somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মপরিচয়ের সন্ধানে বারাক ওবামা

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একটি টেলিফোন কল। নাইরোবি থেকে। বেরির তখন সকালের নাস্তা আধাআধি হয়েছে। রুমমেটের ডাকে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল। ওপাশ থেকে তখন গড়গড় করে দ্রুত আওড়ে যাচ্ছে, হ্যালো বেরি বলছ? আমি তোমার আন্টি জেন। হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ? শোন, তোমার বাবা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। বেরি...
নভেম্বরের এক শীতের সকালে আচমকা এই ফোন পেলেন আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। যার পুরো নাম বারাক হুসেন ওবামা। সংক্ষেপে যাকে অনেকে বেরি ডাকত। যদিও বারাক তা পছন্দ করতেন না। শুধরে দিয়ে অনেককেই বলতেন, প্লিজ, কল মি বারাক।
'ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার'। বারাক ওবামার ৪৪২ পৃষ্ঠার বইটির শুরুর অধ্যায়েই এই ফোন কলের কথা। এর পরপরই লেখক আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তার বাবার গল্পে। অবশ্য তার কাছে বাবা মানে ধোঁয়াশা একটা ব্যাপার। তার যখন মাত্র দুই বছর বয়স, সেই ১৯৬৩ সালে, বাবা তাদের হাওয়াইতে রেখে হার্ভার্ডে ডক্টরেট করতে চলে যান। এরপর বাবার সঙ্গে ফের এবং শেষবার দেখা, তখন বারাক ১০ বছরের বালক। মাত্র দু'বারের দেখায় একটা মানুষের মনের মধ্যে বাবার চরিত্রটা কীরকম দাঁড়াতে পারে? মিথের কাল্পনিক চরিত্রের চেয়ে বেশি কিছু? বারাকও তার বাবাকে, যার নামও ছিল বারাক হুসেন ওবামা, এভাবেই কল্পনা করেছেন।
বইটি পড়তে শুরু করলে ভোরের আকাশের ধীরে ফর্সা হওয়ার মতো একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এটি একটি শেকড়সন্ধানী লেখা। বারাক ওবামা কালো মানুষ। তার বাবা এসেছিলেন আফ্রিকার দেশ কেনিয়া থেকে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম কোনো আফ্রিকান। আর মা অ্যান ডানহ্যাম, সাদা আমেরিকান, ক্যানসাসের বাসিন্দা। ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে দুজনের প্রেম, পরিচয়। অতঃপর বিয়ে। সেটা ১৯৬০ সাল। যদিও বর্ণবিবাহ ছিল তখন অবৈধ। পরের বছরই মাত্র সতের বছরে অ্যান মা হলেন। আর বারাক হুসেন ওবামার পুত্র বারাক কালোই হলো।
কালোদের ওপর নিপীড়ন, বঞ্চনার শেষ নেই। এ নিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস। বারাক ছোট্ট বয়সেই বুঝে গেলেন কালো-সাদার বিভাজন। সাদারা কালোদের দেখতে পারে না, নিকৃষ্ট মনে করে। অথচ তার স্নেহময়ী মা সাদা। তবে সে এমন কালো কেন? তার বাবা কালো বলে?
যতই বয়স বাড়ে আমেরিকা নামক বিশাল দেশটিতে বারাক নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে ভোগেন। সাদাদের মাঝখানে তার মতো কালোকে বড় বেমানান লাগে। নিঃসঙ্গতায় ভোগেন তিনি। এছাড়া চলতে-ফিরতে, সবখানে কালোদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তো আছেই। অথচ এই দেশ তার, এইখানে তার জন্ম।
বইয়ের শুরুতে, সেই টেলিফোনের পর বারাক তার মা, নানা, নানির মুখে শোনা বাবার গল্প তুলে ধরেন। আসলে বাবা সম্পর্কে তার যতটুকু জানা তা এই গল্প শুনে শুনেই। দু'দুবার বারাক কেনিয়া যান। সে দুবার হচ্ছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কেন গেলেন তিনি কেনিয়া? এমন না যে বাবা ও বাবার পরিবারের সঙ্গে জোড়াতালি মারা কোনোরকম যোগাযোগ টিকে ছিল। বরং উল্টোটা। তার বাবা পাঁচ-পাঁচটি বিয়ে করেছিলেন। তার মধ্যে দুজন সাদা আমেরিকান। অবশ্য কেনিয়ার সমাজ-ব্যবস্থায় এরকম পাঁচ-ছয়টি বিয়ে এবং গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলেমেয়ে হওয়াও স্বাভাবিক। তবে? ওই যে বললাম শেকড়, মূল যে তার সেই কেনিয়ায় বাঁধা!
প্রথমবার কেনিয়ার মাটিতে নেমে তিনি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত হন। অনুভব করেন, এই তো তার আসল গোড়া। এখানের সব মানুষ তার মতো দেখতে। যেদিকে তাকাও কেবল কালো মানুষ। আমেরিকায় জন্ম হলেও এই প্রথম বারাক বিদেশের মাটিতে, তার পূর্বপুরুষের দেশকে অন্তর দিয়ে 'নিজের' বলে বোধ করেন।
এই যে 'নিজের বোধ', আইডেনটিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয় সংকট, বর্তমান পৃথিবীতে এ সমস্যা কেবল একা বারাক ওবামার নয়। কালো, সাদা, বাদামি_ সব আদমিদেরই এ আত্মপরিচয়ের সংকট আছে। একটু ভালো খাওয়া, ভালো পরা, উন্নত জীবনের আশায় মানুষ ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এ নতুন নয়। ইতিহাসের শুরু থেকেই এ দেশান্তর চলছে এবং চলবে।
'ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার' বইটির তিনটি পার্ট বা অংশ_ অরিজিন, শিকাগো ও কেনিয়া। অরিজিন মানে উৎস, আর বারাকের উৎসটা কোথায়? সেই কেনিয়া। প্রথম ও শেষ_ দুটি অংশেই লেখক সেই উৎস বা আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছেন। মাঝের অংশ শিকাগো, যেই শহরে তার বেড়ে ওঠা, জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামী যৌবন। অরিজিন অংশের অনেকটা জুড়েই তার বছর পাঁচেক জাকার্তায় কাটানো সময়ের কথা আছে। তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান। তৃতীয় বিশ্বের নিদারুণ দারিদ্র্যের রূপটিও তিনি দেখেছেন সেখানে।
তিনটি অংশের মধ্যে কেনিয়ার অংশটিই বেশি আকর্ষণীয়। লেখকের যেমন সেটা ভালো লাগার জায়গা, পাঠক হিসেবে আমরাও তার সেই আনন্দ-উচ্ছ্বাস অনুভব করি। দু'দুবার কেনিয়া গিয়ে বারাক তার পিতৃপুরুষের কাছের-দূরের প্রায় সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করেন। এমনকি পরেরবার যখন যান, সঙ্গে নিয়ে যান তার বাগদত্তা মিশেলকে এবং বিয়েটাও সারেন সেখানে।
১৯৬৩ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া কেনিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পুরো একটি চিত্র পাওয়া যাবে এ বইটিতে। এসব যে বারাক জোর করে তার লেখায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন তা কিন্তু নয়, সবই এসেছে তার পূর্বপুরুষের মূলত পিতার জীবনকথা বয়ান করতে গিয়ে। আমাদের মতোই একটি দরিদ্র দেশ কেনিয়া, দুর্নীতি যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তার ওপর রয়েছে ছোট-বড় ৪০টি ভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যে বিবাদ। কেনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশটাই বিদেশিদের হাতে। সেই ব্রিটিশ ডাক্তারের মুখ থেকে শোনা কেনিয়ার স্বাস্থ্যসেবার চিত্রটিও বারাক আমাদের জানিয়ে দেন। লোকজন প্রতিরোধযোগ্য রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে, যেমন আমাশয়, চিকেন পক্স। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভয়াবহ হয়ে দেখা দিয়েছে এইডস_ অবস্থাটা এমনই মহামারী আকার ধারণ করেছে, কোনো কোনো গ্রামে এ হার পেঁৗছেছে শতকরা ৫০ ভাগে। আর হ্যাঁ, সেখানকার মানুষের খাবার-দাবারও এই ভারতবর্ষের মতো, মসলা প্রধান।
বারাক ওবামার বইটি লেখার পেছনের বিষয়ে দু-চার কথা বলে শেষ করি। বারাক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়াকালে 'হার্ভার্ড ল রিভিউ'-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এটি খুবই সম্মানজনক পদ। এটিই ছিল কোনো কালো আমেরিকানের প্রথম 'হার্ভার্ড ল রিভিউ'-র প্রেসিডেন্ট হওয়া। এক প্রকাশক বিষয়টাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। তিনি বারাককে একটি আত্মজীবনী লেখার অনুরোধ করেন। এজন্য বিরাট অঙ্কের আগাম টাকাও দেন। ১৯৯৫ সালে 'ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার' প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে বইটি পরিণত হয় বেস্ট সেলারে। আর ১৯৯৬ সালে আফ্রিকান-আমেরিকান বারাক ওবামা ইলিনয় রাজ্যের সিনেটর নির্বাচিত হন। তারপর বাকিটা আজ ইতিহাস।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×