রবীন্দ্রনাথের "ক্ষুধিত পাষাণ" বলে একটা অতি চমৎকার গল্প আছে। গল্পটির পটভূমি দ্বিতীয় মাহমুদ শাহের আমলের (১৪৮৯-১৪৯০) একটা অভিশপ্ত প্রাসাদ। সেই প্রাসাদে কেউ রাত্রি যাপন করলে তার গভীর হ্যালুসিনেশন হয়। সে এমন এক হ্যালুসিনেশন যেখানে মানুষ তিনশো বছর আগের একটা সময়ে চলে যায়। প্রাসাদে কোন এক সময়ে অপূর্ব সুন্দরী এক পারস্য তরুণী সখী এবং দাস-দাসী পরিবৃত্ত হয়ে থাকতো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সেই তরুণী অসীম ঐশ্বর্যের অনন্ত কারাগারে বন্দিনী হয়ে ছিলেন। আর তার অভিশাপ লেখা হয়েছিল প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে। গল্পের শেষে লেখক বলছেন যে, খুব সম্ভবত গল্পটা আগাগোড়া বানানো।
আমার এই গল্পটা বানানো নয়, যদিও গল্পে কিছু রহস্য আছে। পৃথিবী রহস্যময়, এখানে কত বিচিত্র ঘটনা ঘটে! গোলাপের পাপড়ির মত যদি ঘটনার সবগুলো পাপড়ি খুলে খুলে দেখা যেত, তাহলে হয়ত দেখতাম যে কোন রহস্য নেই। কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে তা হয়না। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। হ্যামলেটে শেক্সপীয়ারের সেই অমিয় বানী "দর্শন ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিসীমার বাইরে স্বর্গ ও পৃথিবীতে আরো বহু কিছু আছে, হোরাসিও"!
ঘটনাটি পিতার কাছে খুব ছোটবেলায় শোনা। পিতার কর্মস্থল তখন রংপুরে। ঘটনাটি সে শহরের জামে মসজিদের ইমাম সাহেব কে নিয়ে। সম্ভবত স্বাধীনতার অল্প কিছু সময় পরের ঘটনা। এই ইমাম সাহেব তার ধর্মপরায়ণতা এবং সদগুণাবলির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ইমাম সাহেব বৃদ্ধ বয়সে যখন অসুস্থ তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল তার জানাজার নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব তিনি কাকে দিয়ে যেতে চান। উত্তরে তিনি যার নাম বললেন সে নাম শুনে সকলেই চমকে গেলেন। লোকটি অতি ছোট কাজ করেন। সামাজিক মান মর্যাদায় তার অবস্থান একেবারেই নিচে। শহরে খুব কম লোকই তাকে চেনেন। যারা চেনেন তারা তাকে পাঙ্খাওয়ালা বা পাখাওয়ালা নামে ডাকেন। সকলেই অবাক হলো যে সেই পাখাওয়ালা এতটা ধর্মপরায়ণ ছিলেন যে ইমাম সাহেব তাকে নিজের জানাজা পড়ানোর জন্য ঠিক করেছেন।
সে সময়ে সরকারী অফিসগুলোতে টানা পাখা চালাতেন এমন এক অতি তুচ্ছ পেশাজীবী লোক ছিলেন। রংপুরের মত ছোট শহরে বিচারপতি বা ডিসি সাহেবের মাথার উপরে এই ধরনের টানা পাখাগুলো চলতো। বড় কাঠের ফ্রেমে লাল রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি পাখাগুলো সিলিংয়ের সাথে ঝোলানো থাকতো। সেই কাপড়ের পাখাটি নীচের দিকের একটা অংশ দড়ি দিয়ে যুক্ত করে টান দিয়ে দিয়ে বাতাস করা হতো। যে লোকটি দড়ি টানার কাজটি করতেন তাকে অফিস কক্ষে বসতে দেওয়া হতো না। তিনি বাইরের বারান্দায় বা ছোট কোন ঘরে বসে পরিশ্রমের কাজটি করতেন।
ইমাম সাহেব মারা গেলেন আরও কিছুদিন পরে। তিনি যখন মারা গেলেন তখন সেই পাখাওয়ালার কথা কারো মনে রইলো না। জামে মসজিদের যিনি অতিরিক্ত ইমাম স্বাভাবিক ভাবে তিনিই বড় ইমামের জানাজায় ইমামতি করবেন এমনটা সকলে ধরে নিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার জানাজার দিনে ঠিক সময়ে সেই পাখাওয়ালা উপস্থিত হলেন। ইমাম সাহেবের জানাজার নামাজ সেই পাখাওয়ালাই পরিচালনা করলেন।
কিন্তু পরদিন থেকে রংপুর শহরে পাখাওয়ালাকে আর দেখা গেল না। তিনি দূরে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। কারণ পাখাওয়ালার বাইরে তার যে আরেকটি পরিচয় আছে সেটি তখন প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। তাই তাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৪৪