সম্প্রতি ঘুরে এলাম বাংলার সাগরকণ্যা খ্যাত কুয়াকাটা হতে। ভিষন ভাল লাগল নিরিবিলি কিছুটা সময় কাটাতে পেরে। চারিদিকের কোলাহল থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে আর প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া পাবার প্রত্যাশায় ক’জন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম কোন জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসা প্রয়োজন। কুয়াকাটার চেয়ে এর থেকে ভাল পছন্দ আর কি হতে পারে? অনেকেই হয়তো বা কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিনের কথা বলবেন, মানছি সেগুলোও বেশ, নৈস্বর্গিকতার থেকে কোন অংশেই কম যায় না, কিন্তু নিরিবিলি আর নির্জনতার কাছে কুয়াকাটার বিকল্প খুব একটা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আর সূর্যোদয়ের পাশাপাশি পরিপূর্ণ ভাবে সূর্যাস্ত উপভোগ করার মত জায়গা বাংলাদেশে একমাত্র কুয়াকাটা ছাড়া আর একটাও তো নেই!!
যাই হোক পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা মোতাবেক ১৪ তারিখ রাতে সাকুরা পরিবহনের বাসে চড়ে বসলাম। রাত সাড়ে ন’টায় বাস ছেড়ে দিল। বাসের সহকারীকে জিজ্ঞেস করাতে জানালো পরদিন ভোর সাতটায় আমাদের কুয়াকাটায় পৌঁছে দেবে। বলাই বাহুল্য যে তার কথায় আমি খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারলাম না। কেননা পাটুরিয়া ঘাটের সুখ্যাতি সম্পর্কে আমার খুব ভাল ধারনা ছিল। একবার আটকা পরলে সকাল সাতটা লেগে যাবে শুধুমাত্র ঘাট পারি দিতেই!
ভাগ্য বেশ সুপ্রসন্নই ছিল বলা যায়, কেননা ঘাটে পৌঁছানোর পর দেখতে পেলাম ঘাটে খুব একটা জ্যাম নেই বললেই চলে, সিরিয়ালের প্রথম সারিতে আমাদেরই বাস। মাত্র তিরিশ মিনিটের মাথায় আমাদের বাস ফেরীতে সওয়ারী হলো। আমাদের সঙ্গী দুজন বন্ধুসম বড়ভাই সুইট আর কাকন ভাই ফরিদপুর থেকে আমাদের সঙ্গ দিবেন বিধায় তাদের প্রতি তিরিশ মিনিট পরপর আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ধারনা দিয়ে আসতে হচ্ছিল। রাত আনুমানিক দুটোর দিকে তারা আমাদের সাথে যোগ দিলে আমাদের গ্রুপটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।
রাতের নিঃশব্দতা চিরে আমাদের বাস ছুটে চলল তার গন্তব্য কুয়াকাটার দিকে। রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে সহযাত্রীদের মাঝেও নিরবতার লক্ষণ পরিস্কার হয়ে ফুটে উঠল। একটু পর লক্ষ্য করে দেখা গেল বাসে অধিকাংশ যাত্রীই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! আর সবার কথা জানি না, নিজেই কখন যে ঘুমের কোলে ডুব মেরেছিলাম, নিজেও জানতে পারিনি। হঠাৎ সম্বতি ফিরে পেয়ে দেখতে পেলাম আমরা বরিশাল এসে পৌঁছেছি। ঘড়ির কাটাতে চোখ বুলাতে দেখতে পেলাম চারটার ঘর স্পর্শ করছে। বরিশালের পর থেকেই শুরু বাংলার নদীমাতৃকতার অপরূপ রূপ। কিন্তু শেষ রাতের গভীরতার দরুন আমাদের আর সেই সৌন্দর্য আর উপভোগ করা হয়ে উঠলো না। লেবুখালি, খেপুপারা, কলাপাড়া আর আলীপুরের ফেরিঘাট অতিক্রম করে আমাদের বাস যখন কুয়াকাটা এসে পৌছাল তখন ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠতে হল। বাসের সহকারী একেবারে ভুল কিছু বলেন নাই। সাতটার জায়গায় সকাল আটটায় এসে উপস্থিত হতে পেরে নিজের মধ্যে অবাক হবার পাশাপাশি একটা ভাল লাগা বোধও ছড়িয়ে পরছিল। কেননা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না!
আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হোটেল বনানী প্যালেসে উঠলাম। প্রাতরাশ সম্পন্ন হলে আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম উদ্দেশ্য সমুদ্র দর্শন। কুয়াকাটার সৈকত আমাদের দেশের বিখ্যাত কক্সবাজারের মত দীর্ঘ না হলেও দৈর্ঘের দিক দিয়ে একেবারে কম নয়। তবে এখানে কক্সবাজারের মত বিখ্যাত ঢেউ খুঁজে পাওয়া বিরল। এখানকার ঢেউগুলো খুবই সাদামাটা, আভিজাত্য নেই বললেই চলে! সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সেইন্টমার্টিনের মত লাবণ্যময়ীও নয় তবে কোথায় যেন সুক্ষ একটা পার্থক্য আছে! কেমন যেন আটপৌরে একটা ভাব যেখানে উগ্রতার বিপরীতে নমনীয়তার স্পর্শ বিদ্যমান। সাগরের গর্জনেও যেন ভয়ংকর আগ্রাসী ভাবের চেয়ে নম্রতাই বেশি প্রাধান্য পায়। তবে হ্যা নির্জনতা আর নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খোঁজে যদি কেউ এসে থাকেন তবে তাকে নিরাশ হতে হবে না, যতটা কক্সবাজারে হতে হয়! পুরো সৈকত জুড়ে আগে অসংখ্য নারিকেল গাছের উপস্থিতি দেখা গেলেও এখন আগের তুলনায় সেই সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে আসছে। লোকজনের উপস্থিতি খুব বেশি না হলেও একেবারে যে কম নয় সেটা সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত মানুষজনের কোলাহলেই বেশ বোঝা যায়। আমরা প্রথম দিকে সৈকতের দুপাশ ধরে একটু হাটাহাটি করে তারপর নেমে পড়লাম। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই আর সবার মত জলকেলীতে মত্ত হয়ে উঠলাম। সৈকতের গভীরতা খুব বেশি না হওয়ার দরুন সাগরের বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলেও ভয়ের কিছু ছিল না। প্রায় ঘন্টা দুয়েক জলকেলী সম্পন্ন করে আমাদের খিদে জেগে ওঠায় সমুদ্রস্নান ক্ষান্ত দিয়ে উঠে পড়তে হল।
দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে ফিরতে ফিরতে বেলা চারটে বেজে যাওয়ার দরুন ঘুমনোর পরিকল্পনা সাথে সাথে বাতিল করে হোটেলের ব্যলকনিতেই বসে আড্ডা দিলাম। বেলা একটু পড়ে এলে আবার বেড়িয়ে পড়লাম। রেঁস্তরা থেকে বের হবার সময় চোখে পড়েছিল বন্ধু রানা এক মোটরবাইক চালকের সাথে কী যেন বিষয়ে কথা বলছিল! জিজ্ঞেস করতে ও বলল যে ওদের কাছে একটা ক্যাটালগ আছে যেখানে কুয়াকাটার দর্শণীয় জায়গাগুলো বাইক নিয়ে ঘুরে দেখা যায়। প্রস্তাবটা আমাদের কাছে মন্দ লাগল না। সময়ের স্বল্পতার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে আপাতত আমরা লেবুরবন আর শুটকি পল্লী দেখতে যাবো। বাইক চালক হোসেন জানালো যে সেখানে লাল কাকড়া দেখতে পাওয়া যাবে। দুষ্টুমি করে আমরা ওদের চ্যালেঞ্জ করায় ওরা বলল যে লাল কাকড়া না দেখাতে পারলে নাকি ওদের কোন ভাড়াই দিতে হবে না! সে যাই হোক হোটেল থেকে নেমে আমরা বাইকে উঠে পড়লাম। শুরু হলো সৈকত বরাবর বাইক নিয়ে সমুদ্র দর্শন। বিষয়টা বেশ আনন্দ এনে দিলো, বিশেষ করে আমাকে। একপাশে নিরুত্তাপ কিন্তু সুবিশাল সমুদ্র আর অপর পাশে প্রকৃতির মহোনীয় রূপ আমাকে রীতিমত মুগ্ধ করে দিল। কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়ল স্থানীয় শুটকীপল্লী। বিশাল বালুকাবেলায় বাঁশের চাটাই এর উপর নাম না জানা অসংখ্য সামুদ্রিক মাছ শুটকীতে পরিণত করার প্রক্রিয়া চলছে। আরো একটু এগুলেই চোখে পড়ল বিশাল মাচাকৃতির বেদী। যদিও সেখানে কোন মাছের অস্তিত্ব চোখে পড়ল না, জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলাম যে এখন শুটকীর মৌসুম না থাকায় ওই মাচাগুলো খালি পরে আছে। ভরা মৌসুমের সময় নানান জাতের সামুদ্রিক মাছের শুটকী এখানে তৈরী করা হয়। শুটকী পল্লী পেছনে ফেলে আবার আমাদের বাইকযাত্রা শুরু করে দিলাম। কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়ল অসংখ্য ছোট ছোট লেবুগাছে ভরা বন। লেবুগাছের পেছনেই নানাজাতে গাছগাছালি নজরে আসতে মনে পড়ল সুন্দর বনের সাথে কেমন যেন একটা সাদৃশ্য আছে। জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম সুন্দরবনে অস্তিত্ব এখান থেকে খুব বেশি একটা দূরে নয়। নির্জন জায়গাটাকে একনজরেই ভাল লেগে গেল। লেবুরবনকে পাশ কাটিয়ে আরেকটু সামনের দিকে এগুতেই চোখে পড়ল সমুদ্রের বুক চিড়ে উঠে আসা গুচ্ছাকৃতির বনের দিকে। এ যেন সমুদ্রের বুক চিড়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি জনপদ যা প্রাণের ছোঁয়ার অপেক্ষায় এখনও ঘুমিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পাড়লাম ওটা ফাতরার চর। কুয়াকাটা থেকে ট্রলারে করে সেখানে যাওয়া যায়। এদিকে সূর্যাস্তের সময় আসন্ন, কিন্তু মন খারাপ করেই দেখলাম চারিদিক কুয়াশার মায়াজালে আচ্ছন্ন! মার্চের মাঝামাঝি সময়ে যেখানে ঢাকায় রীতিমত উত্তাপ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে সূর্য, সেই কিনা এই কুয়াকাটায় কুয়াশার মায়াজালে বন্দী!! প্রকৃতির লীলাখেলা বোঝা বড্ড মুশকিল! প্রকৃতির উপর যেহেতু আমাদের কোন হাত নেই, তাই সূর্যাস্ত উপভোগ সামনেই অবস্থানকারী সমুদ্রে বিসর্জন দিয়ে আশপাশের প্রকৃতির দিকে নজর দেয়াই উত্তম মনে করে বেড়িয়ে পড়লাম। কিছুদূর হাটতেই চোখে পড়ল ছোট্ট একটা খাল আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি সেটাকে দু’ভাগে বিভক্ত করে অজানার উদ্দেশ্যে বয়ে গেছে। খালের ওপাশটাকে দেখে যেকেউ সুন্দরবন ভেবে ভুল করে বসতে পারেন! কিছুক্ষণ ধরে ফটোশুট চলল। প্রকৃতির সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে নানা কায়দায় নানান ভঙ্গিমায় আমাদের সহযাত্রীগণ ছবি তুললেন, সেই নিয়ে হাসাহাসিও কম হলো না। অবশেষে যখন ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো সূর্য তখনও কুয়াশার আঁচলবন্দী! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার রওনা দিলাম। পথিমধ্যে বাইক চালক চিৎকার করে কি যেন একটা বলে বাইক থামিয়ে দিল! জিজ্ঞেস করতে হাত প্রসারিত করে অনতি দূরে মাটির দিকে ইঙ্গিত দিতেই চোখে পরল লাল লাল কি যেন এক রকম প্রাণের ত্বরিত উপস্থিতি। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখের নিমিষেই পার্শ্ববর্তী গর্তে সুরুৎ করে ঢুকে পড়ল। চালক ব্যাটা শুরুতে যে চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেছিল, সেটা জিততে পাড়ায় তার আকর্ণ হাসি মুখ থেকে বিস্তৃত হয়ে দূর দিগন্ত অব্দি প্রসারিত হয়ে পড়ল। গোধূলী লগ্নে আমরা আবারও কুয়াকাটার প্রধান সৈকতে এসে উপস্থিত হলাম। ঠিক হলো পরদিন ভোরে আমাদের নিয়ে আবার রওনা দিবে, গন্তব্য এবার গঙ্গামতি চর, লাল কাকড়ার দেশে। আজ যে কাকড়া দেখানো হয়েছে সেটা নাকি স্যাম্পল, গোডাউন গঙ্গামতি চরে অবস্থিত। তথাস্তু বলে আমরা ওদের বিদায় করে দিলাম। সৈকতপারে বসেই কুয়াশাচ্ছন্ন গোধূলী দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে একটা জাম্পেশ আড্ডা দিয়ে দিলাম অন্য কিছু করনীয় না থাকায়। রাতের অনেকটা সময় সেখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে, রাতের খাবার গ্রহণটা তখন ফরজ হয়ে পরেছিল বলে।
আগের রাতের যাত্রা পথের ধকল আর সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে শরীর মন দুটোই এমন পরিশ্রান্ত হয়েছিল যে ভয় হচ্ছিল যে পরদিন ভোরে উঠতে পারব কি না!! প্রিয় বন্ধু রানা সবাইকে সেই দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়ে নিজেই সেই মহান দায়িত্ব গ্রহন করল। আমরাও ওর আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিশ্চিন্তে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিলাম। বলাই বাহুল্য ঘুমিয়ে পরতে কেউই মিনিট দুয়েকের বেশি সময় নিল না!!
পরদিন খুব ভোরে বন্ধু রানার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। আলসেমি কাটছিলনা বুঝতে পেরে রানার উদ্যমী ভুমিকা বিছানা ছাড়তে বাধ্য করল। একটু পরেই হোটেল গেটে বাইক চালক আলী হোসেনের ডাক শুনতে পেলাম। আগের দিন সূর্যাস্ত উপভোগ্য হয় নাই, সেজন্য বিশ্বাস ছিল প্রকৃতি ভারসাম্যতা বজায় রেখে আজ ভোরে সূর্যোদয় উপভোগের সুযোগ করে দেবে। সেই ভরসায় বের হতে না হতেই বুকের মাঝে বিড়াশি শিক্কার একটা ধাক্কা খেলাম। এ যে দেখি চৈত্রের শুরুতে পৌষের কুয়াশা!!! সেই সাথে তাপমাত্রা মোটামুটি ১০ সেঃ এর কাছাকাছি!! কুয়াশার তীব্রতা এতটাই গাঢ় যে দু’হাত দূরে কি আছে সেটাও টিক মত বোঝা যাচ্ছে না। বাইকে দু’মিনিট যেতে না যেতেই টি শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার বেষ্টিত শরীরে রীতিমত কাঁপুনির উপস্থিতি টের পেলাম!!! বাইক থামতেই আমরা সবাই একে অপরের মাথায় শিশিরের স্বেদবিন্দু আবিস্কার করে ফেললাম।
ভগ্ন মন নিয়ে ঝাউবন পাশ কাটিয়ে হোসেন সাহেব আমাদের যেখানটায় নামিয়ে দিল, নিশ্চিৎ ভাবে সূর্যোদয় দেখার জন্য সেটি আদর্শ, কিন্তু প্রকৃতি যখন নিজেই প্রবঞ্চনা প্রদান করে, তখন অতিবীরেরও কিছুই করা থাকে না! আগের দিনের সূর্যাস্তের সাথে সাথে আজ সূর্যোদয় দুটোরই সলীল সমাধি হয়ে গেল এই সাগরতটে! এতোটা ভোরে বিছানা ত্যাগের অভ্যেস না থাকায় শরীরটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছিল। এর মাঝে দেখি বাইক চালক হোসেন লাপাত্তা। ঘন্টা খানেক হয়ে গেলেও তাদের টিকিটারও দেখা পাওয়া যাচ্ছিলনা, মোবাইলের নেটওয়ার্ক অস্থিতিশীল থাকায় তাদের সাথে যোগাযোগও করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিছুই করার না থাকায় উদ্দেশ্যহীন হয়ে এদিক ওদিক হাটাহাটি করতে থাকলাম। অনেকেই সূর্যোদয় দেখতেই এতোটা পথ পায়ে হেঁটে চলে এসেছেন, কিন্তু সকলকেই আশাহত মন নিয়েই ফিরে যেতে হবে ভেবে একটু হলেও সান্তনা বোধ করলাম। আমাদের প্রায় ঘন্টাখানেক দাঁড় করিয়ে রেখে অবশেষে মানিকচাঁদদের চাঁদবদনের দেখা মিললো। তাদের বক্তব্য শুনে বুঝতে পারলাম, আমাদের নামিয়ে দিয়েই তারা আবার খ্যাপ মারতে বেড়িয়েছিল। এই হচ্ছে এই সব বাইক চালকদের এক যন্ত্রণা, ফাঁক বের করে আপনাকে অপেক্ষায় রাখাটাই যেন এদের সৌজন্যতা!
যাই হোক দেরী না করে আবার রওনা দিলাম উদ্দেশ্য চরগঙ্গামতি! লাল কাকড়ার দ্বীপ!!! স্থানীয়রা অবশ্য কাউয়ার চরও বলে থাকেন! সেখানে যেতে ছোট্ট একটা খাড়ি নৌকায় করে পারি দিতে হয়। দুরত্ব আর গভীরতা কোনটাই যদিও খুব বেশি বলে মনে হলো না, তারপরেও আমরা নৌকায় চেপে সেটা পার হলাম। ওপারে পৌঁছে মিনিট দশেক চলার পর হোসেন সাহেব তার বাইক বন্ধ করে দিলে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম সৈকতের একাংশ যেন বিশাল এক চলন্ত লাল কার্পেট বিছানো। অসংখ্য লাল কাকড়া পিলপিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সৈকত জুড়ে। একটু শব্দের উৎপত্তি হলেই সুরুৎ করে গর্তে ঢুকে যাচ্ছে, আবার নিরবতা নেমে এলেই পিলপিল করে বেড়িয়ে পরছে। কাছে গিয়ে যে ছবি তুলবো তার উপায় নেই, একটু নড়াচড়ার আভাস পেলেই তাদের দেখা পাওয়া ভার। অদূর জলের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গুটি কয়েক জেলে নৌকা, জাল ছড়িয়ে তারা অপেক্ষায় আছে মাছ ধরবার জন্য। কুয়াশার চাদর ভেদ করে যে সূর্য আকাশের বুকে উকি ঝুকি মারছে, তাকে যদি কেউ পূর্নিমার চাঁদ বলে ভুল করে বসে তাহলে তাকে খুব একটা দোষারপ করা যাবে না!!
লাল কাকড়া দেখবার শখ ছিল অনেকদিন ধরেই, সেটা পূর্ণতা পেলেও তার ছবি তুলতে না পারার ছোট্ট একটা অপূর্ণতাকে সঙ্গী করে আবারও বাইক চেপে বসলাম উদ্দেশ্য চর গঙ্গামতি হয়ে মিশ্রিপাড়া। সেখানে উপমহাদেশের সর্বোবৃহত বৌদ্ধমুর্তি সংরক্ষিত আছে। কিছুদূর এগুতেই বিশাল তরমুজের ক্ষেত চোখে পড়ায় কৌতুহলী হয়ে সবাই নেমে পড়লাম। সেখানে অদ্ভুত এক ক্ষেতির দেখা মিলল সেখানে, যে তরমুজের দাম জিজ্ঞেস করা হয় না কেন কোনটাই একশ টাকার নিচে নয়। আনুপাতিক হারে ক্ষেতি যে দাম হাকাচ্ছে, সেটাই নির্ধারিত। কোনপ্রকার দরদাম করা যাবে না! যাই হোক শখের দাম নাকি লাখটাকা তোলা। ক্ষেত থেকে তরতাজা তরমুজ খাবার লোভ আমরা কেউই সামলাতে না পেরে একটা তরমুজ নিয়েই নিলাম। তরমুজ খাওয়া শেষ করে কিমি পাঁচ সাতেক গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ পারি দিয়ে মিনিট বিশেক পর উপস্থিত হলাম মিশ্রিপাড়ায়। এখানেই অবস্থিত উপমহাদেশের বৃহত্তম বৌদ্ধ প্রতিকৃতি। আর তার অদূরে রাখাইন পল্লী। ইতিহাসের একটা অংশের চাক্ষুস সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ আপনি করতেই পারেন। ঘন্টা খানেক সেখানে অবস্থানের পর আবার আমরা রওনা দিলাম আমাদের আবাসস্থলের দিকে। মিনিট ত্রিশ সময় পর আমরা যখন হোটেলগেটে উপস্থিত হলাম ঘড়ির কাঁটা তখন মাত্র ন’টা ছুঁইছুঁই করছে। পেটে তখন ছুঁচোর দৌড়ের সঙ্গে রীতিমত নাচানাচি অনুভব করছি। কাল বিলম্ব না করে রেঁস্তরাতে বসে পরলাম।
সেদিনই ফিরে যাব বলে নাস্তা শেষে সোজা চলে এলাম হোটেলে। সব কিছু গোছগাছ করে আবার বেড়িয়ে পরলাম শেষ বারের মত সমুদ্র দর্শনের জন্য। শেষবারের জন্য সমুদ্রতীরে এসেও কারো মধ্যে আর শরীর ভিজানোতে আগ্রহ দেখা গেল না। অবশেষে একটা আরাম কেদারা ভাড়া করে সেখানেই বসে সমুদ্রদর্শনার্থীদের সমুদ্রস্নান দেখার পাশাপাশি ফটোশেসন চলল বেশ কিছুক্ষণ। ঘন্টা খানেক পর কুয়াকাটাকে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম।
ভ্রমণটাতে বৈচিত্রতা আনার জন্য আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম যে, আমরা দু’জন যারা ঢাকা থেকে এসেছি তারা কুয়াকাটা থেকে বাসে না ফিরে বরিশাল থেকে লঞ্চে করে নদী পথে ফিরব। পরিকল্পনা মোতাবেক আগে থেকেই বরিশালস্থ এক বন্ধুকে দিয়ে দুটো কেবিনের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। এর ফলে বৈচিত্রতার পাশাপাশি অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতাও অর্জিত হবে আর কি! যদিও এর আগে আমি বেশ ক’বার লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছি, কিন্তু আমার সঙ্গী প্রিয়বন্ধু রানার সেই অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। বেলা একটার দিকে আমরা কুয়াকাটা ত্যগ করলাম। এবারও একটু বৈচিত্রতার স্পর্শ রাখলাম। কুয়াকাটা থেকে সরাসরি বাসে না চেপে হোসেনকে তৈরী থাকতে বলেছিলাম। ওর বাইকে করে আমরা প্রথমে খেপুপাড়া পর্যন্ত যাব তারপর সেখান থেকে বাস ধরব। উদ্দেশ্য এটুকু পথেই যেহেতু তিনবার ফেরী পার হতে হয়, তাই বাইকে করে যতটা দ্রুত সময়ে অতিক্রম করা যায় আরকি!! পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা হোসেনের বাইকে রওনা হলাম খেপুপাড়া এসে পৌছতে পৌছতে আমাদের প্রায় আড়াইটার মত বেজে গেল। খেপুপাড়া নেমে ক্ষুধার কাছে হার মেনে সিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তন করতে হলো। ঠিক করলাম নদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছে স্থানীয় কোন এক রেঁস্তরায় আগে খাবার খেয়ে তারপর বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দেব। বন্ধুপ্রতিম বড় ভাই সুইট ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম কলাপাড়ায় নাকি জগাবন্ধুর মিষ্টি বেশ বিখ্যাত। সেটাও একটা অনুঘটকের মত কাজ করল আমাদের কলাপাড়ায় দুপুরের খাবার গ্রহন করতে। সে যাই হোক কলাপাড়া পৌঁছে ভাতের হোটেলে যে দশা নজরে পড়ল তাতে করে খাওয়ার রুচি একেবারেই উধাও হয়ে গেল। বিকল্প কোন পছন্দ না থাকায় সেখানেই দুপুরের খাওয়া কোন ভাবে সম্পন্ন করে জগাবন্ধুর খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম! কিছুদূর হাটার পর নজরে এল কোন সাইনবোর্ডের অস্তিত্বহীন এক মিষ্টান্নভান্ডার। এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে ইঙ্গিত করলেন সেটাই জগবন্ধুর মিষ্টান্ন ভান্ডার। ভেতরে ঢুকে অবশ্য নিরাশ হলাম না বরং অনেকটা আশাপ্রদ হলাম। মিষ্টিও বেশ সুস্বাদু লাগলো। দু বন্ধু মিলে গোটা কয়েক মিষ্টি গলাধ্বক্কন করে বেড়িয়ে পড়লাম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর অবশেষে বরিশালগামী বাসে উঠে পড়লাম। বরিশাল এসে যখন আমরা পৌঁছলাম ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা ছুঁইছুঁই। পড়িমড়ি করে ছুটলাগালাম সদর রোডের উদ্দেশ্যে, বন্ধু পাবলোর কাছে তখনও আমাদের লঞ্চের টিকিট সুরক্ষিত আছে। ওর কাছে থেকে টিকিট নিয়ে ভদ্রতার ধার না ধরেই ছুট লাগালাম লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে! অবশেষে লঞ্চঘাটে পৌছার মিনিট দশেক পরেই লঞ্চ ছেড়ে দিল। কীর্তনখোলার বুক ঘোলাটে পানি কেটে কেটে যখন লঞ্চ এগিয়ে যাচ্ছিল আকাশের বুকে তখন পঞ্চমীর চাঁদ শোভা ছড়াচ্ছিল। অবাক করা বিষয় আকাশের কোথাও কুয়াশার বিন্দু মাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল না সেই সময়। ফোকলা দাঁতের চাঁদের বুড়িও তখন যেন আমাদের উপহাস করছিল এই বলে দেখলে তো কেমন আমার ভেল্কি ??
প্রকৃতির প্রবঞ্চনা বুঝি এমনই হয়, সবাই মিলে একাট্টা হয়ে পরলে কী বা করার থাকে??