এদিকে ডা. ইভা হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মাহমুদ হাসান, বিদায়ী মহাসচিব ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ, নব নির্বাচিত মহাসচিব ডা. ইকবাল আসর্লান, স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতৃবৃন্দসহ কয়েকশ’ চিকিত্সক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ছুটে যান। এ সময় ডা. ইভার পিতা পুলিশের এসআই মনিরুল ইসলাম ও ছোট বোন নাদিয়া আফরিন ইমনের আহাজারিতে মর্গের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। ডা. ইভার মা কন্যার শোকে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকওু ডা. ইভার লাশ দেখতে মর্গে যান। সেখানে উপস্থিত চিকিৎসক নেতৃবৃন্দকে তিনি বলেন, খুনিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে। দক্ষিণখানের আমতলা ব্র্যাক ক্লিনিক সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, নম্র ও ভদ্র এই চিকিৎসককে তারা ক্লিনিকে যাতায়াত করতে দেখতেন। তার এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন তারা। এছাড়া ঢাকার বাইরে বিএমএ, স্বাচিপ ও ড্যাব নেতৃত্ব ডা. ইভা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ডা. ইভার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়না তদন্তকালে চিকিত্সক তার মাথা ও চোখে আঘাতের চিহ্নের আলামত পেয়েছেন। তাকে আঘাত করে ও শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। ময়না তদন্তকারী চিকিত্সক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, খুনিরা তাকে ধর্ষণ করার জন্য বহু চেষ্টা করেছিল। তবে ধর্ষণের কোন প্রাথমিক আলামত পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে নমুনার প্যাথলজি পরীক্ষা করে একশত ভাগ নিশ্চিত হওয়া যাবে। ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ চাঁদপুর জেলার ফরিদপুর উপজেলার বালিথুবা গ্রামে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ডা. ইভাকে যেভাবে হত্যা করা হয় ডা. ইভা গত বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণখান আমতলা ব্র্যাক ক্লিনিকে ডিউটিতে যান। ওই রাতে একজন প্রসূতির সিজারিয়ান করেন। এরপর তিনি বিশ্রাম করতে তিন তলার ১ নম্বর কেবিনে যান। পুলিশ ও কর্তব্যরত নার্স খাদিজা জানান, দোতলার তিন তলায় ওঠার গেট বন্ধ করে দিলে তিন তলায় কিছু ঘটলেও বুঝা যায় না। ক্লিনিক ভবনটি চারতলা। তিন তলা পর্যন্ত ক্লিনিক এবং ৪র্থ তলায় বাড়ির মালিক মনির মিয়া ও তার পরিবার থাকেন। ভোরে নার্স খাদিজা ডা. ইভাকে ডাকতে যান। তার কক্ষের কড়া নাড়লেও ভিতর থেকে সাড়া-শব্দ পাননি। তখন তিনি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেন ডাক্তার ইভার রক্তাক্ত মৃতদেহ মেঝেতে পড়ে রয়েছে। বিষয়টি তখনই তিনি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে জানান। ক্লিনিক থেকে ডা. ইভার পিতা মনিরুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে জানানো হয়। তিনি দ্রুত এসে দেখেন তার কন্যার রক্তাক্ত মৃতদেহ পরে রয়েছে। ভবন মালিকের পুত্র বাবু ডা. ইভাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতেন। এমন অভিযোগ করেছেন আত্মীয়-স্বজন। ডা. ইভার পিতা গ্রেফতারকৃত কেয়ারটেকার ফয়সাল, ভবন মালিকের পুত্র বাবু, ওয়ার্ডবয় মামুন ও কর্তব্যরত নার্স খাদিজাকে আসামি করে গত শুক্রবার রাতে দক্ষিণখান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে ঘটনার পর ক্লিনিক থেকে আসামিরা পালিয়ে যান। শনিবার ভোরে পুলিশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীননগর থানায় নিলাখ গ্রাম থেকে পলাতক কেয়ারটেকার ফয়সালকে গ্রেফতার করে। সে ওই গ্রামের বাসিন্দা স্বপন মিয়ার পুত্র। মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ফয়সাল পড়াশুনা করেছেন। তাকে ঢাকায় এনে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে ডা. ইভা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক হওয়া হলো না ডা. ইভা ২০০৯ সালে সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। এরপর তিনি সেখানে ইন্টার্নিশীপ শেষ করেন। তার মামা জসিম উদ্দিন বলেন, ডা. ইভা এফসিপিএস (গাইনি) পার্ট-১ শেষ করে শেরে বাংলা নগর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এফসিপিএস- পার্ট ২ এ অধ্যয়নরত ছিলেন। দক্ষিণখানের একটি ভাড়া বাসায় বোন ইমন ও মা হাসিনার সঙ্গে থাকতেন। পিতা পুলিশের এসআই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে কর্মরত। ইভা পিতাকে বলতেন, ‘আমি দ্রুত গাইনি বিশেষজ্ঞ হয়ে যাচ্ছি। আব্বু আর তোমার চাকরি করার প্রয়োজন নেই।’ বোন ইমন এবার বিবিএ শেষ করেছে। সে বর্তমানে চাকরি খুঁজছে।
ইভার মামা জানান, মাত্র নয় দিন ওই ক্লিনিকে ইভা ডিউটি করেছে। পাঁচ মাস আগে ফয়সাল সেখানে কেয়ারটেকারের চাকরি নেয়। উত্তরা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, গ্রেফতারকৃত ফয়সাল নিজে ডা. ইভাকে হত্যা করেছে। আর কেউ ছিল না বলে জানিয়েছে।
দক্ষিণ খান থানার ওসি লোকমান হাকিম বলেন, চারজনকে আসামি করে ডা. ইভা বাবা মামলা দায়ের করার পর পর বাবু, মামুন ও খাদেজাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার থেকে ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া স্বীকারোক্তি যাচাই বাছাই করা হচ্ছে বলে ওসি জানান।
চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ ও সাধারন ছাএ-ছাএীদের ক্ষোভ, খুনিদের গ্রেফতারের দাবি বিএমএর সভাপতি ডা. মাহমুদ হাসান ও মহাসচিব ডা. ইকবাল আসর্লান, ড্যাবের সভাপতি ডা. এ কে এম আজিজুল হক ও মহাসচিব ডা. এ জেডএম জাহিদ হোসেন পৃথক বিবৃতিতে ডা. ইভা হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ডা. ইভাকে হত্যা করার ব্যাপারে একজন কেয়ারটেকার যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তাতে বিষয়টিকে ‘জজ মিয়া নাটক’ বলে মনে হচ্ছে।
অবিলম্বে ডা. ইভার নেপথ্যে খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে চিকিৎসক সমাজ কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৩৭