গিটারটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো বিজয়। দীর্ঘদিনের বিরতিতে আঙুলে একরকম জড়তা এসে গেছে। কিছুদিন হলো নিয়মিত প্র্যাকটিস করে নিজেকে ফিরে পাচ্ছে। নিজেকে ফিরে পাওয়াটা দরকার। সামনের সপ্তাহে কলেজে দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কলেজে বিজয়ের বেশ সুনাম। স্কুলে এধরণের অনুষ্ঠান থেকে একটু আড়ালে থাকলেও কলেজে সেটা হচ্ছে না। গিটার বাজিয়ে চড়ানো গলা বন্ধুমহল থেকে শুরু করে শিক্ষকদের কানেও পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে। যদিও অনেকদিন হয়ে গেলো গিটার বাজানো হয় না।
"আরে তুই না পারলে আর কে পারবে? তোর গান ছাড়া প্রোগ্রাম হবে নাকি? গানের আইটেম তিনটা হবে। গানের সাথে কয়েকটা ছেলে পেলে পারফর্ম করবে এই আরকি। তুই গান গাইতে পারবি নাকি কিল খাইতে পারবি এখনি জানায় দে!"
কথাগুলো বলছিলো শাহেদ ভাই। প্রোগ্রামের সবকিছু দেখাশোনা করছেন তিনি। নিজের উৎসাহ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ওস্তাদ।
সেদিন বাসায় এসে অনেক্ষণ গিটারটা নিয়ে পড়ে ছিলো বিজয়। মাথায় অনেকগুলো গান কিলবিল করছে। অবশ্যই বাংলা গান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অন্য সংস্কৃতি ধার করা তার পছন্দ না। এমন না যে সে অন্য গান শুনে না। হিন্দী, ইংরেজি, এরাবিক সব ভাষার গানই কম বেশি তার পছন্দের তালিকায় আছে। শোনাও হয় বেশ। তবে তার দেশটা বাংলাদেশ। অনুষ্ঠান; সে যেমনই হোক, দেশীয় সংস্কৃতির পরিবেশনেই সেটা সম্পন্ন করা সম্ভব।
পার্টিতে যে যার মতো আনন্দ করবে, যেমন খুশি গাইবে নাচবে কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বেলায় সেখানে পরিবেশনের ব্যাপার থাকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাম "কালচারাল ফাংশন" দিলেই সেখানে বিদেশী সংস্কৃতির পরিবেশন জায়েজ হয়ে যায় না- বিজয়ের সহজ সরল ভাবনা। অনুষ্ঠান পরিবেশনের সময় যখন ভিন্ন দেশের গান, নাচ উপস্থাপন করা হয় এবং তার মাত্রা বাংলা এবং বাংলাদেশ দুটোই ছাপিয়ে যায় তার খুব অপমান বোধ হয়। অন্যদের কেমন লাগে সে জানে না, বুঝেও না। নিজের দেশের বিশাল গানের ভান্ডার। সেই ভান্ডার থেকে তুলে আনা গানে একটা অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না, হিন্দী গান গলায় তুলে কিংবা হিন্দী গানের সাথে তাল মিলায় আমাদের নাচতে হচ্ছে ভাবতেই খুব লজ্জা হয়।
৪২ বছরেও কি আমাদের নিজেদের একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠে নাই? ছোট বড় প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে বাইরের কালচার ধার করে নিজেদের অনুষ্ঠানের ডালা ভরে তুলতে হয়। এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে ভেবে পায় না বিজয়। কাউকে বলতেও ইচ্ছা হয় না এসব কথা। তবে সে কাউকে কিছু বলবেও না। প্রোগ্রামের জন্য সে বেশ কিছু বাংলা গান মাথায় রেখেছে। গানের সাথে পারফরম্যান্সের কথা বিবেচনা করে গানগুলো অবশ্যই মজার হবে। সে দেখিয়ে দিতে চায় বাংলা গানেই যে কত বিনোদনের খোরাক হয়, বাংলা গানের সাথেও যে স্টেজে পারফর্ম করা যায়! চিন্তা করতে করতেই গিটারটা হাতে নিলো বিজয়। আজকে অনেক দিন পর ঝড় উঠবে গিটারে, কণ্ঠে ঢেউ।
"কী রে, গান সিলেক্ট করেছিস? স্টেজ কাঁপায় দেয়া লাগবে কিন্তু। ধুম ধারাক্কা গান চাই!"
শাহেদ ভাই বললেন হাতে কিল দিয়ে।
বিজয় মাথা নেড়ে হাসলো।
- হবে। ধুম ধারাক্কা গানই হবে। আপনি পারফর্মারদের রেডি করেন। ফাস্ট বিটের সাথে তাল মেলাতে পারবে তো?
"ওইটা নিয়ে তুই চিন্তা করিস না, হয়ে যাবে। তুই লেটেস্ট হিন্দী গানগুলা শুনতে থাক!"
- লেটেস্ট, ওল্ড সব হিন্দী গানই আমি শুনি। কিন্তু অনুষ্ঠানে বাংলা গান হবে।
অর্জিত ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের পুরোটাই যেন শাহেদের মধ্য দিয়ে চলে গেলো! মাথায় হাত দিয়ে প্রায় বসে পড়ে বললো,
"কী বলিস! মাথা তোর খারাপ, না আমার!? বাংলা গানের সাথে পারফর্ম্যান্স হয় নাকি? বেশি হলে স্টেজে হাত পা নেড়ে দৌড়াদৌড়ি, শেষ! বাংলা গানের সাথে এর বেশি আর কী? এসবে হবে না। চলতি হিন্দী গানের সাথে সব যায়। মানুষও এটাই খাবে।"
বিজয় ক্ষোভ চাপা দিয়ে বললো, বাংলা গানের সাথে পারফরম্যান্স হয় না কে বললো? তাছাড়া আপনার এই ধারণা আমাদের ৪২ বছরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকে অপমান করার শামিল।
শাহেদ হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললো, আরে রাখো তোর সংস্কৃতি। আমোদ ফুর্তিই বড় কথা। দেশ স্বাধীন হইছে তো এর জন্যই নাকি?
বিজয় ভেতরকার ক্ষোভটুকু আর চাপা দেয়ার চেষ্টা করলো না। জোর গলায় বলতে লাগলো,
শাহেদ ভাই আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন বাংলা সংস্কৃতিতে আনন্দ ফুর্তি করা নিষেধ, তাই অন্যদের থেকে সংস্কৃতি ধার করে আনন্দ করতে হবে!
"দেখ বিজয়, আমি তর্ক করতে চাচ্ছি না। তবে..."
বিজয় কথা টেনে নিয়ে বললো, আমিও আপনার সাথে তর্ক করতে চাচ্ছি না। তর্কে আপনি আমার সাথে পেরেও উঠবেন না। শুধু বলবো, আপনি একটা পার্টির আয়োজন করেন। বাংলা, হিন্দী, উর্দু যা খুশি মিশিয়ে আমোদ ফুর্তি করেন, আমি আসতে রাজি আছি। তবে আপনি যখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন সেই পরিবেশনে বাংলার সাথে হিন্দী, উর্দু, ইংরেজির মাল মসলা মেশানো হলে সেখানে আমি নাই।
শাহেদ হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বললো, বিজয় তুই ভেবে দেখ। কলেজের জন্য এটা বেশ বড় ইভেন্ট।
- অবশ্যই বড় ইভেন্ট। আর তাই একটা বড় ইভেন্টে আপনি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ধারণ করে বিনোদন উপহার দিতে ভয় পাচ্ছেন তা দেখে আমি আপনার হয়ে লজ্জা পাচ্ছি। ৪২ বছরে কি বাঙালি এতটুকু স্বকীয়তা অর্জন করতে পারলো না? আজও একটা প্রোগ্রাম আয়োজন করতে হলে অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি ধার করে একসাথে ব্লেন্ড করতে হচ্ছে কেন? আপনারা এমন বিকলাঙ্গ প্রোগ্রাম আয়োজন করতেই পারেন। আপনাদের স্বাধীনতা। তবে আমি জেনে শুনে কোন সুস্থ স্বাভাবিক শিশুকে বিকলাঙ্গ করে পৃথিবীতে আনতে চাই না। দুঃখিত।
শাহেদকে বেশ আহত মনে হলো বিজয়ের ছেলেমানুষিতে।
"Ok fine! তোমাকে দর্শকসারিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আশা করি প্রোগ্রাম উপভোগ্য হবে!"
বিজয় একটু হেসে ঠান্ডা গলায় বললো, উপভোগ্য হবে আমিও কামনা করি। তবে আমি সংস্কৃতি আহরণে বিশ্বাসী হলেও ধার করার বিরুদ্ধবাদী।
বলেই বিজয় ঘুরে দাঁড়ালো। এই ঘুরে দাঁড়ানো আর ফিরে আসার জন্য না। বিজয় তার রক্তের ভেতর একধরণের স্বস্তি অনুভব করছে। অনুষ্ঠানে হয়তো বাংলা এবং বাংলাদেশ উপেক্ষিতই থাকবে, তবে তার ব্যক্তিসত্তা কোন আপোষ করে নাই, স্বস্তিটুকু এই ভেবে। তবে সেই রক্তে টগবগিয়ে ওঠা আগুন অনুভূতি পাচ্ছে না।কীভাবে পাবে?
এখানে বাংলার চিকনি-চামেলিরা কোমর দোলাবে, ওখানে ফেলানির ক্ষত-বিক্ষত লাশ কেঁপে কেঁপে উঠবে! ভাবতেই বিজয় প্রবল দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়। বাঙালির জাতির পিতা আছে, কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতি এবং তার এই দুঃখবোধের কোন মা-বাপ নাই!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:২৪