আগের পর্বগুলো:
পর্ব১: Click This Link
পর্ব২: Click This Link
প্রারম্ভিক কথা: গত ৩ মাস লিখিনি, কিন্তু তাই বলে মেগাসিরিয়ালকে তো অন্য নাম দিতে পারিনা! ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ের কিছু কথা নিয়ে শুরু করেছিলাম এই সিরিজ, আরেকবার দেখা যাক শেষ করতে পারি কিনা। ভাল লাগলে, সেটাই আমার প্রাপ্তি, কারণ কলেজে ঢুকার সময়ও কেউ টের পায়নি, বার হওয়ার সময়ও না। শুরু হচ্ছে মেগাসিরিয়াল ঢাকা কলেজের ৩য় এপিসোড, ঢাকা কলেজ:৩; ক্লাশ এবং প্র্যাকটিকাল নামের কিছু প্রহসন!
গতকাল একজনের কাছ থেকে শুনছিলাম, একজন নামকরা ডাক্তারের কথা, যার ইন্টারমেডিয়েটের প্র্যাকটিকালে এক্সটার্নাল ছিলেন ঢাকা কলেজের একজন। তাঁকে তেমন একটা প্রশ্ন না করেই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, শুনে আমার পুরানো মেগাসিরিয়ালটার কথা মনে পড়ে গেল!
আগের দুই পোস্টের কমেন্টগুলোতে কিছুটা উল্লেখ করেছিলাম, ফার্স্ট ইয়ারে মুটামুটি ভালই ক্লাশ হয়েছিল আমাদের ব্যাচে। তবে সেকেন্ড ইয়ারে ক্লাশ নামের প্রহসন ছাড়া আর কিছুই হয়নি। আমরা প্রায় ২০/২৫ জনের মত ছিলাম এ সেকশনে যারা ফার্স্ট ইয়ারে রেগুলার ক্লাশ করতাম। সেকেন্ড ইয়ারেও সেরকম ইচ্ছাই ছিল। প্রথম কিছুদিন (প্রায় ১ মাস) রেগুলার ক্লাশ হয়েছিলও। বাসার সবাইও চাইত ঢাকা কলেজের বদনাম যাই থাকুক আমি যেন রেগুলার ক্লাশ চালিয়ে যাই। পারলাম কই? আমরা ক্লাশে যেয়ে রেগুলার বসে থাকতাম টিচার-রা আর আসেন না। বায়োলজি, বাংলা আর ইংলিশের ক্লাশগুলো রেগুলার হয়েছিল আরো কিছুদিন তারপর আর কোন খবর নেই। ম্যাথের এক টিচারের সাথে আমাদের প্রায় ঝামেলা লেগে গিয়েছিল। উল্লেখ্য সেকেন্ড ইয়ারে ম্যাথের জন্য আমাদের কোন ফিক্সড ক্লাশরুম বা গ্যালারি ছিলনা। স্যার-রা যেখানে ক্লাশরুম ফাঁকা পেতেন, সেখানেই শিডিউল ফেলতেন।
আমরা ঐ স্যারের জন্য প্রায় সপ্তাহখানেক শিডিউল টাইমে রুমে যেয়ে বসে থাকতাম, স্যার আসতেননা। একদিন এক ঘন্টা পার হওয়ার পর অনেক খুঁজে স্যার-কে বের করে বললাম স্যার ক্লাশ নিচ্ছেন না কেন আমাদের? স্যার দিলেন বিখ্যাত ঢাকা কলেজিয় উত্তর- 'আমি রোজ তোমাদের ঐ রুমে যাই, যেয়ে দেখি তোমরা কেউ থাক না। আজও যেয়ে ফাঁকা রুমে ঘুরে আসলাম। আমি আর ক্লাশটা নেব না, অন্য কেউ নেবে।' স্যারের নামটা আজ আর মনে পড়ছে না। আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম স্যারের কথায়। আসলে জামায়েত স্যার, সালাম স্যার, হক স্যার আমাদের যেভাবে শেখাতেন, তাঁদের ডিপার্টমেন্টের একজন টিচারের এই উত্তরে আমরা স্থম্ভিতই হয়ে পড়েছিলাম।
আগেও বলেছিলাম, আমাদের ব্যাচে ঢাকা কলেজের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ইভেন্ট ছিল কেমিস্ট্রি ল্যাবের বিনোদন। বিশাল বেসিন ভর্তি থাকত ভাল এবং ব্যবহৃত টেস্ট টিউবের গাদায়। বিশাল ল্যাব, সেখানে আমরা টেস্ট-টিউব দিয়ে বোলিং প্র্যাকটিস করতাম! ল্যাবের অন্য প্রান্তের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফ্লোরে পরে ভাঙত সেগুলো। আমরা ল্যাবের ঐ প্রান্তে কখনো যেতাম না, ভাঙা টেস্ট টিউবের জন্য। আবার মাঝে মাঝে গবেষনা করতাম বাংলাদেশের ফাস্ট বোলারদের এখানে প্র্যাকটিস করালে ওরা আরো বিধ্বংসী বোলিং করতে পারত, মাশরাফিরা তখনো আসেনি, শান্তই ছিল একমাত্র ভরসা। যাই হোক, একটা ব্যাক্তিগত স্মৃতি শেয়ার করি আজকে। একদিন ল্যাব ক্লাশে স্যার টেবিলে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছেন কিভাবে কাজ করতে হবে, আমি আর আমার এক ফ্রেন্ড ল্যাবের পেছনে তখন ধুমসে কিলাকিলি করছি মজা করে। সামনের ছেলেদের জন্য স্যার প্রথমে টের পাননি। একটু পরে টের পেয়ে, ল্যাবের পেছনে এসে আমাদের দুইজনকেই বের করে দিলেন। আমরা দুইজনই খুশি হয়েছিলাম, প্রচন্ড গরমে সেদিন ল্যাবে না থাকতে পারলে ভালই হত। পরে অন্য ফ্রেন্ডরা ব্যাপক মজা করেছিল এটা নিয়ে, 'আগে জানলে আমরা স্যারের সামনেই মারামারি করতাম'।
ঘটনা শেষ হয়নি এখনো। পরের সপ্তাহে স্যার প্র্যাকটিকালের উপর একটা শিট দিতে নিয়ে এলেন ক্লাশে। রোলকল শেষে বললেন শিট-টা কে নিয়ে ফটোকপি করে সবাইকে দেবে? অনেকে হাত তোলায়, স্যার বললেন সবচেয়ে রেগুলার যে তাকে দেবেন। পার্সেন্টেজের খাতা চেক করে বললেন 'রোল ৬ কার? সব ক্লাশে প্রেজেন্ট! ওকেই দেব।'
হাসিমুখে বললাম 'স্যার, আমি।'
স্যারের চেহারাটা যা হল না! এখন বলে ফেলেছেন, কথা তো উঠাতেও পারেননা, তো আমাকে দিয়ে বললেন 'তুমি আমাকে ক্লাশ শেষ হওয়ার সাথেসাথে ফেরৎ দিয়ে যাবে।' তথাস্তু! তবে স্যারের চেহারা দেখে ক্লাশের সবাই খুব মজা পেয়েছিলাম!
ঢাকা কলেজে পড়ে পলিটিকসের কথা না বললে মানুষ মারবে ধরে আমাকে! বলব, অবশ্যই। তার আগে প্র্যাকটিকাল রিলেটেড আরেকটা কথা না বলে পারছিনা। ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি ল্যাবের স্যার-রা প্র্যাকটিকাল খাতা সাইন করতেন না, বলতেন পরে এসো। এটা পরবর্তীতে সবাইকে ঝামেলায় ফেলে। আমাদের আগের অনেক স্টুডেন্টের কাছে শুনেছিলাম, এক্সটার্নালরা খাতা দেখে নাকি জানতে চান, কবে করা? কবে সাইন নেয়া?...ইত্যাদি। এক ছেলের খাতা বেশি নতুন হওয়াতে এবং পরে সে স্বীকার করায় যে ৩মাস আগে সাইন করেছে, এক্সটার্নাল তার খাতা নাকি ছিড়ে ফেলেছিলেন। এখন যে ট্রেন্ড চলে এসেছে বছরের পর বছর কে পাল্টাবে? আমরাও পারিনি। বরং আরও মজা হয়েছিল ইন্টার ফাইনালের পর। কোন ফ্রেন্ড যেন খবর বের করেছিল, ওমেকা কোচিং-এ ঢাকা কলেজের ফিজিক্স/কেমিস্ট্রির ডেমোনস্ট্রেটর স্যার-রা প্র্যাকটিকাল ক্লাশ করান এবং সাইন করেন। ওখানে নাম লেখালে নাকি ফুল মার্কস শিওর। তো গেলাম সেখানে।
অবাক কান্ড। যেই ডেমোনস্ট্রেটর স্যার-রা ল্যাবে সাইন করতে গড়িমসি করেন সেখানে কি সুন্দর সাইন করছেন! আমার ফিজিক্স খাতা যখন সাইন করাই ওমেকাতে বসে তখন রাত ৯.৩০। সাইন করার পর, ফাইনালে রোল নাম্বার কত লিখে আসতে হয় একটা কাগজে (লিখলে ৫০ শিওর!)। লিখলাম। আবার ওমেকার একজন ভাইয়া টেকনিক শিখিয়ে দিয়েছিলেন, লবণ যাই দেক, ল্যাবের মামাকে স্যাম্পল নং বললে আর ১০০ টাকা ঘুষ দিলে লবনের নাম বলে কাগজে লিখে দিয়ে যাবে। এটাই নাকি ট্র্যাডিশন!
আসলে ওমেকা-তে এই কোচিং করানোটা ওমেকা এবং ডেমোনস্ট্রেটর স্যারদের উভয়ের জন্যই লাভজনক ছিল। সাধারণত ডেমোনস্ট্রেটর স্যার-দের কাছে কেউ প্রাইভেট পড়ত না। এই সিজনে তাঁদের একটা ইনকাম হত। আর ইন্টারের পরপরই তো ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রিপারেশন টাইম, চান্সে ওমেকারও একটা ভাল ব্যবসা হত, সহজে ঢাকা কলেজের পরীক্ষার্থীদের মাঝে এড চালানো হয়ে যেত।
যাক গে। ঢাকা কলেজে ভর্তি-পরীক্ষা যেদিন দিতে যাই, সেদিন থেকেই এই কলেজের পলিটিকস সম্পর্কে টাচ পেয়েছিলাম। কলেজের গেটেই দেখলাম তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ছাত্রলীগ ব্যানার টাঙিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ভর্তিচ্ছুদের! হা হা হা হা! ভর্তি পরীক্ষার পরদিন পেপারে খবর 'ছাত্রলীগের কর্মীদের সাথে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ; তিন ছাত্রলীগ ক্যাডার আটক!'
মুটামুটি ঢাকা কলেজের সব ক্ষমতাসীন ছাত্ররাজনীতিকদের সাথেই নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ হচ্ছে বহু বছর ধরে। কারণ একটাই, ক্যাডারদের চাঁদা দিতে ব্যবসায়ীদের অপরাগতা প্রকাশ আর কখনো কখনো ফ্রিতে টিশার্ট দিতে রাজি না হওয়া। আমি স্টুডেন্ট থাকা অবস্হাতেই ছাত্রলীগের সাথে ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ছাত্রলীগের জায়গায় এই মহান দায়িত্বে নিয়োজিত হয় ছাত্রদল। ২০০২ সালে তো পাশ করে ফেললাম, এখন আশা করি ছাত্রলীগ গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে। পরের ব্যাচগুলো আরো ভাল বলতে পারবে এ সম্পর্কে!
বি.দ্র: পরের পর্বে পলিটিকসের আরো কিছু কথা থাকবে, সেই সাথে প্র্যাকটিকাল ক্লাশে আমার করা একটা শয়তানির কথা এবং অবশ্যই লাইব্রেরির কথা; পড়ার আমন্ত্রণ রইল। আর আপনাদের কথাও শেয়ার করূন, প্লীজ। ধন্যবাদ, সবাইকে।