কাক ডাকা একটি সকাল।
রাশেদ সাহেব মর্নিং ওয়াক করতে বের হলেন। ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন অতি ধীর ও মন্হর গতিতে। বয়সের ভার তার জোরে দৌড়ানোর ক্ষমতা হরন করে নিয়েছে। কিন্তু তার মনোবল কমাতে পারেনি। তাই প্রতিদিন তিনি বের হোন মর্নিং ওয়াকে।
সময়টা তার মোটেও ভালো যাচ্ছে না। সরকারি চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন মোটামুটি তিনি অবসর। সারাদিন তার সময় কাটে ছোট একটি ঘরে। সালেহা বেগম মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। এতগুলো সময় তিনি একা থাকলেও নিজেকে কখনো একা মনে করেননি। কাজের চাপ তাকে অনেক কিছুই ভাবতে দেয়নি। কিন্তু আজ সে নিজেকে অনেক অসহায় ও নিস্ব মনে করেন। যদি আজ সালেহা বেঁচে থাকতো, হয়তো তার দিনগুলো আরো ভালো ভাবেই কাটতো। রফিক তার একমাত্র ছেলে। বিয়ে করেছে অনেক আগেই। তারও একটা ছেলে আছে, রুবেল। তার একমাত্র নাতি। তাকে দেখেই অনেকটা বেঁচে থাকার অবলম্বন মনে করেন তিনি। ইদানিং তার নাতিটাও তাকে খুব একটা সময় দেয় না। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যায়। এখানে নাকি অনেক পড়ার চাপ। তাই সারাদিন শুধু পড়ালেখা নিয়েই ব্যাস্ত থাকে। তার ছেলে আর পুত্রবধু সবাই ব্যাস্ত নিজেদের কাজ নিয়ে। তাকে সময় দেওয়ার মতো কেউ নেই।
ইদানিং আরো সমস্যা হচ্ছে তার। পেনশনের টাকাটা নিয়ে অনেক দিন ধরেই ভোগান্তির মধ্যে আছেন। আবার তার ছেলেও টাকাটা চেয়ে রেখেছে অনেক দিন আগে থেকেই। এই টাকাটা দিয়ে সে একটি বিজনেস করবে। কিন্তু এই টাকাটা নিয়ে তার নিজেরও একটা স্বপ্ন আছে। সালেহার ইচ্ছা ছিলো একটা এতিমখানা খোলার। তার জীবদ্দশায় সেটা সে করতে পারেনি। তাই এখন সেটা করার ইচ্ছা আছে তার। কিন্তু ছেলের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেও কোনো সদুত্তর পাননি। ছেলে বলেছে তার চাহিদাটাই আগে।
ছেলের চাহিদা পূরন করতে গিয়ে তিনি আরেকটি বিয়ে করেননি। যদি সৎ মার কাছে তার সন্তান ভালো না থাকে। তাই নিজের ইচ্ছা ও জৈবিক চাহিদাকে অপূর্ন রেখেই তিনি তার ছেলের সব চাহিদা মটনোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আজ সামন্য কিছু টাকার মায়া সেই ছেলে ছাড়তে রাজি না।
আজ সকালেই এটা নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি হয়েছে। ছেলে রাগের মাথায় তাকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। আসলে রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছুই বলে। এটা হয়তো তার মনের কথা নয়। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ধানমন্ডি লেকের চারপাশটা ঘুরে আসেন তিনি।
কিন্তু দিন চারেক পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। রফিকের সাথে তার তর্ক যুদ্ধ চলতেই থাকে। আর কিছু হলেই তাকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এই ছেলেকেই তিনি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন।
তার আবদার কখনো প্রত্যাখান করেননি। কিন্তু আজ সে তার সাথে কতো খারাপ আচরনই না করছে।
এক সপ্তাহ পর।
বাসার পরিস্থিতি কিছুটা হলেও শান্ত। কিন্তু তার মনের ভিতর জটলা বাঁধছে নিয়মিত। ফজরের নামায আদায় করার পর তিনি মর্নিং ওয়াকের জন্য রেডি হচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই বুকের ভিতরটা ব্যাথা করে ওঠে। বুকে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন তিনি। ব্যাথায় চোখটি বন্ধ হয়ে আসে অচিরেই। বাবার রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভিতরে উকি দেয় রফিক। দেখেন তিনি বসে আছেন। ভিতরে গিয়েই বলেন-
আমার টাকাটার কি হলো? তোমাকে না বলেছি তাড়াতাড়ি করতে। আমার দিকে একটুকুও নজর নেই তোমার। খাওয়া আর শোয়া ছাড়া তো তোমার কোনো কাজ নেই। আর শেষ বয়সে এসে তোমার এতো মনের ইচ্ছা পূরনের কি আছে। আর সকালের হাটাও কি ছেড়ে দিয়েছো নাকি? এভাবে করে আর কতোদিন। তার চেয়ে তুমি চলে যাও। আমার কথা না শুনলে আমার সাথে তোমার থাকা হবে না। -বলেই আলতো করে একটা ধাক্কা দেন তার বাবার গায়ে। বুকের উপর থেকে হাতটা পরে যায় রাশেদ সাহেবের। সব শেষ হয়ে যায় তখন। তিনি চলে গেছেন বহুদুরে, সবার ধরা ছোয়ার বাহিরে।
ডুকরে কেঁদে ওঠে রফিক। তার আর্তচিৎকারে ভরে ওঠে পুরো ঘর। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। তার ব্যবহার তার বাবার মনকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে। কথা বলছো না কেন বাবা? তোমার কি হলো বাবা? আমার টাকা লাগবে না। তুমি কথা বলো বাবা। আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা। আমাকে ক্ষমা করো বাবা।
রাশেদ সাহেব চলে গেলেন সালেহার কাছে। তার শেষ ইচ্ছাটা তিনি পুরন করতে পারেন নি। কিন্তু তাতে কি হবে, ছেলেরটা তো হলো। রফিকের জন্য তিনি রেখে গেছেন তার সমস্ত সম্পত্তি। ভালো থাকুক তার সন্তান।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:৪৩