বিংশ শতাব্দীতে এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। তাঁর ইসলামি দর্শনভিত্তিক সাহিত্য ও তাফসির সারা বিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপকহারে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়ে আসছে।তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক,সংগঠক ও মুজতাহিদ।
এখন পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে ইসলামি আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা ও দর্শনের প্রভাব সবচাইতে বেশি।তিনি হলেন বিশ্বজননীন ইসলামি বিপ্লব সৃষ্টি ও পুনর্জাগরণের রূপকার।সারা বিশ্বের অগণিত যুবক তো বটেই,এমনকি অসংখ্য আলেম ও গবেষক তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি ইসলামকে তাঁর সাহিত্য,গবেষণা ও কর্মপন্থার মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে পেশ করেছেন।
লোকেরা যখন ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে মানতে শুরু করেছিলো এবং তাকে রাজনীতি অর্থনীতি ও সমাজ সংস্কৃতি থেকে গুটিয়ে মসজিদ ও খানকায় সীমাবদ্ধ করেছিলো তখন তিনি দৃঢ় হস্তে কলম ধরেন এবং ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ও সর্বজনীন বিপ্লব হিসেবে তুলে ধরেন।তিনি ইসলামি চিন্তা ও দর্শনের সঠিক রূপায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতে ইসলামি নামক বিপ্লবী সংগঠন এবং গড়ে তোলেন ইসলামি আন্দোলন।তিনি ইসলামি আন্দোলনের পরিধিকে অনেক বিস্তৃত হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) ইসলামি আন্দোলনের পরিধির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
"দুনিয়াতে জামায়াতে ইসলামীর জন্য করার যে কাজ রয়েছে,সে সম্পর্কে কোনো সীমিত ধারণা পোষণ করবেন না।তার কাজের পরিধির মধ্যে রয়েছে পূর্ণ প্রসারতাসহ গোটা মানব জীবন।ইসলাম সকল মানুষের জন্য এবং যেসব বস্তুর সাথে মানুষের সম্পর্ক,ইসলামের সাথেও সেসবের সম্পর্ক রয়েছে।অতএব ইসলামী আন্দোলন এক সর্বব্যাপী আন্দোলন।"(একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়,আব্বাস আলী খান,পৃ.৮)।
পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম মাওলানা তারিক
জামিল মাওলানা মওদূদীর সম্পর্কে বলেন,
"মাওলানা মওদুদী (রহ.)অনেক উচুঁ মানের একজন আলেমে দ্বীন ছিলেন। তিনি আলাদা কোন মাযহাব বা ফেরকা তৈরি করেন নি। মাওলানা ইসলামের অনেক বড়ো খেদমত করছেন। আলাদা কোন ফিকহ তৈরি করেন নি! আলাদা কোন ইজতিহাদ করেননি! তিনি হানাফি মাযহাবের খাঁটি অনুসারী এবং বড়ো হানাফি আলেম ছিলেন। সারা বিশ্বের কাছে ইসলামকে অত্যন্ত চমৎকার এবং যুগোপযোগী হিসেবে উপস্থাপনা করেছেন। ইসলামের আলোকে বিভিন্ন মতবাদ গুলোর বিশেষ করে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ত্রুটি ও বর্জনীয় দিকগুলো তুলে ধরতে পেরেছেন তাঁর বিকল্প আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি!"
মাওলানা মওদূদী সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে
উপমহাদেশে একটি সফল সাহিত্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।তার সাহিত্য চর্চা নিছক সাহিত্য চর্চা ছিলো না,বরং তা ছিলো একটি সাহিত্যিক যুদ্ধ।চতুর্দিক থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে জাহিলিয়াতের যে প্রস্রবণ শুরু হয়েছিলো তিনি সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে তার উপযুক্ত জবাব দেন।তার শাণিত লেখার স্রোতে জাহিলিয়াতের ভেতর বাহির ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিলো।
তার মতো খুব কম লোকই সাহিত্য দিয়ে অনর্গল যু্দ্ধ করেছেন।সাহিত্য দিয়ে তিনি বিরুদ্ধবাদী সাহিত্যকে আঘাত করেছেন,চিন্তা ও যুক্তি দ্বারা অপর মতবাদকে ধ্বসিয়ে দিয়েছেন।সেই মহান সংগ্রামের কিছু চিত্রপট তুলে ধরা হলো-
এক. আল-জিহাদু ফিল ইসলামঃ
স্বামী শ্রদ্ধানন্দ হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপটে ভারতজুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূচনা হয়।ফলশ্রুতিতে জিহাদের অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার শুরু হয়।বিভিন্ন মহল থেকে জিহাদের বিরুদ্ধে অপবাদ রটানো হয়।সেই সময় সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী "আল-জিহাদু ফিল ইসলাম" শীর্ষক গ্রন্থ লিখে জিহাদের অপব্যাখ্যার জবাব দেন।
দুই. ইসলাম ও জাতীয়তাবাদঃ
ভারতবর্ষের অন্যতম বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)"মুত্তাহিদা কওমিয়াত আওর ইসলাম" বা একজাতিতত্ত্ব নামে গ্রন্থ লিখেন এবং তাতে প্রচার করেন হিন্দু মুসলমান এক জাতি।এ মতবাদের মাধ্যমে কংগ্রেস ফায়দা লাভ করতে থাকে।
মাওলানা মওদূদী তার এ চিন্তাধারাকে বিভ্রান্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তার চিন্তাকে খন্ডন করে লিখেন "মাসালায়ে কওমিয়াত"।তার এই গ্রন্থ পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করে।ফলে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে তা প্রকাশ ও প্রচার করা হয়।
"১৯৩৯ সালে মাওলানা মওদূদী 'মাসলায়ে কাওমিয়াত' নামে যে বই লিখেছিলেন তা মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঐ বছরই তিনবার মুদ্রণ করে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। কারণ ভারতীয় কংগ্রেসের একজাতি তত্ত্বের পক্ষে ইসলামের দোহাই দিয়ে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের নেতা মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর 'মুত্তাহিদা কাওমিয়্যাত আওর ইসলাম' নামক এক ভাষণের দ্বারা মুসলিম লীগের 'Two Nation Theory' (দ্বিজাতি তত্ত্ব) সম্পর্কে মুসলিম জাতির মধ্যে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল।
মাওলানা মওদূদীর ঐ বইটি মাওলানা মাদানীর ঐ ভাষণের সকল যুক্তি কুরআন, হাদীস ও ইসলামের ইতিহাসের যুক্তি দিয়ে বলিষ্ঠভাবে খন্ডন করেন। তাই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ মাওলানা মওদূদীর বইটিকে অত্যন্ত মজবুত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ঐ বইটি মুসলিম লীগের জনসভায় পড়ে শুনানো হত। (জীবনে যা দেখলাম,অধ্যাপক গোলাম আযম,পঞ্চম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ১০১-১০২)
তিন.ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ঃ
মুসলিমলীগ যখন ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভুল কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকে এবং তাদের আখলাক থেকে ইসলামি চিন্তা ও কর্মসূহ সরিয়ে ফেলে তখন মাওলানা তাদের কর্মনীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং লিখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "ইসলামি হুকুমত কিসতরাহ কায়েম হোতি হ্যায়" তথা ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি মুসলিমলীগের কর্মনীতিতে চপেটাঘাত করেন।
চার. সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদাঃ
জাল হাদিসের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং জবাব দিয়েছেন। মাওলানা আমীন ইসলাহী সাহেবের উস্তাদ মাওলানা হামীদুদ্দীন এর হাদিসের বিরোধিতা করাতে কঠোর সমালোচনা করেছেন। এইসব বিভ্রান্তির কঠোর জবাব দিয়েছেন।উপমহাদেশে হাদিস-বিরোধী আন্দোলন মাথাচারা দিয়ে উঠলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং
তাদের ভ্রান্ত ধারণা খন্ডন করে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ- "সুন্নাতে রাসূলকি আইনি হাইসিয়্যাত" ।এতে সুন্নতের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন এবং তার আইনগত মর্যাদা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে উপস্থাপিত করেছেন।
পাঁচ. কাদিয়ানী সমস্যাঃ
হিন্দুস্তানে সাইয়েদ আহমদ শহীদ জিহাদের আন্দোলন শুরু করেন।এতে মুসলমানদের মধ্যে জিহাদের ও কোরবানির স্পৃহা আগুনের ন্যায় জ্বলে ওঠে। এদিকে সুদানে শাইখ মুহাম্মদ সুদানী (রহ.) জিহাদের ডাক দেন। তাতে সুদানে বৃটিশ ক্ষমতার কম্পন শুরু হয়।অন্যদিকে সাইয়েদ জামালুদ্দিন আফগানি প্যান ইসলামি আন্দোলনের সূচনা করেন। এতে ইংরেজরা খুবই ভীতসন্ত্রস্ত হন। তারা চিন্তা করতে থাকেন,কীভাবে মুসলমানদের এ উত্থান ঠেকানো যায়।এ চিন্তারই বিষবৃক্ষ হলো- কাদিয়ানী মতবাদ।তাদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদে মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী উপমহাদেশে কাদিয়ানী মতবাদ প্রসব করেন এবং এর উপর বহু গ্রন্থ রচনা করেন।তাদের মুখপত্র ছিলো-আল-ফজল।এ মতবাদের প্রচারে মুসলমানরা দ্বিধাবিভক্ত হতে থাকে, লাভবান হয় ব্রিটিশরা।তখনই কলম হাতে সিংহের মতো গর্জে ওঠেন মাওলানা মওদূদী।
মাওলানা মওদূদী (রহ.) ১৯৫৩ সালে ''কাদিয়ানী সমস্যা'' নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম প্রমাণিত করেন। ফলে ইতিহাসখ্যাত বড়ো রকমের কাদিয়ানী বিরোধী হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেকগুলো সংগঠন একযোগে কাদিয়ানীদেরকে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তারা সর্বদলীয় কনভেনশনে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে 'ডাইরেক্ট একশন কমিটি' গঠন করে। জামায়াতে ইসলামি এই কমিটির বিরোধিতা করে অহিংস আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু তথাপি মার্চ মাসের শুরুতে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে এবং পুলিশের গুলিতে কিছু লোক নিহত হয়। পরে একটি সামরিক আদালত মাওলানাকে এই গোলযোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়, (যদিও কাদিয়ানী সমস্যা নামক বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি)। অবশ্য সেই মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়নি।মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর চাপ এবং দেশী বিদেশী মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনুরোধ ও বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের কারণে মৃত্যুদন্ডাদেশ পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড করা হয়, কিন্তু পরে তা-ও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
ছয়. পর্দা ও ইসলামঃ
পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার প্রভাবে অনেক মুসলিমরা বিভ্রান্ত হন এবং পর্দা ও অন্যান্য প্রথার বিরুদ্ধে তারা আওয়াজ তোলেন।যেমন কাসিম আমীন(১৮৬৫-১৯০৪) খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রচারণায় পর্দা, বহুবিবাহ ও ডিভোর্সের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।তিনি ১৯০১ সালে তার রচিত "দি নিউ উইম্যান" গ্রন্থে পর্দাবিরোধী চিন্তাধারা তুলে ধরেন।
এসব আক্রমণাত্বক বিরোধিতার জবাবে ইসলামিক স্কলাররা আত্মরক্ষামুলক জবাব দিতে থাকেন।সেই জবাবের পরাজিত ভঙ্গি গ্রহণ করতে পারলেন না মাওলানা মওদূদী। সেই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে মাওলানা লিখেছিলেন "পর্দা ও ইসলাম" নামক গ্রন্থটি।
এই গ্রন্থে তিনি পাশ্চাত্যের ভ্রান্ত চিন্তাধারা ও
ইসলামি পর্দার স্বরূপ তুলে ধরেন।
সাত. ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণঃ
ইউরোপ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের সূচনা হয়,এ ধাক্কা লাগে মুসলিম দেশসমূহে।নামধারী মুসলিম ও সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা এ আন্দোলনকে টেনে আনেন মুসলিম বিশ্বে।ফলে তা ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করে।ম্যালথাসের ভ্রান্তচিন্তা ফলাও করে প্রচার করা হয়।মাওলানা মওদূদী আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে জন্মনিয়ন্তণ আন্দোলনের কুফলসমূহ তুলে ধরেন। সেই চিন্তাধারা স্থান পেয়েছে তার রচিত "ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ" নামক গ্রন্থে।
এভাবে তিনি একটি যুগান্তকারী সাহিত্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন।উম্মাহর চিন্তার পরিশুদ্ধিকরণে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন।তিনি বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের পুনর্জাগরণ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন।নির্মাণ করেন অসংখ্য সাহিত্য।তাঁর রচনাবলি বিশ্বের ৪০ টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।সেই সব সাহিত্য আজও দেশে দেশে ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের কর্মীদের হৃদয়ের চুল্লিতে অনন্য জ্বালানি শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
-জি.মোস্তফা এর ওয়াল থেকে সংগৃহিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৩