গতকাল তিনটার পর ডাইনিং রুমে গিয়েছিলাম দুপুরের খাবার খেতে। সাধারণত এই সময়টা বেশ ফাঁকা থাকায় খুব আয়েশ করে দুপুরের খাবার খাওয়া আর তার ফাঁকে ফাঁকে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া দুটো এক সঙ্গেই করা যায়। আর আমি এই সুযোগটা নিতেই বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করি। অফিসের বসদের খাবার এর আগেই শেষ হয়ে যাবার দরুন মোটামুটি বেশ নির্ভিক চিত্তে এবং নিঃসংকোচে খাওয়া আর তার পাশাপাশি আড্ডা দেয়া দুটোই বেশ জোরসে চালিয়ে নেয়া যায়। আর আমি সেটার সদ্ব্যবহার খুব ভাল ভাবেই করে থাকি। গতকালও সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্যই ডাইনিং রুমে তিনটের পরেই প্রবেশ করা। খাবারের শেষের দিকে আলোচনার বিষয় বস্তু হলো “শাহাবাগ”। খুব অল্প সময়ের মাঝেই অবাক হয়ে গেলাম আমার ক’জন জ্ঞানী সহকর্মীদের জ্ঞানগর্দভ মন্তব্যের বহর শুনে!! আমার এক বিজ্ঞ সহকর্মী বললেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর প্রোফাইল পিক আপলোড করার জন্যই সবাই নাকি সবাই শাহাবাগে ভিড় জমাচ্ছেন। আরেক সহকর্মী আরেক কাঠি এগিয়ে এসে মন্তব্য করছেন ছোট ছোট বাচ্চাদের ফুর্তির জায়গা আগে ছিল হাতিরঝিল আজকাল সেটা পরিবর্তিত হয়ে শাহাবাগ হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে হলেগুলোতে ছেলে মেয়ে একসঙ্গে থাকতে পারে না, সেজন্য একত্রে থাকার সুবিধা তৈরী করার জন্যই তারা রাতে শাহাবাগে রাত্রি যাপন করছে। আমি সত্যি সত্যি নির্বাক হয়ে গেলাম উনাদের বিজ্ঞ বিজ্ঞ মতামতের নমুনা দেখে। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে শাহাবাগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এরকম মন্তব্য শুনে মনে মনে তাঁদের শিক্ষার মানের প্রতি প্রশ্ন না তুলে পারলাম না।
গত ক’দিন যাবৎ ব্যক্তিগত আর কর্মক্ষেত্রের কাজ এই দুয়ের মারপ্যাচে ঢাকার বাইরে থাকার জন্য শুরু থেকে আমার শাহাবাগ যাওয়া হয়ে ওঠে নাই। কিন্তু মোবাইল ব্যবহারের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে আমি মোটামুটি এই গণজাগরনের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে গিয়েছি। গতপরশু রাতে যখন ঢাকা আসি, তখন থেকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে পরদিন যে করেই হোক অফিস শেষ করেই শাহাবাগে উপস্থিত থাকবোই থাকবো। কিন্তু ডাইনিং রুমে আমার জ্ঞানী সহকর্মীদের মন্তব্য শুনে আমার প্রতিজ্ঞা শুধু দৃঢ়ই হলো না, বরং আরো কৌতুলদীপ্তও হয়ে উঠল। সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক যেতেই হবে শাহাবাগে। আর যাই হোক না কেন বাচ্চাদের এমন ফুর্তিটা চাক্ষুস করার সুযোগ কোন মতেই হাত ছাড়া করা যাবে না। যাবার সময় অন্য এক সহকর্মীকে পেলাম সঙ্গী হিসেবে। অফিস শেষ করে বাইক নিয়ে ছুটে চললাম অজানা এক শিহরণকে সঙ্গী করে গনজাগরণের উদ্দেশ্যে।
শাহাবাগ যাবার জন্য যে ক’টি বিষয় আমাকে অনুপ্রেরিত করেছে তার মধ্যে একটি হলো সশরীরে উপস্থিত হয়ে গণজাগরনের এই ক্ষণের সাথে নিজের একাত্মতা প্রকাশ করা। আর অন্যটি হচ্ছে যে বিষোবাষ্প বছরের পর বছর ধরে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা থেকে মুক্তি পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। জানি না ভবিষ্যতে কি হবে, আমাদের ন্যায়পাল আর দিকপালদের কোন শুভবুদ্ধির জাগ্রত হবে কি না, তবে শাহাবাগ মোড়ে আসা মাত্রই আমার প্রথম উদ্দেশ্য পূর্ণতা পেল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ছেলে বুড়ো তরুন তরুনী নির্বিশেষে সবাই একাকার হয়ে গিয়েছেন এই মহা মিলনস্থলে। কে নেই এখানে, কোন বয়সের উপস্থিতি নেই এখানে ?? মনের অজান্তেই অচেনা এক ভাল লাগার শিহরণ বয়ে গেল শরীরের ভেতর দিয়ে।
প্রথমে ভেবেছিলাম একদম নিশ্চুপ থেকে নিজের একাত্মতা প্রকাশ করেই চলে আসব, কিন্তু যতই আমি শাহাবাগের মোড়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি, ততোই যেন নিজের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতিরে আবিষ্কার করতে থাকি। ভিড় ঠেলতে মাঝে মধ্যে কুনুই চালাতেও দ্বিধা বোধ করি না। ডানে বামে সহাস্রাধিক কুনুইএর গুতো হজম করতে করতে এক পর্যায়ে অনুধাবন করি যে আমি মহাজনসমুদ্রের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছি। যে সহকর্মীর সাথে এসেছিলাম, সেও যে কখন হারিয়ে গিয়েছে টেরও পাই নি। তখনও মনের মাঝে ইচ্ছে ছিল আর যাই হোক কোন স্লোগানে অংশ গ্রহন করবো না, শুধু মাত্র নিরবে দাঁড়িয়ে থেকেই এই যুদ্ধ যাত্রার নির্বাক সহযাত্রী হয়ে থাকবো। কিন্তু মনের ভেতর জেগে ওঠা অন্য এক অনুভূতি কখন যে মুষ্টি বদ্ধ হাতকে উর্ধ্বমুখী করে ফেলেছে, নিজের কাছে সেটাও কেন যেন অজানাই রয়ে গেল। গলা চিড়ে তীব্র বেগে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো জয় বাংলা...জয় বাংলা, তুমি কে আমি কে...বাঙ্গালী, বাঙ্গালী...ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই...রাজাকারের ফাঁসি চাই...রাজাকারের আস্তানা এই মাটিতে হবে না...ক তে কাদের মোল্লা তুই রাজাকার তুই রাজাকার। গ তে গোলাম আযম তুই রাজাকার তুই রাজাকার...!!!একি আমারই কন্ঠস্বর না কি আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা অন্য কারো কন্ঠ, যা দৃঢ় চিত্তে বেড়িয়ে আসছে গলা চিড়ে ???
আমি কোন দিন কোন মিছিল মিটিং এ যাই নাই, গলা ফাটিয়ে স্লোগানে অংশগ্রহন করা তো বহুত দূরের কল্পনা। জানি না সেই আমি কোন এক অদৃশ্য সুত্রাকারের ইশারায় গলা মেলালাম ইথারে ভেসে আসা স্লোগানের সঙ্গে। আমি গণ আন্দোলন দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, গন অভ্যুত্থান দেখলেও সেটা বোঝার মত বয়স আমার তখনও হয়ে ওঠেনি, সাদা কালো লেখনিতে যখন সেগুলোর কথা পড়তাম, মনের কোনে একটা দুঃখবোধ কাজ করত, আক্ষেপ কাজ করত, কিন্তু আজ আমার সেই দুঃখবোধ যেন কর্পূরের মত এক ফুৎকারে উড়ে গেল। আজ সেখানে দেখতে পেলাম প্রাপ্তির অপার আর নির্মল আনন্দ। জনজাগরনের স্বতস্ফুর্ত এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পেরে আজ নিমিষেই যেন আমার অনেক কিছু প্রাপ্তির খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে গেল।
লেখাটা আমার দুই সহকর্মীর মন্তব্য দিয়ে শুরু করেছিলাম, ভেবেছিলাম উনারা নিশ্চয় প্রমান সাপেক্ষে মন্তব্যগুলো করেছিলেন। আর আমি উনাদের সেই বর্ণনার সাথে কোন মিল খুঁজে ফেরার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। অনেককেই দেখতে পাচ্ছিলাম যারা নিজ নিজ চেনা পরিচিতদের সাথে করেই ছোট ছোট দল করে গান গাইছিল, কেউ কেউ বা মোমের বাতি জ্বালিয়ে আলোর আগমনী বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারপাশের অন্ধকারকে দূর করার জন্য। কোথাও বা বড় বড় সাদা কাপড় বিছিয়ে রাখা হয়ছিল, যেখানে দল মত নির্বিশেষে নিজ নিজ মনের কথামালাগুলো লিপিবদ্ধ করছিল বিনা দ্বিধায়, বিনা সঙ্কোচে। সেই বিশাল জনসমুদ্রের ভিড়ে দু’এক জন বিচ্ছিন্ন মানুষ যদিও বা নিজেকে জাহির করার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাসে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, তাতে কি খুব বেশি কিছু আসে যাবে ?? অনেকেই গনসংগীতে গলা মিলাচ্ছিল, সেই গণ সঙ্গীতে যদি কোন স্বল্পবয়সী কিশোর কিশোরী ফুর্তি খুজেঁ ফেরে, তাতে কি গনজাগরন ঝিমিয়ে পরবে ?? না, বরং তাতে করেও এই জাগরণ হয়ে উঠবে আরো দুর্বিনিত। যারা দিনের পর দিন মিথ্যের পসরা সওদা করে বেরাতো, ধর্মের নামে মিথ্যে অভিযোগ তুলে আমাদের স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত জনগোষ্ঠির কাছে প্রতারণার জাল ফেরী করে বেড়াতো, তাদেরই মুখোশ একদিন না একদিন উম্মোচিত হবে। আজ তাদের পাওনা কড়ায় গন্ডায় শোধ করে দেয়া হবে। সময় এসেছে সকলের দেনার খাতা করায় গন্ডায় পরিপূর্ণ করে দেবার। সময় এসেছে যে বিষোবাষ্প আমাদের এতদিন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল, তার থেকে মুক্তি নিয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস ফেলবার।
হ্যাঁ এই মহান গণজাগরনের মাঝে দু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বিশেষ করে যাদের বিরূদ্ধে এই আন্দোলন তারাতো চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবে না। আমাদের তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। নিজেদের কোন বিভাজনে বিভক্ত হওয়া যাবে না। এদের পাশাপাশি কিছু চোর ছ্যাচরা থাকবে যাদের আজন্ম দৃষ্টিই থাকে অন্যের পকেটের প্রতি, রাতের অন্ধকারে মেয়েদের শরীর বরারবর ছুটে আসা নোংরা হাত থাকবে, কিন্তু এদের সংখ্যা এতটাই নগন্য যে এদের মালুমে আনাটাও আমার দৃষ্টিতে অপরাধের মতই। এই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন ঘটনা কখনই একটা গণজাগরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, পারবে না। দুর্জনের নানা কথা বলবেই, দুর্মুখেরা চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখবেই কিন্তু তাতে থেমে না থেকে বরং সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে কখনও বা উপরে ফেলে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
স্বপ্ন দেখি রাজাকার মুক্ত সোনার বাংলার, জানি সেদিন আর দূরে নেই, ভোর আসবেই, অন্ধকার দূর হবেই, আলোর দেখা মিলবেই। রাত্রি বিদায় নেবে নতুন প্রভাতের রাঙ্গা ভোরে। সেই দিনের সূচনা হলো বলে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:২৬