শ্যাম্পেনের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। খুবই বিচ্ছিরি কাজ। ট্রে ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে যায়। ব্যথা চেপে রেখে কেউ ঢুকলেই মুখে একটি প্রাণবন্ত হাসি এনে বলতে হচ্ছে, ‘গুড ইভিনিং’। হাসিটা এদেশে বাধ্যতামূলক কিনা। কাস্টমার সার্ভিসের প্রথম কথা।
তো, ওয়েটারের কাজে এসেছি। ওয়াটারলুর ন্যাশনাল থিয়েটারের ছাদের ক্যাফেতে বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়েসহ যে কোন ধরনের অনুষ্ঠানেই বাতিক্রম না হলে ‘রেসেপশন ড্রিঙ্ক’ থাকে এবং তা অবশ্যই শ্যাম্পেন।
অতিথিরা একে একে প্রায় সবাই চলে এল- চল্লিশ জন। এখানকার সব অনুষ্ঠানই আমাদের দেশের কর্পোরেট অনুষ্ঠানের মত। অতিথিরা সবাই একসঙ্গে ঢুকবে, বসবে এবং সবাইকে একই সাথে খাবার পরিবেশন করা হবে। তো, স্টাটার পর্ব শেষে অতিথিদের টেবিলে যখন মেইন ডিশ পরিবেশন করছি, হুট করে মনে হল, বিয়ের গাউন পরা কনেকে এখনো দেখলাম না। সহজাত বাঙালি ঔৎসুক্য আর কি। সহকর্মী ইংরেজ ছোকরাকে জিজ্ঞেস করি। সে খুব সাধারণ ভঙ্গিতে বলল, এটা গে ওয়েডিঙ। অ্যা? এটা সমকামী বিয়ে? স্পেশাল টেবিলটিতে চোখ ফেলি, হ্যাঁ, দুই ভদ্রলোককে বিশেষ করে আলাদা করা যায়- এরাই তবে জামাই-বউ। আট-দশটি সাধারণ বিয়ের মতই বিয়ে- মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয় এবং বন্ধুরা সবাই এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই সবাই খাচ্ছেদাচ্ছে, মজা করছে, মদের গ্লাস উঁচিয়ে বিবাহিত দম্পতির দীর্ঘ সুখী জীবন কামনা করছে।
চারঘন্টার ছোট্ট শিফটে কাজ করতে এসেছিলাম। তাতে পাব পঁচিশ পাউন্ড। কাজ শেষে যাওয়ার সময় সবাইকে টিপস দিল বিশ পাউন্ড করে। বাহ! মনে মনে বললাম, এমন বেশি বেশি সমকামী বিয়ে হলেই তো হয়।
কিছুদিন পর লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী সেলফ্রিজেস নামে সুবিশাল ব্যয়বহুল বিপণিবিতানের ‘এইচ এন এম’ স্টোরে সেলসম্যানের কাজে ঢুকি। কটা দিন যেতেই খেয়াল করলাম, আমার স্টোরে আর যে ৬/৭টা ছেলে কাজ করে সবাই সমকামী। বাদ কেবল আমি আর একজন। ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার থেকে শুরু করে একজন যে পাকিস্তানি আছে, সেও। আমার সাথে এক কলম্বিয়ান ছেলেও কাজে ঢুকেছে। জিম করা পেশীবহুল শরীর। একদিন সে বলল ক্রিসমাসের ছুটিতে পার্টনারকে নিয়ে আমেরিকা যাচ্ছে। ও হ্যাঁ, সমকামীরা একে অন্যকে হাজব্যান্ড বা ওয়াইফ বলে না- বলে পার্টনার।
পোশাক ও ফ্যাশনের জবগুলোতে কাজ করা অধিকাংশই এমন সমকামী। প্রকাশ্যে রাস্তায়, বাসে, লিফটে ছেলে ছেলেকে, মেয়ে মেয়েকে চুমু খাওয়া অহরহ দেখা না গেলেও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে যায়। কেউ কেউ হয়ত অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু কি করা- ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশ। ইউরোপের অনেক দেশে এখনো সমকামী বিয়ে বৈধ নয়। এমন সম্পর্ককে ভাল চোখে দেখেও না। আমার এক পোলিশ সহকর্মী বলছিল, পোল্যান্ডে সমকামীরা রাস্তায় চুমু খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, ক্যাথলিক দেশ- ধরে মেরেই ফেলবে।
আমাদের দেশে সমকামীদের সম্পর্কে যেমন নেতিবাচক ধারণা আছে বা তারা অদ্ভুত আচরণ করে, এমন কিছু এখানে নেই। কাজের সময় কাজ। কারো সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নাই। ওটা ব্যক্তিগত বিষয়।
ভাদ্র ১৪১৯