জাদুকাটা শব্দটির সাথেই কেমন যেন এক অদ্ভুত মোহ কাজ করে...এই শব্দের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক মায়া, যা সাদা চোখে দেখা যায় না, অনুভব করে নিতে হয়...এই মায়াময় শব্দকে সঙ্গী করে অনন্তের পানে বয়ে চলা এক নদীর সন্ধানেই আমরা ক’জন ভ্রমন পিয়াসী মানুষ বেড়িয়ে পরেছিলাম। পেছনে পরে ছিল নাগরিক যান্ত্রিকতার যন্ত্রণাময় সভ্য জীবন! সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত বরাবর বয়ে চলা এই যাদুকাটা নদী নিজেই যেন এক মায়াবিনী। নিজের বুকে মায়া আর জাদুর পসরা সাজিয়ে নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজানা কোন এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে!
রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকা থেকে বাস যোগে রওনা দিয়ে আমাদের বিশাল ভ্রমন দল যখন সুনামগঞ্জে এসে পৌঁছাল তখনও সুনামগঞ্জের ঘুম ঠিক মত ভাঙ্গেনি। ঘুম ঘুম চোখে একটু বিরক্ত ভাব নিয়েই সুনামগঞ্জ যেন আমাদের বরন করে নেয় তার আপন বৈশিষ্ট্যে। পাখিদের কলোকাকোলিতে মুখরিত হবার আগেই আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে সুনামগঞ্জের পুরোন বাস স্ট্যান্ড জেগে ওঠে। সকালের প্রাকৃতিক কাজ কর্ম সেরে প্রাতরাশ সম্পন্ন করে আমরা বালুরঘাটে এসে পৌঁছাই বেলা আনুমানিক দশটার দিকে। উদ্দেশ্য বজরা যোগে রওনা দেয়া যাদুকাটা হয়ে বারিক টিলার মুখে। এখানকার ঘাটটা বেশ সুন্দর আর মনোরম। বিশাল বট প্রজাতি গাছের শ্যামল ছায়া আর পরিপাটি করে সাজানো ঘাট এই দুয়ের সেতু বন্ধনে নদীর ঘাটটা যেকোন ভ্রমন পিপাসীর মন কেরে নেবে।
বেলা এগারোটার দিকে বজরা নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি সুরমা নদী ধরে, জাদুকাটার উদ্দেশ্যে। আমাদের দু দুটো নৌবহর ভাদ্র মাসেও ঝিরিঝিরি বৃষ্টিকে সঙ্গী করে সুরমা নদীর বুকে নিজেকে সঁপে দেয়। সুরমার ঘনোকালো জলরাশিকে পেছনে ফেলে আমাদের বজরা কুল কুল করে বয়ে চলে জাদুকাটার দিকে। প্রথম দিকে সুরমার দুপাশে ইট পাথরে জঞ্জাল চোখে পরলেও সময়ে সাথে সাথে সবুজ সেই জঞ্জালকে দুহাতে সরিয়ে দিয়ে আপন জায়গা দখল করে নেয়। কিছুদূর এগুতেই বাংলার সেই চির চেনা শ্যামল ছায়া দৃষ্টি সীমানার মধ্যে চলে আসে। যেখানে রাখাল বালক গরুর পাল নিয়ে মেঠো পথে চরে বেড়ায়, জেলেরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে নদীর বুকে জাল ফেলে নাম না জানা মাছের শিকারে মেতে ওঠে! কোথাও বা কৃষক অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে তার ঘামে ফেলা ফসলি জমিতে বেড়ে ওঠা ধানের শিষে দুষ্টু বাতাসের হুটোপুটি খেলায়। অনেক দূর থেকে ভাটিয়ালি গানের সুরে মন যেন উদাস হয়ে যায়। ঘন্টা খানেক এগুতেই আমাদের বজরা কাচুয়ারা হাওড়ে এসে পরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি চারিদিকে ধু ধু জলরাশি। চোখের দৃষ্টি সীমানার মাঝে কোথাও কোন জনবসতির ছায়া বাধাগ্রস্থ হয়ে দাড়াতে পারে না সেই জলরাশির বুকে। দৃষ্টির শেষ সীমানায় যেন আকাশ, মেঘ আর জল এক হয়ে মিশে গেছে! মাঝে মাঝে দু একটা ছন্ন ছাড়া ভিটে মাটি চোখে পড়লেও সেটা অনুল্লেখযোগ্যই।
ক্লান্তিহীন এই হাওড় পারি দিতে দিতে যখন একঘেয়েমি লেগে যাবে ঠিক তখনই সবাইকে আচমকা শিহরিত করে দূর আকাশে কালো ছায়ার মত করে মেঘালয়ের চূরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। নীল আকাশের বুকে ঘনকুচকুচে কালো বলিরেখার উপস্থিতি সবার মাঝে গুঞ্জনের উদ্রেক হতে না হতেই একটু একটু করে নিজের উপস্থিতি দাম্ভিক ভাবে প্রকাশ করে উঠবে। মেঘালয় নামটা যে একান্তই তার নিজের সেটা জাহির করতে বিন্দু মাত্র সময় নেয় না মেঘালয়। সত্যি সত্যি সে যেন মেঘদের নিজের আলয়ে রেখে দিতে ভিষন পছন্দ করে। মেঘেরাও কি করে না ?? নইলে তারাও বা কেন সেই আলয় থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না ?? মেঘ আর পাহাড়ের অপূর্ব সহাবস্থান মেঘালয়কে দিয়েছে অনন্য এক রূপ যার উদাহরন মেঘালয় নিজেই। আর এজন্যই বুঝি অহঙ্কারে তার পা মাটিতে স্পর্শ করে না! অহঙ্কারী এই পাহাড়ের অপরূপ রূপ অবলোকন করতে করতে কখন যে আমাদের নৌবহর কাচুরা হাওড় ছেড়ে জাদুকাটার বুকে পদার্পণ করেছে সেটা অন্য কারো জানা থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু আমার পক্ষে সেটার উত্তর জানা নেই! চকিতে জলের দিকে নজর পরতেই বুঝতে পারলাম, আমরা এখন জাদুকাটার বুকের মাঝে এসে পরেছি। মেঘালয়ের পাদদেশ থেকেই বুঝি বা এই নদীর উৎপত্তি যেজন্য তার এই লুকোচুরি খেলা, যেন কেউ সহজে তাকে চিনে নিতে না পারে! হায়রে মায়াবতী, জাদু জানা ছলনাময়ী !!! মায়ার জালে আচ্ছন্ন রেখেও সর্বাঙ্গে লুকোচুরির ছোপ না রাখলেই কি নয় ?? কি হয় নিজের রহস্যের একটুকু অবগন্ঠন খুলে দিলে ??
আনুমানিক বেলা তিনটার দিকে আমরা যে টিলার পাদদেশে এসে পৌঁছলাম, তার নাম বারিক টিলা। কোন সেই মহান ব্যক্তি যার নামে এই টিলার নামকরণ, তার কোন খোঁজ না পেলেও চারিদিকে সবুজের সরব উপস্থিতি আমাদের সবার নজর কেরে নেয়। টিলার কোল ঘেসে মহনীয় ভঙ্গিমায় বয়ে বেড়ানো জাদুকাটার অন্যপ্রান্তেই কাটা তারের বেড়া “সীমান্ত অনতিক্রম্য” বিজ্ঞপ্তি সরব কন্ঠে জানান দিয়ে যাচ্ছে! প্রকৃতি যেখানে নিজেকে উম্মক্ত রেখেছে সেখানে আমরা মানুষেরা কেন নিজেদের অবরূদ্ধ করে যাচ্ছি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ??
ভূপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক তিনশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই টিলার উপর উঠলে প্রথমে যেটা নজর বন্দী হবে, সেটা হচ্ছে জাদুকাটা নদীর বহমান পথ। কি এঁকে বেঁকে সেই পথচলা !! আর তার বুকে নাম না জানা কত কত নৌকার চলমান প্রতিযোগিতা !! সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কেউ বা মাছ ধরা নিয়ে, কেউ বা যাত্রী পারাপারে, কেউ বা ব্যস্ত নদীর বুকে জমে থাকা পাথুরে বালি বা ছোট বড় পাথর উত্তোলনে!!! আর এই জাদুকাটা নদী নিরবে নিভৃতে নিজের সমস্ত সম্পদ উজার করে দিচ্ছে নিঃস্বার্থ ভাবে, বিনা প্রতিবাদে!!!
বারিক টিলা থেকে আমাদের গন্তব্য কড়ইগড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেহেতু এই এলাকা পর্যটন অধ্যুশিত এলাকা নয়, সেজন্য এখানে রাত্রি যাপন করার কোন সুবন্দোবস্ত নেই। আর আমাদের বহরও নেহাত কম নয়। প্রায় সত্তুর, এত্ত লোকের জন্য রাত্রি যাপনের কোন রকম ব্যবস্থাকেই সুব্যবস্থা বলা বাঞ্ছনীয়। সেই বাঞ্ছনীয় ব্যবস্থাই হলো কড়ইগড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়! বারিক টিলা থেকে আমাদের কাঙ্খিত প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় কিলো চারেক পথ। আশা ছিল উচু নিচু পাথুরে পথ, কিন্তু হতাশ হতে হলো কংক্রিটের আঁকা বাঁকা সরু পথ দেখে!! নারী শিশুদের জন্য মটর বাইকের ব্যবস্থা থাকায় তারা সেই পথের পথিক হলেন, সেই সঙ্গে অনেকেই তাদের অনুসারীও হলেন!! আর আমি সংগী হিসেবে পেলাম ক’জন যারা এই কংক্রিটের পথেও পাহাড়ি পথের স্বাদ নিতে আগ্রহী!!!
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমরা যতই গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, মেঘালয় যেন ততই আমাদের নিকটবর্তী হয়ে চলছে!! আঁকা বাকা পথের একপাশে রহস্যময় মেঘালয়ের গর্বিত উপস্থিতি অন্যপাশে বিস্তৃত মাঠ জুরে সবুজ ফসলের সমাহার, এ যেন কোন রঙ শিল্পীর তুলির সুচারু আঁচড়!! সবুজেরও এতো রঙ থাকে নাকি ?? জানা ছিল কি না তাও জানি না !!! বিশ্ব বিধাতার অপূর্ব নিদর্শন দেখতে দেখতে মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই আমাদের গন্তব্যস্থল করইগড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় । ১৯৪৫ সালে এই বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়ছিল, যা পরবর্তিতে ২০১০ সালে এলজিইডির সহযোগিতায় কাঁচা থেকে পাকায় রূপান্তরিত করা হয়!! ভবনটির পেছনেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী কড়া নজরদারি রেখে চলছে মেঘালয়কে পেছনে ফেলে।
মিনিট দশেক বিশ্রাম শেষে শরীরের দূর্গন্ধময় ক্লান্তি দূর করার জন্য ছুটে গেলাম ঝিরির পানে। মজার বিষয় হলো দুদেশের সীমান্ত রক্ষীরা জটিল জটিল সব অস্ত্রসামগ্রী নিয়ে মানুষের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সক্ষম হলেও পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে আসা ঝিরি পথের এই পানির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যার্থ হয়েছে নিদারূন ভাবে। আর আমরা দুপক্ষের সেই ব্যর্থতার সদ্ব্যবহার করলাম চরম পুলকতায়। হিম শিতল সেই ঠান্ডা ঝিরি পানির গভীরতা কোন কোন জায়গায় হাটু পর্যন্ত কোথাও বা আবার গোরালি অব্দি। কিন্তু তাতে কি ?? শরীর চুবিয়ে রাখতে তো কোন বাধা নেই!!! পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলে আসা সেই হিম শিতল পানিতে শরীর ভেজানোর আনন্দ, যে না ভিজিয়েছে তাকে আর বলে বোঝান সম্ভবপর নয়। চারিদিকে সুনশান নিরবতা, থেমে থেমে ঝিরি পথে পানির কুল কুল বয়ে চলার শব্দ আর আমাদের জলকেলি সব মিলেই অদ্ভুত এক আবহ তৈরি হয়ে পরে। ঘন্টা খানেক হাটু পানিতে জলকেলি করে তবেই আমরা থামি। গা-ভেজানো শেষ হয়ে এলে আমরা দুপুরের খাবার নিয়ে ফেলি।
সারাদিন ঝিরঝির বৃষ্টি শেষে আকাশে অল্প সময়ের জন্য সূর্যের চাঁদপনা মুখটার দর্শন মেলে। আর এতে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের। মেঘালয়ের চারপাশ থেকে অদ্ভুদ সাদা সাদা মেঘের উপস্থিতি চোখে পরে, যেন সবাই একযোগে ঘুম ভেঙ্গে বৈকালিক পদোব্রোজে বের হয়েছে!!! এ যেন অপূর্ব এক অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রদর্শনী! সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেসে বয়ে বেড়ানো সেই শুভ্র মেঘের থেমে থেমে উড়ে চলা দেখে নিজেকেও ওদের একজন বলে মনে হয়। মনে হয়, যদি আমিও ওই শুভ্র মেঘমালার সাথী হয়ে উড়ে বেড়াতে পারতাম!!!
লীনা আপা ঠিকই বলেন, বড় বড় দলের মাঝেও ছোট ছোট ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। এটা অনেকটা নিজেদের প্রয়োজনে আবার অনেকটা সময়ের দাবী মেনেই। ঠিক তেমন ভাবেই এই সত্তুর জনের বিশাল বহরের মাঝেও আমাদের একটা ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে অনেকটা নিজেদের মত করেই সময় কাটানোর জন্য, অনেকটা নিজেদের ভ্রমন পিপাসা মেটানোর জন্য। আমি চরম সৌভাগ্যবান যে সেই ক্ষুদ্র দলে স্থান পেয়েছিলাম, যেখানে অনেকেরই স্থান হয় নাই, আবার অনেকেই নিজের অজান্তেই স্থানচ্যুত হয়ে পরেছিলেন! যাই হোক, জন, আরিফ, আসিফ, মাহবুব, রাখি, লীনা আপা আর কচি আপাকে নিয়ে গড়া সেই দলের অংশ হতে পেরে নিজেকে সত্যি সৌভাগ্যবানই মনে হয়েছে সব সময়। মাঝে মাঝে শরিফ ভাই, ইকবাল ভাই, তুষার ভাই, পান্না আপা উনারাও ছিলেন তবে সেটা আশা যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের এই ছোট্ট দলটি নিজেদের মধ্যেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে নিজেদের সামর্থেরও বাইরে গিয়ে। আর এটাই হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে দল হয়ে ওঠার প্রথম শর্ত, যেটা অনেকে মেনে নিতে চাইলেও কার্যসম্পাদনের সময় ভুলে যান বা পিছিয়ে পড়েন।
বিকেল ঘনিয়ে এলে আমরা আবারো চলে যাই সেই বারিক টিলায়। টিলার উপর দাঁড়ালে অনেক দূর বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে চোখ পরে মেঘালয়ের রেঞ্জ। আর পড়ন্ত বিকেলে সোনা ঝরা রোদের আলতো পরশ গায়ে মেখে যাদুকাটা নদীর মৃদু পথচলা। নদীর বুকে ছোট ছোট নৌকাগুলোকে মনে হয় কোন শিল্পীর পটে আঁকা কোন ছবি! বিভিন্ন পেশজীবি মানুষের কর্ম চাঞ্চল্যতাও চোখে পরে, হাতের কাজ সেরে ঘরে ফেরার তাড়া খুব সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। আকাশ হাল্কা মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও সেই মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে ওঠে পূর্ন যৌবনা চাঁদ। গোধূলি বেলায় যদিও সে তার জোৎসনাকে আড়ালে রেখেই মেঘের সাথে লুকোচুড়ি খেলায় মত্ত থাকে, কিন্তু সময়ের আবর্তনে সে আর নিজের রূপ লাবণ্য আড়াল করে রাখতে পারে না। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে পাহাড়ের কোলে ঢলে পরলেই চাঁদ তার অপার রূপ সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় সারাটা আকাশ জুরে নিজের রাজত্ব দখল নিতে। মেঘও বুঝিবা “বিনা যুদ্ধে ছাড়িব না সূচাগ্র মাটি” এই মর্মে চাঁদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়! চন্দ্র-মেঘের এই রাজত্ব দখলের যুদ্ধের চরম মূল্য দিতে হয় আমার মত চন্দ্র প্রেমিকদের, যারা চাঁদের অপার সৌন্দর্য সুধা পান করার জন্য সুদূর ঢাকা থেকে অনেক হাক ডাক করে এসেছেন এই নির্জন বারিক টিলায়, জাদুকাটার মায়া জালে বন্দী হতে!
নাসার সময় অনুযায়ী বাংলাদেশের নীল আকাশে ৩১ অগাস্ট সন্ধ্যা সাতটা একান্ন মিনিটে পূর্ণ চন্দ্র (Blue Moon) দেখা যাবার কথা। সেই সময়টাকে পাখির চোখ করে আমার মত অনেক জোৎস্না প্রেমিক (প্রেমিকাও ছিলেন) বারিক টিলার আকাশের দিকে চাতক পাখির মত চেয়ে থাকে। আকাশে তখনও চন্দ্র মেঘের যুদ্ধ বিদ্যমান। প্রবল সেই যুদ্ধে কখনও বা মেঘ জয়ী হয় কখনও বা জয় হয় চাঁদের। গোধূলী লগ্ন পারি দিলে, আমরা বজরা যোগে চলে যাই, টিলা থেকে অদূরে অবস্থিত বালুকালয়ে। নদীর বুকে জেগে ওঠা অন্যান্য চড় থেকে এই বালুকালয়ের মূল পার্থক্য হলো এই বালুকালয় পুরো এলাকা জুড়েই অসংখ্য ছোট ছোট নুড়ি পাথরে পরিপূর্ণ! আর সেই নুড়ি পাথরের বুক বেয়ে চলে যায় জাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ স্ফটিক শীতল জল। এরই মাঝে সংগ্রামরত চাঁদ তার চাঁদপণা মুখ বাড়িয়ে দেয় অল্প কিছুটা সময়ের জন্য। সেই স্বল্প সময়েই জোৎস্নাস্নাত পাহাড় ঘিড়ে সৃষ্টি হয় অপূর্ব এক আবহ! যার সৌন্দর্য প্রকাশ করার মত ভাষা আমার মত ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে রীতিমত অসম্ভব!
ছোট বেলায় আমরা হাত ঘড়ির বিভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারন করতাম, কেউ বা টেলিভিশন এর সময়টাকে মানদণ্ড নির্ধারন করতো, কেউ বা রেডিওকে। অনেকেই আবার এক ধাপ এগিয়ে বলতো আমার ঘড়ির সময় বিবিসি-র সাথে মেলানো। জানিনা, এখন কার বাচ্চা কাচ্চারা কোনটাকে মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, হয়তো বা তারা ইন্টারনেট থেকেই সঠিক সময় নির্ধারন করে নিতে পারে। সে যাই হোক আমরা সবাই নিজ নিজ হাত ঘড়ি অথবা মুঠোফোনের পর্দায় এক চোখ রেখে অন্য চোখে আকাশের চন্দ্র মেঘের যুদ্ধ দেখতে ব্যস্ত। এর মাঝেই হঠাৎ করেই সবাইকে চমকে দিয়ে মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে চাঁদ তার মোহনীয় জোৎস্নার চাদরে চারপাশটাকে ঘিরে ফেলে। আর আমরা সাক্ষী হই অপার এক সৌন্দর্যের। চাঁদের এই বিজয়ে আমাদের এই চন্দ্র প্রেমিকদের উচ্ছাস দেখে কে ?? আমার তো মনে হয় শুধু আমরাই নই, চন্দ্রের এই বিজয়ে জাদুকাটা নদীর পানির নিচে লুকিয়ে থাকা নুড়ি পাথরগুলোও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে!!!
মিনিট চল্লিশ সময় ধরে জাদুকাটার বুক চিড়ে জেগে ওঠা বালুকালয়ে জোৎস্না সুধা পান শেষে সবাই আবার ফিরে আসি কংক্রিট ঢালা পাহাড়ি রাস্তা ধরে আমাদের আশ্রয়স্থলে। ফেরার পথে যেদিকেই চোখ যায় মুগ্ধতা যেন রীতিমত গ্রাস করে নেয় আমাকে। মেঘের আড়াল থেকে বিজয়ী চাঁদ কিছুটা সময় বেড়িয়ে আশার ফলে, পাহাড়ের চারপাশে তখন যেন অঝোর ধারায় জোৎস্নার বারিধারা বর্ষিত হতে থাকে। অকৃপণ হাতে চাঁদ যেন তার অপরূপ সুধা ঢেলে দেয় আমাদের চারপাশটাকে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে যখন নিচে নামছিলাম, তখন চারপাশটাকে মনে হচ্ছিল চন্দ্রাগ্রস্থ কোন এক নৈস্বর্গিক স্থান। প্রকৃতি এত্ত রূপ ধরে রেখেছে তার প্রতিটি খাঁজে খাঁজে!!! অন্যান্যদের খবর জানি না, তবে সেই প্রকৃতির একটা অংশ হতে পেরে নিজেকে দারুন সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল!!
শেষ রাতে ভারী বর্ষনের ফলে সকালের একটা আয়োজন থেকে আমাদের পিছিয়ে আসতে হয়। তবে এই বর্ষনের অন্য আরেকটা রূপ দৃষ্টি গোচর হতেই মনের ভেতর জমে থাকা সেই খেদ নিমিষেই তুলার মতই উরে চলে যায়। শেষ রাতের দিকে ভারী বর্ষনের ফলে, পাহাড়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকা ঝর্ণাগুলো যেন নাম না জানা কোন এক বাঁশুরিয়ার বাঁশির সুরে এক নিমিষেই জেগে ওঠে। দীর্ঘ ঘুম ভাঙ্গতেই ঝর্ণাগুলো চপলা কিশোরীর মত নাচতে নাচতে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসতে থাকে। তাদের সেই উচ্ছোল প্রাণোবন্ত নৃত্য আমাদের মনে গভীর দোলা দিয়ে চলে যায়। মুহুর্তেই আলোকচিত্র প্রেমীদের হাত সরব হয়ে ওঠে অভুতপূর্ব এই দৃশ্যমালাকে স্থির চিত্রে বন্দী করার জন্য।
যাত্রা পথের শুরুতেই কাচুরিয়ে হাওড় দেখে মনের খুব গোপন কোনে একটা আশা কখন যে বাসা বেঁধেছিল বুঝতে পারি নাই। ইচ্ছে ছিল, যদি এই হাওরের পানিতে গা ভেজাতে পারতাম !!! আসলে পানি দেখলেই আমার এই ইচ্ছেটা প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু স্থান, কাল পাত্র ভেদে কোন কোন সময় সেই ইচ্ছেটাকে প্রবল বাহু জোরে গলা টিপে হত্যা করে ফেলি, অনেকটা ভ্রূন হত্যার মত করেই। ফেরার পথেও সেই একই বাসনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে, যখন তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করতে যাবো, ঠিক সেই সময় জানতে পারলাম হাওড়ের এক স্থানে নোঙ্গর ফেলা হবে। কারন আর কিছুই না, যান্ত্রিক জীবনে পদধূলি দেবার আগে, নিজেকে আরো সুদ্ধ করে তোলার জন্য হাওরের পানিতে পূণ্য স্নান করা হবে! নিজের মনের কোনে সুপ্ত থাকা ইচ্ছেটা পূরণ হতে দেখে চোখের নিমিষেই আমি বজরা থেকে নেমে গেলাম সোজা পানিতে, এই ভেবে যদি পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়ে যায়!! নিরাশ হতে হলো না, কিছুক্ষণ পরেই আমার সংগী সাথীর অভাব হলো না। সাঁতার জানারা তো নামলেনই, অজানারাও বন্দি থাকলেন না বজরার লৌহ বাহুডোরে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই হাওড়ের নির্মল পানিতে জলকেলিতে মত্ত হয়ে পরলো চোখের পলকেই। কেউ কেউ বা আবার লাইফ জ্যকেটের আশ্রয়ে সাঁতার কাটার ছলে হাওরের অথৈ জলে গা ভাসিয়ে দিলেন। আর আমি ?? মনের সুখে হাওরের পানির স্পর্শ নিতে লাগলাম আমার শরীরের আনাচে কানাচে!
সব কিছুরই শেষ আছে। শেষ হতে হয়, জাগতিক এই নিয়মকে কেউ চোখ রাঙ্গিয়ে চলে যেতে পারেনি, আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। দুপুর নাগাদ আমরা আবার সেই বালুঘাটে এসে পৌঁছলাম। দুপুরের আহার গ্রহণ করে বেড়িয়ে পরলাম সুনামগঞ্জের সুনামধন্য পুরুষ হাসন রাজার স্মৃতি বিজোরিত হাসন রাজা মিউজিয়ামে। সেখানে তাঁর অনেক কীর্তির সাথে পরিচিত হলাম। শেষ বিকেলের মরে আসা সূর্যের আলোয় যখন সুরমা নদীর তীর ধরে হেঁটে বেড়ানোর ছলে গোধূলীর স্পর্শ নিচ্ছিলাম, তখনও মনের ভিতর জমে থাকা বিস্ময়গুলো, ভাল লাগাগুলো হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল মনের এই ঘর থেকে ও ঘরে। বারবার মনে হচ্ছিল, বাউল সম্রাটা শাহ আব্দুল করিম কি কখনো সেই জাদুটানায় গিয়ছিলেন ?? কখনো কি তিনি জাদুটানার জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন ?? নইলে তিনি কি করে এমনটা বলে গেলেন ???
“বন্ধে মায়া লাগাইছে, পিরিতে শিখাইছে, দেওয়ানা বানাইছে...কি জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে...”
মনের ভিতর এখনও গুনগুন করে ওঠে ওনার কথামালা...কি জাদু করিয়া আমায় মায়া লাগাইছে...!!!
কৃতজ্ঞতাঃ লীনা হক (আমাদের ভ্রমন সঙ্গী)
[img|http://ciu.somewherein.net/ciu/image/26981/small/?token_id=930e78deb0fcf3cc8abbc499d7a27c6b
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৪৬