ফিরছিলাম আমরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। আমেরিকার মানচিত্রে ক্যালিফোর্নিয়া একেবারেই পশ্চিম দিকে, প্রশান্ত মহাসাগরের পারে। গুগলে আমার ৩ মাসের কাজ শেষ হয়েছে সবে , ২৫০০ মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে ফেরত চলেছি ইলিনয়ের ভুট্টা ক্ষেতে।
জারিয়া আর আমি দুজনেই বেশ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। এতোটা পথ পাড়ি দিতে গাড়িতে যাওয়ার কথা সহজে কেউ ভাবে না, কিন্তু আমরা স্বচক্ষে আমেরিকার পথ প্রান্তর দেখার এই সুযোগ হারাতে চাইনি। তাই ক্যালিফোর্নিয়াতে এসেছিলাম গাড়িতেই, সাড়ে ৪ দিন ধরে পথ চলে, ওয়াইওমিং এর ৬০০০ ফুট উঁচু পর্বত পেরিয়ে। সে ৩ মাস আগের কথা। প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক ঢেউ বয়েগেছে, সিলিকন ভ্যালিতে আমাদের ৩ মাসের স্বপ্নের সময়টাও কেটে গেছে তাড়াতাড়ি। এবার ফেরার পালা, ঠিক করলাম আমরা এবার অন্য পথে ফেরত যাবো, আগের বারে গিয়েছিলাম উত্তর দিকের রাস্তা ধরে, এবারে তাই ঠিক করলাম মধ্য-দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে যাবো।
(মাউন্টেইন ভিউ থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে আমাদের যাত্রাপথ)
-------------------
ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড়ি পথ, সমতল ভূমি, আর উষর মরুভূমি পেরিয়ে পৌছালাম অ্যারিজোনাতে। মরুভূমিটা দেখার মতো – আরব মরুভূমির মতো বালুময় না ... ঝোপঝাড় আর ক্যাকটাসে ভর্তি, কিন্তু লু হাওয়ার প্রবল প্রকোপে সেরকমই ভয়াবহ লাগে। অ্যারিজোনার অঙ্গরাজ্যটা পাথুরে, সবুজ আর লাল পাহাড় রাস্তার দুপাশে ভরা। অল্প পথ পেরুতেই এসে গেলাম আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের এলাকায়।
কলোম্বাস ভারতে যেতে গিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন, তাই এখানকার মানুষদের “ইন্ডিয়ান” বলে অভিহিত করে বসেছিলেন। সেই থেকেই এই নামটা প্রচলিত, তবে ইদানিং নেটিভ আমেরিকান, অর্থাৎ মার্কিন আদিবাসী বলা হয়। দুই তিনশো বছর ধরে ইউরোপীয় আগন্তুকেরা আমেরিকাতে বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, যুদ্ধ হয়ে, নতুন রোগ-ভোগে মার্কিন আদিবাসীদের সংখ্যা কমেছে অনেক। বিংশ শতকের শুরুতে মার্কিন সরকার অবশেষে এদের সাথে চুক্তি করে, নির্দিষ্ট কিছু এলাকা এদের দেয়া হয়, সেই এলাকাগুলোতে মার্কিন সরকারের বা স্থানীয় অঙ্গরাজ্যগুলোর শাসন চলে না, বরং আদিবাসীদের স্বায়ত্বশাসন চলে। এই এলাকাগুলোকে ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশন বলা হয়। অ্যারিজোনা থেকে পূর্বে নিউ মেক্সিকো অবধি এরকম বিশাল একটা এলাকা আদিবাসীদের রাজ্য, মাঝে মাঝে ছোট খাটো সব শহর দেখা যায় শ্বেতাঙ্গদের, ব্যস এই।
আর আদিবাসীদের রাজত্বে, এহেন তেপান্তরের মাঠ, কিংবা তেপান্তরের পাহাড়ি রাস্তার মাঝেই অবস্থান গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের।
-------------------
ওয়েস্টার্ন গল্প পড়ার পোকা ছিলাম স্কুলে থাকতে। সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন গল্পে যখন এরফান জেসাপ, বা ওসমান ব্রাদার্স, বা শেরিডান মোকাবেলা করছে আউটলদের, লাল পাহাড়ে পর্বতে, মরুভূমির ক্যাকটাস পেরিয়ে র্যাঞ্চে, তখন কল্পনার চোখে যেন দেখতে পেতাম। সেই ওয়েস্টার্ন গল্পের জগতের চেহারাটা বাস্তবে দেখা হবে, ভাবিনি কখনো।
-------------------
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হলো একটা গিরিখাত। কলোরাডো নামের পাহাড়ি নদীটি বয়ে চলছিলো অ্যারিজোনার পাহাড়ি পথ ধরে। পাহাড়ি নদীর স্রোত হয় প্রচন্ড, সেই ভয়াবহ স্রোতে ক্ষয় হতে থাকে পাহাড়ের পাথর। এক দিন, দুই দিন, এমন করে করে ৬০ লাখ বছর কেটে যায়। খরস্রোতা নদীর ঘর্ষণে ততোদিনে তৈরী হয়েছে ১ মাইল গভীর এই গিরিখাত। এই ক্যানিয়ন যেখানে, সেই পুরো এলাকাটা বিশাল একটা মালভূমি (সমূদ্র সমতল থেকে অনেক উচুতে অবস্থিত সমতল এলাকা)। প্রায় ৬০০০ ফুট খাড়া নেমে যাওয়া গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিস্তার পূর্ব পশ্চিমে মোট ২৭৭ মাইল, আর চওড়ায় এটি ৪ থেকে ৮ মাইলের মতো। আকাশ থেকে স্যাটেলাইট চিত্র দেখতে খুব আশ্চর্য লাগে, মনে হয় বিশাল সমতলভূমির মধ্যে কেউ বোধহয় লাঙল দিয়ে দাগ কেটে দিয়েছে।
(স্যাটেলাইট থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের একাংশ, যেখানে আমরা গিয়েছিলাম)
জারিয়া আর আমার অভ্যাস হলো হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা ... গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে থামবো এটা আগে পরিকল্পনাতে ছিলোনা। মরুভূমির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাত মাথায় ভুত চাপলো, এক দিন পুরো কাটাবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে। সেটার আশে পাশে আবার জনবসতি নেই ... গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করার জন্য ঘরবাড়ি পুরো বিশাল এলাকাতেই বানানো মানা। ম্যাপে খুঁজে পেতে প্রায় ৫০ মাইল দূরে উইলিয়ামস নামের একটা ছোট্ট শহর খুঁজে পেলাম, বাংলাদেশের উপজেলা সদরের মতো ছোট্ট সেই শহরেই রাতের মতো থামলাম। পরদিন সকালেই চলে যাবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ন্যাশনাল পার্কে।
কেটে চললো রাত, অধীর প্রতীক্ষায়।
(চলবে)