ছোট একটা সফর হওয়ার কথা ছিল। মোট দশ দিনের। বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে কিছুটা সময় কাটান আর সাথে সাথে বই মেলা, শাহবাগ, টিভি-পত্রিকার ইন্টার্ভিউ, দুটো বইয়ের প্রকাশনা উৎসব। সময় ঝড়ের থেকেও দ্রুত গতিতে পার হতে লাগল। কিন্তু কাল হল আট দিনের দিন। ২০ শে ফেব্রুয়ারি রাতে পড়লাম সড়ক দুর্ঘটনায়। বাম পা আর ডান পায়ের হাড্ডি ভেঙ্গে একাকার হয়ে গেল। ২২ তারিখে ডাক্তাররা হাড্ডি মেরামতের কাজ করলেন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে। হাতে বসান হল লোহা, পায়ে প্লাস্টিকের স্ক্রু। শুরু হল সাময়িক পঙ্গু জীবন। হাঁটা ফেরার ক্ষমতা চলে গেল। এক দিকে শরীরের ব্যথা বেদনা আর অন্য দিকে শুরু হল নিজের সাথে নিজের এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। নিজেকে নিজে প্রতিটা মুহূর্তে প্রশ্ন করা, ‘কেন আমি? কেন আমি ?? Why me, Why me ???
যেই বাংলাদেশ আমি সব সময় হৃদয়ে ধারণ করি, বাস্তব তার থেকে অনেক অন্য রকম। প্রতি দিন মানুষ খুন হচ্ছে। আমার কাছে এইটা একেবারেই জরুরী না, কে মারা যাচ্ছে জামাত, শিবির না রাজাকার। এরা বাঘ না, পাক হানাদার বাহিনীও না। এরা এই দেশেই জন্মান, এই দেশেরই সন্তান। এক মায়ের এক ছেলে যদি পুলিশে যায় আরেক ছেলে শিবিরে যায়, তা হলে এক ভাই কি আরেক ভাইকে মেরে ফেলার জন্যে সদা প্রস্তুত থাকবে? মায়ের ভূমিকাই বা কি হবে? মা কি এই খুনা খুনিতে উৎসাহ দিবে? না কি যেই ছেলে বিপথগামী হয়েছে, তাকে সঠিক শিক্ষা আর জ্ঞানটা দিবে? একটা দেশের সরকারকে না ওই দেশের মায়ের ভূমিকায় (governance) থাকার কথা? এক জন সরকার সমর্থক বন্ধুর ধারণা, ওদের মেরে শেষ করে ফেলা যাবে, কিংবা পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়া হবে। আসলে তা কি সম্ভব? এক জন শিবির যখন খুন হচ্ছে, তার প্রতিবাদে তার পরিবার পরিজনের চারজন সমর্থক হচ্ছে। আর পাকিস্তানের কি ঠ্যাকা পড়েছে এই সব মানুষদের বাংলাদেশ থেকে নেবার।
১৯৮৬/৮৭ সালের কথা। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল আর বিবর্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে আয়োজন করল, এক বিশাল জাতীয় সেমিনার, বিষয়—বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি। আমার উপর দায়িত্ব ছিল, ছাত্র শিবিরের ওপর গবেষণা করে তাদের ১৯৭১ পরবর্তী উত্থানের কারণ আর প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা। অজানা অনেক তথ্য বের হয়ে আসল। মওদুদি মতবাদ প্রচারের পাশাপাশি তারা নিজেদের এক বিশাল পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছিল। হলে সিট, পরীক্ষার নোট, অর্থনৈতিক সাহায্য, চাকরির ব্যবস্থা সবই তারা করছিল।পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষাতো আছেই। পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়ার আগে তাদের আরও তিন ধাপ উত্তীর্ণ হয়ে আসতে হত। সেমিনারে উপস্থিত সবাই মৌলবাদের উত্থানের সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে সেদিন উপস্থিত ছিলেন কর্নেল (অব) কাজী নুরুজ্জামান, প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। অনেকটা অঙ্গীকার হয়ে দাঁড়াল, মৌলবাদের উত্থান বন্ধ করতে হবে, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে মৌলবাদের কাল থাবা থেকে; দরিদ্র এই দেশকে অকারণ হানাহানি থেকে বাঁচাতে হবে।
কিন্তু না অঙ্গীকার, কথার ফুল ঝুড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির দুই প্রধান দল বিষয়টাকে আমলেই আনে নি। বরং নিজের সুবিধার জন্যে মৌলবাদী দল জামায়াতকে ব্যাবহার করেছে। কখন ক্ষমতায় যেতে, আবার কখনও বা ক্ষমতা থেকে প্রতিপক্ষকে সরানোর জন্যে। এর থেকে দল দুটো তাদের স্বল্পমেয়াদী সুবিধা আদায় করতে পারলেও, আসল লাভবান হয়েছে জামায়াত। বেয়াল্লিশ বছরে তারা তাদের ভয়ঙ্কর মতবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশ জুড়ে। ছোট বেলায় সব মা ই হয়ত বাচ্চাদের আগুন নিয়ে খেলতে না করেছে। আগুনকে অল্প থাকতেই সামাল দিতে হয়। এখন বাংলাদেশকে আরও অনেক কিছুর সাথে সাথে পুড়তে হচ্ছে মৌলবাদের দুষ্ট শিখায়।
এক সময় বলা হত, রাজনীতি হল রাজা বাদশাদের ব্যাপার স্যাপার। সমস্ত দেশের জনগণের মধ্যে কম বেশী রাজনীতি ঢুকে গেছে। অল্প কিছু মানুষ হরতাল, ঘেরাও, অবরোধ করে, আরেকটা ক্ষুদ্র অংশ তাদের ঠেকায়। অনেকটা ক্রিকেট খেলা, এক দল বল বল ছুড়ে, অন্য দল তা ব্যাট দিয়ে হিট করে। দেশের বাকি ৯৮% ভাগ মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কে ভুগে—কার মাথায় বল এসে পড়ে, কখন কি বিপদ হয়ে যায়। তাদের ই বা কি দোষ, এই কয়টা মানুষের কাছে তারা জিম্মি! তাদের খেলার জন্যে স্কুল বন্ধ, কলেজ বন্ধ, সারা রাস্তা ঘাট রণাঙ্গন; পিকেটার আর পুলিশের করুণ আহত কিংবা নিহত হওয়া। কিন্তু যাদের মাথায় বল পড়ে নি, তাদের খুব বেশী যায় আসে না। রাজনীতি কারণে তারা সবাই যেন, “আমারা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে”।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলার সময়, লড়াকু বাঙ্গালী আর সারা বিশ্ব আশা করেছিল, একটা যুক্তি, ন্যায় আর বিতর্কের দেশ হবে বাংলাদেশ। কত না বরেণ্য মানুষ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবি শঙ্কর প্রমুখ আয়োজন করেছিলেন “কন্সার্ট ফর বাংলাদেশ”। এমেরিকার সিনেটর টেড ক্যানেডি মার্কিন সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। সে সময়কার অন্যতম প্রধান মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ কবি ছুটে আসলেন বাঙ্গালীদের পাশে দাঁড়াতে। সৃষ্টি করলেন অমর কবিতা: September on Jessore Road। কিন্তু না সেটা হয় নি। যুক্তি, তর্ক, বিতর্কের, জনগণের মতামতের কোন স্থান এখানে নাই। আছে শুধু গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরতন্ত্রের সার্থক প্রয়োগ। বিরোধী দল মানে পরিত্যক্ত। কিন্তু গণতন্ত্রে নির্বাচিত সবারই সরকারের কার্যকরী অংশীদার হওয়ার কথা। সরকারী দলের প্রধান সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তার আশে পাশে সব জী হুজুরের দল। দেশের সব কিছুই, রাজনৈতিক বিভাজনে বিভক্ত: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে আরম্ভ করে আইনজীবী,মৎস্যজীবী, শ্রমিক, ছাত্র পর্যন্ত কেও এই বিভাজন থেকে বাইরে না। এটা দেখে লর্ড ক্লাইভ নিশ্চয়ই মহা আনন্দিত হচ্ছেন। তার “ডিভাইড এন্ড রুল” থিওরির কি সার্থক ব্যাবহার। জনগণ মাথা ফাটাফাটি করে মরে, আর দুই মহিলা আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা ক্ষমতা দখলের মিউজিক্যাল চেয়ার খেলে---একবার উনি, একবার ইনি।
দেশের হাড্ডিসার জনগণ প্রবাসের রুক্ষ মায়া মমতাহীন পরিবেশে গাধার খাটুনি খেটে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে, দেশের অন্যরা বিল্ডিঙের ধ্বসের নীচে পড়ে, আগুনে পুড়ে, না খেয়ে রপ্তানি করে টাকা আয় করে দিচ্ছে। না আছে তাদের ন্যুনতম সম্মান, না আছে তাদের কোন অধিকার। আছে শুধু প্রতি পদে এক পাহাড় লজ্জা, অপমান আর আহত,নিহত হওয়ার সমূহ আশংকা। সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে প্রমোদ করছে এই দুঃখী মানুষদের টাকার সুবিধাভোগীরা।
আমার পঙ্গুত্ব ধীরে ধীরে ভাল হয়ে আসছে। কিন্তু ভাবি, আমার দেশটাও তো এক ধরণের পঙ্গু। আমার পঙ্গুত্ব দূর করার জন্যে ডাক্তারের চিকিৎসা, মানুষের ভালবাসা,আশীর্বাদ, সহযোগিতা আছে। কিন্তু বেচারা বাংলাদেশের কি আছে? আর কত ভুগবে বাংলাদেশ? আর কত ভাঙচুর হবে? আর কত মানুষকে প্রাণ দিতে হবে? আর কত দিন নিজেদের মধ্যে মারামারি, হ্রেষা হ্রেষি চলবে? পৃথিবীর কত দেশই কত সুন্দর ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থা কেন এত গ্লানির হবে? সবার সামনে কেন বাড়ে বাড়ে মাথা হেট করতে হবে? আমার পঙ্গুত্বের প্রথম দিক কার প্রশ্ন অন্য ভাবে ফিরে আসে। Why me র জায়গায় আরেকটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে কুড়ালের মত প্রতি মুহূর্তে ঘা দিতে থাকে, Why Bangladesh? Why Bangladesh??
মে ১৯, ২০১৩
http://www.lekhalekhi.net