বর্তমান যুগের কৈশোর কি আসলেই কৈশোর? নাকি কিশোর বয়স থেকে ভবিষ্যত চিন্তা করাই কৈশোর?
টিউশনে ছাত্রকে পড়ানোর এক পর্যায়ে অনুমতি নিয়ে সে বাথরুমে গেল। আবার পড়ার টেবিলে ফিরে আসার পর দেখলাম তার চেহারা কালো হয়ে আছে। বিষন্ন মন। ঠিক যেমন সূর্যের সাথে আড়ি দেওয়া মেঘ। দুই মিনিট পর আন্টি এসে বলল ছাত্র আমার ভেতরে গিয়ে নাকি কান্নাকাটি করেছে। শুনে তো অবাক। ভাবলাম পড়া বুঝতেছে না বলেই কি মেধাবী ছাত্রের এই কান্নাকাটি! নাহ, ঘটনা সেটা না। বিকেলে খেলতে পারে নাই বলে এত বড় ছেলের কান্নাকাটি। আন্টির অনুরোধ আমি যেন ঠিক বিকেল চারটায় উনাদের বাসায় উপস্থিত হয়। এই অনুরোধের মূল কারন হল আমার ছাত্র যেন বিকেলে না খেলে পড়ালেখা করে নিজের ভবিষ্যত গঠনে মনোযোগ দেয়। আন্টির অনুরোধ রাখতে আমি বাধ্য আমার অবস্থানগত কারনে।
ছাত্রের সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষার পরে আজকেই প্রথম দিন ছিল। হয়ত সে আশায় বুক বেধেছিল আজকের দিনটা অন্তত সে খেলতে পারবে। মিথ্যা আশায় আশাহত হয়েছে আমার মেধাবী ছাত্রটা। আমার ছাত্রকে মেধাবী বলছি কারন সে ভাল মানের ফাঁকিবাজ হলেও ক্লাসের রোল প্রথম দিকে এবং তার বাবা-মা চায় সে আরো ভাল রেজাল্ট করুক। যতটুকু তাকে বুঝেছি তার সারমর্ম হল আসলেই সে মেধাবী ও ভাল ছাত্র দুইটাই। আমার ছাত্রের সমস্যা আর কষ্টটা আমি বুঝি। তাই তার পরীক্ষার আগে ইচ্ছা করেই কয়েকদিন দেরিতে গিয়েছিলাম যাতে সে কিছুক্ষণ হলেও খেলতে পারে।
এবার আমার দিকটাতে আসি। বড় হয়েছি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি একটি গ্রামে। সেই ছোটবেলার আমি আর আমার ছাত্রের মধ্যে ব্যাপক মিল আছে। আমরা দুইজনই খেলতে না পারলে পড়ালেখায় মন বসে না আর ফাঁকিবাঝি করতে না পারলে পেটের ভাত হজম হয় না টাইপের। আমি বড় হয়েছি গ্রামের অবারিত-অফুরন্ত-বিশুদ্ধ বাতাসের নিঃশ্বাস নিয়ে। তপ্ত, কাঠফাটা রোদে গায়ের চামড়ার রঙ পরিবর্তন করে। আর আমার ছাত্রটা চার দেয়ালে বন্দি। স্কুলে যাওয়ার সময় কিছু যান্ত্রিক ধোঁয়া নাকে ঢুকিয়ে বাসায় ফিরে সে। হয়ত ছুটির দিনের রোদের আলোয় সে খেলতেই পারে না। বড় হয়েছি জীবন নিয়ে এক প্রকার খেলতে খেলতে। সোনালি কৈশোরগুলো পেছনে ফেলে কবে যে বড় হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। স্কুলের পাশে যে বিশাল মাঠ ছিল সেটাতে হাজিরা দিতাম প্রতিদিন। আর আমার ছাত্রটার মাঠ হল তাদের বিল্ডিং এর নিচের পার্কিং স্পেসটা। তাহলে আমার মেধাবী ছাত্রের জগত কি ৩-৪টা কারের সমান যায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে! থাকলেও থাকাটা অন্যায়। কারন সে আমার ছাত্র।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় গোসল করার জন্য পুকুর নামের ইয়া বড় একটা বাথটাব ছিল। যতক্ষণ গেজেঁলদের মত চোখ লাল হত না, যতক্ষণ পুকুরের জল পুরোপুরি ঘোলা হত না ততক্ষণ সাঁতরে চষে ফেলতাম পুকুরটা। পুকুর পাড়ের কলাগাছ থেকে চুরি যেত কলা, প্রতিদিন। আর আমার ছাত্রকে বাথটাবকেই পুকুর মনে করতে হবে কেন! আমার রাগী বাবা যেমন রাগ নামক স্বর্গীয় জিনিসটা এক পাশে রেখে আমাকে কোলে করে পানিতে নামিয়ে সাঁতার শিখিয়েছে ছোটবেলায়, তেমনি আমার মেধাবী ছাত্রটারও অধিকার ছিল সাঁতার শিখার। কেউ একজন তাকে সাঁতার শেখাবে এই অধিকার তার প্রাপ্য ছিল। আমার ছাত্রটাকে তার কোন দুষ্ট বন্ধু যদি দুষ্টামির ছলে পুকুরে ধাক্কা দেয় তখন তার সম্ভাব্য পরিণতি কি হতে পারে তা চিন্তা করতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলি।
আমার ছাত্রের চাওয়া কিন্তু খুব অল্প। শুধু বিকেলে একটু ক্রিকেট খেলার অনুমতি আর সময় চায় সে। আর তার এই চাওয়াটা পিষ্ট হয় অনেকগুলো বইভর্তি ভারি একটি স্কুল ব্যাগের সৌজন্যে।
সে কিভাবে ক্রিকেট শিখেছে জানিনা, তবে আমাকে শিখিয়েছে আমার বাবা। উনার রাগ নামক স্বর্গীয় জিনিসটাকে এক পাশে রেখে দিয়ে। উনার স্বর্গীয় রাগের তোপে পড়েছি অনেকবার। ঠিক সময়ে পড়া বুঝিয়ে দিতে না পেরে একবার এমন ধোলাই পড়ল যে রাত একটায় বাজার থেকে প্যারাসিটামল আনিয়ে খেতে হয়েছিল। নিজ থেকে তাগিদ অনুভব করে বাবা আমাকে ক্রিকেট আর সাঁতার শিখিয়েছিল বলে সেই আঘাতগুলো গায়ে লাগলেও কলিজাতে লাগে নাই। আফসোস লাগে এই ভেবে যে আমার ছাত্রসহ বর্তমানের মেধাবী ছাত্রদের চাওয়া-পাওয়া, আবেগগুলো একটি ভারি ব্যাগ কিংবা একটি কঠোর আদেশের চাপ অগ্রাহ্য করতে না পেরে অনুভুতিশুন্য হয়ে অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়।
গ্রামের যে ছেলেটি গায়ে কাঁদা মেখে কাঁদামুক্ত হওয়ার জন্য পুকুরে নামত, পুকুর থেকে উঠত পুকুরের পানি ঘোলা করে আর চোখ লাল করে সে ছেলেটি আজ শহরে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই শহরে আছে বলা যায়। গ্রামের সেই কর্দমাক্ত ছেলেটি শহরে এসে আজ তার মেধাবী ছাত্রের সাথে কৈশোরের সোনালী স্মৃতি রোমন্থন করে আর ছাত্রটি আফসোস করে সে ও যদি গ্রামে বড় হত তাহলে বোধ হয় মন্দ হত না।
দেশের অধিকাংশ স্কুল ছাত্রের অবস্থা এর ব্যাতিক্রম নয়। বন্ধুদের নিয়ে এরা আর মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে পারে না। সাঁতার প্রতিযোগিতা দেই না বধুদের নিয়ে। দল বেধে চুরি করে খাওয়ার মজাটা এরা পায় না। স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে হাউস টিউটরদের ভিড়ে আর ঘুমাতে পারেনা। বিকেলটা মাটি না হয়ে কংক্রিট হয়ে যায়। পাঠ্যবই এর নিচে লুকিয়ে গল্পের বই এরা পড়তে পারেনা। স্কুল ফাকি দিয়ে মেলায় যেতে পারেনা। ক্লাসের পেছনের দরজা দিয়ে বের হতে পারাটাই এদের কাছে ভাগ্যের ব্যাপার। প্রাইভেটে যাওয়ার নাম করে বের হয়ে লম্বা একটা সাইকেল ট্যুর দেওয়ার মত ভাগ্য এদের হয়না। কৈশোরটা সোনালী করে রাখতে গেলেই এদের অভিবাবকেরা এদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করে কপালে বয়সের বলিরেখা বানিয়ে ফেলে।
আমার ছাত্রের অভিবাবকরা তাদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত আর আমি আমার ছাত্রের কৈশোরটা সোনালী না হওয়ার জন্য দুঃখিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:০১