শস্য-ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত জয়পুরহাটের আদিবাসিদের জীবনের হালচাল কি- জানতে অবশ্যই আমাদের ইচ্ছা করে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার ব্যস্ততার কারণে যেখানে পাশের লোকটির খবর নেয়ার সময় থাকে না সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আদিবাসিদের খবর নেয়ার আমাদের ফুরসুৎ কোথায়? তারা কি বিকশিত হচ্ছে না কালের গহ্বরে তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে?অনেক দিন ধরে তাদের সাথে দেখা করে কথা বলার জন্য মন আনচান করছিল। রমজানের ছুটির একদিন কাজে লাগালাম।
সকাল ৯টার দিকে জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজের পশ্চিমের গ্রামে গিয়ে সাক্ষাৎ হলো একজন বৃদ্ধের সাথে। বাঁশের মাচানে বসে আছেন। আমি গিয়ে পাশে বসলাম। বললাম-
-ক্যামন আছেন?
-ভাল আছি। আপনাকে তো চিনলাম না?
- আমি মোঃ রফিকুল ইসলাম। জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক।
-তা কি মনে করে?
- আমি আপনার সাথে একটু আলাপ করব।
- ঠিক আছে।
-আপনার নাম কি?
-ক্ষণিয় সিং
- আপনি তো আদিবাসি?
- জ্বি।
-আপনারা কত দিন আগে এখানে বসবাস শুরু করেন?
-অনেক আগে। দাদার আমলেরও আগে।
- আপনি কি জানেন তারা কোথা থেকে কেন এসেছিল?
-আমি শুনেছি আমার পূর্ব পুরুষেরা রাঁচি থেকে এসেছিল রেললাইনের জন্য জঙ্গল কাটতে। তারপর এখানে বসবাস শুরু করে।
এর মধ্যে আরও দুজন আসলো- একজনের নাম ককোয়া সিং আরেকজন কমল সিং।
আমি ককোয়া সিং এর সাথে কথা বলা শুরু করলাম। ক্ষণিয় সিং বাড়ীর ভিতরে গেল।
ককোয়া সিংকে জিজ্ঞেস করলাম-
-আপনারা কি গোষ্ঠী?
- সিং।
-আপনাদের ধর্ম কি?
- হিন্দু।
- আপনাদের বিয়ে কি অন্য গোষ্ঠীর মধ্যে হয়।
- না, আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যেই হয়।
-আপনাদের নিজস্ব ভাষা কি?
- বোনা
- তুমি কেমন আছ? আপনাদের ভাষায় কি বলে?
-তই কিসান হিস?
- আমি ভাল আছি।
-হামিও ভাল হি।
- চমৎকার আপনাদের ভাষা। আচ্ছা একটা গান গানতো।
ক্ষণিয় সিং আমাদের জন্য চেয়ার নিয়ে আসলেন।
- আপনাদের পেশা কি?
- কৃষি কাজ।
-এবার গান শুনান।
কমল সিং বলল
- অল্প একটু পারবো।
আচ্ছা তাই গান।
-মামাহো ভাগিনা চলু মামা বনারে শিকার
নোই মিলে হরিণও শিকার
চলু মামা ঘারা ঘুরে যাই।
অর্থাৎ-
মামা বনে যাব করতে হরিণ শিকার
না মিলে শিকার চল বাড়ী ঘুরে।
গানটি শুনুন।
এরপর আমি গেলাম খঞ্জনপুর মাহালী পাড়ায়। সড়কের পাশেই বসে ডালি বানাচ্ছে একজন। আমি পাশে গিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রথমে একটু রাগী স্বরে বলল-
-কথা বলে লাভ কি?
- এমনি, আমি পাশে থাকি ক্যাডেট কলেজে। আদিবাসিদের সন্মন্ধে কিছু জানতে চাই।
- এরকম অনেকে জানতে চায়। আমাদের কোন লাভ হয় না।
- আমিও হয়তো আপনার কোন লাভ করে দিতে পারবো না। এমনি কিছু কথা বলতাম।
- আচ্ছা বলেন।কিছু মনে করেন নি তো। দঃখে কথা গুলো বললাম।
- না, কিছু মনে করিনি। আচ্ছা আপনার নাম কি?
- রবিন মাহালী।
- এখানে কত গুলো মাহালী পরিবার আছে?
- ৩০-৩৫ টি।
- আপনাদের কি ধর্ম?
- খৃষ্টান।
- সবাই?
- হ্যাঁ, প্রায় সবাই, দু একটা বাড়ী বাদ দিয়ে।
- আপনাদের সন্মন্ধে কিছু বলেন।
- আমাদের বাপ দাদাদের জমি জাতি ছিল কিন্তু তারা মদ তামাক খেত তাই জমি জিরাত বিক্রি করে ফেলতে হয়েছে। অনেকে আমাদের বাপ দাদার কাছ থেকে কম জমি কিনে বেশী জমি লিখে নিয়েছে। তারা তো বুঝতো না।
- এখন আপনাদের সমস্যা কি?
- দেখেন, আমরা যে ডালি কুলা বানাই, তার ন্যায্য মূল্য পাই না। পেটের ক্ষুধায় কম দামে বিক্রি করতে হয়। আমি কষ্ট করে বানালাম আর যে কিনে বিক্রি করলো তার লাভ আমার চাইতে বেশী। সরকার যদি ন্যায্য দামে কিনতো তাহ্অলে আমরা ঠকতাম না।
- আপনাদের গোষ্ঠীর সবাই কি ডালি কুলা বানায়?
- হ্যাঁ, আমরা অন্যকোন কাজ জানি না।
- ওয়ার্ল্ড ভিশন বা অন্য কেউ আপনাদের দেখা শুনা করে না।
- ওয়ার্ল্ড ভিশন কিছুটা করে।
- আপনারা কোন ভাষায় কথা বলেন?
- আমদের নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলি।
- তুমি কেমন আছ? আপনাদের ভাষায় কিভাবে বলেন?
- আম চিলাকা মিনা মিয়া?
- আমি ভাল আছি?
- ইং বেশ মিনাইয়া।
- আপনারা আপনাদের ভাষা লিখতে পারেন না?
- আমাদের কোন অক্ষর নাই?
- তাহলে আপনাদের ভাষা তো একদিন হারিয়ে যাবে।
- মায়ের ভাষা কি কখনও হারায়? মা বাপ তাদের ছেলে মেয়েদের শিখাবে।
চলবে-
২য় খন্ড
১. ০৬ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:৪৪ ০