.বিশ্ব শক্তি ভারসাম্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ চোকপয়েন্ট রয়েছে। অতীতে কেবল বিকল্পহীন সরু জলপথগুলো (প্রণালি) এই গুরুত্ব পেত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মারণাস্ত্রের বৈপ্লবিক উন্নতি এবং পরাশক্তিদের নিকটবর্তী রণকৌশলগত অবস্থানের কারণে কিছু ভূ-অঞ্চলও নতুন করে ক্রুশিয়াল জিওস্ট্রাটেজিক লোকেশন হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। কিছু লোকেশন দেখে নিন।
.
[১] ইউক্রেন; কৃষ্ণসাগরের উত্তরে ব্যাপক গুরুত্ববহ একটি অবস্থান। রাশিয়ার বিপক্ষে ন্যাটোর সামগ্রিক রণপ্রস্তুতিকে আশ্রয় দেয়া ও গোপন রাখার জন্য অতুলনীয় জোন। তবে, ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল হয়ে যাওয়ায় ইউক্রেনের সেই গুরুত্ব ৯০ ভাগ শেষ হয়ে গেছে। এবং ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে বিশ্বযুদ্ধের দরজা খোলা হয়েছে।
.
[২] তুরস্ক; বিশ্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্রুশিয়াল অবস্থান। কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের একমাত্র পথ বসফরাস প্রণালীর মালিকানার কারণে সহস্রাব্দকাল ধরে সীমাহীন গুরুত্ব উপভোগ করছে। তার উপরে ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের কারণে গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। দেশটি স্লাভিক ও দক্ষিণ ইউরোপকে জর্জিয়ার সাথে (রাশিয়ান ব্লকে) যুক্ত করে। তেল+গ্যাস সমৃদ্ধ আজারবাইজান, কৌশলগত ইরান ও ইরাক এবং কার্যকর যুদ্ধক্ষেত্র সিরিয়াকে সংযুক্ত করে। ন্যাটো জোটে থেকেও এই দেশ এখন পর্যন্ত নিজেকে বাফার জোন হিসেবে ধরে রেখেছে। সম্প্রতি ইস্তাম্বুল খাল খননের মাধ্যমে নিজ অবস্থানকে আরো ক্রুশিয়াল করে তুলেছে।
.
[৩] মরোক্কো; গুরত্বটা জিব্রাল্টার প্রণালীর কারণে। যদিও প্রণালীর মালিক ব্রিটেন। মরোক্কোর জলসীমা ব্যবহার করে ব্রিটেনের মালিকানা বাইপাস করে উত্তর আটলান্টিক থেকে ভূমধ্যসাগরে ঢোকা যাবে। মরোক্কোতে সম্প্রতি ইস/রাইলের দূতাবাস ও বিমান পরিবহণ চালু হয়েছে [অর্থাৎ এক দিকে ঝুঁকে গেছে]। তাই, এদিকে দৃষ্টি না রাখলেও চলবে।
.
[৪] সিরিয়া ও লেবানন; বাফার স্টেট হিসেবে সিরিয়ার গুরুত্ব ছিল, কিন্তু দেশটা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন সকল পরাশক্তি ও তাদের মার্সেনারিদের অ্যাক্টিভ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে টিকে থাকা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। সিরিয়ার গুরুত্ব লেবাননে ট্র্যান্সফার হয়েছে। সেখানকার সরকার ও হিজবুল্লাহর দ্বন্দ্ব মূলত মার্কিন-রাশান দ্বন্দ্ব। অপারগ সরকার এখন আরবদের দ্বারস্থ হয়েছে। আপাতত সমাধানের সম্ভবনা দেখা যায়নি।
.
[৫] ইস/রাইল; বিশ্বের তেল (এবং স্বর্ণ ও হীরা) বাণিজ্য পথের মুখে অ্যামেরিকার নিযুক্ত চৌকিদার। আরবদের নিরবিচ্ছন্ন উত্থানকে দমিয়ে রাখতে এবং বিশ্বের অপরাপর সকল শক্তির ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে অ্যামেরিকার নিকটে এই চৌকিদারের বিকল্প নেই। থিওডোর হার্জেল ও বেন গুরিয়ন’রা এটা বোঝে। ফলে, চৌকিদারির বিনিময়ে তার সর্বোচ্চটাই আদায় করে নেয়।
.
[৬] মিশর; সুয়েজ খালের মালিকানার কারণে গুরুত্ব। সুয়েজ খাল ভূমধ্যসাগর (ইউরোপ) ও লোহিত সাগরকে (আফ্রিকা ও পরে ভারত মহাসাগরকে) সংযুক্ত করে। আরব বসন্তের মাধ্যমে দেশটিকে ডিস্ট্যাবিলাজ করার সকল প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সিসি ক্ষমতায় এসে সকল পক্ষের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন।
.
[৭] ইয়েমেন; বাবেল মান্দেব প্রণালীর কারণে গুরুত্বপূর্ণ। লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মাধ্যমে ভূমধ্য সাগর ও আরব সাগরকে সংযুক্ত করে। হুথি ইনসার্জেন্সি এর মাধ্যমে দেশটিকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করা হয়েছিল। আরব জোটের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কিছুটা স্থিরতা এসেছে, কিন্তু শঙ্কামুক্ত হয়নি। মার্কিন ও রাশিয়ান ব্লক এটা হাতে রাখতে মরিয়া।
.
[৮] ইরান; এই গ্রহের সবচেয়ে কৌশলগত অবস্থান। দেশটি হরমুজ প্রণালি মালিক, যার মধ্য দিয়ে ইরাক, খুজেস্তান (ইরান), কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের টার্মিনাল থেকে পেট্রলিয়াম পণ্য বিশ্ববাজার প্রবেশ করে। আর, বিশ্বের তেল সম্পদের ১০% এর মালিকানা তো নিজের রয়েছেই। উপরন্তু, এটিই একমাত্র দেশ, যার ক্যাস্পিয়ান সাগর ও পারস্য উপসাগর উভয়ের সাথে সীমান্ত রয়েছে। ফলে, এর ট্রান্সকন্টিনেন্টাল অয়েল ট্রান্সপাস’কে কখনই বিঘ্নিত করা যাবে না। জোর করে বন্ধ করতে চাইলে তুরস্ক, বিশাল পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া ও সাইনো ব্লকের স্থলপথ কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। ইরান ছাড়া কেবল রাশিয়ার এই গুরুত্ব রয়েছে; কিন্তু সেজন্য অতি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ইন্ডিয়া ও চীন থেকে ইরানের মধ্য দিয়েই ইউরোপে (বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার) সকল পণ্য যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও সোভিয়েত উভয় বাহিনী ইরান দখলের জন্য আক্রমণ করেছিল। রাশিয়া যদি এখানে সফল হতো, তাহলে বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য অন্যরকম হতো।
.
[৯] বাংলাদেশ; ইরান ও তুর্কির পর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্রিটিক্যাল ইকুয়েশনের দেশ। এর গুরুত্বের বিষয়ে বোদ্ধারা নীরবতা অবলম্বন করে থাকেন [আর পোস্টদাতা তো কোথাকার ছার!]।
.
[১০] মায়ানমার; বিচ্ছিন্নতাবাদী পূর্ব ভারত, চীন, ও বাংলাদেশকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করার মোক্ষম অবস্থান। এই দেশটিকে নিয়ে অ্যামেরিকা ও চীনের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্যাপক টানাপড়েন চলে আসছে। তবে, চীনই এখানে কার্যকর জয়ী পক্ষ এবং যে কোনো মূল্যে মায়ানমারকে হাতে রাখতে বদ্ধ পরিকর।
.
[১১] তাইওয়ান; চীনের ঘাড়ের উপর মার্কিন নিঃশ্বাস হচ্ছে তাইওয়ান। চীনের সাথে স্থল সম্পর্ক নেই; তাই ক্রিটিক্যাল কোনো বিশেষত্বও নেই। মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করার উপযুক্ত পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। এটা দখলে রাখতে চীন এবং বাগিয়ে নিতে অ্যামেরিকা মরিয়া হয়ে আছে। এই ভূ-ভাগকে কেন্দ্র করে বারবার সামরিক মহড়া ও পালটা মহড়া চলে আসছে।
.
[১২] দক্ষিণ কোরিয়া; চীনের পিঠে মার্কিন বিষফোঁড়া। মার্কিন রাডার টার্মিনাল, এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার এর বহিঃনোঙ্গর ও রিফুয়েলিং স্টেশন এবং পূর্ব চীন সাগরে আধিপত্য অব্যাহত রাখার জন্য এটি বিশেষ উপযুক্ত পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। চীন আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার পূর্বে থেকেই অ্যামেরিকা একে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। একে জোটে পাবার জন্য চীন সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
.....
এছাড়াও , ক্রুশিয়াল জিওস্ট্রাটেজিক লোকেশনের মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, জর্জিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পানামা, সার্বিয়া, সোমালিয়া ও ডেনমার্ক। সৌদি আরব একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তিশালী দেশ হচ্ছে ইরান, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া।
.
বর্তমানে আধিপত্যবাদী পরাশক্তিধর দেশ হচ্ছে অ্যামেরিকা, রাশিয়া ও চীন। জার্মানি ও ফ্র্যান্স ন্যাটোর প্রতি এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অ্যামেরিকার প্রতি আস্থা রেখে চলছে। উত্তর কোরিয়া হচ্ছে চীন ও রাশিয়ার অক্ষ। আবার, পারমাণু শক্তিধর দেশ না হয়েও সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় একটি বিশাল আধিপত্য বলয় তৈরি করে ফেলেছে।
.
✍Mohammad Salimullah
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৮