আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ১
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ২
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ৩
১৯৯২ সালে মোজাহিদ বাহিনী যখন কাবুল দখল করে তখন রাজধানী কাবুল সহ সারা দেশ সোভিয়েত বাহিনীর বোমা বর্ষনে ধ্বংসস্তুপ। মোজাহিদরা নিজেরা বিভক্ত থাকায় সমগ্র দেশ বিভিন্ন উপ গ্রুপের নিয়ন্ত্রনে চলে যায় এবং তারা খুন ধর্ষন ও চাঁদাবাজি করতে থাকে। ফলে সাধারন মানুষ এদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ওঠে এবং দেশটি সাধারন মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে মধ্য এশিয়ায় বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ আত্মপ্রকাশ করে যা পাকিস্তানের জন্য বানিজ্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করে। কিন্তু পাকিস্তানের এ সুযোগ গ্রহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। মধ্য এশিয়ার এ দেশ গুলিতে আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে পন্য পাঠাতে হত কিন্তু আফগানিস্থান একটি অস্থিতিশীল দেশ হওয়াতে পন্য পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। দেশটিতে কেন্দ্রীয় কোন নিয়ন্ত্রন না থাকায় মহাসড়কে বিভিন্ন মোজাহিদ গ্রুপ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী উপজাতীয় নেতারা চেকপোষ্ট বসিয়ে চাঁদা তুলত ও লুটপাট চালাত। ফলে পন্য পরিবহন করা অসম্ভব বা ব্যবহুল হয়ে পড়ে। এছাড়াও দেশটি অস্থশীল ও অনিরাপদ থাকায় বিশাল সংখ্যক আফগান সরনার্থী পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে যাচ্ছিল না। যা পাকিস্তানের জন্য নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলে পাকিস্তান এর সামাধান খুজতে থাকে।
এমন সময় দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে তালিবানের আধ্যাতিক গুরু মোল্লা ওমরের। সময়টা ১৯৯৪। সাধারন মানুষ তখন মোজাহিদ গ্রুপ গুলোর অত্যাচারে অতিষ্ট। মোল্লা ওমরের সঠিক জম্ন তারিখ জানা না গেলেও ধারনা করা হয় ১৯৫৯ সালে কান্দাহারে একটু দরিদ্র পশতুন পরিবারে তিনি জন্মগ্রহন করেন। জন্মের আগেই বাবা মারা যাওয়ায় কম বয়সেই তাকে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়। তিনি আফগানিস্তানের দারুল উলুম হাক্কানী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছেন বলে জানা যায়। এ মাদ্রাসা ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ১৯৮৯ সালে তিনি মোজাহিদ বাহিনীতে যুক্ত হন। তার নেতা ছিলেন নেক মোহাম্মদ। ১৯৮৯-১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে চার বার আহত হন মোল্লা ওমর। ধারনা করা হয় ১৯৮৯ সালে জালালাবাদ যুদ্ধি তিনি একটি চোখ হারান। যুদ্ধ শেষে তিনি পাকিস্তানে চলে যান এবং সীমান্তশহর কোয়েটাতে একটি মাদ্রাসাতে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে তিনি মোল্লা হিসেবে পরিচিতি পান। পরে তিনি করাচির বিনুরি মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। সেখানেই প্রথম তার সাথে ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাত হয় পরে ঘনষ্টতা বাড়ে। অন্যান্য পশতুনদেন মত ওমর পশতু বলতেন না বরং আরবিতে কথা বলতেন যা এসময়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। পরে ওমর কান্দাহারে ফিরে আসেন এবং সাংগিসারে একটি মাদ্রাসা খুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
এমনি ১৯৯৪ সালের একদিন মোল্লা ওমরের সাথে সাক্ষাত করতে আসেন তার সাথে যুদ্ধ করা আর এক মুজাহিদ মোল্লা আব্দুস সালাম জাইফ। জাইফ তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে যথেষ্ট উদবিগ্ন ছিলেন এবং এর থেকে পরিত্রান এর পথ খুজছিলেন। তিনি ওমরকে নেতা হিসেবে মেনে নেন ও পুনরায় বিপ্লব শুরু করতে উদবুদ্ধ করেন। পরে কয়েকজন সাবেক মোজাহিদ ও তার মাদ্রাসার প্রায় ৫০ জন ছাত্র নিয়ে মোল্লা ওমর একটি দল প্রতিষ্ঠা করে। যা পরবর্তীতে তালিবান নামে পরিচিতি লাভ করে।
তাদের অস্ত্র বলতে ছিল বেশ কিছু পুরনো রাইফেল ও রাশিয়ানদের ফেলে যাওয়া একটি পুরনো মোটরসাইকেল। যাতে সাইলেন্সার না থাকায় চলার সময় বিকট শব্দ করত। তারা আশেপাশের মাদ্রাসাগুলো থেকে সদস্য সংগ্রহ শুরু করলেন। সদস্য সংখ্যা কিছুটা বাড়লে তারা সন্ত্রাসীদের চেকপোস্ট গুলোতে হামলা করে তাদের হত্যা ও বিতারিত করতে শুরু করে এবং তাদের অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করে। শুরুর দিকে তারা প্রভাবশালী কিছু ওয়ারলর্ডকে হত্যা করায় বাকিরা আতংকিত হয়ে পড়ে। অনেক গ্রুপ বিনা বাধায় তাদের পজিশন ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময়ে জনসাধারনের কাছে তারা ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং তালিবান নামে পরিচিতি পায়। তালিবানরা মোটরসাইলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করত। ফলে মোটর সাইকেলের উচ্চ শব্দ তালিবানের প্রতিক হয়ে দাঁড়ায় ও জনমনে স্বস্তি নিয়ে আসে। তালিবানের মোটর সাইকেলের শব্দ শুনতে পেলে জনগন নিরাপদ বোধ করতে শুরু করে। কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের শরনার্থী শিবিরে বেড়ে ওঠা ও সেখানকার মাদ্রাসায় পড়াশুনা করা ছাত্ররা তালিবানে যোগ দিলে তাদের সদস্য সংখ্যা গিয়ে ১৫০০০ এ দাঁড়ায়।
১৯৯৪ সালের ৩ নভেম্বর এক আকস্মিক হামলায় তালিবান কান্দাহার শহর দখল করে নেয়। ফলে তাদের হাতে প্রচুর অস্ত্র, আর্টিলারী, ট্যাংক, হেলিকপ্টার এমনকি মিগ জংগি বিমান চলে আসে। তালিবান এগুলো চালাতে পেরেছিল কিনা জানতে পারিনি। ১৯৯৫ সালের ৪ জানুয়ারির মধ্যে তালিবানরা ১২ টি প্রদেশের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রনকারী গ্রুপ গুলি বিনা বাধায় আত্মসমর্পন করে বা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। শুরুর দিকে তারা পাকিস্তান সীমান্তবর্তী পশতু প্রধান এলাকা গুলো নিয়ন্ত্রন নেয়। তালিবান পতাকা হিসেবে শুরুর দিকে সাদা কাপড় ব্যবহার করত যা ন্যায়, সততা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতিক। পরে পতাকায় কালিমা যোগ করা হয়। এ সময়ে তালিবান বাহিনীতে তাজিক, উজবেক ও অন্যান্য উপজাতীয় মানুষ যোগ দিতে শুরু করলে তালিবান একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠে। তালিবান সেসময়ে ব্যপক জনপ্রিয়তা পায় কারন তা খুন, ধর্ষন, চাঁদাবাজি ,দূর্নীতি, চেকপোস্ট দূর করে এলাকা ও মহাসড়ক গুলি জনসাধারনের কাছে নিরাপদ করে তুলেছিল।
এমন সময় পাকিস্তান তালিবানের মধ্যে নতুন সম্ভাবনা খুজে পায়। তারা তালিবানকে সহযোগিতা করতে শুরু করে। কথিত আছে তালিবান আই এস আই বা সি আই এর তৈরি। বাস্তবে তালিবান নিজেরাই সংগঠিত হয়েছিল জনগনের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনের তাগিদে। পরে আই এস আই তাদের সহযোগিতা করতে শুরু করে। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ তালিবান হেরাত প্রদেশ দখলে নেয়। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মোল্লা ওমরের সমর্থকগন তাকে আমির উল মুমেনিন বা বিশ্বাসীদের নেতা খেতাবে ভূষিত করে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে তালিবান কাবুল দখল করে আফগানিস্তানকে এমিরেটস অফ আফগানিস্তান হিসেবে ঘোষনা করে। মোল্লা ওমর কান্দাহার থেকেই সরকার পরিচালনা করতে থাকেন। ওমর তার জিবনে মাত্র ২ বার কাবুল সফর করেন। নতুন সরকারকে পাকিস্তান, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত এই তিনটি মাত্র দেশ স্বীকৃতি দেয়।
এদিকে তালিবান কাবুল দখল করলেও এক চতুর্থাংশ এলাকা তখন ও তাদের নিয়ন্ত্রনে আসে নি। আহমেদ শাহ মাসুদ ও আব্দুর রাশিদ দোস্তাম উত্তরাঞ্চলীয় জোট গঠন করে। পরে অন্যান্য নেতারা তালিবান বিরোধী এই জোটে অংশ নেয়। ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে মাজার ই শরীফের লড়াইয়ে দোস্তামের বাহিনী পরাজিত হয়। ২০০০ সালে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের নিয়ন্ত্রনে পানশীর শহ ১০% এলাকা রয়ে যায় যার নেতৃত্বে ছিলেন আহমেদ শাহ মাসুদ। ২০০১ সালে দুজন আরব আত্মঘাতীর হামলায় পানশীর উপত্তকায় মাসুদ নিহত হন।
(মোল্লা ওমর সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্যই অনুমান নির্ভর। বিভিন্ন ইতিহাস লেখকের লেখায় ওমর সম্পর্কে তথ্যগুলিতে কিছুটা ভিন্নতা আছে।)
চলবে………
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২২ দুপুর ১২:৪০