খেরোখাতা : ১ : পড়ুম না আমি কুয়েটে!!!
খেরোখাতা : ২ : সেকেন্ড টাইম!!!
খেরোখাতা : ৩ : হল কথন, সিট যেখানে হতাশার গল্প
এসএসসি পরীক্ষার পরই বন্ধুদের মাঝে প্রাইভেট পড়ার জন্য হুড়াহুড়ি পড়ে গেল। যথারীতি আমিও তাদের সাথে সামিল হলাম। সামিল হলাম এই কারণে নয় যে আমি খুব সিরিয়াস স্টুডেন্ট, কারণ বাসা থেকে বের হওয়ার মতো একটা অজুহাত পাওয়া গেল। সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেয়া কোন ছেলের জন্য যখন তখন বাসা থেকে বের হওয়া একটু মুশকিলই। পরীক্ষার কিছুদিন পরই বিশাল অসহযোগ আন্দোলন করে কিনে ফেললাম সাইকেল। মা কিছুতেই সাইকেল কিনতে দিতে চায় না, আমি কিনবোই। অবশেষে সাইকেলের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সামাজিক সুবিধার বর্ণনা তার সাথে বিশাল অসহযোগ আন্দোলনের মুখে আমাকে সাইকেল কিনে দিতেই হলো। কিছু বুঝি আর না বুঝি দুই তিনটা প্রাইভেট, সাইকেল তার সাথে অফুরন্ত সময় দিনগুলো প্রায় উড়ে চলে গেল। বন্ধুবান্ধব সবাই মোটামোটি কেবি কলেজে পড়বে ঠিক করে রেখেছে। আমারও তাই ইচ্ছা। কারন প্রথম কথা কলেজটা কোএড , তারপর আবার এটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসে। ঘোরাঘুরি করার ব্যাপক সুযোগ সুবিধা। যেতে আসতে হবে বাসে। সুখচিন্তায় আমার ঘুমই আসে না! আস্তে আস্তে রেজল্টের সময় ঘনিয়ে এল আর টেনশনে আমার বন্ধু বান্ধবের স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকল। আমার অবশ্য রেজাল্ট নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা নেই। আমি পাশ করলেই খুশি, টেস্টেও আমার রেজাল্ট ৪ই পার করেনি। সুতরাং রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা ভাবনার প্রশ্নই উঠে না। পড়াশোনা নিয়ে আমার সিরিয়াসনেস বরাবরই কম। রেজাল্টের দিন বিকাল চারটায় ঘুম থেকে উঠে গেলাম রেজাল্ট আনতে। স্কুলে গিয়ে দেখি বিশাল অবস্থা। বন্ধু বান্ধব সবাই তাদের বাবা মা সহ এসে গম্ভীর চেহারা নিয়ে অপেক্ষমান অবস্থায়। এটা দেখে আমার মনে হল এই রেজল্টটা অন্য রেজাল্ট থেকে একটু ভিন্ন হলে হতেও পারে। মোটামোটি নিজেকে এতিম এতিম লাগল। আমার সাথে অবশ্য কেউ যায় নাই। কারন আমার অভিভাবকরা আমার পাশ করা নিয়েই সন্দিহান, গিয়ে মান সম্মান হারানোর কি দরকার! অবশ্য সেটা আমার কারণেই। আমিই বলেছি কমপক্ষে তিনটা সাব্জেক্টে ফেল করবো। গেলে তোমাদের নিজেদের রিস্কে যাবা। রেজাল্ট হল, সেবার মোট ৫৮টা জিপিএ ৫। কিভাবে জানি আমিও পেলাম! ব্যাপারটা যতটুকু সহজে বললাম এতটা সহজ ছিলনা। আমার কাছে এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত রেজাল্ট। সবাই যেখানে আনন্দে আত্মহারা প্রত্যাশিত রেজাল্ট পেয়ে, আমি আত্মহারা অপ্রত্যাশিত রেজাল্টের কারণে। কিভাবে যেন হইহুল্লোড় আর কোলাকোলি করে এক ঘন্টা চলে গেলো। স্কুলের সামনের এক দোকান থেকে বাসার ল্যান্ড ফোনে ফোন করে জানালাম রেজাল্ট। একটু পর দেখি আমার মা হাজির, হাতে এডমিট কার্ড। রেজাল্ট লিস্ট থেকে রোল নাম্বার এডমিট কার্ডের সাথে মিলিয়ে তবে বিশ্বাস করলেন যে আসলেই জিপিএ ৫ পেয়েছি!!! :#> চিন্তা করে নিন ছাত্র হিসেবে আমার অবস্থা! রেজাল্টের পর নিজেকে কেমন জানি মেধাবী মেধাবী মনে হতে থাকল! যে আমি নিজেই নিজের পাশ নিয়ে সন্দিহান ছিলাম আমার কাছে মনে হতে থাকল আরে এসএসসি’র পড়া আবার পড়া নাকি, এমসিকিউ ভালভাবে পড়লেই হয়!! আমি নিজেই নিজের পরিবর্তন দেখে অবাক। রেজাল্টের কিছুদিন পরে টেবুলেশন শিট আসলো। আমার রেজাল্ট দেখে স্কুলের অনেক শিক্ষকই অবাক হয়েছিলেন, আমাকে পছন্দ করেন এমন দুই একজন বাদে। টেবুলেশন শিট দেখে তাদের (আমি নিজে সহ) দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়, কেননা আমি যে “গোল্ডেন” জিপিএ ৫ পেয়েছি! মজার ব্যাপার হচ্ছে, টেবুলেশন শিট আসার পর আমার সাথে শিক্ষকদের আচরন রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেল। ক্লাস টেনে যে শিক্ষক ক্লাস টিচার ছিলেন সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে অপছন্দের ছাত্র ছিলাম আমি, কেননা পুরো ক্লাসে কেবল আমি তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়িনি। রাতারাতি তাঁর কাছে আমি তুই তোকারি থেকে বাবা’র পর্যায়ে চলে গেলাম! কেননা তাঁর বিষয়ে আমাদের পুরো সেকশনে মাত্র দুইজন এ+ পেয়েছে এবং সে দুজনের মাঝে আমিও একজন। জিপিএ ৫ পেয়েই আমার ভাব চরম ভাবে বেড়ে গিয়েছিল আর গোল্ডেন পাওয়ার পর তো হাওয়া মে উড়তা যায়ে টাইপ অবস্থা!! ব্যাপারগুলো খুব উপভোগ করেছি তখন এবং এখনো করি। এর মাঝে আমার বাপজান পড়ে গেলেন মহা ফ্যাসাদে। অতি অতীতে কোন এক সময় তিনি বলেছিলেন জিপিএ ৫ পেলে কম্পিউটার কিনে দেবেন। তখন হয়ত তার মাথাতেই আসে নাই যে ছেলে চড় দিয়ে ক্লাসমেটের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে পারে, সে জিপিএ ৫ পাবে, তাও আবার "গোল্ডেন"! রেজাল্টের পর যথারীতি সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে কম্পিউটার কেনার ধান্ধা করতে থাকলাম, কিন্তু কারও কিনে দেওয়ার ইচ্ছা নাই। এমনিতেই আমার পড়াশোনার আগ্রহ কম। কম্পিউটার কিনে দিলে গোল্লায় যাব এ ব্যাপারে তারা মোটামোটি নিশ্চিত। আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি এমনিতেই গোল্লায় গেছি। কম্পিউটার কিনে দিলে আর খারাপ হওয়ার মতো কিছু নাই। হয়ত কিনেও ফেলতাম, কিন্তু হলনা। কারণ এরই মাঝে ভাল রেজাল্টের কারণে বাবা-মা চিন্তা করতে থাকলেন ঢাকায় ভর্তি করাবেন কিনা। কেননা কেবি কলেজের চারপাশের অতি মনোরম নিসর্গে অভিভূত হয়ে নাকি অনেকেই সেই নিসর্গে হারিয়ে যায়। আর তাঁদের ধারনা আমার দ্বারা সেটা আরও ভালোভাবে সম্ভব। আমার তো মাথায় হাত। কোএডে পড়ার এতো ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু নটর ডেমে গেলে তো আবার সেই একই ঘটনা! তাছাড়া এখানে এতো বন্ধু বান্ধব রেখে ঢাকায় যাওয়া মোটামোটি অসম্ভব! ব্যাপক খোঁজ খবর নেয়া হতে থাকল। সবশেষে যাওয়াই ঠিক হলো। এক সময় আমি নিজেও কনভিন্সড হয়ে গেলাম ঢাকা যাওয়াই ভালো। একে তো পুরোপুরি স্বাধীনতা তাছাড়া আগে কখনো ঢাকা যাইনি। জীবনে প্রথম বার ঢাকা গেলাম কলেজের ভর্তি ফর্ম কিনতে। গিয়েছিলাম ট্রেনে। আমি গিয়ে পুরোপুরি হতাশ। কেননা ইচ্ছা ছিলো ঢাকা নিয়ে শোনা কথাগুলো যেমন জ্যাম ইত্যাদি ইত্যাদি চেখে দেখতে। কিন্তু এ যে দেখি রাস্তা কমলাপুর স্টেশন থেকে রাস্তা পার হলেই কলেজ! যদিও পরে এগুলো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, এখন জরুরী কোন কাজ না হলে ভুলেও ক্যাম্পাসের বাইরে বের হই না। তা ভর্তি হওয়া নিয়ে সে সময় নতুন নিয়ম হলো কোন ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যাবে না। আমি তো মোটামোটি নিশ্চিত চান্স পেয়েই গেছি। তা ভাইভা হলো, বোর্ডে যতদূর মনে পড়ে সুশান্ত স্যার ছিলেন। ১০টা প্রশ্ন ছিলো, ৬টা কি ৭টা পেরেছিলাম। আমার নিশ্চিত টাইপ ভাব স্যারের পছন্দ হয় নাই এবং তিনি তা বলেও দিয়েছিলেন। গ্রুপ ওয়ানের সব সময়ই নাম ডাক। মনে হয় সুশান্ত স্যারের কারণেই সেখানে হয় নাই এবং সে জন্য স্যারকে ধন্যবাদ। যেদিন ক্লাস শুরু হলো গিয়ে দেখি আমি গ্রুপ ফোরে। সেখানকার গল্প আরেক দিন হবে...
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১০ সকাল ১১:২৮