ভদ্রলোক বললেন তিনি বাংলা লিখতে পারেন না। আমেরিকাতে পিএইচডি করেছেন। একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া তার প্রায়ই যাতায়াত।
রাজশাহীর লোক। উচ্চারণে আঞ্চলিকতা পুরো মাত্রায়। কানে বাজে যখন ইংরেজি শব্দও তার এই রাজশাহীয় টানে বের হচ্ছিল। কথার এক ফাকে জানালেন ম্যানেজম্যান্টের একটা বই লিখছেন। আমার কেমন একটু বোধ হল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাংলায়?’ তখনি তার সেই জবাব, ‘আরে না না, বাংলা আমি লিখতে পারি না।’ বলে ঠোঁটের কোণে খানিক হাসির মত করলেন। যার অর্থ হতে পারে ওনার ক্যালিবার সম্পর্কে আমার আসলে কোন ধারনাই নাই।
একটু বাদে ওনার স্টাডি রুমে নিয়ে গেলেন। রায়মা, যার সাথে এখানে আসা, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে গদ্গদ হয়ে বলে উঠল, ‘স্যারের দেখি বইয়ের ভাল কালেকশন।’ ঘরের একপাশে দেয়ালের পুরোটাই উপর থেকে নিচ অব্দি শেলফ করেছেন। বইয়ের কালেকশনে চোখ ঘুরিয়ে ঠোঁটের কোণে সেই হাসিটাই আনি যেটা ভদ্রলোক একটু আগে আমার প্রশ্ন শুনে দিয়েছিলেন। কোন স্থানে গিয়ে সেখানকার মানুষের পাঠক-রুচি ও বিদ্যার দৌড় নাকি বোঝা যায় বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারলে। ভদ্রলোকের কালেশনের একশভাগের পচানব্বইভাগই ইসলামী বইপত্র এবং তা অধিকাংশই বাংলায়। কেবল নিচে শেলফের এক কোণায় বেমানানভাবে পড়ে আছে ম্যানেজম্যান্টের কিছু ইংরেজি বই। বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক বাংলা লিখতে না পারলেও বাংলায় পড়তে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
ধাক্কাটা খেলাম পরদিন। আমার বন্ধু ও সহকর্মী রায়মার ফোন, ‘আচ্ছা, মোড়ক উন্মোচনের ইংরেজি কি?’ ‘বুক লঞ্চিং,’ বললাম। সেই ভদ্রলোক, মানে প্রফেসর ডক্টর মোঃ মন্তাজ উদ্দিন রায়মাকে এইমাত্রই ফোন করে নাকি ইংরেজিটা জানতে চেয়েছেন। বই লেখার বাংলাটা না হয় ভুলে গেছেন তিনি, তাই বলে ইংরেজিও!
মন্তাজ সাহেব একটা আন্তর্জাতিক সেবা প্রদানকারী ক্লাবের সদস্য। বিশ্বের দুইশটির বেশি দেশে যার শাখা রয়েছে। সেই ক্লাবের হয়ে একটি ফোরাম গঠন করেছেন নিজে। অতএব প্রেসিডেন্টও তিনি। ব্যাপারটা কোন সোশ্যাল সাইটের মত, নিজে রেজিস্টার্ড হয়ে অন্যদের ঢুকতে আমন্ত্রন জানানো। মন্তাজ সাহেবের অনুরোধে রায়মা সেখানে সদস্য হয়েছে; আমাকেও পিড়াপীড়ি করছে। এখানে ঢুকে লাভ কি? উত্তরে রায়মা জানায়, এই মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান হয়, বিদেশে কনফারেন্সে যায়। আমার এক প্রতিবেশিও এই ক্লাব করে। সে বলল, আসলে মূল লাভ নেটওয়ার্ক তৈরি হয়, সেবাটেবা নাম মাত্র। আমিও সেবার মহান ব্রত বাদ দিয়ে কিছু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই ঢুকতে রাজি হলাম। রায়মা বলল, সামনেই দক্ষিণ এশিয়াতে, তারপর ইউরোপে কনফারেন্স আছে। চাইলে মন্তাজ সাহেব নিয়ে যাবেন, কেবল যাওয়া-আসার ভাড়া লাগবে। তাছাড়া, এখন উনি যে নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আছেন, যেটি আমার বাসার কাছাকাছি, চাইলে সেখানে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। রায়মার নেটওয়ার্কিং দক্ষতা দেখে আমি মুগ্ধ। দেশটাই চলছে মামা-চাচার জোরে! অতঃপর দুজনে একদিন ভদ্রলোকের বাসায় গেলাম সদস্য হওয়ার মানসে।
পথে যেতে যেতে ভদ্রলোক সম্পর্কে অনেক কথা বলে রায়মা। তরুণ সংসর্গ পছন্দ করেন। তিনি যখন আমাদের বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি ছিলেন তখন তার বাসায় মাঝে মাঝে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন। সরকারের একটি মন্ত্রনালয়ে চাকরি করতেন; রিটায়ার করেছেন। টাকাপয়সা ভালই কামিয়েছেন। ধানমণ্ডিতে তিনতলা বাড়ি। ভাড়া দেন না, নিজেরাই থাকেন।
কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে ও কথা বলে বুঝলাম আমার উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার সম্ভবনা একেবারেই ক্ষীণ। মন্তাজ সাহেব নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টির পার্টটাইম শিক্ষক মাত্র। এবং আদতে আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন প্রো-ভিসি। রায়মার কথার ফাকটাও বোঝা গেল। সে বলেছিল, ‘তুমি আসার আগে আমাদের এখানে যিনি ভিসি ছিলেন তিনি এখন অমুক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন।’ এ থেকে আদৌ কি বোঝার উপায় আছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি ভিসি হিসেবে নাই? ওনার ডিমোশন হয়েছে?
নেহায়েৎ অশোভন দেখায়, তাই সদস্য হওয়ার টাকাটা দিলাম। আমি ও আমার স্ত্রীর—দুজনের। বউকে ফেলে একা ঘুরতে বিদেশ যাব, এ কেমন কথা? পরদিনই মন্তাজ সাহেবের ভুলে ভরা ইংরেজি টেক্সট আসে মোবাইলে। ক্লাবের নতুন সদস্যদের নিয়ে আসছে শুক্রবার গুলশানের একটি ক্লাবে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। ছেলেদের সবাইকে স্যুট-টাই পরে যেতে বলা হয়েছে। টেক্সটের শেষে ভুল বানানে উল্লেখ করা, ‘Delitious dinar will be served.’’
অনুষ্ঠান শুরু হল দেড়ঘণ্টা দেরিতে। আমাদের টেবিলের সুদর্শন একজন ঘোষকের দায়িত্ব পালন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হাতে তার মন্তাজ সাহেবের লেখা ঘোষণাপত্র—ইংরেজিতে। শুরুতে ওয়েলকাম বানানটাই ভুল। আরও চোখ বুলিয়ে দেখলাম, কেবল যে বানান ভুল তাই নয়, ব্যাকরণগত ভুলও কম নয়। মাথার ভেতরে মন্তাজ সাহেবের সেই কথাটা তখন বেজে উঠল, ‘আমি বাংলা লিখতে পারি না।’
ঘোষণা কানে আসতেই বজ্রপাতের মত চমকে উঠলাম। কখনো বাংলা, কখনো ইংরেজিতে বলছে। ইংরেজি বাদই দিলাম, বাংলাও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারছে না। প্রোগ্রাম হয়ে যাচ্ছে ‘ফ্রোগ্রাম’, চিফ ‘ছিফ’, চার্টার ‘ছার্টার’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কানে অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল। শুনেছি এই ক্লাব করে সব ধনী ব্যক্তিরা। সদস্যপদ রাখার জন্য বছরে কমপক্ষে পাচহাজার করে চাঁদা দিতে হবে। এই তার নমুনা! রাত দশটারও বেশি সময় ধরে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, অমুক অ্যাডভাইজর, তমুক ট্রেজারারসহ জন পনের বক্তব্য রাখলেন। আশ্চর্যজনকভাবে একজনও পাওয়া গেল না যিনি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন। উচ্চারণে ভয়াবহ সমস্যা। অথচ তারা সবাই বড় বড় পদে কর্মরত।
এর মাঝে আমাদের নতুন সদস্যদের ক্রেস্ট, ব্রশার, ফুলের তোরা ইত্যাদি দেয়া হল। রায়মার কাজ থাকায় আগেই বের হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী বলল, ‘আমি জানতাম এখানে কি হয়। তোমাকে আগেই বলেছিলাম।’ ‘তাহলে,’ আমি জিজ্ঞেস করি, ‘এরা এখানে আসে কেন?’
আমার স্ত্রী ব্রশারটা খুলে বিভিন্ন সদস্যদের পেশা দেখিয়ে বলে, ‘ধান্ধা। দেখ, এই যে উপস্থাপনা করছে লোকটা, সে একটা ইন্সিউরেন্স কম্পানিতে চাকরি করে। এই যে তিনজন ডেভেলপার কম্পানির চাকুরে। সরকারি চাকুরে যারা আছেন, সবারি বড় বড় পদ।’
‘মানে নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে প্রফেশনাল লাইফকে এগিয়ে নেয়া—অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া?’
‘ঠিক তাই।’
‘কিন্তু অনেক মহিলাও তো আছে—’
‘ও আল্লা, শোননি? মহিলাগুলো শাড়ি-গয়না নিয়ে আলাপ করছে? কেউ কেউ আছে সিঙ্গেল। ওরা আসে সঙ্গি খুঁজতে।’
আমি হতাশ হই, ‘তাহলে, এই চ্যারিটি আর মানবসেবা!’
‘সবাইকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না। অনেক বয়স্ক লোক আসেন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য। কিছু নিঃসঙ্গ মানুষ আসেন বন্ধু বাড়াতে।’
ঘড়ির কাটা দশটা ছুঁতেই স্ত্রী বলে, ‘চল উঠি, একঘেয়ে, বিরক্তিকর বাজে উচ্চারনের ভাষণ শেষ হবে না। মন্তাজ সাহেবের ডেল্লিশাস ডিনার শুরু হতে বহু দেরি।’
বীতশ্রদ্ধভাবে উঠে আমরা হাঁটা দিলাম। লিফটের কাছে পৌঁছতে ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক ছুটে এলেন। জানালাম, রাত হয়ে যাচ্ছে, কাল জামাতের হরতাল। আমাদের গাড়ি নেই। ডিনার শুরু হতেও বেশ দেরি। ‘আরে না না,’ তিনি অমায়িকভাবে বললেন, ‘এই শেষ বক্তা, এখনি ডিনার শুরু হবে। আমার গাড়ি আপনাদের পৌঁছে দেবে—ও নিয়ে ভাববেন না।’ তিনি আমাদের একটা টেবিলে এনে বসালেন। টুকটাক কথাবার্তা বললেন, ভিজিটিং কার্ড দিলেন। ইঞ্জিনিয়ার, সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করেন। বুফে ডিনার কিছুক্ষণ বাদে সত্যিই শুরু হল।
দ্রুত খাওয়া শেষ করে আমরা মন্তাজ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নেই। সিটি কর্পোরেশনের লোকটিকে কোথাও দেখলাম না। কিন্তু রাস্তায় নামতেই তাকে পাওয়া গেল। ভদ্রলোকের নিজের গাড়ি, ড্রাইভারকে বললেন, ‘তুমি ওনাদের নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যেও।’ উষ্ণ ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম।
ফাকা রাস্তায় গাড়ি সাই সাই চলে। স্ত্রী ক্রেস্ট খুলে দেখছে। আমাদের দুজনকে একটি ক্রেস্ট দিয়েছে বলে এম্নিতেই আমার মেজাজ খারাপ। আমার নাম লিখে নিচে ‘অ্যান্ড স্পাউস’ দিয়ে লিখেছে স্ত্রীর নাম। অথচ দুজনই সমান টাকা দিয়েছি। আলাদা ক্রেস্ট কেন দেবে না? মিছিমিছি কেন আরেকজনকে হেয় করা? ‘অ্যান্ড স্পাউস’ দিয়ে আমার নাম নিচে লিখলে কি আমি মেনে নিতাম? এখানে মূল কাজটাই বলতে গেলে ব্রশার ও ক্রেস্ট তৈরি, এবং একটু পরিকল্পনা—এতেই মন্তাজ সাহেব লেজে গোবরে এক করে ফেলেছেন।
‘এই দেখেছ,’ স্ত্রী বলে, ‘তোমার আমেরিকার পিএইচডি করা মন্তাজ সাহেবের কাণ্ড?’
‘কি?’
‘ক্রেস্টে যে দুই-চারটা শব্দ আছে, ওতেও বানান ভুল। সেলিব্রেশন লিখেছে ‘Celebaration’, ফার্স্ট লিখেছে ‘Frist’।’
‘অ্যাঁ !’ আমার আক্কেল গুড়ুম অবস্থা।
‘আরও আছে। ক্লাবের যে লোগোটা বানিয়েছে ওর বাংলা স্লোগানটা দেখ।’ দেখলাম ওতে লেখা ‘‘মৌলিক গুণাবলীর লালন করুন’’।’
আমার হাসি আসে না। বরং বুকের ভেতর কষ্ট অনুভব হয়। একটা লোক যে ইঞ্জিনিয়ার, এমবিএ করা, তারপর আমেরিকা থেকে ডক্টরেট করেছেন বলে দাবি করেন—এই তার জ্ঞান! যে ব্রশার আমাদের দেয়া হয়েছে সেটা খুললেই প্রথম পাতায় অর্ধেকের বেশি তার বড় একটা ছবি, নিচে ইংরেজিতে (ভুল তো আছেই) সারা জীবনের বৃত্তান্ত। ‘প্রফেসর ডক্টর মোঃ মন্তাজ উদ্দিন, অমুক মন্ত্রণালয়ে ডায়রেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন, বর্তমানে দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাজাঙ্কট প্রফেসর, সাবেক প্রো-ভিসি, সাবেক ট্রেজারার, সাবেক ডিন, সাবেক চেয়ারম্যান ও ডিপার্টমেন্ট হেড অফ অমুক অমুক বিশ্ববিদ্যালয়...। তিনি ভ্রমণ করেছেন (২০টি দেশের লিস্ট)।...’
আমার কানের ভিতর কেবলি বাজতে থাকে তার সেই স্বীকারোক্তি, ‘আমি বাংলা লিখতে পারি না।’
ফাল্গুন ১৪১৯