somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেখর দেবের প্রত্নচর্চার পাঠশালা

০৬ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রচ্ছদঃ মোবাশ্বির আলম মজুমদার, প্রকাশনীঃ পাঠসূত্র, হাদিয়াঃ ১৪০ টাকা, পৃষ্ঠাঃ ৫৮
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ISBN: 978-1-23456-2533



“আমি কবিতাটির জনয়িতা
থ্রি-পিচ মোড়ানো কবিতাটির পিতা।...
আমি থ্রি-পিচ মোড়ানো কবিতাটির পতি।”

এবারের বইমেলায় নির্জনচারী ধ্যানমগ্ন কবি শেখর দেবের ‘প্রত্নচর্চার পাঠশালা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের পূর্ব থেকেই নামের কারণে কিঞ্চিৎ কৌতুহলবোধ কাজ করছিল। কবি কি তাহলে প্রত্নতাত্ত্বিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো! না। সেতো কবি। শব্দের কনি আর কলমের ব্রাশ হাতে হয়তো কবি নিজেই নেমে পড়েছে হাজার বছরের প্রাচীন শ্যাওলা ধরা শব্দের স্যাঁতস্যাঁতে গোরস্থানে। একে একে উৎখনন শেষে বের করে আনবে কিছু জীবাশ্ম জীবন এবং জাক্কুম ফলের গন্ধ মেশানো কাব্যের শরীর। ম্যাট্রিক্স হাতে প্রেক্ষিত বিশ্লেষণপূর্বক উদঘাটন করবে ঘটনা এবং ঘটনার পেছনের রটনা। মূলতঃ কবির ঐতিহ্য প্রীতিই হয়তো তাকে এমন একটি নামকরণে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে। কবিতা কেন লেখেন এ প্রশ্নের উত্তরে তার সহজ সরল উত্তর- “কবিতা লিখি মনের পীড়ন থেকে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতকে শিল্পিত অবয়ব দেয়ার চেষ্টা থেকে লিখি। এমনও যে, কবিতার কাছে আশ্রিত হয়ে নিজেকে নির্ভার মনে হয় তাই।” প্রচ্ছদ কথায় প্রিয় কবি এজাজ ইউসুফী এর ভাষায়, শেখর দেব নতুন শতক শুরুর কাব্য-প্রতিনিধি। বর্জ্য আধুনিক বাংলা কবিতার বিপরীতে নতুন স্বরায়ন ও কথন-ভাষ্য বির্নিমাণের কালে তার আবির্ভাব। অধুনা উত্তর সময়ে পরিবর্তন প্রবণতার সন্দর্ভ যখন চলমান তখন ভিন্ন এক নান্দনিক কাব্য-প্রয়াস নিয়ে হাজির হয়েছেন কবি শেখর দেব।” গ্রন্থটির বোরখা উন্মোচনের কালে কবি ভাষ্য- “আধুনিকোত্তর কালের নান্দনিক কাব্য-ভাষা ও বোধ নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। শেকড়ের অমৃত সঞ্জীবনী নিয়ে লোকায়ত চেতনার বহুরৈখিক স্বরায়নই আমার মূল লক্ষ্য। বাঙালির চিরায়ত দর্শনের ভেতর প্রবাহিত সংস্কারের পরিশুদ্ধ ভাবনাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বা অনিবার্যতার একটি তর্ক তুলে দিতেই এ কবিতাগ্রন্থ।” কবির নিজস্ব ব্লগে প্রকাশিত “কবিতার চিন্তা ও চেতনা” প্রবন্ধে তার ঐতিহ্য প্রীতি লক্ষণীয় (Click This Link )| তার ভাষ্যমতে- কবিতে সময় সচেতন হতে হয়। কবিতায় সময়কে ধারণ করতে না পারলে কবি ব্যর্থ। এই ধারণের ব্যাপারটি হতে পারে কবিতার বিষয়, অঙ্গিক ভঙ্গি এসবের সমকালিন প্রবণতাকে ধারণ। কবির একটি দেশ থাকে। যে দেশের আলো বাতাসে সে বেড়ে ওঠে। যার মাটির উপর হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শিখেছে। আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, বর্ণিল সংস্কৃতি। একজন কবি এর সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, খোঁজেন সংগতি আর অসংগতি। ”

গ্রন্থটিতেঃ লাখবাতি, ফুল-পুরাণ, মা-মাটি দলিল, শ্মশান সাধু, ম্যাসেজ ও কথিত ফুলপাখি, নূপুর ও বৃষ্টি, তুলো চোর পাখি, সার্চ লাইট, শীত নামে শহরে, ভাদরে রসায়ন, মোহনদেবী, রোদেলা সাবিত্রী, মোক্ষলাভ কিংবা বাহারি বেলুন, রাহুশনিময়, জলকুমারী, ঘুম ভাঙে কমলাপুরে, চুমুগন্ধী হাওয়া, মেধস মুনি, পালশঠোঁটে বসন্ত, ছুঁড়ে দেয়া সুখ, কামচন্দ্রিমা, পিতা ও পৃথিবী, গুলজারের মোড়ে মৃত্যু বিষয়ক, ফুলেশ্বরী, পদ্মযোনির অন্তরালে, ঘুমকাব্য, মার্কসের মালভূমি, প্রজন্মবোধ, গোল চাঁদ, কন্ট্রাডিকশান, মাটির আয়না, মুগ্ধ মৌনতা ইত্যাদিসহ মোট ৪৮টি নির্বাচিত কবিতা সংকলিত হয়েছে। কবিতার তনু-মন আশ্চর্স দক্ষতায় নির্মাণের পাশাপাশি নামকরণেও কবি বিদিক মুন্সিয়ানা দেখিতে সক্ষম হয়েছেন।

লাখবাতি কবিতায় কবি প্রাচীন বাংলার আবহমান সংসারকে তুলে ধরেছেন দাদার শোক আর দিদির দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে। এই হতাশার জন্ম হয়েছে পরম সুখে দিনাতিপাত করতে গিয়ে বিদ্রোহী চেতনায় পারদজনিত ক্লান্তিময়তার কারণে যা বারংবারই বাঙ্গাল জাতিকে পরাস্ত করেছে। সামাজিক রীতি-ণীতিতে সংস্কার সাধনের পরেও সব সংস্কার শেষ হয়ে যায়নি। বরং তা এখনো চলমান রয়েছে। বিষয়টি আমাদেরকে নির্জীব ও নিস্তেজ করেছে। কবিতাটির অর্ন্তনিহিত ভাব গ্রন্থটির নামকরণের সাথে যায়।
কাঠের সিন্দুকে জ্বলে লাখবাতি। অন্নপূর্ণার হাসিতে কোকিল/ডাকে ধানের গোলায়।/ পরিপাটি ধুতির ভাঁজ, জ্বলে হাসি সুখের বাতি।/ রঙিন আঁচলে দেখা দিঘির দীঘল ঘাট সব জানে।/ শিমুলতলায় ঝরাপাতা করবন্দি করে পেয়েছি সুদীর্ঘ আয়ু।/গন্ধরাজের বাগানে প্রজাপতি-চোখে খুঁজেছি তৃষ্ণা বিনাশী নদী।/অবশেষে সেই নদীতেই হারিয়েছি সব।/ শুভ্র বসনা দিদির সন্তানেরা নিয়ম ভেঙে গড়েছে দিনরাত।/আঁধার সিন্দুকে জমা আছে দাদার শোক, দিদির দীর্ঘশ্বাস।

কবি বলতে তিনি ধ্যানমগ্ন সাধুকে বুঝেন যিনি নিতান্তই ভালো মানুষ। কবির ধ্যান শব্দের শক্তিকে ব্যবহার করে নিজ এবং অন্যের মনের ভেতর অনুভূতির পুলক জাগরণের ধ্যান। কবির চিন্তায় প্রচন্ড আবেগ থাকে যাকে চেতনার সার্থক প্রয়োগে কাব্যিক করে তুলতে হয়। শ্মশানসাধু কবিতায় কবির ধ্যানমগ্ন জগৎ ভ্রমনের বৃত্তান্ত খুঁজে পাওয়া যায় যেভাবেঃ যাপনের যবনিকা টানার আগে লাশ-পোড়া আগুন গায়ে মেখে/চণ্ডাল সাধুকে বলে: শিবঠাকুর শ্মশানে-শ্মশানে তুমি কজন পার্বতীর বুকেদিয়েছ আগুন।/ সাধু মৃদু হেসে পাশ ফিরে শোয় পরম মমতায়।

শেখর দেবের এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে উত্তরাধুনিক ভাবাক্রান্ত রোমান্টিক কবিতা হিসাবে সনাক্ত করা যায়। তার কবিতায় প্রকৃতি এবং নৈসর্গিক দৃশ্যায়ন দেখা যায় খুব বেশি। মাত্রা বা লাইন ব্রেক অনিয়মিত। রোমান্টিক কবিতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো এই সংকলনের কবিতাগুলোতে উপস্থিত যা নিম্নরুপ-

• যুক্তির উর্ধ্বে সহজাত প্রবৃত্তি অর্থাৎ সংবেদন, আবেগ, অনুভূতি এবং কল্পনাকে স্থান দেয়া। যেমন- স্বপ্নের ফোটানো ফুলগুলো/ কোন এক মালিনী এসে তুলে নিয়ে যায় ভোরে/ পড়ে থাকি প্রাত্যাহিক রাস্তায়/ আবেশ ক্ষেত্রের বাইরে হেসে ওঠে সুখগুলো/ বেদনা ছোঁড়ার হাত ভেঙে যায়।”, “শ্যাওলার মেলা হতে কিনে আনি বাঁশি/ বাঁশিতে ফুঁ দিলে বেড়ে যায় শিহরণ...”, গুলজারের মোড়ে মৃত্যু বিষয়ক কাব্যে “নিজেকে দেখতে গিয়ে অন্ধ হয়েছি সেদিন/ চারদিক আঁধার কিলবিল”, কিংবা “নিয়ত এক চঞ্চল পাখি ওড়ে সমস্ত আবেগের ভেতর। কাছে এলে ফুল ফোটে চারপাশ, গন্ধে গন্ধে লাগে মৌতাত বুকে যদি রাখো মাথা পৃথিবী জড়িয়ে যায় নিপুণ নিঃশ্বাসে।”
• শহুরে সংস্কৃতি থেকে গেঁয়ো এবং প্রাকৃতিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন। যেমন- পিতা ও পৃথিবী কাব্যে “কতোটা মেঘ জমা হলে মুছে যায় নীল। নরোম বুকে সমস্ত জমিয়ে কেঁপেছে পৃথিবী।” কিংবা “নিরবতার চাদরে দুঃস্বপ্নের ওম/ বানিয়েছে স্বপ্নের সংসার।... সোঁদা গন্ধে ডুবে/ ভেসে উঠি মাটির আয়নায়।”

• আত্মবাদী (Subjective) দৃষ্টিভঙ্গির উপর বিশেষ জোরারোপ এবং প্রতিষ্ঠিত শাসন যন্ত্রের নিবর্তনমূলক আচরণের প্রতিক্রিয়ায় বিদ্রোহী, উদ্ধত, অসামাজিক কিংবা নির্বাসিত অন্ধকার জীবন যাপনে অভ্যস্ত, এবং অনেক বেশি প্রকৃতি ও নর/নারীপ্রেমী চরিত্রের সৃষ্টি। প্রকৃতিকে স্বর্গের প্রতীকরূপে বিবেচনা করা। গোলচাঁদ কাব্যে প্রেম মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছেঃ সেই থেকে পূর্ণিমা এলে/গায়ে চাঁদের গন্ধে আলোকিত মাতাল বোঝিনা/কেন চাঁদ গোল হলে আঁধার ভালো লাগে, আর তোমার গোলে হারিয়ে ফেলি অনাবিল মৌনতা। ”, কিংবা “ “পুনর্জন্ম হলে/ নিশ্চল পাথর হয়ে সুরম্য ইমারতে/ সাক্ষী হবো এসবের।”, কিংবা “চলিষ্ণু সূর্যের কাছে সমূহ তেজদীপ্ত মুদ্রা জমা রেখে চেয়েছি শীতল পৃথিবী... পুঁজির পুটলি দেখে বলে দিতে পারি কতদূর যাবে মানুষ”, কিংবা ত্রিভূজ কাব্যেঃ “কথা ছিল তুমি বৃষ্টি হলে হবো সাগর, কথায় কথায় তুমি হলে বৃষ্টি আর আমি সুনীল আকাশ।” কিংবা “দৃশ্যের প্রতিফলন নিয়ে ফিরে এসেছি কুঠিরে/চোখের পর্দা হতে স্বর্গে র দৃশ্য আর সরে না।

• অতিপ্রাকৃতিক বিষয়, রহস্যময়তা এবং মধ্য/প্রাচীন যুগীয় ইতিহাসের প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ। রোদেলা সাবিত্রি কাব্যেঃ “সব দৃশ্য সরে গেছে অপার্থিব আঁধারে।/ সাবিত্রির কঠিন চোখে সত্যবান হয়ে বেঁচে ছিলাম কিছুকাল।”

• মানবাধিকার, আদর্শবাদ, অহংবাদের (Individualism) প্রচার। মা-মাটির দলিল কাব্যেঃ “সুবাসিত ফুলের বাগান উজাড় হলে হারিয়েছি মাটি। মায়ের অশ্রুসিক্ত চোখে দেখি না মাটির গল্প।” কিংবা মা্যাসেজ ও কথিত ফুলপাখিতেঃ “ফুলের কপট কাপড় খুলে দগদগে ক্ষত দেখে বাঁধন মন ছিঁড়ে যায় পাখি। বেদনার বালিশ জাগে বরষার রাত।”

• মৃত্যু, ক্ষণজীবিতা (Transience), বিভিন্ন বিষয়ে মানবজাতির অনুভূতি, অন্তঃপর্যবেক্ষন (Introspection), মনস্তত্ত্ব, বিষন্নতা (Sadness) এবং অবসাদের (Melancholy) প্রতি বিশেষ জোরারোপ। রঙিন ভ্যাকুয়াম কাব্যেঃ “মানুষকে দেবত্বের গুণাবলী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি/ মানুষ বড়ো বেশি হাসি-খুশি সামাজিক।...... সামাজিকতা রঙিন ভ্যাকুয়াম/শ্বাসকষ্টে মৃত্যুর খবর গোপন হয়েছে সব।”, কিংবা “শামুক জানে মুক্তোর ক্যান্সারে কতোটা সুখ লুকোনো...”, কিংবা “চুমুগন্ধী হাওয়ার বিশদ বর্ণনের আগে/দুটি চোখ বন্ধ হয়ে আসে...”, কিংবা “ডিসি হিলের ফুটপাতে জন্ম নিল যে আজ, কাঁদতে চেয়ে হঠাৎ থেমে যাবে।... শংকিত বাংলায় এখনো প্রেমিকের বুকে প্রেমিকা মাথা রাখে স্বপ্ন-সুখে”

• প্রচলিত রীতিণীতি এবং কানুনের চেয়ে নিজস্ব সৃজনশীল উদ্দীপনার (Spirit) উপর ব্যাপক নির্ভরতা। যেমন, ভাদরে রসায়ন কাব্যে “ভাদরে আকাশ দেখে বৃষ্টি মেপ না...”, “ কিংবা জন্মবীজ বুকে বেধেঁ/একান্তে পৃথিবী গড়ার ছিল স্বপ্ন, “শক্ত বুক পেতে দিলে/সূর্য ওঠে সমূহ কোলাহলের মাঝে”, “চাঁদ কি জানে কেন আকাশ এত ঝলমল”, কিংবা “ভোর হলেই ঘুম ভাঙানোর অপেক্ষায় শুয়ে থাকো অনাবিল আনন্দের ভেতর/ বালিশের অবিকল একটা স্বপ্ন মাথায় গুজে নড়ে চড়ে ওঠো...”।

রোমান্টিক ধারার প্রভাব সাহিত্যে কখনোই শেষ হয়ে যায়নি। বরং তা বিভিন্ন উপায়ে আত্মস্থ হয়েছে পরবর্তী সময়ে এবং ঘুরেফিরে এসেছে। শেখরের কবিতাকে উত্তরাধুনিক ভাবাক্রান্ত বিবেচনা করার মূল কারণঃ

• কবিতায় উত্তরাধুনিক হাতিয়ার বা কৃৎকৌশল প্রয়োগের ফলে অনেক সহজপাঠ্য টেক্সট/কবিতাও জনসাধারণের জন্য পাঠ দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ, মেকি বাস্তবতার চিত্রায়ন এড়াতে গেলে সিমুলেশন বা রিপ্রেজেন্টেশনের পন্থা বিধৃত করার প্রয়োজন হয়। উত্তরাধুনিক দর্শন যেহেতু কোন নিজস্ব অর্থ বা বাস্তবতা উৎপাদন করতে চায় না বরং পাঠকের সাবজেক্টিভ বোঝাপড়ার উপর ছেড়ে দেয় (participation)| বাস্তবতা তখনই নির্মাণ করা সম্ভব হবে যখন কোন সুনিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব হবে। যেহেতু জ্ঞান পরিবর্তনশীল সেহেতু আর্থ-সামাজিক জ্ঞানগত জায়গায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেহেতু এখন পর্যন্ত নির্মিত জ্ঞান হেজিমনি আক্রান্ত এবং নিবর্তনমূলক। মানব জ্ঞানের মৌলিক জায়গাগুলোর এখনো কোন সমাধান সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। যেমন ঈশ্বর, জীবনী শক্তি, মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থান, শাসক-শোষিতের সম্পর্ক ইত্যাদি। বাশিঁওয়ালা কাব্যে লক্ষ্য করুণঃ “মনের বারান্দায় ফ্রয়েড নামায় সুনিবিড় সন্ধ্যা/ বাশিঁওয়ালা আমি/ বাজাতে শিখিনি কোন দিন...”। খোদ কবির ভাষাতেইঃ চিন্তায় আবেগ থাকে, তাই চেতনার দরকার হয়। কবির এমন কোন দায় নেই কবিতায় একটি নির্দিষ্ট বিষয় বোঝাতে হবে। বোঝাতে গেলেই কবি কাব্য মঞ্চে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কবির চিন্তা ও চেতনার সমন্বয়ে কবিতা হয়। বোঝার দায়িত্ব পাঠকের। না বুঝলেও তেমন ক্ষতি নেই কারণ আগেই বলেছি কবিতার ভাষা মনের ভাষা। তাই মনের ভাষা সবসময় বুঝতে হবে এমন কথা নেই। আমরা ক`জন নিজের মনকে বুঝি? আবার অন্যের মন! তবে অনুভূতির একটা মজা আছে। অনুভূতির মজা মুখে বলে প্রকাশ যোগ্য হয়ে ওঠে কম। অনুভূতির কথা অনুভবের ব্যাপার। এই অনুভবের জন্য চাই স্থির মন। অস্থিরতা কবি ও কবিতা দুটোকে নষ্ট করে।

• উত্তরাধুনিক বয়ান/কবিতার বিষয়বস্তু সিমুলেশন ও রিপ্রেজেন্টেশনের কৌশল উদ্ধারপূর্বক অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে থাকে যেমন- যুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ইত্যাদি নির্ভর হয়ে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিদ্রুপ এবং হাস্যরস (irony)| এছাড়াও পূর্ববর্তী কাজের আত্মীকরণ হতে পারে (pastiche), ইতিহাস বা পটভূমি এবং জীবন, জীবিকা ও সৃষ্টি পর্বে কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকতে পারে (intertextuality), যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে যে কোন সময় পর্বে ডুব দিতে পারা বা কালিক বিভাজন মুছে ফেলা, কোন ঘটনাকে সত্যাসত্যভাবে উপস্থাপন করা (metafiction) যেমন- লালনের হাতে ইলেকট্রিক গিটার বাজানো, সমাজ ও জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রন না করার দর্শন থেকে ভ্রান্তি উৎপাদন(paranoia), টেক্সটের আকারগত বিশালতা(maximalism), সত্য এবং মিথ্যার ফাঁরাক না রাখা (faction), প্রাত্যহিক জীবনে পুরাণ, রূপকথা বা স্বপ্নীল যাত্রার শব্দচিত্রায়ন দেখা যায় (magic realism) কারণ, তারা মানুষিকতার দৃশ্যায়ন চায়, মানবিকতার নয়। কারণ মানবিকতা সমাজ সৃষ্ট একটি রিপ্রেজেন্টেশন। কিছু কৌশলের ব্যবহার সীমিত পরিসরে দেখা গেলেও সকল কৌশল আলোচ্য গ্রন্থে ব্যাপকভাবে ফুঁটে উঠেনি। নীড়হীন নিরবে কবিতায় লক্ষ্যণীয়ঃ “কোনদিন আর ডেকোনা কোন ঘোরলাগা অভিসারে/যেটুকুন দিয়েছি হৃদয় নিংড়ে তার সব হলো হলাহল/বৃষ্টির দিন শেষে রোদ উঠে গেলে শরীরে উজ্জ্বল/করুণ আকুতি নিয়ে নিবিড় আরাম আর চেওনা/মানুষ হতে চাই, সামাজিক নয় তেমন যা কাঙ্ক্ষার/উদ্ভাস্তু হৃদয় নিয়ে কতদূরে হারাবো নীড়হীন নিরবে/কোলাহলে ভেতর যদি পেয়ে যাও সমাধির কিছু অধিক/তবে বুঝবে, একদিন তুমি ভালবেসেছিলে আমায়।”

• উত্তরাধুনিক কবিতার আখ্যানবস্তু (Subject) ব্রক্ষ্মান্ডের নির্দিষ্ট কাঠামোহীনতা নির্দেশ করতে সারবিহীন (Theme) এবং মুক্ত ছন্দ বা লিখনশৈলী (free verse) ব্যবহার করে থাকে। লাইনের ব্রেক এবং কাঠামো এলোমেলো বা উদ্দেশ্যহীণ হয়ে থাকে। বস্তুনিষ্ঠ রচনার লক্ষ্যে রচয়িতার বক্তব্যকে সচেতনভাবে লেখা হয়ে থাকে যাতে পাঠক নিজের মতো করে পাঠ করতে পারে। এর মূল কারণ, জীবন এবং জগতের কোন বিশেষ অর্থ নেই কিংবা এর উপর মানবজাতি যে অর্থ ও কর্মকান্ড করছে তাও অর্থহীণ। এটি শূণ্যবাদী দর্শনের (Nihilistic) প্রভাব। ফলতঃ অর্থে কেবল হতাশা ব্যক্ত করার বদলে কোন বোধই প্রকাশ না করা এবং পাঠকের মনোজগতে ভাবনার উদ্রেক এবং কৌতুহুলী করে তুলে। যেমন, এটি কবিতা নয় শাস্তি কাব্যে “কিছু কথা একদম কবিতা হয় না/ অথবা কিছু খুব কবিতা....”

টেক্সচুয়াল বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডে আমরা মানুষেরা জগতবীক্ষার তর্জমা (Transcription) করে চলেছি প্রতিনিয়ত। কবিও তার ব্যতিক্রম কিছু নন। শেখরের কবিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেতনাবেগে তাড়িত সহজ-সরল ও সাবলীল ভাষায় মুক্তবৃত্তে লিখিত (যেমন- চোখ সোজা বয়ে গেছে পথ)। ছন্দ প্রকরণের কড়াকড়ি নেই। রগরগে যৌনতার চুনকাম সংলগ্নতা কম, মিশনারী ভালবাসার ছোঁয়া আছে। ফুল-পুরাণ কাব্যে তার ভাষ্যঃ “চাঁদ দেখাবে বলে/ যে পুরাণ শুণিয়েছিলে/তার কোন এক খন্ডে/ তুমি ছিলে দেবী।” তার লেখনী মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া চরিত্রের মুখোশ উন্মোচনকারী। তার কবিতায় বিমূর্তায়ন কম, মিথের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত, সরল দৃশ্যায়ন বেশি যা প্লেটোর অনুসরণ তত্ত্বের অণুযোগী (Imitation)| এজাজ ইউসুফী’র সাথে একমত পোষন করে বলা যায়- “লৌকিক দর্শনের প্রতি আনুগত্য তার প্রতিটি কবিতায় সন্তপর্ণে অনুপ্রবেশ করেছে। কাব্যের প্রাচীন কৌলিন্যকে ভেঙে দিয়ে ভারতবর্ষের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও মানবতন্ত্রের সন্ধানে ভরদ্বাজের ভূমিকা নিয়েছেন কবি। সমাজের বহুত্বময় রূপকতার আভাসও পাওয়া যায়। এ দেশের জল-হাওয়া ও মাটি-মানুষের দেশাত্মবোধের পজিটিভ ধারণাটিও কবি বুঝতে পেরেছেন। পুরাণ কিংবা প্রত্নস্মৃতিও জাগরূপ হয়।” আশা জাগানিয়া অস্থি মজ্জায় কবি শেখর দেবের কবিতা সুখপাঠ্য হিসাবে পাঠকদের সমীহ আদায় করে নিতে পারবে বলে আমার ধারণা। সবাইকে “প্রত্নচর্চার পাঠশালা” পড়ে দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।


সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:২৪
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্তর্দাহ

লিখেছেন মুনতাসির রাসেল, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১২:৫০


তোমার নীরবতা আজ মহাকালের মতোই ভারী,
তোমার চোখের গভীর অশ্রুধারা
আমার প্রতিটি শ্বাসে জীবন্ত এক অভিশাপ হয়ে জেগে থাকে।
তোমার হৃদয় ভাঙার শব্দ আমি শুনিনি,
তোমার ব্যথার সুর আমি বুঝিনি—
তোমার সেই বোবা যন্ত্রণাগুলো
আমার হৃদয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট থেকে বাংলাদেশের জন্য যা শিক্ষণীয় - ভাবনা

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ৯:৩৮


চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বোঝার জন্য আমাদের কিছুটা পেছনে ফিরে যাওয়া উচিত। ২০১৩ সালের শেষ দিকে ইউক্রেন পার্লামেন্টের ব্যাপক সমর্থন উপেক্ষা করে রাশিয়াপন্থী ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ যখন "[link|https://en.wikipedia.org/wiki/European_Union–Ukraine_Association_Agreement|ইউরোপিয়ান... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:০১

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের একটি 'সংশোধিত' অংশকে রাজনৈতিকভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তবু তো ফাল্গুন রাতে এ গানের বেদনাতে আঁখি তব ছলছলো....আমার দুঃখভোলা গানগুলিরে ......

লিখেছেন ইন্দ্রনীলা, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫



মাঝে মাঝে আমার বুকের গহীনে এক ব্যথার নদী উথলে ওঠে। উথাল পাথাল ঢেউগুলো পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে। উত্তাল বেগে ধেয়ে এসে ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে বুকের মাঝে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথা হালকা পোষ্ট!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:০৭

অবিশ্বাস্য হলেও লেকটির অবস্থান খোদ ঢাকায়; কেউ কি এর লোকেশন বলতে পারেন?



কাটা তরমুজের ছবিটা দেবার বিশেষ মাজেজা আছে;
উটিউবে একজন কামেল বুজুর্গান পাকা সূমিষ্ট তরমুজ কেনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×