ হলো যে পথের জীবনের বিদ্যা অর্জন করল না, দ্বতীয় পর্বে মানে যৌবনকালে ধন সম্পদ অর্জন করল না, তৃতীয় পর্বে বয়েসকালে পুণ্য অর্জন করতে পারল না, বৃ্দ্ধ বয়সে তার পরিণতি কী হবে ? রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তি যাঁর প্রভাব কোন বাঙালির জীবনে নেই–এটা হতেই পারে না। রবীন্দ্রনাথ দেশভাগ দেখেননি। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধও দেখেননি। কিন্তু তাঁর বহু গল্পে মানুষের জীবনের, মানুষের রাষ্ট্রের ও সমাজের এমন কিছু কথা বলা হয়েছে যেগুলো চিরকালীন।
একবার গ্রীষ্মকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলাম। খুব গরম সেদিন। তিনি আমার ঘর্মাক্ত কলেবর দেখে জিজ্ঞেসা করলেন -- "খুব গরম লাগছে বুঝি? পাখার কাছে একটু সরে বস।" তারপর একটু হেসে বললেন, "এখন এখানে ইলেকট্রিসিটি হয়েছে, আগে তো কিছুই ছিল না। ঘোর গ্রীষ্মে তখন কতদিন কাটিয়েছি এখানে--"
বললাম, "কষ্ট হ'ত নিশ্চয় খুব"-- হেসে উত্তর দিলেন, "না, খুব কষ্ট হ'ত না। গরম নিবারণের একটা খুব ভাল ওষুধ জানা আছে আমার।" জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বললেন--"কবিতা লেখা। বেলা বারোটার সময় একটা কবিতা লেখা শুরু করলে সমস্ত দুপুরটা যে কোন দিক দিয়ে কেটে যায়--জানতেও পারি না। হঠাৎ দেখি বিকেল হয়ে গেছে।" [আপনাদের বলতে হবে গল্পটি কার লেখা।
( চলবে....)