প্রারম্ভিক কথা: সবাই মেগাসিরিয়াল(, কয়েক পর্বে আরকি) আকারে পোস্ট দেয় আমি বাদ যাব কেন? ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ের কিছু কথা নিয়ে শুরু করলাম এই সিরিজ, দেখা যাক শেষ করতে পারি কিনা। ভাল লাগলে, সেটাই আমার প্রাপ্তি, কারণ কলেজে ঢুকার সময়ও কেউ টের পায়নি, বার হওয়ার সময়ও না। শুরু হচ্ছে মেগাসিরিয়াল ঢাকা কলেজের প্রথম এপিসোড, ঢাকা কলেজ:১ টিচার এবং পারিপার্শ্বিকতা।
এস.এস.সি পাশ করেছি ২০০০সালে, নম্বরের শেষ ব্যাচ। পাশ করার পর, সবাই উপদেশ দেয়া শুরু করল, নটরড্যামে যা, ওরাই সবচেয়ে ভাল। ভাল সেটা আমিও মানতাম, কিন্তু কিছুটা স্বাধীনচেতা ছিলাম, এত প্রেশারের মধ্যে পড়াশুনা পছন্দ ছিলনা। ওদের সারাটা বছর যেই খাটনি, এসাইনমেন্টের চাপ নেয়ার কথা শুনেছিলাম- মনে হত সেটা আমার পোষাবে না। তাছাড়া অনেকেই আবার বলত, পড়লে ঢাকা কলেজ থেকেই সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব। তাই বাসার কাছের কলেজ রেখে ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে।
বেশ মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছিল ভর্তির আগে। তখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তি হতে হত, ঢাকা কলেজের ভর্তি পরীক্ষার নোটিশ এসেছিল সবার পরে, একসময় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম-গুজব শোনা যাচ্ছিল ঢাকা কলেজের ইন্টারমেডিয়েটে আর স্টুডেন্ট নেয়া হবেনা। যাই হোক, শেষমেশ ভর্তি হলাম, এর আগে ৪টা কলেজে চান্স পেয়েও যাইনি; নটরড্যাম সহ। পরীক্ষাগুলো দিয়েছিলাম বিপদের জন্য, কোন কারণে যদি ঢাকা কলেজে আসলেই না নেয়!
আগেই বলেছি, আমার বাসা থেকে কলেজ অনেক দূরে, রিকশায় যেতে ১ ঘন্টা লেগে যেত, মনে রাখতে হবে তখন জ্যাম এখনকার চেয়ে কিছু কম হত। যেদিন রূটিন টাঙ্গানোর কথা ছিল সেদিন আম্মা নিয়ে গেল আমাকে, যেয়ে দেখি ক্লাশ সেদিনই শুরু হবে। তাই আর ক্লাশ করলাম না, বাসায় চলে এলাম পরেরদিন থেকে রেগুলার করব, আম্মাই বলল বাসায় চলে যেতে।
তো পরেরদিন, এদিনও আম্মার সাথে গেলাম, একদম ক্লাশে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল আম্মা (হাসবেন না প্লীজ, এরপর থেকে রোজ একা গেছি, প্রথম আর শহরে কখনো একা চলিনি আগে তাই বাসার সবাই একা ছাড়তে কিছুটা হেজিটেট করছিল)। বিশাল গ্যালারি (গ্যালারি-১, জুওলজি ডিপার্টমেন্টের পাশে), ঢুকে মনে হচ্ছিল স্টেডিয়ামে গান গাইতে ঢুকেছি, গ্যালারিতে এত স্টুডেন্ট ছিল। স্কুলের ফ্রেন্ডরা দেখে ডাকল, ওদের সাথেই যেয়ে বসলাম। হা হা হা, একেক বেঞ্চে কমে ১২ জন করে বসেছে, বুঝুন কত বড় বেঞ্চ! প্রথম পিরিয়ড ছিল ইংরেজি, ফরহাদ স্যারের ক্লাশ। ক্লাশ শেষে যখন রোল ডাকেন তখন টের পেলাম, মোট ১৯২ জন এ সেকশনে!
ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এর টিচাররা (সরি, প্রথমে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম), এই একটা ব্যাপারে কারো কোন কনফিউশন ছিলনা। অন্যান্য কলেজেও জোস জোস সব টিচার ছিলেন (কেমিস্ট্রিতে নটরড্যামের একজন, বাংলায় ভিকির একজন, নাম মনে আসছেনা, সেজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী)। কিন্তু ওভারঅল টিচারদের জন্য সবাই বলত, এদের টিচাররাই বেস্ট। আসলেই তা ছিল। তবে আমার লাক কিছুটা খারাপ ছিল, আমি ভর্তি হবার কিছুদিন আগে সারা দেশে একটা গনবদলি হয়, অনেক ফেমাস টিচারকেই ঢাকার বাইরে পোস্টিং দেয়া হয়। তারা ঢাকা ছেড়ে বাইরে সেটেল হতে পারছিলেননা; খুবই স্বাভাবিক, হোল ফ্যামেলি নিয়ে ঢাকায় অনেকদিন ছিলেন সবাই। তারপরও আমি যাদের পেয়েছিলাম তারা কোন অংশে কারো চেয়ে যোগ্যতায় কম ছিলেননা।
যাই হোক, আমার কলেজ লাইফের প্রথম ক্লাশ ফরহাদ স্যারের (পরে ঢাকা বোর্ডের কন্ট্রোলার ছিলেন)। উনি ক্লাশে এসে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখেন লেখা দুই লাইনে 'ভালবাসি' আর বোর্ডের আরেক কোনায় 'পারলে ঠেকাও'। স্যার কিছু বললেন না পড়া সম্পর্কে, বললেন ভালবাসা কি, বিভিন্ন বয়সে ভালবাসার কথা, 'লাঞ্চন' গল্পের লেখকের সুপ্ত ভালাবাসার কথা, তারপর বললেন, 'সত্যিই ভালবাসলে বললে বলবে "ভালবাসি" তখন দেখা যাবে কে আসে ঠেকাতে, "পারলে ঠেকাও"!' তারপর কিছুটা আলোচনা করলেন লাঞ্চনের লেখক সম্পর্কে, সে যে ভাবছিল তার ভক্তের ব্যাপারে...কি কি ভাবছিল...সব.... ডিটেইলস বললাম না, বুঝে নিন কি কি ভাবনার কথা ছিল। স্যারকে খুবই ভাল লেগেছিল সবার। আবার একটা একসিডেন্টও হয়েছিল স্যারের একটা কথায়, স্যার বলেছিলেন 'কারো আমার ক্লাশ ভাল না লাগলে বেরিয়ে যেতে পার, আমাকে কিছু বলার দরকার নেই, আর আমি কিছু মনেও করবনা'। পরের ক্লাশে, ফিজিক্স, এক ছেলে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ম্যাডাম তাকে বললেন, কিকে বলে সে বেরোচ্ছে, উত্তর শুনে ম্যাডাম তাকে একটা চড় মেরে জায়গায় বসতে বলেছিলেন, এবং আর কোনদিন টিচারদের সাথে বেয়াদপে করতে না করেছিলেন। অবাকই লেগেছিল, কলেজের স্টুডেন্ট হিসেবে।
যাই হোক, আমাদের ম্যাথ নিতেন শামসুল হক স্যার, সপ্তাহে দুইদিন। তাকে যে কি পরিমানে যন্ত্রণা করেছি এ সেকশনের সবাই, তার কোন ইয়ত্তা নেই। স্যার রোল ডাকতেন তিনজন করে, তারপর বলতেন '১,২ আসছে, ৩ এবসেন্ট', রোল ডাকতে লাগত ১০ মিনিট, আবার মাঝে মাঝে স্যারও হিসেব গুলিয়ে ফেলতেন। এই ক্লাশটাতে আমরা প্রক্সি দিতাম, যত খুশি তত, আমার রেকর্ড ছিল ২৭জন, সেকেন্ড আরেক ফ্রেন্ডের-২৪জন। এখন মাঝে মাঝে ভাবি কি শয়তানিটাই না করতাম। স্যারের ক্লাশে একবার একজন ওয়াকম্যানের হেডফোন ডিসকানেক্ট করে, ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দিয়েছিল, স্যার সারা ক্লাশ খুজেও বার করতে পারেননি কে। স্যার অবশ্য ভুলে গিয়েছিলেন একটু পরেই। স্যার দুর্দান্ত ম্যাথ করাতেন, তাও আমাদের এই যন্ত্রণা তার সহ্য করতে হয়েছে।
কলেজ লাইফ সত্যিকারের এনজয় করেছি কেমিস্ট্রি ল্যাবে। ল্যাব ছিল বিশাল। অন্তত ২৫ফিট লম্বা টেবিল, তার মাঝে বেসিনে থাকত ব্যবহৃত এবং নতুন টেস্ট-টিউবের গাদা। আমরা সেই টেস্ট টিউব দিয়ে বোলিং প্র্যাকটিস করতাম, ল্যাবের অন্য প্রান্তের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফ্লোরে পরে ভাঙত সেগুলো। আমরা ল্যাবের ঐ প্রান্তে কখনো যেতাম না, ভাংগা টেস্ট টিউবের জন্য। আবার মাঝে মাঝে গবেষনা করতাম বাংলাদেশের ফাস্ট বোলারদের এখানে প্র্যাকটিস করালে ওরা আরো বিধ্বংসী বোলিং করতে পারত, মাশরাফিরা তখনো আসেনি, শান্তই ছিল একমাত্র ভরসা। কেমিস্ট্রি ল্যাবে আরো ভয়ংকর কাজ করেছি, তা পরের পর্বে বলব।
কেমিস্ট্রির এক ম্যাডামকে আমরা যমের মত ভয় পেতাম, গার্ড দিতেন পরীক্ষার হলে ভীষণ কড়া, ক্লাশে পড়াতেনও ব্যাপকভাবে। আরেকজন টিচার বিমলেন্দু ভৌমিকও কেমিস্ট্রি পড়াতেন- খাস সিলেটি উচ্চারণে, পয়লা দিন এসে গল্প করে কাটাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে সবাই বিরক্ত ছাড়া কিছুই হয়নি। কয়েকদিন আগে রাশিয়ার একটা সাবমেরিন ডুবে ১৮০জন মারা গিয়েছিল, কারণটা তিনি বলছিলেন, আমিও দেখলাম এত ইন্টারেস্টিং, দুঃখজনক ঘটনা তার বর্ণনাতে জঘন্য হয়ে উঠছিল। এখন কোথায় আছেন, কেমন পড়ান কে জানে। মনে আছে, একদিন দুই ফ্রেন্ড ক্লাসে দেরি করে ঢুকতে গিয়ে গ্যালারির দুইদিক থেকে উকি দিয়ে দেখি বিমলেন্দু স্যার। দেখেই ঠিক করলাম, ক্লাশ করব না। কিন্তু স্যার টের পেয়ে বেড়িয়ে এসেছিলেন ধরতে, আমরা একছুটে হাওয়া। পরে শুনেছিলাম এই চান্সে নাকি আরো ১০-১২ জন ভেগেছিল ক্লাশ ফাঁকা পেয়ে, সিড়ি দিয়ে সোজা দোতলায়!
অনেক গীবত করলাম, কিন্তু সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের কথা ভুলি কি করে?
বাংলার ফেরদৌসি ম্যাডাম, ইংরেজীর হরষিত বালা স্যার, ফিজিক্সের ডঃ ননী গোপাল সাহা স্যার, নজরূল ইসলাম স্যার, ডঃ হাসানুজ্জামান স্যার যা শিখিয়েছেন তা কোনভাবেই ভোলার মত না। তবে ম্যাথের সালাম স্যার, জামায়েত স্যারের কাছ থেকে যা শিখেছি, আজো তার ব্যবহার করে চলেছি।
একজন টিচারকে বিশেষভাবে মার্ক না করলেই নয়, ডঃ গোপাল চন্দ্র দেবনাথ। আমি বায়োলজি খুব একটা পছন্দ করতামনা, স্যারের পড়ানোর গুণেই আমি এই সাবজেক্টের মজাটা পেয়েছিলাম। প্রাণিবিদ্যার টিচার, কিন্তু বোটানী, জুওলজি দুটাই ক্লিয়ার হয়েছিল স্যারের কল্যাণে। হরষিত বালা স্যার ইংলিশ দুর্দান্ত পড়াতেন, আজো মনে পড়ে।
পরের পর্বগুলোতে থাকবে ল্যাব, হল, পলিটিকস, হয়ত কিছু বন্ধুর কথাও, মুডের উপর। আশা করি ভাল লাগবে। শেয়ার করূন আপনাদের কথাও।