প্রতিবেশি
মাত্র সাড়ে তিনগজ দূরত্ব আমাদের কিচেনের জানালা ও তাদের কিচেনের জানালা, রান্নার সময় ঐ পরিবারের রাধুনীকে প্রায়ই দেখা যায়, কালে-ভদ্রে চোখা-চোখিও হয় তবে দ্বিতীয়বার দেখার চেষ্টা কখনো করিনি। গত রমজানে ইচেছ হয়েছিল প্রতিবেশির হক আদায় করার এই সুযোগটি নিব। একটু আতঁলেমি হবে ভেবে আবার পিছিয়ে যায়। রাতে তারাবিহ নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার সময় লিফটে ঐ প্রতিবেশি ভদ্রলোককে দেখি প্রতিদিনই তাকে সালাম দিই আওয়াজ করে, ওনি মাথা দোলায় শুধু। একবার অনেকটা গায়ে পড়ে জিগ্যেস করলাম- ভাইজান কেমন আছেন?
এক কথায় উত্তর- ভালো, এরপর থেকে এত্তো মুডি ভদ্রলোকের সাথে কখনো কথা বলিনি আমারও ইচ্ছে নেয়ে গেছিল। ছয় ফ্ল্যাটের একেকটা ইউনিট। প্রতিদিনই প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের দেখা হচ্ছে এমনকি লিফটে উঠা-নামার সময় একজনের গায়ের গন্ধ আরেকজনে পায় কিন্তু কথা হয় না কারো সাথে কারো। প্রত্যেকেই যেন এক একটা রক্ত মাংশের রোবট। অথচ মসজিদে গেলে প্রত্যেকেই একই কাতারে লাইনে দাড়ায়, একই সময়ে ইফতার করি, একই বিল্ডিং এর ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটে থাকি, জোৎসনা দেখতে অনেকেই একত্রে ছাদে উঠি- ছাদে উঠে একত্রে বৃষ্টিতে ভিজি কিন্তু মজা নিই ভিন্ন ভিন্ন। ওরাই আমার প্রতিবেশি। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের শাহজাদপুর। বাচ্চাদের সাথে মিশার লোভ কখনোই আমি সামলাতে পারিনা, প্রথম থেকেই কারণে অকারণে বাচ্চাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য কয়েকটা বাচ্চার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, তবে সব বাচ্চার মধ্যেই দেখলাম শূন্যতা এবং সীমাবদ্ধতা। যাইহোক, ১১ রমজানের মধ্যরাত হতেই পাশের ফ্ল্যাটের চিৎকার করে কান্নাকাটির শব্দ পাচ্ছিলাম। উকিঁঝুকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিলাম, দু'ফ্ল্যাটের দু'জানালার সংযোগস্থলে এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম ঐ বাসার রাধুঁনীকে মনে মনে খুজছিলাম। কাউকে দেখা যাচ্ছিলনা কিন্তু কান্নার শব্দ থেমে থেমে বড়-ছোট হচ্ছিল। এই অবস্থা দীর্ঘ হওয়াতে অনেক সাহস নিয়ে বের হয়ে কলিং বেল টিপছি। কয়েকবার বেল টিফার পর মাঝ বয়সি এক ভদ্রলোক বের হলেন কান্না কাটি করতে করতে। দরজা খুলেই জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? এত্তরাতে ভদ্রলোকের বাড়িতে কলিং বেল দিচ্ছেন কেন?
কোন বিপদ হয়েছে কিনা আপনারা কাদঁতেছেন কেন এ জন্য ডির্স্টাব করলাম।
ভদ্রলোক শুধু বললেন- ওনি সম্ভবত মারা গেছেন!
কে মারা গেছেন একটু দেখতে পারি? ওনি বললেন- মা।
বললাম ডাক্তার কল করেছেন, আমি কি একটু দেখতে পারি?
ওনি বিরক্তি হয়ে অনেকটা জাড়ি দিয়েই বল্লেন- আপনার সমস্যা কি, এখন যান!!!!
এই আমাদের ঢাকার প্রতিবেশি। রুমে গিয়ে অস্থিরতায় ঘুমাতে পারিনি। সেহেরী করে ফজর নামাজ পড়তে গিয়ে জানতে পারি প্রতিবেশির ফ্ল্যাটে একজন মা মারা গেছেন।
সকালে যথারীতি যান্ত্রিক জীবনে অর্থাৎ যার যার কর্মজীবনে বের হয়ে গেছিলাম। ইহাই আমাদের ঢাকা। ইহাই আমাদের প্রতিবেশী। আমরা পাশের ফ্ল্যাটের খবর পায় অনলাইন পত্রিকায় বা দৈনিকে। এখানে প্রতিবেশীর সর্ম্পক বলতে তেমন কিছু নেই- হক বলতে কিছু নেই, আমরা সবাই ডিজিটালাইজড, বিস্তারিত পত্রিকায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৩:১৫