আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ১
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ২
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ৩
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ৪
১৯৯৬ সালে তালিবান কাবুল দখল করে আফগানিস্তানকে ইসলামিক এমিরেটস ও অফ আফগানিস্তান হিসেবে ঘোষনা করে এবং শরিয়া আইন জাড়ি করে। তালিবান মতাদর্শ শরিয়া আইন, পশতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারা ও দেওবন্দী মতবাদের সংমিশ্রনে একটি নতুন উদ্ভাবিত মতবাদ। শুরুর দিকে তালেবান নীতি ও আদর্শ মৌদুদী ও জামায়াত ই ইসলামী দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরবর্তীতে মুফতি রশিদ আহমদ লুধিইয়ানভি দ্বারা ব্যপক ভাবে প্রভাবিত হয়।
প্রায় ২০ বছরের গৃহযুদ্ধে আফগানিস্তান তখন ধ্বংশস্তুপ। তখন আফগানিস্তানের অর্থনীতি ও অবকাঠামোর অবস্থা খুবই করুণ। দেশের কোথায় তখন পানির সাপ্লাই নেই, রাস্তা নেই, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বাসস্থান, খাবার, পানিয় জল, টেলিফোন সংযোগ সব কিছুই প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। শিশু মৃত্যুহার, স্বাস্থ্য, মানব সম্পদ সবকিছুর অবস্থাই দূর্দশাগ্রস্থ। একদিকে দেশে কাজ নেই অন্যদিকে যুদ্ধে পরিবার প্রধান নিহত হওয়ায় বিধবা প্রধান পরিবারের সংখ্যা দাড়ায় আনুমানিক ৯৮০০০। যাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল।
এমন সময় সদ্য গঠিত তালিবান সরকারের সামনে ছিল তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। যার মধ্যে দেশে শরিয়া আইনের প্রতিষ্ঠা ও শৃংখলা ফিরিয়ে আনা, অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সমগ্র দেশে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আফগানিস্থানে তখন খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ও অবকাঠামো উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। তাদের প্রয়োজন ছিল বিদেশি সহায়তার। কিছু এন জি ও শহরাঞ্চলে খাদ্য ও স্বাস্থ্য খাতে কাজ করলেও তা ছিল অপ্রতুল। অন্যদিকে তালিবান সরকার এন জি ও গুলোর উপর আস্থা রাখতে না পারায় তারা সেগুলোকে শহরাঞ্চলের বাইরে কাজ করার অনুমতি দেয় নি। ততদিনে রাশিয়া অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ায় এবং মোজাহিদ দের কাছে মার খাওয়ায় তারা তালিবানের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ায় এ অঞ্চলে ইউরোপ ও আমেরিকার কার্যসিদ্ধি হয়ে যায় ফলে তারাও এ অঞ্চলের উপর আগ্রহ হাড়িয়ে ফেলে এবং তাদের থেকেও কোন প্রকার সাহায্য পাওয়া যায় নি।
তালিবান সরকার শহরগুলোতে কঠোরভাবে তাদের আইন বাস্তবায়ন করতে শুরু করে এবং গ্রামাঞ্চলে জিরগা ব্যবস্থা উৎসাহিত করে যার মাধ্যমে তালিবান আইন বাস্তবায়ন হবে। ফলে গ্রামাঞ্চলে তালিবান নিয়ন্ত্রন ছিল পরোক্ষ বা সামান্য। তালিবান সরকার এ সময় দূর্নীতি ও অইসলামিক, অনৈতিক কর্মকান্ড দমনে কঠোর হয়। নারীদের প্রতিও তাদের কঠোরতা প্রকাশ পায়। অভিবাবক ছাড়া নারীদের রাস্তায় বের হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। নারীদের কর্মসংস্থান হাসপাতাল গুলোতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, সেখানে নারী রোগিদের পুরুষ ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা নিষিদ্ধ ছিল। তালিবান ক্ষমতা নেয়ার আগে বেশিরভাহ প্রাথিমিক বিদ্যালয়ে নারীরা শিক্ষাদানে জড়িত ছিলেন। নারীদের নিষিদ্ধ করার ফলে শিক্ষকের অভাবে প্রচুর স্কুল বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। উচ্চ শিক্ষায় নারীদের নিরুৎসাহিত করা হতে থাকে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতেই এ ব্যবস্থা বলে তালিবানের পক্ষ থেকে প্রচার করা হতে থাকে।
জাতীসংঘের সহায়তা কার্যক্রমে নিযুক্ত মহিলাদের বোরকা পড়তে বলা হয় এবং পুরুষদের সাথে কথা বলার সময় পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলতে বলা হয়। ফলে জাতিসংঘ মুসলিম মহিলাদের নিয়োগ দেয়া শুরু করে, কিন্তু এখানে তালিবান বিদেশী মহিলাদের আফগানিস্তানে আসার জন্য সাথে মাহরাম বা স্বামী থাকার শর্ত দেয়। ফলে ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘ তার কার্যক্রম ঘুচিয়ে চলে যায়। ( জাতিসংঘ নারীদের পরিবর্তে পুরুষদের কেন নিয়োগ দেয়নি তা বোধগম্য নয়)
তালিবান এসময়ে ছবি আঁকা, মুর্তিবানানো, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, গান গাওয়ার মত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয়। চলচিত্র, টেলিভিশন, স্যাটেলাইট চ্যানেল নিশিদ্ধ করা হয়। বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়ানো, দাবা খেলার মত বিষয় গুলোতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে তাকে মারধর করা হত বলে বিভিন্ন মাধ্যমে দাবি হয়। দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে কোথাও কোথাও খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারের অভিযোগে বিদেশি সাহায্য কর্মীদের হত্যা করা হয় এবং পোলিও টিকা কার্যক্রমের আড়ালে গুপ্তচড়বৃত্তির অভিযোগ এনে তা বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। কোথাও কোথাও নারীরা একা ঘর থেকে বের হলে মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায়। দূরবর্তী অনেক এলাকার তালিবান ও আরব আল কায়দা নেতাদের বিরুদ্ধে পশতু ব্যতিত হাজারা ও অন্যান্য উপজাতীয় নারীদের কিডন্যাপ করে যৌনদাশি ও গৃহকর্মী হিসেবে পাকিস্থানে পাচারের অভিযোগ আছে। আবার অনেক তালিবান নেতা এসব কার্যক্রম প্রতিহত করেছেন বলেও বলা হয়ে থাকে। তালিবান সরকার আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী বালকপ্রিতি বা বালকের যৌন দাসত্ব (ঘেটুপুত্র) বন্ধ করে দেয়।
১৯৯৮ সালে তালিবান পুলি খুমরি পাবলিক লাইব্রেরি ধ্বংশ করে যাতে ৫৫০০০ এর বেশি বই ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। ১৯৯৯ সালে মোল্লা ওমর একটি ডিক্রি জাড়ি করেন যাতে ৬ শতকে তৈরি বাহামিয়ানের বুদ্ধ মুর্তি ধ্বংশ না করতে বলা হয়। ২০০১ সালে তিনি আর একটি ডিক্রিতে দেশের সব মুর্তি ধ্বংশ করার আদেশ দেন। তখন এ মুর্তি গুলি ভেঙ্গে ফেলা হয়। এ সময় জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ২৭৫০ টি শিল্প কর্ম ধ্বংশ করা হয়।
উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করতে গিয়ে তালিবান বেশ কয়েকটি গনহত্যা চালায় বলে অভিযোগ। পাকিস্তান এ কাজে প্রত্যক্ষভাবে তাদের সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ আছে। তালিবানের শাসনামলে আভ্যন্তরিন সংঘর্ষে ৪ লাখ মানুষ প্রান হারায় বলে মনে করা হয়।
জনগনের নিরাপত্তা ও শরিয়া আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তালিবান ক্ষমতায় আসলেও তাদের দিকে নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের ব্যপক অভিযোগ ওঠে। মূলত শহরাঞ্চলের বাইরে তালিবানের নিয়ন্ত্রন দূর্বল থাকায় অনেক অতিউৎসাহী নেতা নারী নির্যাতন ও প্রচুর স্কুল কলেজ ধ্বংশ করেছে বলে মনে করা হয়। আর যতটা না করেছে তার চেয়ে পশ্চিমা গনমাধ্যম আরো বেশি তা প্রচার করেছে বলে তালিবানের পক্ষ থেকে বলা হয়। তবে কিছু পশ্চিমা নারী সাংবাদিক ও সাহায্য কর্মী তালিবানের হাতে তাদের গ্রেফতারের পরের ঘটনাবলি বর্ননা করতে গিয়ে বলেছেন তালিবান তাদের সাথে যে ভাল ব্যবহার করেছে তা ছিল তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। তারা পূর্বে তালিবান সম্পর্কে যা শুনেছেন তার সাথে তাদের সাথে করা আচরনের কোন মিল নেই। এদের মধ্যে একজন যুভনে রিডলে, যিনি একজন ব্রিটিশ নারী সাংবাদিক ছিলেন এবং কর্মসূত্রে আফগানিস্তানে গিয়ে তালিবানের হাতে বন্দী হন। পরিবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহন করেন।
২০০০ সালে ওসামা বিল লাদেনকে আশ্রয় দানের দায়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার অভিযোগে আফগানিস্তানে হামলা চালায় এবং তালিবান শ্বাসনের অবসান ঘটায়। এরপর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানীকে আবার ক্ষমতায় বসায়।
( এ সময়ে দেশে নির্ভরযোগ্য কোন সংবাদ মাধ্যম না থাকায় ও বিদেশি সাংবাদিকদের কার্যক্রমে বাধা থাকায় নির্ভরযোগ্য তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। )
চলবে………
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২২ বিকাল ৫:৪৫