তখন টাইপ করল মৌন, আই থিংক আই এম ইন লাভ উইথ ইউ সুধা ডিয়ার।
এতটুকু টাইপ করে দুবার পড়ে নিজেকেই নিজে গালি দিয়ে বলল মৌন, কি পাগলামিটাই না করতে যাচ্ছিলাম। একটা মেয়ের সাথে প্রথম দিনে কথা বলতে গিয়ে তাকে এ কথা বলব? হ্যাভ আই গন ম্যাড? কি মনে করবে সুধা। আর আমি ওকে লাভ ইউ বললে কি লাভ হতে যাচ্ছে? ও তো সেক্ষেত্রে বিভোরের প্রেমে পড়বে। কি লাভ হবে সেটা আমার জন্য? মৌনের কিছুটা রাগ হল। মনে হল এ সিনেমাটিক কাহিনি হতে যাচ্ছে। মৌন সেদিন রাতের মত রুমে এসে শুয়ে পড়ল। মেজাজটা ঠান্ডা করতে আরেকটা সিগারেট ধরালো সে। তারপর সটান হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সুধার ব্যাপারে সে কি করবে তা আগামিকালের জন্য রেখে দিল।
সুধার সাথে প্রথমবার দেখা করার পর থেকে বিভোরের মন উতলা হয়ে উঠল।কিন্তু সে রাতে সুধাকে ফোন করতে গেলে তার আগেই তার কাছে একটা ফোন চলে আসে। সে উৎসাহি হয়ে ফোন তুললে বুঝতে পারে তার পুরাতন প্রেমিকা তাকে ফোন করে। এড়াতে চাইলেও পারে না বিভোর! বহুদিন পর মেয়েটা তাকে ফোন করেছে। মনের ভেতর একটা বেদনা বিষম মাথাচাড়া দিয়ে উঠল! নিরা ছিল সে মেয়েটির নাম। নিরার সাথে কথা বলার আগে লেখা বিভোরের ডায়রি হতে,
আজ একজনকে দেখলাম, অসামান্য এক কন্যা। যেন রুপকথা থেকে নেমে আসা এক রাজকন্যা। সম্মহিত হয়ে গেলাম। নাহ, সে জলপরী, সে পদ্মলতা, সে এমনি যে আবিষ্ট করে স্বপ্নে মাতায়। সে মাধবীলতা, আপন জালে জড়িয়ে আনন্দের আহ্বান দেয়। তাকে নিয়ে লেখা স্তুতির শেষ নেই, শেষ হতেই পারে না। সকল কবিরা মিলিয়া তাকে একান্তে আপন শব্দের মালায় বিভুষিত করলেও তার মাহাত্ম্য শেষ হবে না। একান্তে তাকে পাবার আশা সম্মতি দিচ্ছে মনে।
এটুকু লেখার পর ভাবলো আরো কোন কিছু ডায়রিতে লেখার আগে বিভোর ভাবলো তার জেনে নেয়া উচিত বিভোরের সুধা তাকে নিয়ে কি ভাবছে। বিভোরের সুধা, আহা। ভাবলো বিভোর। কিন্তু ততক্ষনাৎ নিরা ফোন করে। বিভোর নিরার কন্ঠ শুনে শঙ্কিত হয়। কোন সমস্যা হয়েছে নাকি নিরার, নাহলে তাকে কেন খুজবে এতদিন পর, এই রাতে। অথচ নিরা তেমন কিছু বলল না। নিরা পুরোনো কথা তুলল। নিরার সাথে কথা বলার পর ডায়রিতে লেখল আবারো,
নিরা বড্ড দেরি করে ফেলল। আজ সে আমার মনে আলোড়ন তুলতে গিয়েও ব্যর্থ, সেই মনে, যে মন দীর্ঘ একটি সময় তার অনুরক্ত ছিল। কিন্তু আমি এখন সুধার সাথে আবদ্ধ হয়ে গেছি, এ আমি টের পাচ্ছি। সুধার প্রেমেও পড়েছি হয়ত। নিরাকে আর আমি আপন করতে পারব না। নিরা তুমি এখন আমার জগতে মৃত। তুমি নিজেকে আর মৃত বৃক্ষ হয়ে আমাকে জড়িয়ো না। চলে যাও আমার মন থেকে, দুরে! আমি তোমাকে পেতে গিয়ে সুধাকে হারাতে পারবোনা। আমি হীরা ফেলে কাচে মুঠো ভরতে পারবনা!
১৩-০৪-১১
যেদিন বিকেলে বিভোর আর সুধা দেখা করেছিল, যে রাতে মৌন প্রথমবারের জন্য বিভোর হয়ে কথা বলেছিল সুধার সাথে, তার ঠিক তিনদিন পরের রাত হল আজের রাত। সুধাকে বেশিদিন ভুলিয়ে রাখা গেল না মৌনের পক্ষে। সে ধরে ফেলল মৌনের নাটক। এরপর মৌন সুধাকে অনুরোধ করেছিল আজকে, অনেক আকুতি, তবে সুধা সব জানতে পারার পর মৌনকে বন্ধুরুপে গ্রহন করল না, হয়ত মৌনের সাথে আর কোনদিন কথা হবে না সুধার। যদিও মৌন বহুবার সুধার সাথে যোগাযোগ করতে চাইল, ফোন দিল, তবুও সুধা নীরব রয়ে গেল মৌনের কাছে, আর একটি শব্দ সুধা বলেনি মৌনের সাথে। আজ রাতে সুধা ডায়রিতে লিখল,
আজ হঠাত একটা ধাক্কা খেলাম। একটা ছেলে, যাকে কিনা আমি একান্তে স্কন্ধের নিচে মালা পড়িয়ে আপন করব ভাবছিলাম, সে বিভোর নয়, অথচ পুরোটা সময় আমার সাথে সে বিভোর সেজে নাটক করে গেলো। আমার জীবনটা কোন রঙ্গমঞ্চ নয়, এ আমি সে একটোর কে বুঝিয়ে দিয়েছি! এখন বুঝতে পারছি ডায়রি, এ জন্যই তো বারবার ভেবেছি বিভোর কেন রাতে আমাকে ফোন করলে অন্যভাবে কথা বলে, আবার দিনে একরকম। হ্যা, মানুষ ঘরে একরম, বাইরে একরকম, তবে তাই বলে এতটা বদলে আমার বিশ্বাস করাটা ঠিক হয়নি। কতটা সময় নষ্ট করে ফেললাম, কতটা লজ্জাহীন হয়ে কথা বলেছি এ অন্যলোকের সাথে। তবে ছেলেটা আমার কোন ক্ষতি করে নি, অবশ্য সে সময়ও পায়নি। কিন্তু, মনের তো করেছে। কি সুন্দর বলে দিল, আমার বাবা মায়ের দেয়া নাম বিভোর! কেন এমন হয়? খুব মনক্ষুন্ন হল আজকে। এভাবে আমাকে ঠকিয়েছে ছেলেটা, অথচ বন্ধুর মত কথা বলত। তবে আমি বিভোরকে সব খুলে বলেছি, তাতে করে আর যাই হোক, আমাদের ভেতরের সততা সঠিক থাকবে। আমি বিভোরের কাছে কিছু লুকাব না।
অতঃপর মন খারাপ করে বসে রইল সুধা। তার এই রুপ সবসময় তাকে ঠকাতে সাহায্য করে এসেছে। মাঝে মাঝে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করত আগে যেন তা রুপ তিনি বাড়িয়ে দেন। তখন সুধা ছোট ছিল, যাকে বলা হয় শিশু। আর এখন সে প্রার্থনা করে যেন ঈশ্বর এ রুপ ফিরিয় নেন। এমন অশুভ বর্ষন সুধা পেতে চায় না আর। সে ক্লান্ত! বড় ক্লান্ত, দীর্ঘদিনের গ্লানি জমে বাধা হয়ে উঠেছে মনে, পাহাড় হয়ে উঠেছে।
সুধার সাথে বিভোরের বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলে এর পরপরই, পরের সপ্তাহে ওদের এংগেজমেন্ট এর আয়োজন করা হবে। ওদের এংগেজমেন্ট এর কথা সবাইকে জানানো হল, ওদের পরিবার, আত্মীয় বন্ধু সবাই জেনে গেল, আরো একজন জানলো, সে হল মৌন। মৌন সুধার সাথে সে রাতে শেষবার কথার পর ঠিক করল আর সুধাকে বিরক্ত করবে না। কিন্তু সুধার সাথে না জুড়তে চাইলেও জুড়ে যায় সে। এমন কখন অনুভব হয়নি। মাত্র তিনদিন। এতটা আপন হয়ে গেল সে বিভার এত দ্রুত!
একটা মেয়ে এট অল্প সময়ে তার মাথা ও মনের পুরোটা অংশে নিজের স্থাপনা কিভাবে করে ফেলেছে ভাবতে লাগলো মৌন। এ যেন গোবরে পদ্মফুল! সে চাইছিল একটুখানি বিরক্ত করতে, একটুখানি সুধাকে বুঝতে। আবার দুরে সরে যাবে ভেবেই সুধার কাছে এসেছিল, এখন সে আটকে গেছে। আজ রাতে মৌনের বুকে ব্যথা হচ্ছে! আজ রাতে তার ভেতরে এমন বিষাক্ত ঝড় উঠেছে যা সুধা ছাড়া কেউ থামাতে পারবে না।
সুধাকে চাই!
দুটি অক্ষর লিখল মৌন, আরও লিখল,
হোক সে বিভোর,
হোক সে বিধাতা,
ছিনিয়ে নিবে সুধা?
আমিও এ মানিনা।
সুধা শুধু আমার,
আমি সুধাকে চাই।
যদি না পাই সুধা,
তবে আমি বৃথা।
সে বিনা আমি বীনা;
বাজিয়ে বিহীন বীনা।
ওহ গড, মৌন চিৎকার করল, দীন দৌড়ে আসলো পাশের রুম থেকে। দীন মৌনের কাছের মানুষ, ভৃত্য হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল, কিন্তু সে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত মৌনকে আগলে রেখেছে, রাখতে চেয়েছে ভাবলো দীন। মৌনের বখে যাওয়া সহ্য হয়না দীনের, কিন্তু মৌনের জন্য বাবা মায়ের ভালবাসা সে পূরন করতে পারে নি তা ভেবেই মুটিয়ে পড়ে দীনের মন। বয়সে সে মৌনের দশ বছরের বড়। ছোট ভাইয়ের সমান দীনকে সে সন্তানরুপে বড় করেছে। নিজে বিয়ে করেনি, মৌন-বিনা পরিবারের সমপর্যায়ে কেউ নেই দীনের।
দীন মৌনের মাথায় হাত বুলালো, মৌন দীনের শান্ত মুখের দিকে তাকালো। দীন মৌনের পাশে বসলো বারান্দায়। মৌন দীনকে সুধার সম্পর্কে বলতে লাগলো। মৌন চুপ হয়ে গেলে দীন একটু ভাবলো। এরপর বলল, মৌন তার বাড়ির খোজ নিয়ে বলতে পারবে? মৌন কিছুটা ধীরে বলল, তাতে আর কি হবে? সুধার বিয়ে তো_, মৌনকে থামিয়ে দিল দীন, মৌন ওর বাড়ির খোজ নিয়ে দেখো, আমি তোমার জন্য ঐ মেয়েকেই বৌ করে আনবো। কিন্তু আমাকে কেন সুধা বিয়ে করবে। মৌন মুখটা নিচু করল। দীন হাসলো, কেননা তুমি ওর বর, দিনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল মৌন!
এর সপ্তাহখানেক পরে, মৌন মুখ শুকনো করে বসেছিল সোফায়। সেদিনের অপমানটা সে ভুলতে পারেনি। এর আগে দীন তার হতে অনেক কষ্ট পেয়েছিল, কিন্তু পাঁচদিন আগে যা হল, তা ভোলার নয়। এরপর হাল ছেড়ে দিয়েছে মৌন। সুধার বিভোরের সাঠে বিয়ের দিন এগিয়ে গেছে। সুধার ষেদিনের ঘৃনাভরা চোখেকে সে হেসে উড়াতে পারছেনা। কি হল তার?
টিভিটা খুলে নিল মৌন, বিভোর সুধা ভালো থাকুক খারাপ থাকুক, সে তাদের জীবনে আর কোনদিন ইন্টারফেয়ার করতে যাবেনা। হয়ত তার কথা অলক্ষ্যে কাউকে ভাবিয়েছিল, হয়ত! টিভিতে চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ তার চোখ একটা নিউসে আটকে গেল। নতুন কিছু না, পত্রিকায় সে প্রায়ই পড়ে।গন-ধর্ষনের শিকার সুধা নামের এক যুবতী। টাইটেলটা পড়ল, কিন্তু নামটা সে দেখল না, পরপর মুখ ফিরিয়ে আবার লক্ষ্য করল টাইটেল নিউসটা, মেয়েটির নাম সুধা! আপন চোখকে শত্রু মনে হল মৌনের!
_____________________________(চলবে)
ছবি আমার আঁকা।
প্রথম পর্ব, Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব, Click This Link
ভালো থাকুন!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:০৮