সন্ধ্যা ছয়টা । আমি একটি বাড়ির বাইরে দাড়িয়ে আছি । বাড়িটি আলো দিয়ে সজ্জিত । সাদা আর নীল আলোর সমাহারে বাড়িটি যেন নতুন একটা রূপ পেয়েছে । সদর দরজায় শুভ বিবাহের বোর্ডটি জ্বলজ্বল করছে । আজকে কারো বিয়ে। কারো নতুন জীবনের শুরু ।
একটি ডেভিড কার্ড , কিছু টাকা,একটি চিরকুট আর একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি ছিল মানিব্যাগটিতে । সাধাসিধে একটি মেয়ের সাদাকালো একটি ছবি । এই ডিজিটাল যুগে কেউ সাদাকালো ছবি মানিব্যাগে রাখে ব্যাপারটাই হজম হচ্ছিল না আমার ।
নিজের বেকারত্বের অসীম সময়ের কারণেই হোক আর সাদাকালো সেই ছবিটির হজম না হওয়াতেই হোক ঠিক করলাম মানিব্যাগটির মালিকে খুঁজে বের করবো ।
আর যাই হোক কিছু একটা কাজতো পেলাম ।
নাম : আহসান কবির
বাসা : চট্টগ্রাম
ব্যাংকের চাকুরিরত বন্ধুর সুবাধে ডেভিড কার্ডের দৌলতে এই পর্যন্ত শোনার পর মাথা ঘুরা শুরু করেছিল । ঢাকা শহরের ধুলোবালি খাওয়া,বাবার টাকায় পড়াশুনা শেষ করা,টাকার অভাবে বেন্সন থেকে গোল্ডলিফ ব্রান্ড বেঁছে নেয়া এই বেকার আমি চট্টগ্রাম যাব কিভাবে । ভাড়ার টাকা কোন রকমে জোগাড় হলেও যদি তার দেখা না পাই । তবে আমি যাব ব্যাপারটি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম।
আজ সকাল থেকে নিরা খুব খুশি তার এতদিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে । কতকিছুই না করতে হয়েছে আজকের দিনটির জন্য । চারটি বসন্ত পার করে নিজের সাথে সমাজের সাথে লড়াই করে আজকের দিনটি এসেছে । যদিও মনে মনে আদিবের উপর একটু রাগ করে আছে । রাগ করার অবশ্য একটি বড় কারণও রয়েছে । যার জন্য এতকিছু উনি মহাশয় এখন পর্যন্ত আসতে পারে নি । নতুন কোম্পানিতে চাকরী করলে কি বিয়েটাও ঠিক মত করবে না । কথা গুলো ভাবার সময় নিজের অজান্তেই হেঁসে উঠে নিরা । আসুক মহাশয় তার খবর করে ছাড়বে ভেবে রেখেছে সে ।
চাকুরীরত বন্ধুর কাছ থেকে এক হাজার টাকা আর কবির ভাইয়ের পুরা ঠিকানা নিয়েই ট্রেনে চেপে বসেছিলাম । এই এক হাজার টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো তা ভাবতে ভাবতেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল । টিউশন ফী আর পড়াশুনার চাপে কোথাও ঘুরতে পর্যন্ত পারি নি কোনদিন । চাকরী পেলে জীবনের সব আশা পূরণ করবো ভেবে রেখেছি । তবে সবার আগে কবির ভাইয়ের মানিব্যাগটা তাকে ফেরত দিতে হবে । কি ভাববেন তিনি এই মানিব্যাগটা হাতে পেয়ে । হয়তো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরবেন অথবা অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবেন ।
ডা: কামাল হাসান পরেছেন সমস্যায় । সমস্যা কি কম ছিল যে নতুন একটা সমস্যা মাথার উপর চেপে বসবে । ডাক্তার ব্যাপারটাকে মানুষ আসলে কি মনে করে ডাক্তাররা কি মানুষ হয় না । তাদেরও তো জীবন আছে তাই না । ছোট মেয়ের জন্মদিনটা কত ধূমধাম করে আয়োজন করেছেন তিনি । কেক কাঁটা পর্যন্ত হয় নি তার মাঝেই কল আসতে শুরু করেছে । মাঝে মাঝে তার মনে হয় সব ছেড়ে বনবাসে যাবেন । কিন্তু পারেন না ঐযে তিনি তো ডাক্তার । আর ডাক্তারদের তো জীবন জীবন নয় ।
নিরার প্রেম করার কোন ইচ্ছা কোনদিন ছিল না । আপুর প্রেম করে বিয়ের পরিণতি দেখে ভেবে নিয়েছিল প্রেম মানেই কষ্ট । জগতের সব প্রেমিক ছেলেরাই অবিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু কেন যেন আদিবকে ভালো লেগে যায় তার । খুব সাধারণ ছেলেটার ভরাট কণ্ঠ না সুনলে তার ঘুম আসতো না । পার্কে বসে বাদাম আর বেলি ফুলের মাঝেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল খুব সহজে । শহরের উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে নিরা চাইলেই অনেক কিছু দাবি করতে পারতো আদিবের কাছে । কিন্তু কোনদিন কোন দাবি করে নি সে মন থেকে শুধু ভালবেসে গিয়েছে ।
চট্টগ্রাম থেকে দশ কিলোমিটার অদূরে দুর্ঘটনাটি হয়েছে । তিনজন নিহত আর বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছে । নিহত তিনজনের মাঝে একজন বয়স্ক, একজন শিশু আর একজন মধ্য বয়স্ক । ডা: কামাল হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্র আহতদের চিকিৎসায় লেগে গেলেন । তার ছোট মেয়ের জন্মদিনের কথা আর মনে পরল না । মানুষের সেবায় হয়তো জীবনের প্রকৃত সুখ নিহিত রয়েছে ।
খুব সাধারণ কিছু বায়না, মিষ্টি ঝগড়া, উপহার এসব নিয়েই কেটে গেছে চারটি বছর। সময় যে কেন এত তাড়াতাড়ি কেটে যায় ? খুব বেশি স্পেশাল কিছু ছিল না নিরা আর আদিবের প্রেমে। তবে প্রতি বছর নিরার জন্মদিনে ওকে নিয়ে নৌকা করে ঘুরতে যেত আদিব । অনেক অনেক বেশি ভালো লাগার সময় ছিল সেগুলো । আর আজকে সেই আদিবকে নিজের করে পাবে নিরা , একান্তই নিজের ।
এটা কি আহসান কবিরের বাসা ?
দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিল । যাক বাবা তাহলে ঠিক যায়গায় এসেছি । ধার করা টাকার ভ্রমণ তাহলে বৃথা যায় নি । হাহাহা কি সব ভাবছি এইসব । বাসার দিকে পা বাড়ালাম এবার হাবিব ভাইকে দেখার অপেক্ষা ।
বাবা রাজি হতে চায় নি কিন্তু নিরার একটাই কথা বিয়ে করলে আদিবকেই করবে নয়তো বিয়েই করবে না ।ছেলের পরিবার অতটা উন্নত নয় খুব অল্প বেতনের চাকরী তার সত্তেও আদরের মেয়ের কথা ফেলতে পারে নি নিরার বাবা । শেষে রাজি হয়েছেন । কিন্তু এত দেরী করছে কেন আদিব ? এদিকে ল্যান্ডফোন টা বেজেই চলেছে । বাসায় কি আর কেউ নেই ? নিরাকেই ফোনটি রিসিভ করতে হল । ফোনের ওই পাশ থেকে ডাঃ কামালের কণ্ঠ শুনতে পেল নিরা ।
মেয়েটির সাথে প্রায় ধাক্কা লেগে গিয়েছিল আমার । নিজেকে কোন রকমে এই অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছি । মানিব্যাগ দিয়ে এসে শেষে মেয়ের ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারানোর কোন ইচ্ছা আমার নেই ।সেজেগুজে আসা সুন্দর মেয়েটিকে দেখা মাত্র চিন্তে পারলাম । মেয়েটি নিরা । আদিব-নিরা ডিপার্টমেন্টের সেরা একটি জুটি ছিল । আমার ভর্তির সময় আদিব ছিল সেকেন্ড ইয়ারে । আদিব আমাদের হলে থাকতেন আর নিরা ছিল সহপাঠী ।
এখন আমি হাসপাতালে । নিরা নামক মেয়েটি অঝরে কান্না করছে । সামনে একটি মধ্য বয়স্ক মানুষের লাশ । আহসান কবির ভাইয়ের লাশ । নিরার ভাইয়ের লাশ । মানিব্যাগটির মালিকের লাশ ।
মানিব্যাগ থেকে চিরকুটটি বের করলাম । “ সাবধানে থেকো “ জেল কালির কলম দিয়ে লিখা চিরকুট । স্ত্রীর লিখা চিরকুটটি হারিয়ে তার আর সাবধানে থাকা হল না ।
নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম । আমার কাজ অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে শুধু মানিব্যাগটি আর ফেরত দেয়া হল না ।মানিব্যাগটি ফেরত পেয়ে তার অনুভূতি দেখা হল না । চিরকুটটির সাবধানে থেকো লিখার মত আহসান কবিরের আর সাবধানে থাকা হল না ।
আর আদিব, না তখনো আদিব আসে নি । হয়তো আর আসবে না ।
এভাবেই কত কত আদিব হারিয়ে যাচ্ছে । তারপর হঠাৎ একদিন পত্রিকার পাতায় অথবা খবরে তাদের রক্তমাখা ছিন্ন ভিন্ন ছবি চোখে পরে । জঙ্গি দমন করে আমরা হই মুক্ত । আর ধর্মের নামে অনেক বড় কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সাধনে হারিয়ে যায় কত আদিব ।অপেক্ষায় থাকে কত নিরা । যা হয় ভালোর জন্য হয় কথাটি বলে হইত আমরা সব কিছু ভুলে যায় । কিন্তু সেই সব নিরা কখনো ভুলতে পারে না ।
তারা নীরবতা ধারণ করে । অসম্ভব ভয়ঙ্কর নীরবতা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৭ দুপুর ২:৪৬