একজন বিপ্লবী নারী, একজন সাম্যবাদী যোদ্ধা, একজন সাধক, একজন দরদী কণ্ঠশিল্পী, একটি গানের পাখি, একজন স্ত্রী আর একজন মা, আসলে তাঁকে যে নামেই আখ্যায়িত করি তিনি ফিরোজা বেগম।
নজরুল গীতি সম্পর্কে কিছু বুঝার বয়স যখন আমার হয় নি। তখন বড় বোনের কাছে প্রথম শুনি শ্রদ্ধেয় ফিরোজা বেগম এবং তাঁর স্বামী কমল দাশগুপ্ত এর নাম। তারপরে সময়ের সাথে বিমুগ্ধ হয়েছি তাঁর কণ্ঠের যাদুতে। তিনি চলে গেছেন আজ সাত দিন। তাঁর চলে যাওয়ার আগে জানতাম তাঁকে শ্রদ্ধা করি, তাঁকে ভালোবাসি কিন্তু তাঁর জন্য কাঁদবো একথা আমি নিজেও জানতাম না। ভেবেছিলাম শ্রদ্ধা নিবেদনে সাত দিন অন্য প্রসঙ্গ নয়, অন্য স্ট্যাটাস দেয়া নয় শুধু তাঁর কণ্ঠের গানই শুনবো যেমনটি শুনেছিলাম শ্রদ্ধেয় শিল্পী মান্না দে এর চলে যাওয়ার পরে। এর মাঝে বিভিন্ন বিতর্ক এসে মনটাকে বিক্ষিপ্ত করেছে। আমি দেখে শুনে বেদনা এবং লজ্জায় মূক হয়েছি। চলার পথে বাধা বিতর্কই হয়তো বা শিল্পী ফিরোজা বেগমকে আরো মহান করে তুলেছে।
কবি নজরুলের গানকে ভালোবেসে, নজরুল গীতিকে প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিতীয় কেউ জন্ম নিবেন কিনা জানি না।
শিল্পী ফিরোজা বেগম এর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যে যত কথাই বলুক না কেন আমার মতে সাম্যবাদকে প্রতিষ্ঠা দিতেই হয়তো জীবন সঙ্গী হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় শিল্পী ও সুরকার কমল দাশগুপ্তকে। সেদিন চ্যানেল আই তে শিল্পী সুস্মিতা আনিস (নাম সম্পর্কে নিশ্চিত নই) গান গাওয়ার ফাঁকে বলছিলেন ‘আমার ফুফা কমল দাশগুপ্ত এর খ্যাতির কথা সেভাবে প্রচারিত হয় নাই...’ শুনে আমার ভালো খুব লেগেছিলো। একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে নারী’রা ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সুন্দর একটি প্রোফাইল পিকচার দিয়ে নিরাপদ নয় সেখানে ফিরোজা বেগম এর মতো গুণী এবং সুন্দরী নারীকে রক্ষণশীল পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়েছে। অল্প বয়সে (আজকাল চল্লিশ বছরকে অল্প বয়সই মনে করা হয়) অকাল বৈধব্যের অভিশাপ নিয়ে তিনটি সন্তান সহ জীবন কাটাতে হয়েছে। সে জীবন কতটা কঠিন ছিলো সে কথা আর কেউ না হোক একজন নারীর পক্ষে অনুমান করা কঠিন হওয়া উচিৎ নয়।
শ্রদ্ধেয় শিল্পী ফিরোজা বেগম চলে যাবার পরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যারা কথা তুলেছেন তারা নারী। কোন পুরুষ তাঁকে নিয়ে সত্য মিথ্যা নোংরা কথা লেখেন নাই (অন্তত আমার চোখে পড়ে নাই)।
নিজেকে নারী বলে পরিচয় দিতে লজ্জিত না হওয়ার কারণ খুঁজে পাই না। আজ এসব কথা লেখার দিন নয়। জনৈক এক লেখিকার লেখা পড়েই এতো সব কথা লিখতে হলো।
মানবিক দীনতা থেকে মানুষকে অনেক সময় অমানুষের মতো আচরণ করতে দেখা যায় এটাই সান্ত্বনা।
পরিশেষে -
সাত দিন নয়
সাত মাস নয়
সাত বছর নয়
সাত যুগও নয়
যুগ যুগ ধরে ফিরোজা বেগমকে হারানোর শোক আমাদের বহন করতে হবে
আর একই মাটিতে জন্ম নিয়ে প্রিয় শিল্পী ফিরোজা বেগম, তোমার সাথে আমার দেখা হলো না এই কষ্ট নিয়ে আমি কাটাবো বাকিটা জীবন...
১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪