বিষণ্ন কাঁটাতার (১)
ঘটনা সমান্য। তবু লিজার বেশ ভয় ভয় লাগছে। বান্ধবীদের কথা শুনে টেনশন হ”েছ আরও বেশি। ওরা অবশ্য সবকিছুতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সেদিন সুমির বয়ফ্রেন্ড নিয়ে সে কী আদিখ্যেতা! আহা! কী হ্যান্ডসাম! কী সুইট! কত সুন্দর করে কথা বলে! কত লম্বা! লিজা রাস্তায় একদিন দেখেছে ছেলেটাকে। তেমন আহামরি মনে হয়নি। ঠোঁটগুলো মেয়েদের মতো, কুঁজো হয়ে হাঁটে। দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এই এখনো, সামান্য একটা ঘটনা রংচং মিশিয়ে নানাদিকে নিয়ে যা”েছ। ইতি বলল, ‘ছেলেটা যদি তোকে ধরে নিয়ে যায়? খারাপ কিছু করে?’
সুমি বলল,
‘দেখতে-শুনতে তো খারাপ না।’
ইতি বলল,
‘চেনা লোক’ সিনেমায় একবার দেখেছিলাম মেয়েটাকে ভিলেনেরা ধরে নিয়ে যায়। তারপর জঙ্গলের ভেতরে একটা ঘরে অনেক দিন আটকে রেখে ওই সব করে।’
লিজার বেশ রাগ হলোÑসে বলল,
‘চুপ কর তো ইতি। তোর মাথায় কি খালি সিনেমা ঘোরে নাকি! আর কোনো কাজ নেই তোর। আর শোন, লাইফটা সিনেমা না।’
ইতি চুপ করে যায়। সুমি বলে, ‘আ”ছা ছেলেটা তোকে কী বলেছে?’
লিজা বলল, ‘বলছে, কোচিং থেকে বের হলে দেখে নেবে’
‘তুই ওকে চড়টা মারতে গেলি কেন?
‘জানিস না, প্রতিদিন আমার রিকশার পেছন পেছন কোচিং পর্যন্ত আসে।’
‘আজকে কী করেছিল?’
‘আমি রিকশা থেকে নামতেই এসে হাত ধরেছে। বলে সে নাকি আমাকে ভালোবাসে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কষে একটা চড় লাগালাম।’
সুমি বলল, ‘কিš‘ কাজটা কি ঠিক হলো?’
‘কেন?’
‘তুই ওকে বুঝিয়ে বলতে পারতি।’
‘আমি বোঝাব?’
‘হুম’
‘আমার কী ঠেকা পড়েছে?’
‘তাই বলে চড় মারবি?’
‘হুম, এগুলোকে লাই দিতে নাই। লাই দিলেই মাথায় ওঠে’
‘এখন যদি খারাপ কিছু করে?’
‘দেখি’
‘তুই বাসায় জানিয়েছিস?’
‘না রে। বাবা যে রকম রাগী জানলে উল্টাপাল্টা কিছু করতে পারত, ভয়ে জানাইনি।’
‘তবু আমার মনে হয়, জানানো উচিত ছিল।’
‘হুম’
‘এখন জানা তাহলে’
‘নাহ এখন জানানো যাবে না’
‘অন্তত এখন তোকে এসে নিয়ে যেতে বল।’
‘আ”ছা দাঁড়া, ফোন করছি।’
সুমি বাইরে গিয়ে দেখল ছেলেগুলো সব চায়ের দোকানে বসে কোচিংয়ের গেটের দিকে তাকিয়ে আছে।
লিজা ওর বাবাকে ফোন করেই যা”েছ। মিজান সাহেব ফোন ধরছেন না। কোম্পানির একটা জর“রি মিটিং চলছে। তিনটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে তাঁর। সেগুলোর মিটিং থাকে নিয়মিত। অন্যদের কথা বলতে দিয়ে তিনি লিজাকে মেসেজ দিলেন, ‘আই অ্যাম ইন এ মিটিং কল ইজ লেটার।’ লিজার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সে সুমিকে বলল, ‘আ”ছা তুই যা, আব্বু চলে আসবে।’
‘না, আঙ্কেল আসুক। পরে যাই।’
‘র্ধু, দরকার নেই, তোর বাসা তো দূরে এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’
ইতি, শান্তা আর সামিরা চলে গেছে। এখন সুমিও চলে যা”েছ। লিজার ভয় ভয় লাগছে। বাবার মিটিং কখন শেষ হয় কে জানে। না কি সে একাই চলে যাবে ছেলেগুলোর সামনে দিয়ে। সবার ওপর চরম মেজাজ খারাপ হ”েছ তার। মেয়ের চেয়ে মিটিং বড় হলো। এই ঘটনা মায়ের কানে গেলে ধুন্ধুমার কাণ্ড লেগে যাবে। তিন-চার দিন কথাবার্তা বন্ধ। না, মাকেও জানানো যাবে না। বাবাকে সে বেশি পছন্দ করে। এমনি বেচারা বাইরে যতই প্রভাবশালী হোক, বাসায় মায়ের ধমক খেতে খেতে শেষ। এই বদমাশ ছেলেটার কথা লিজা কাউকে জানায়নি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কেবল সাইফকে জানিয়েছে। সাইফ অবশ্য বলেছে সে একটা কিছু করবে। কিš‘ ছেলেগুলোকে দেখেই বোঝা যায়, সাইফের মতো পড়ালেখা করা ছেলেকে ওরা পাত্তা দেবে না। লিজা কোচিংয়ের গেটে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, ছেলেগুলো দোকানেই বসে আছে সেভাবে। বের হতে গেলেই সোজা ওদের চোখে পড়ে যাবে। এর মধ্যেই রিকশায় করে একটা ছেলে এসে থামল গেটে। লিজা জানে, ওরাই কোচিংয়ের শেষ ব্যাচ। সন্ধ্যার পর স্যার আর ছাত্র পড়ান না। ছেলেটা হয়তো স্যারের কাছে কোনো কাজে এসেছে। লিজা এসব ভাবতে ভাবতে পড়ানোর ঘরটায় এসে বসল। আর কেউ নেই। স্যার চলে গেছেন ভেতরের ঘরে। ছেলেটা এসে পড়ানোর ঘরেই ঢুকল। কাউকে না পেয়ে লিজাকেই জিজ্ঞেস করল, ‘ভেতরে কি অন্য কোনো ব্যাচ পড়ছে।’ লিজা বলল, ‘না ভাইয়া, আমরাই শেষ ব্যাচ। আমাদের পড়ানো শেষ হয়ে গেছে।’ ‘ও আ”ছা।’ বলে ছেলেটা বের হয়ে গেল। পরক্ষণেই অবার ভেতরে ঢুকে বলল, ‘সবাই কি চলে গেছে।’
লিজা বলল। ‘হ্যাঁ, কেন।’
‘না আপনি একা বসে আছেন তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
‘আমার আব্বু আসবে একটু পর।’
‘কিš‘ আপনাকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হ”েছ। কী ব্যাপার? সমস্যা না থাকলে আমাকে বলতে পারেন।’ লিজার কেন যেন মনে হলো ছেলেটাকে বলা যায় সবকিছু। ওর ভেতরে কেমন একটা সারল্য আছে।
সে বলল, ‘আমি একটা বিপদে পড়েছি।’
‘কী বিপদ? বলেন।’
‘কয়েকটা বখাটে ছেলে খুব ডিস্টার্ব করছে আমাকে। আব্বুর মিটিং চলছে নইলে সে এসে নিয়ে যেত।’
‘হা হা হা এই ব্যাপার। আ”ছা চলেন আমার সঙ্গে। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।’
লিজার তবু ভয় কাটছে না। ছেলেটা তো একা। ওরা চার-পাঁচজন। যদি ঝামেলা হয়। সে বলল, ‘থাক, আমি অপেক্ষা করি। মিটিং শেষ হলে আবার ফোন করব।’ ছেলেটা বলল, ‘মিটিং যদি রাত ১২টায় শেষ হয়? ততক্ষণ অপেক্ষা করবেন একা একা?’
‘হ্যাঁ। তা ছাড়া আমার কারণে আপনিও তো বিপদে পড়তে পারেন।’
‘র্ধু। আপনি চলেন তো। কিছু হবে না।’
লিজা উপায়ান্তর না দেখে ওর সঙ্গেই বের হলো। ছেলেগুলো ওদের দেখেছে। লিজা ভয় পেয়ে ওর হাত ধরে রইল। আলী বলল, ‘ভয় পাবেন না। চলুন আপনার ভয় কাটিয়ে দিই।’
ছেলেগুলো লিজার সঙ্গে আলীকে দেখেই প্রথমেই চিনতে পারেনি। রাজীব বলল, ‘পোলাডারেসহ আজ থাপ্পড়ের শোধ নিব।’ ওরা আরেকটু কাছে আসতেই জীবন বলল, ‘দোস্ত ওইটা তো মনে হয় আলী।’ রাজীব বলল, ‘কোন আলী?’
‘বিশ্বাসপাড়ার আলী।’ রাজীবের কথা শুনে সবাই থমকে গেল। ওরা ভাবছে লিজার বোধ হয় আলীর সঙ্গে প্রেম। আলী আর লিজা দোকানের সামনে আসতেই লিজা আরও শক্ত করে আলীর হাত চেপে ধরল আর যতটা সম্ভব গা-ঘেঁষে রইল। ঠিক তখনই আলী একদম ছেলেগুলোর সামনে থামল। আলী জীবনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অ্যাই তোরা নাকি ওকে কী বলবি? এখন বল।’ জীবন বলল, ‘আসলে আলী একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। আমরা বিষয়টা বুঝতে পারিনি।’ তারপর লিজার সামনে এসে বলল, ‘স্যরি আপু ভুল হয়ে গেছে আমাদের।’ লিজা অবাক হয়ে দেখল, আলীর চেহারা দেখেই কেমন ভয় পেয়ে গেছে ওরা সবাই। আলী জীবনকে বলল, ‘এই কোচিংয়ের সামনে তোদের যেন আর না দেখি।’
আলী যে রিকশায় এসেছিল সেটা তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। রিকশাচালক রাজু আলীর চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট হবে। বিকেলে আলী যখন বের হয় তখন রাজু সব সময় ওর সঙ্গে থাকে। সারা দিনের জন্য না হলেও বলা যায়, বিকেলবেলায় এটা আলীর প্রাইভেট রিকশা। রাজুও চৌকস ছেলে। আলীর খুব ভক্ত। শুধু ও সঙ্গে থাকলেই আলী সাত-আটজনকে দেখে নিতে পারে। আলীর জন্য রাজু যেকোনো ঝামেলায় যেতে রাজি। আলী রাজুকে বলল, ‘তুই এই আপুকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আয়। আমি মিরাজের চায়ের দোকানে আছি।’ বলে বাঁয়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল সে। রাজু লিজাকে নিয়ে ততক্ষণে রওনা দিয়েছে। লিজার তখনই মনে হলো, ছেলেটাকে তো অন্তত একটা থ্যাংকস দেওয়ার দরকার ছিল। রাজুকে সে বলল, ‘আ”ছা ছেলেটা আপনার পরিচিত মনে হ”েছ। নাম কী ওর?’
‘কার কথা বলতেছেন?’
‘ওই যে আপনাকে বলল, আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে।’
‘ওহ্ আপনি আলী ভাইয়ের কথা বলতেছেন।’
‘হ্যাঁ, আলী নাকি নাম?’
‘হুম। আলী ভাই।’
‘কিš‘ আপনি চেনেন কীভাবে ?’
‘কী বলেন, আপা। প্রত্যেক দিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তো আমি তাঁর সঙ্গে থাকি। এই সময় কোনো প্যাসেঞ্জার ওঠাই না। আলী ভাই বলছে বইলা আপনেরে নিয়ে যাইতেছি।’
‘আ”ছা, উনি কি মাস্তান নাকি? ছেলেগুলো কেমন ভয় পেয়ে গেল উনাকে দেখে।’
‘ছি ছি আপা, আলী ভাই মাস্তান হবে কেন? উনি খুব ভালো মানুষ। আমারে অনেক স্নেহ করে।’
‘আপনি কি আমাকে উনার ফোন নাম্বারটা দিতে পারেন?
‘আলী ভাইরে না জিগাইয়া কেমনে দিই।’
তারপর কী যেন ভেবে আবার বলল, ‘লেখেন’
লিজা মুঠোফোন বের করে নাম্বারটা নিয়ে সেভ করে রাখল। নেমে লিজা ভাড়া দিতে গেলে রাজু নিল না। বেশ জোরাজুরি করল সে, তবু ছেলেটা নিল না। শেষে ব্যাগ থেকে কয়েকটা চকলেট বের করে রাজুর হাতে দিল সে। বলল, আপনি খান আর আপনার আলী ভাইকেও কয়েকটা দিয়েন।’
বি:দ্র:-এটা কোন স্বপ্ন নয়,কাল্পনিক কোন কাহিনীও নয়,একটি সত্য কাহিনীর উপর ভিওি করে উপন্যাশটি লেখা পুরো লেখাটি পোষ্ট করতে না পারা জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। তবে এই কাহিনীটা নিয়েই এবারের বই মেলাই একটি বই বের হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৫৬