প্রারম্ভিক কথা: রেগুলার লেখা হয়না, কিন্তু তাই বলে মেগাসিরিয়ালকে তো অন্য নাম দিতে পারিনা! ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ের কিছু কথা নিয়ে শুরু করেছিলাম এই সিরিজ, আরেকবার দেখা যাক শেষ করতে পারি কিনা। ভাল লাগলে, সেটাই আমার প্রাপ্তি, কারণ কলেজে ঢুকার সময়ও কেউ টের পায়নি, বার হওয়ার সময়ও না। পড়ুন আর উপভোগ করুন দেশের একমাত্র বিজ্ঞাপনবিরতি বিহীন মেগাসিরিয়াল। শুরু হচ্ছে মেগাসিরিয়াল ঢাকা কলেজের ৭ম এপিসোড, ঢাকা কলেজ:৭; আমার প্রিয় একটা জায়গা (লাস্ট ওয়ান) আর নামকরণগুলো!
আগের পর্বগুলোতে ঢাকা কলেজে আমার প্রিয় সবকয়টা জায়গার কথাই বলা শেষ, যদিও পুকুরপাড়টাই আসলে ছিল সবচেয়ে প্রিয় জায়গা! আরেকটা জায়গা আমাকে টানত, সেটা হচ্ছে ১নং গ্যালারীর পাশের জুওলজির মিউজিয়ামটা! কেন? বলছি!
আমি ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় ভীষণ দুর্বল, আম্মা বলত, "আমার ছেলে খুবই ভাল ছবি আঁকে, খালি আম এঁকে নিচে লিখতে হয় চিত্র: আম, নইলে সবাই পেয়ারা মনে করে!" স্বভাবতই বায়োলজির ছবিতে আমার গোল্লা খাওয়ার কথা! আসলে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার লাইফের গোল ছিল ইন্জিনিয়ার হওয়া, প্রকৃতির গঠনকে খুব কাছ থেকে চেনার জন্য (পরে কেন হইনি সেই গল্প আজো আমাকে কষ্ট দেয়, পরে আরেকদিন বলব)। মেট্রিকে কোনমতে লেটার আসলেও শুধু ছবির জন্য বায়োলজি আমাকে ভীত করত। দুইটা কারণে এই ভয়টা কেটেছিল, প্রথমটা হল ড. গোপালচন্দ্র দেবনাথ স্যার, আরকেটা হল ঢাকা কলেজের মিউজিয়ামটা।
খুব যে বড় ছিল মিউজিয়ামটা, তা না। কিন্তু কালেকশন ছিল অসাধারণ। সাপ-খোপ তো অসংখ্য ছিলই (সবই জারে ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা), টানত বেশি আমাকে মানুষের বিবর্তনের ধাপগুলো! একটা সেল্ফের বেশ বড় অংশ জুড়ে ছিল, ভ্রুণের ১ মাস থেকে শুরু, এরপর ২ মাস, ৩ মাস, ৬মাস, ৭মাস, জন্মের ১সপ্তাহ আগ পর্যন্ত নমুনা আছে মিউজিয়ামে। ফরমালিনে ডুবানো নমুনাগুলো দেখতে খুবই অবাক লাগত তখন। ফরমালিনে ডুবানো অক্টোপাস ছিল, সাপ ছিল বেশ কয়েকধরণের। স্টাফড আরো বেশ কিছু প্রাণি ছিল, সবগুলোর কথা এখন মনে নেই। ঢাকা ইউনিভার্সিটির জুওলজি ডিপার্টমেন্টের মিউজিয়ামের তুলনায় হয়ত কিছুই না কালেকশন, কিন্তু আমার জোস লাগত তখন। ঢাবির জুওলজি ডিপার্টমেন্টের মিউজিয়ামের (হোয়াইট হাউজের তিনতলায়) স্টাফ করা আস্ত বাঘই আছে (পূর্ণবয়স্ক)। ১নং গ্যালারীর করিডরে অনার্সের স্টুডেন্টরা প্র্যাকটিকাল করত, হাঙরের মাথার ব্যাবচ্ছেদ চালাত ট্রে-তে নিয়ে। এগুলোর যোগান আসত কোথাকে, কে জানে!
তবে, জুওলজি ল্যাবে একটা বাজে জিনিস শিখেছিলাম ডেমো স্যারের কাছে। ব্যাঙ কাটার সময় নিয়ম হচ্ছে পেটের দিকের আলগা চামড়াটা কাঁচি দিয়ে ফুটো করে, পরে সেই ফুটো ধরে স্কালপেল চালিয়ে চামড়াটাকে মাংস থেকে আলাদা করা। স্যার আমাদের একদিন কাটার সময় দেখিয়েছিলেন চামড়া ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেও সেটা ছুটে যায়, এতে সময় বাঁচে! আর যায় কই, এরপরে ইন্টারে যতগুলো ব্যাঙ কেটেছি, সবকয়টার চামড়া টেনে তুলেছি, স্কালপেলের গুষ্ঠি কিলাই!!
মজার কথাগুলো পরে লিখছি, মনে হয়ে গেছে যখন জুওলজি প্র্যাকটিকাল নিয়ে আরো কয়েকলাইন লিখি। ফাইনালে আমার এসেছিল কেঁচোর স্নায়ুতন্ত্র। এই জিনিস খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না, তাও একটা লাইন ফলো করে আমরা কাটতাম, ট্রেতে নিয়ে দেখাতাম স্যারকে, স্যাররাও দেখে মাথা দোলাতেন, 'ভাল হয়েছে' বলতেন, আমার এক ক্লাশমেটের পরেছিল তেলাপোকার খাদ্যনালি দেখনো, বেশি যত্ন নিয়ে কাটতে যেয়ে ব্যাটার নালি গেল কেটে! এখন নতুন তেলাপোকা পাবে কই। তো আমি করলাম কি ওরটা নিয়ে খাদ্যনালীর কাটা জায়গাটায় নালীটার কাটা মাথাদুটো একসাথে রেখে সামান্য বাঁকা করা পিন মেরে দিলাম, দেখে মনে হচ্ছিল, এই জায়গাটায় নালীটাকে টেনে পরিস্কার করে দেখানোর জন্য পিন দিয়ে ধরে রাখা হয়েছে। স্যার তো আরো খুশি,'সুন্দর হয়েছে তোমার ব্যাবচ্ছেদ'।
আঁতলামি মার্কা স্মৃতিচারণ আর না। আজ থেকে বলব ক্লাশমেটদের সাথে ঘটা বিভিন্ন মজার ঘটনা, ক্লাশে করা শয়তানি গুলোর কথা! আজকে বলব কয়েকটা নামকরণের কথা! প্রথমজন 'কেরামত'।
সময়টা ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর। ক্লাশ শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মাঝেই প্রায় ৫০/৬০ জন ছেলের মাঝে বেশ ভাল যোগাযোগ স্হাপিত হয়ে গিয়েছিল। বাকিদের সবার নাম মনে না থাকলেও চেহারায় চিনতাম, হাই-হ্যালোটুকু সবসময়ই থাকত। কেরামতও ছিল তাদেরই একজন। কেরামতের আসল নাম ভুলে গেছি। কেরামত নামকরণের কারণটা বেশ মজার। তখন ঢাকা কলেজের মেইন গেট দিয়ে ঢুকলে এখন যে ভেন্ডিং মেশিনটা দেখা যায়-সেটা সম্ভবত মাত্র বসিয়েছে। ৭টাকা দিয়ে কফি বিক্রি করত, ঠান্ডা/গরম দুইধরণেরই। একটা ছেলে সারাদিন সেখানে থাকত- সার্ভ করার জন্য টাকা দিলে সে তার স্পেশাল কয়েন ঢুকিয়ে দিত মেশিনে- চুঁইইইইই করে কফি বেরিয়ে আসত কাপে করে অনেকে শখ করে টাকা দিয়ে ছেলেটার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেরাই কয়েনটা চেয়ে নিয়ে ইনসার্ট করত।
যাকগে, আমার এক স্কুলফ্রেন্ড একদিন সকালে কফি কিনবে, ভেন্ডিং মেশিনের পাশে দাড়িয়ে ছেলেটাকে খুঁজছিল। তো তখনই আরেক ক্লাশমেট, এর সাথে কথা হয়নি আগে কখনো, পাশে দাড়িয়ে ওকে বলল 'আর শুধু শুধু ৭টাকা দিয়ে কফি খাবে কেন, ৫টাকার কয়েন ঢুকিয়ে দাও একটা, তারপর এই সুইচে চাপ দিলে দেখবে কফি এসে পড়েছে।' তো আমার ঐ ফ্রেন্ড বিশ্বাস না করাতে সে আবার বলল, ' আরে আমি নিজে দেখেছি, ঐ ছেলে সবার কাছে ৭টাকা নিয়ে কয়েনের গর্তে ৫টাকার কয়েনই ঢুকায়, অনেকদিন দেখেছি।' তো ওর চাপাচাপিতে আমার ঐ ফ্রেন্ড ৫টাকার কয়েন ঢুকিয়ে সুইচে চাপ দিল, কিছুই হলনা। ঐ ছেলে তখন কফি বের করার জন্য সবকয়টা সুইচে চাপ দিল, ফলাফল শূন্য! ক্লাশ ছিল, আর দাড়াতে পারেনি তখন কেউই।
পরে খোঁজ (The Search!) নিয়ে দেখা গেল আসলে ৫টাকার কয়েন না, অন্য কি একটা কয়েন জানি ইউজ করা হত। কেরামতি করা টাকা বাঁচাতে গিয়ে এই অবিস্মরণীয় ঠক খাওয়ার পর আমার ঐ ফ্রেন্ড সেই ক্লাশমেটের নামকরণ করল 'কেরামত', বাকি যতদিন দেখেছে ওকে সবসময় কেরামত নামেই ডাকত ওকে
ভাল কথা যে ধরা খেয়েছিল সে ছিল আরেক চিজ! স্কুলফ্রেন্ডদের একজন ছিল সে, আর ছিল একজন কঠিন চাপাবাজ, এক রাস্তার দুই মাথায় দুই চাপা মারত! সমস্যা হল কি, কারে কোন চাপা মারছে সেটা সে মনে রাখতে পারতনা। এজন্যই তাকে যত বিপদের পড়তে হত, এখনো পড়ে একারণেই! তার নাম আমরা আড়ালে দিয়েছিলাম চাপা কবির (ছদ্মনাম)!
তখন বিটিভিতে চলত আলিফ লায়লা। সেটা নিয়ে ক্লাশে মাঝে মাঝে ব্যাপক হাসাহাসি করতাম সবাই। না হেসে কোন উপায় আছে, এত নিম্ন মানের লাইটিং, যাত্রাপালার মত একটিং কিন্তু অসম্ভব নিম্নমানের, সব ইনডোর শুটিং কিন্তু সেটগুলো এত ফালতু.........না হেসে উপায় আছে? তো সেখানে এক মেয়ে ভিলেন ছিল বদি (মোটাসোটা, কেমনে জানি হাসত!) তো একদিন চিকনামত এক ক্লাশমেট কেমনে জানি চিকার মত হাসল কি নিয়ে জানি, ব্যাস ওর নাম রাখলাম বদি।
বদিও আমাকে বদি নামেই ডাকত, জানিনা, বদি নামকরণে সে মাইন্ড করেছিল কিনা, তবে এই নামেই সবসময় কথা হত। বদির সাথে কয়েক বছর আগে টিএসসি-তে দেখা, ঘুরতে এসেছিল। মাঝে অনেকবছর যোগযোগ বা কথাবার্তা নেই। দেখা হওয়াতে ভাল লাগল, কুশলাদি জানলাম। এবং আলাপচারিতার একপর্যায়ে দুজনেই আবিস্কার করলাম নিজেদের আসল নামগুলো কারোরও মনে নেই, দুজনই দুজনকে সম্বোধন করছিলাম বদি নামেই আসল নামটা সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আজকে আবার ভুলে গেছি, আমি শিওর বদিও
আমি সমগ্র ক্লাসমেটদের একটা বিশেষ উপায়ে বিভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ করেছিলাম। সবগুলো এখন নিজেরও মনে নেই, তবে বিশেষ একটা শ্রেণী ছিল 'বদনা শ্রেণী' এবং এর সদস্য ছিল মাত্র একজন (আমি নিজেকেও নিজের ডিফাইন করা কোন একটা শ্রেণীতে ফেলেছিলাম), ধরি তার নাম ছিল লিনিয়ার! এই শ্রেণীবিভাজন সবাই জানত কেউই খুব একটা মাইন্ড করতনা, বরং মজাই পেত, ক্লোজ বন্ধুরা প্রায় সবাই জানত কে কোন শ্রেণীতে। লিনিয়ারও জানত, প্রায়ই মুচকি মুচকি হাসত নামকরণের বহর দেখে! নাহ, বড় ভাল ছেলে ছিল লিনিয়ারকে নিয়ে কিছু মজার ঘটনা আছে, কিঞ্চিত ১৮+ বলে পোস্টে আর বললাম না। দুনিয়ার বদ ছিল আরেকটা, এর নাম কোনদিন রাখা হয়নি, ক্লাশে করত না হেন ফাজলামি নাই! ম্যাথের হক স্যারকে এমনিতেই প্রচুর জ্বালাতাম, আর ও একটু পরপর জিকির করত 'স্যার, কিচ্ছু বুঝিনা....স্যার, কিচ্ছু বুঝিনা.....স্যার, কিচ্ছু বুঝিনা.....'! আরেকজন ব্যাপক লম্বা, ৬ফিট ২/৩ হবে। ওকে সবাই আদর করে মাইকেল হোল্ডিং ডাকতাম, কারণ ওর শরীরে কিছু হাড্ডি ছাড়া বলতে গেলে কিছুই ছিলনা। যাকগে, ক্লাশে লিনিয়ারের একটা ঘটনা বলি পরের প্যারায়, কিঞ্চিত ১৮+ ঘটনা!
বাংলার এক ম্যাডাম (নামটা ভুলে গেছি এখন), পদ্মা নদীর মাঝি ক্লাশে রিডিং পড়াতেন স্টুডেন্টদের দিয়ে। ক্লাশে বই আনতই ৫/৬জন, সেগুলো যে বেঞ্চের স্টুডেন্টরা পড়ছে তার আশেপাশেই থাকত, পড়ার ধারাবাহিকতা ঠিক রাখার জন্য। তো লিনিয়ারের সেদিন পড়ার কথা, ওর আগের একজন হিসেব কষে বের করল ও কোন জায়গায় পড়বে (ম্যাডাম পারহেড আধপৃষ্ঠা করে পড়াতেন)। ওর কপালটাও খারাপ ছিল সেদিন। তো যে শয়তান হিসেব কষেছে (ধরলাম নামটা হ্যানস) ওর পড়ার জায়গা কোনটা, সে দেখল ওখানে কুবেরের একটা ডায়লগ আছে, দূরের নৌকার মাঝিকে চিৎকার করে ডাকে কুবের, 'ও মাঝি, মাছ কিবা?'। তো হ্যানস করল কি, মাঝি শব্দটার 'ঝি' কে রিপ্লেস করে দিল 'গি' দিয়ে। পরে দেখেছিলাম কলম দিয়ে একটানে কেটে যেভাবে নতুন শব্দটা লিখেছে 'মাি' গভীর মনযোগ দিয়ে কেউ পড়তে থাকলে এক্সিডেন্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক! তো লিনিয়ারের কপাল ভাল, সে খুব স্লো পড়ত, ঐ জায়গায় এসে সে ‘মা’ পর্যন্ত বলে থেমে গিয়েছিল। ম্যাডাম ওকে ডেকে বললেন, 'থামলে কেন?' ও বলল, 'ম্যাডাম এই জায়গায় শব্দটা মনে হয় মাঝি হবে, আমার বইয়ে প্রিন্টিং মিসটেক আছে, মাছি লেখা।' ম্যাডাম বললেন, 'আচ্ছা মাঝি হবে ওখানে, পড়েরটুকু পড়।' পাশে আমরা কয়েকজন তো হাসতে হাসতে শেষ!
ইয়ে, টিচারদেরও কিন্তু কিছু নাম রেখেছিলাম আমরা। ছেলেদের কলেজ, কাজেই শিওর থাকতে পারেন নামকরণগুলোও সেরকমই ছিল। প্রথমপর্বে কেমিস্ট্রির এক টিচারের কথা বলেছিলাম তাকে কমবেশি সবাই লেন্দু** নামে ডাকতাম। কেমিস্ট্রির আরেক ম্যাডাম ছিলেন ভীষণ কড়া, বোরকা পড়তেন বলে ডাকতাম নিনজা নামে। তাঁর ক্লাশ শুরু হয়েছিল যেভাবে, এক ক্লাশমেট দৌড়ে রুমে ঢুকে বলেছিল, 'হাজিরাখাতা হাতে এক নিনজা আসতেছে......'; সেই থেকেই তার নাম হয়ে গেল ক্লাশে নিনজা। উল্লেখ্য, আমরাও যথারীতি বাংলার এক ম্যাডামের জন্য পাগল ছিলাম, অনেকেই তাঁকে নিজ নিজ সুইটহার্ট বলে দাবি করত!
বি.দ্র: মেগাসিরিয়ালের প্রায় শেষের দিকে এসে পড়েছি, আর বড়জোর ২/৩ পর্ব হবে! শেয়ার করুন, কলেজ লাইফের বিভিন্ন নামকরণগুলোর কথা আমার পোস্টে। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ! এই মেগাসিরিয়ালটি রেগুলার চলার জন্য আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ অপ্রয়োজন, আমড়া কাঠের ঢেকি, বড়বিলাই, মুনতার প্রতি।