
ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকাটা ছেলেটার প্রচন্ড ঘাম ছুটছে মুখ বেয়ে। শরীরের অর্ধেক অংশ ঢেকে আছে ভেঙে পড়া ঢালাইয়ের ভিতর। ছেলে তার মাকে ফোন করে বলছে, "মা আমি ভিতরে আটকে আছি, কেউ বের করতে পারছে না আমাকে। ওরা এমপিদের গাড়ির ট্যাক্স মউকুফ করে দিয়ে দামী গাড়ি আমদানী করার সুযোগ করে দিতে পারে কিন্তু আমাদের মতো গরীবদের উদ্ধার করার মতো সরঞ্জাম আনতে তাদের যত ট্যাক্স বাহানা। আরেকজনের মোবাইল থেকে তোমার সাথে ফোনে কথা বলছি, হতে পারে এটাই শেষ কথা। নি:শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে মা। যেকোন মুহুর্তে আমার মৃত্যু হতে পারে। আমার টেবিলের ড্রয়ারটার ভিতরে কালো রঙের একটা বক্স আছে ওটার ভিতরে কিছু টাকা আছে। টাকা গুলো আস্তে আস্তে জমাচ্ছিল বোনটার বিয়ে দিব বলে। সেই সুযোগ হয়তো আর পাবো না মা। ভালো থেকো মা, ভালো থেকো তোমার ছেলের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর। লাইন কেটে গেল। একটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটলো।
"বাবা আজ লাল জামাটা নিয়ে আসবে।"
"ভাইয়া ঘরে আসলে এ মাসে কলেজের বকেয়া বেতনটা যেকোন ভাবে দিতে বলবো।"
"ছেলেটা ঘরে ফিরলে ঔষুধ আনার কথা বলতে হবে।"
"বাজার শেষ হয়ে আসছে, ঘরে ফিরলে ওকে বলা লাগবে।"
এক মা, এক বাবা যখন ছেলে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিল। এক বোন যখন ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিল। ছেলেটা বা মেয়েটা যখন তার বাবা-মায়ের অপেক্ষায় ছিল। এক স্ত্রী যখন স্বামীর অপেক্ষায় অলস দিন পার করছিল তখনই ছোবল দিল করাপ্ট সিস্টেমের সাপটা। পুঁজিবাদের নগ্ন থাবায় শিকার হয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফিরলো তাদের প্রিয়জন। তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে মৃত্যু হল কয়েকটি স্বপ্নের। মৃত্যু হল কয়েকটি আশার, কয়েকটি আকাঙ্খার।
স্বাভাবিক মৃত্যু আর আকস্মিক মৃত্যুর তফাত্ কোথায় জানেন ? স্বাভাবিক মৃত্যুতে স্বপ্ন-আশা খুব কমই ভঙ্গ হয় কিন্তু আকস্মিক মৃত্যু জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দেয় ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে। সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা ধূলিসাত্ করে দেয়, মনে লালন করে রাখা ভবিষ্যত্ পথ পাল্টে দেয়, শুরু করতে বাধ্য করে নতুন এক জীবন সংগ্রামের।
এইসব লাশের ক্ষতিপূরণ কি মুল্যে ক্রয় করবেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সমবেদনা আর শোক প্রকাশ করে নাকি নামমাত্র কয়েকটা কাগজের টুকরো প্রদান করে ? প্রধানমন্ত্রীর বুকে টেনে নেয়া পারবে তো এক বাবা হারানো ছোট্ট মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিতে ? উনার আর্থিক সহযোগিতা পারবে তো এক কর্মহীন বৃদ্ধ বাবার একমাত্র সম্বল ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দেখা স্বপ্নকে জোড়া লাগাতে ? মন্ত্রী মহোদয়ের 'বিচার হবে তদন্ত হচ্ছে,' এই আশ্বাস কি ভুলিয়ে দিতে পারবে স্বামী হারানো এক স্ত্রীর কষ্টকে ? পারবে কি প্রিয়জন হারানোর কষ্টে অশ্রুধারার ঢল আটকিয়ে রাখতে, পারবে কি আশা আর স্বপ্নের ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে রুখে দিতে ?
যতদিন করাপ্ট সিস্টেম থাকবে ততদিন স্বপ্নগুলোও হোঁচট খেতে থাকবে, আশাগুলো ভঙ্গ হতে থাকবে, আকাঙ্ক্ষাগুলো পুঁজিবাদের হাতে শোষণ হতে হতে নিঃশেষ হয়ে মুখ বুঝে রইবে এবং একদিন এভাবেই কোন ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়ে থাকবো আমি অথবা আপনি কিংবা লাশ হয়ে ঘরে ফিরবো বিনা কড়াঘাতে।