আমার কাছে বান্দারবান বিশেষ এক স্থান দখল করে নিয়েছে সেই ২০০৯ থেকে যেবার প্রথম অনেক ঝড় ঝঞ্ঝাট পারি দিয়ে একদম কেওকারাডাং এ গিয়ে উপস্থিত হই। সেই থেকে আমার প্রিয় দর্শনীয় স্থানের তালিকায় বান্দারবানের অবস্থান বেশ উঁচুতে। অন্য কারো কথা বলতে পারব না, তবে নিজের কথা বলতে পারি, আমার কাছে বান্দারবান মানেই হলো এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ছুটে বেরানো, বান্দারবান মানেই হলো নীল আর সবুজের মাঝে সাদা কালোর অপূর্ব সংমিশ্রণ, আমার কাছে বান্দারবান মানেই হলো হাপ ছেড়ে বাঁচা, বান্দারবান মানেই হলে একপল স্বস্তি নিয়ে নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া। বান্দারবান মানেই হলো দিগন্ত বিস্তৃত জুড়ে সবুজের ঢেউ খেলে বেরানো, বান্দারবান মানেই উঁচু উঁচু পাহাড়ের ফাঁক গলে সর্পিলাকৃতিতে সাঙ্গুর বয়ে চলা। আমার কাছে বান্দারবান মানেই শাহীন ভাই!
বছর তিনেক হয়েছে এর মাঝে বান্দারবান যাওয়া হয়ে ওঠেনি, এর মাঝে যদিও বিভিন্ন কারণে নিজের ব্যস্ততা ছিল কিন্তু কারণ অনুসন্ধান করে দেখলাম আসলে শাহীন ভাইয়ের অনুপস্থিতিও অনেকটা বড় ভূমিকা রেখেছে। সত্যি কথা বলতে কি, পাহাড়ের আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠার পেছনে যাঁর সবচেয়ে বড় অবদান তিনি শাহীন ভাই। সেই মানুষটি যখন দীর্ঘ তিনটি বছর পর আহবান জানালেন তখন সেই আহবান উপেক্ষা করার মত কোন কারণই খুজে পেলাম না। দ্বিতীয়বার ভাববার অবকাশ না নিয়েই রাজী হয়ে গেলাম তাঁর ভ্রমণ সঙ্গী হবার জন্য। আহবানের দিন থেকে আমার দিনক্ষণ গণনার শুরু। শেষের দিকে এসে অবাক করে দিয়ে শাহীন ভাই জানিয়ে রাখলেন এইবার ট্যুরের সমস্ত দায় দায়িত্ব না কি আমাকেই বহন করতে হবে! বলে কি! ভাগ্যিশ শরীফ ভাই ছিলেন, উনার সহযোগিতায় অবশেষে একটা ট্যুর প্লাণ দাঁড় করিয়ে ফেললাম। শাহীন ভাইয়ের সময় সংক্ষেপের কারণে ঈদের ছুটির পরপরই বেড়িয়ে পরতে হলো। মনের মধ্যে অন্যরকম একটা উত্তেজনা নিয়ে আবারও বেড়িয়ে পড়লাম সঙ্গী হিসেবে পুরনোরাই ছিলেন তবে তাদের সাথে নতুন একজন সঙ্গীও যুক্ত হলো যিনি আবার ইতোমধ্যে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে সংযুক্ত হয়ে হয়েছেন।
ছয় জনের ছোট্ট একটা দল নিয়ে আবার বেড়িয়ে পড়লাম প্রিয় বান্দারবানের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ তিন বছর পর। সারারাত্রির বাস যাত্রা শেষে আমরা যখন বান্দারবানের মাটিতে পদার্পণ করলাম তখনও শহরের চোখেমুখে ঘুমের ছোপ লেগে রয়েছে, আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় আমাদের উপস্থিতিতে কিছুটা যেন বিরক্তিকর ভঙ্গীতে তিনি আমাদের স্বাগত জানালেন। নিজেদের আলস্য কাটিয়ে ওঠার জন্য চায়ের কাপে চুমুক রাখতে যাব এমন সময় আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়িচালক এসে উপস্থিত! তাকে দেখা মাত্রআমাদের মধ্যে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। চা শেষ করেই উঠে পড়লাম গাড়িতে গন্তব্য সবার প্রিয় মিলনছড়ির একমেদ্বিতীয় হিল সাইড রিসোর্ট।
আমাদের অন্যতম ভ্রমণ বন্ধু আবির আর রেজওয়ান একবার বলেছিলেন মিলনছড়ির হিল সাইড রিসোর্টের ঝুল বারান্দায় আরাম কেদারায় বসলেই বান্দারবানের অর্ধেক রূপ দেখা হয়ে যায়। মন্তব্যটির সাথে আমি দ্বিধাহীন ভাবেই সহমত প্রদর্শণ সেদিনই করেছিলাম, আজ আবারও সেই ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সেই মন্তব্যটিকের আবারও ঝালাই করে নিলাম। সারারাতের ভ্রমন জনিত ক্লান্তি যেন নিমিশেই দূর হয়ে গেল অজানা কোন এক দেশে! অনাকাঙ্খিত অতিথি হুদ হুদের আগমনে সৃষ্ট গত কিছুদিনের টানা বৃষ্টি আমাদের বগালেকের পরিকল্পনা অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়ায় খুব বেশি তাড়া এইবার ট্যুরে মোটামুটি অনুপস্থিতই ছিল, যেটি আমার পাহাড়ি ট্যুরে বিরল একটা ঘটনা! কাজেই আয়েশি ভঙ্গিতে আমাদের স্মৃতি রমন্থনে কোন বাধা নিষেধ আসল না কোন পক্ষ থেকে বিশেষ করে শাহীন ভাইয়ের কাছ থেকে। আয়েশি ভঙ্গীর সবচেয়ে আদর্শ নিদর্শন দেখতে পেলাম শরীফ ভাই আর এনামের শারীরিক ভাষায়। বান্দারবানে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় কাটানোর পরেও তাঁদের ক্যামেরা ব্যাগের মাঝেই ঘুমন্ত অবস্থায় থেকে গেল!
পরিকল্পনায় যেহেতু বগালেক অনুপস্থিত সেজন্য ঠিক হলো দুপুরের খাবার শেষে বেড়িয়ে পড়ব নীলাচলের উদ্দেশ্যে। ইচ্ছে ট্রাকিং করা। বউকে বলতেই খুব আগ্রহ দেখলাম তাঁর চোখে মুখে। মনে মনে ভাবলাম বেচারী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত কি অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য তাহলে নিশ্চিত রুমের দড়জার ঠিক ঠাক করে তালাবদ্ধ করে নিজেকে সেখানে নিরাপদভাবে সমর্পণ করে রাখত! যাই হোক দুপুরে খাবার শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম নীলাচলের উদ্দেশ্যে যেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড় আর আকাশের মিলন মেলা উপভোগ করা যায় দুচোখ ভরে!
হিল সাইড রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে মিনিট দুয়েক হাঁটার পরেই বউ আমার বুঝতে পারল জীবনের অন্যতম খারাপ একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে নিজের অজান্তেই! এখন আর ফেরার পথ নেই। বেচারী মিনিট দশেক হাঁটার অভিজ্ঞতা যার নেই, তাকে কি না পাহাড় দাপিয়ে বেড়াতে হবে। এদিক ওদিক তাকানো দেখে প্রশ্ন উঠল কি খুজছে? ঝটপট প্রতিউত্তরে “রিক্সা” আসতে সবার মাঝে একটা হাসির রোল উঠতেই নিজের ভুল ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরে কিছুটা যেন ম্রিয়ম্রাণ হয়ে পরল। এদিকে অনেক অনেক দিন পর সবুজের কাছে আসতে পেরে আমি যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছি!
হিল সাইড রিসোর্ট থেকে কিছুটা উপরে উঠে এলেই হাতের ডান পাশে এগুতে হয় নীলাচলে উঠবার জন্য। যতবারই আমি এখানে এসেছি হেঁটেই এসেছি, কখন গাড়িতে আসার দুর্ভাগ্য হয়নি, সেই ইচ্ছেও মনের গহীনে উঁকিও মারেনি কোনদিন। পাহাড়ের কোল ঘেষে বয়ে চলা এই আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলার যে নির্মল আনন্দ সেটি আমি কখনই গাড়িতে চড়ে হারাতে চাইনি, হয়তো বা ইচ্ছেও হবেনা কোন দিন। নীলাচলে উঠবার সময় অবশ্য আপনার চোখে মেঠো পথের চেয়ে ইট বিছানো পিচ্ছিল পথটাই প্রথমে চলে আসবে, কিন্তু তারপরেও পায়ে চলার আনন্দ ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। নীলাচলে ওঠার আগেই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এক পাহাড়ি দম্পতি কর্তৃক পরিচালিত চায়ের দোকানে গলা ভিজিয়ে নেয়ার প্রস্তাব আসতেই সবাই একবাক্যে রাজী হয়ে গেল। কিছুটা বিশ্রাম পেয়ে বউয়ের মুখে যেন কিছুটা হাসি ফিরে এলো। আসলে কাছের লোক ছাড়া সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সাথে পথ চলটা যেকোন মহিলার জন্য সামান্য হলেও অস্বস্তিকর, সেটি ওকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল, তারপরেও সঙ্গীদের সবাই আন্তরিক হওয়ায় সেই অস্বস্তিভাবটি ধীরে ধীরে কেটে ওঠার লক্ষণ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল যা কি না সঙ্গত কারণেই আমাকে স্বস্তি দিয়েছিল। চায়ের ফাঁকে ফাঁকে কিছুটা আলাপচারিতা ওকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল যেটির প্রমান পেলাম বিশ্রাম শেষে পুনরায় যাত্রা শুরু করতেই। আমাকে পেছনে ফেলে কখন যে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি! যখন টের পেলাম তখন দেখছি হাসি হাসি মুখে সে অনেকটা পথ এগিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে অনিক, এনামদের সাথে।
নীলাচলে ওঠার পূর্ব মুহুর্তে গোটা বান্দারবান শহরের ছবি চোখের সামনে চলে আসে অনেকটা আকস্মিকভাবেই। আর সেটি দেখতে পেয়ে আবারও নিজের প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যায়। যতদূর চোখ যায় দৃষ্টি সীমানায় যেন শুধু সবুজ গালিচা! কোথাও বা আঁকাবাঁকা হয়ে আকাশকে ছোঁয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় মত্ত, কোথাও বা আকাশকে বশ মানিয়ে দিব্বি আকাশের কোলে হেলান দিয়ে ধ্যানে মগ্ন! এর ফাঁকে ফাঁকে ছোট খাট কালো মেঘের দল সূর্যটাকে এক আধটুকু আড়াল করলেই সবুজ কার্পেটে যেন নতুন ছোয়া লেগে যায়। সবুজেরও যে অনেক ভিন্নতা থাকতে পারে, সেটি যেন নতুন করে আবারও উপলব্ধি করলাম নীলাচলে এসে!
মিনিট তিরিশেক সময় পর দলের সবাই যখন নীলাচলের চূড়ায় এসে উপস্থিত হই তখন আকাশের বুকে মেঘের ঘনঘটা। নিকট দূরেই কোন কোন পাহাড়ের বুকে যে বৃষ্টি হচ্ছে সেটি দৃশ্যমান হতেই শরীফ ভাই আর এনামের মধ্যে ক্ষুদ্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সেগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করার। সেই প্রতিযোগিতায় নিজের সামিল হবার ইচ্ছে থাকলেও সাহসে কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিজের মত করে কিছুটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই মনের ক্যানভাসে সেই দূর্লভ চিত্রের স্থান দেবার!
কাছের পাহাড়েই বৃষ্টি হচ্ছে অথচ আমাদের স্পর্শ করছে না, বিষটি ভাবনায় আসতে কেমন যেন এক শিহরণ খেলা করে যায় মনের ভেতর। কাছে কিন্তু যেন কত দূরে এমন একটা অনুভূতি নিয়ে কাছের পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ আর সবুজের মিলন মেলা দেখতে দেখতে সময় যে কখন শেষ হয়ে আসে বুঝে ওঠা মুশকিল হয়ে পরে। পরিকল্পনায় হাতিবান্ধা ট্রেইল থাকায় নীলাচলকে বিদায় জানানো আবশ্যক হয়ে ওঠে। হাতিবান্ধা ট্রেইলটি ব্যক্তিগত ভাবে আমার খুব প্রিয় একটা ট্রেইল। বান্দারবান এসে এই ট্রেইল ধরিনি এমন বিরল ঘটনা বোধকরি একবারের বেশি দুবার ঘটেনি আমার জীবনে, বিশেষ করে বর্ষা পরবর্তী সময়কালের জন্য এই ট্রেইলটি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষদের জন্য খুব প্রিয়। মারমা গ্রাম পেড়িয়ে কিছুদূর এগুলেই হাতিবান্ধা ট্রেইলের দেখা মেলে যার দুপাশটায় সবুজ পাহাড়ের নিরব উপস্থিতি আর মাঝবরাবর নিটল জলের কুল কুল করে বয়ে চলা। পুরো ট্রেইল জুড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার বিরামহীন ডেকে যাওয়া সেই পথটাকে যেন আরো বেশি অপার্থিব করে তোলে!
দিনের আলো থাকতে থাকতেই সেই পথ পারি দেয়াটা সমুচীন ভেবেই নীলাচলকে বিদায় জানিয়ে হাতিবান্ধা ট্রেইলের দিকে পা বাড়িয়ে দেই। নামবার সময় ঔৎসুক মুখ করে বউয়ের জিজ্ঞাসা কতটা পথ পারি দিলে তবে এই পথের শেষ মিলবে? উত্তরে মুচকি হেসে বলি এই তো আর কিছুটা পথ মাত্র বাকি!
হাতিবান্ধা ট্রেইলের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি এই পথটিও বাদামী রঙের ইটের ছোঁয়ায় পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। মনে পরে প্রথম যে বার এই পথ অন্বেষণে নেমেছিলাম সেই সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল আর সেই বৃষ্টিকে সঙ্গী করেই আমরা বিভিন্ন বয়সীর ১৫-১৬ জনের নারী পুরুষের দলটি কোন মতে জান হাতে রেখে বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল কাদা মাটির পথ পাড়ি দিয়েছিলাম! উপরওয়ালার করুণায় কোন ধরণের দূর্ঘটনাই ঘটেনি সেদিন কিন্তু পুরোটা পথ জুড়েই ছিল চরম উত্তেজনা এই বুঝি কেউ না কেউ পা পিছলে দুম করে আছড়ে পরে যায় পাহাড়ের বুক থেকে। সেবারের তুলনায় অনেকটা সহজ হলেও বিপত্তিটা ছিল অন্যরকম, সেটি বুঝতে পারলাম ইটের পথে পা রাখতেই। বৃষ্টির কারণে শেওলা জমে ইটের পথটিও অন্যরকম বিপজ্জ্বনক হয়ে উঠেছে, তার উপর এমন পথে অনভ্যস্ত একজন মহিলার জন্য বিষয়টি রীতিমত আতঙ্কের! সবার আন্তরিক সহযোগিতায় সেই পথ অতিক্রম করে আমরা যখন হাতিবান্ধা গ্রামে উপস্থিত হলাম তখন মনে পড়ল এই গ্রামে শাহীন ভাইয়ের একটা পরিচিত পাহাড়ি পরিবার থাকে, যাদের বাসায় এর আগেও বেশ কয়েকবার বিশ্রাম নিয়েছি! যথারীতি এবারও তাঁদের বাসায় কিছুটা বিশ্রাম নিতে হলো, সেই সাথে কিছুটা ফটোগ্রাফি!
হাতিবান্ধা গ্রামটি পার হলেই দেখা মেলে হাতিবান্ধা ট্রেইলের, দীর্ঘ তিন বছর পর আবারও সেই ট্রেইল ধরব বিষয়টি ভাবতে বেশ শিহরিত হয়ে উঠলাম। বাতাসে যেন সেই ভেজা ঝিরিপথের আদ্র ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। যতই সময় অতিক্রম করছে ততই যেন উত্তেজনার পারদ উর্ধ্বমূখী হয়ে চলছে। অবশেষে মিনিট তিরিশেক বিশ্রাম শেষে পাহাড়ি পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরি কাঙ্খিত সেই হাতিবান্ধা ট্রেইলের পথে। মারমা পাড়া থেকে নিচে নামতেই কূল কূল শব্দে বয়ে চলা পাহাড়ি ঝর্ণার মিষ্টি রিনিঝিনি আওয়াজ মনের মাঝে একধরণের প্রশান্তি এনে দেয়। পাশাপাশি ঝি ঝি পোকার অবিরাম শব্দ পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় যোগ করে ভিন্ন এক মাত্রা।
হাতিবান্ধা ট্রেইলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুই পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি ঝিরি পথ যেখানে থেমে থেমেই পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা ঝর্ণার জলের দেখা মেলে। পাথুরে পথের ফাঁকে ফাঁকে কখনও বা সেই জলের স্রোত তীব্র হয় আবার কখনও বা শান্ত সুবোধ বালিকার মত বয়ে চলে। চারিদিক থেকে নাম না জানা হরেক রকম গাছ গাছালির ঘন ছায়া আর তার ফাঁক গলে সূর্যের আলোর লুকোচুরি খেলা পুরো পরিবেশটাকে এক অন্যরকম মায়াজালে বন্দী করে দেয়। একপাশে যেমন সবুজ পাহাড়ের শ্যামলতা দৃশ্যমান ঠিক তেমনি অন্য দিকে পোর খাওয়া পাথুরে মাটির দৃঢ়তাও নজরে আসে। নাগরিক জীবনের সমস্ত কোলাহল যেন এখানে একদমই নিষিদ্ধ এমনই এক অপার্থিব জগতের প্রতিচ্ছবি এই হাতিবান্ধা ট্রেইল।
মারমা পাড়া থেকে হাতিবান্ধা ট্রেইল ধরে পুনরায় নাগরিক জীবনে ফিরে আসতে প্রায় চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিট সময় লেগে যায়। এই পুরোটা সময় আমরা যেন ভিন্ন কোন এক জগতের দেখা পাই! মিনিট চল্লিশ পর আমরা যখন ট্রেইলের শেষ মাথায় এসে উপস্থিত হই তখন অনুভব করি পেটের মাঝে হাল্কা হাল্কা ক্ষুধা ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এদিকে সূর্যমামা তার সারাদিনের ব্যস্তময় সময় কাটানোর পর ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করেছেন দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে আলো আধারিতে বান্দারবান শহরের একটু শ্রীদর্শন করা হোক সেই সাথে পেট পূজো! এখানেই দেখা মেলে নাফাখুম যাবার সময় আমাদের অন্যতম প্রিয় গাইড মং এর সাথে।
হাল্কা পেট পূজোর পাশাপাশি বান্দারবানের অর্থনীতির উন্নতিতে খানিকটা অবদান রেখে আমরা রাত আটটা নাগাদ ফিরে আসি আমাদের আশ্রয়স্থান মিলনছড়ি হিল সাইড রিসোর্টে। ঘন্টা খানেকের বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবারে পাশাপাশি চলে আবার স্মৃতি মন্থন। আমাদের দলের কনিষ্ঠ সদস্য অনিক থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ সদস্য শাহীন ভাই পর্যন্ত সকলেই নিজ নিজ স্মৃতির ঝাপি খুলে বসেন নিমিষেই। স্মৃতি রোমন্থনের পাশাপাশি পরদিনের কার্যক্রম নিয়েও সংক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। পরবর্তী দিনের সম্ভাব্য করণীয় তালিকায় থাকে নীলগিরি পরিদর্শন, কাফ্রু পাড়ার ট্রেইল অন্বেষণ, ফেরার পথে বান্দারবানের অতিপরিচিত শৈলপ্রপাত দর্শণ!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৪৯