রশিদ সাহেব মাজায় হাত দিয়ে মুখ বিকৃত করে একটা গালি দিলেন।
বউয়ের সাথে বসে টিভি দেখছেন বলে, বা পাশে ছেলেটা কম্পিউটারে গেম খেলছে বলেই কি না- তাঁর গালিটা তেমন যুৎসই হল না। ঠোঁট সূচালো করে গালি দেওয়ার আনন্দ পাওয়া গেল না, কারো বাপ-মাকে জড়ান গেল না; কেবল একটা ভদ্রমতন 'শালা' দিয়ে কাজ সারতে হল। গালিটা দিয়ে তিনি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে কিনা। উঁহু, দুজনের কারোরই কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, আগের মতই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
রশিদ সাহেব আবার চেষ্টা করলেন, 'উফ, মাঞ্জার ব্যথাটা শেষ কৈরা ফালাইল। সিফাতের মা, কি করি কও তো?'
'সিফাতের মা' টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলেন, 'মাঞ্জা তো ব্যথা করবই- সকালে উইঠা এট্টু হাঁটাহাঁটি-দৌড়াদৌড়ি করতে পারেন না? সারাদিন এম্নে শুইয়া-বয়া থাকলে একদিন হাড্ডিতে জং ধইরা যাব নি।'
রশিদ সাহেব প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেলেন। তিনি মোটেও সারাদিন শুয়ে বসে থাকেন না। প্রতিদিন সকালে তিনি আটটায় ওঠেন, দশটায় বন্ধু মিজানের সাথে পার্টনারশিপ করে গড়া মিল-টায় যান। যুবক বয়সে মাত্র কয়েক লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ন্যাংটোকালের বন্ধুর সাথে ব্যবসায় নেমেছিলেন, এই মিল দিয়েছিলেন- ঝুঁকি কম ছিল না। কিন্তু সেই ঝুঁকির বদৌলতে আজ তিনি আর তাঁর বন্ধু- দুজনেই আর্থিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মিল-টা একটা তেলের মিল, সবকিছু মিলিয়ে ভালই বেচাকেনা হয়। রশিদ সাহেব মিজানের সাথে কথাবার্তা বলেন, একাউন্টের খাতাপত্র চেক করেন। কর্মচারী সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষ করে একটার দিকে তিনি বাড়িতে এসে পড়েন। এগুলো কি কাজ না? তাঁর কেন হাঁটাহাঁটি-দৌড়াদৌড়ি করতে হবে? কিন্তু মূর্খ মহিলা এসব কি বুঝবে, এদের কিছু বলাই বৃথা।
ছেলেটাও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। ছোটকালে বাপের কি ভক্ত ছিল, এখন খুব একটা কথা বলে না। মায়ের সাথে মাঝেমাঝে কথা কাটাকাটি করে, কিন্তু এমনিতে চুপচাপ। সারাদিন স্কুল-প্রাইভেটে দৌড়াদৌড়ি আর বাড়িতে এসে গেম খেলা। আগে তো ওর ঘরেই কম্পিউটার ছিল, রাত একটা-দুটো পর্যন্ত বসে বসে গেম খেলত। একদিন মিজান বাসায় এসে ঘরের ভেতরে কম্পিউটার দেখে কেমন গম্ভীর হয়ে গেল- রশিদ সাহেবকে ডেকে বলল, 'পুলাপানের ঘরে যন্ত্রপাতি দিছস ক্যা? আজাইরা রাইত জাগব, পড়ালেখার ক্ষতি হইব- বুঝস না? জিনিসটা বাইরে টিভির কাছে বসাইয়া দে, ভালো হইবো।' ব্যস, তারপরেই কম্পিউটারের স্থানান্তর ঘটানো হল, ছেলের গেমের নেশাও কমল অনেকটাই। আচ্ছা, এতো আগ্রহ নিয়ে কি গেম খেলে? কি আছে জিনিসটায়? দেখার জন্য রশিদ সাহেবের কৌতূহল জাগে, তিনি সোফা থেকে উঠে ছেলের পিছে গিয়ে দাঁড়ান। উঠতে গিয়ে ব্যথায় তাঁর মুখ দিয়ে আরেকটা গালি বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায়, কোনোমতে আটকে ফেলেন সেটা।
-'বাপ, কি কর?'
ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়, তারপর আবার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, 'গেম খেলি আব্বা।'
-'কি গেম?'
'অ্যাডভেঞ্চার গেম। তোমারে ধর একটা ম্যাপ দিব, দুই একটা ওয়েপন দিব, তারপর কইব যে অমুক অমুক জিনিস খুইজা বের কর। মাঝে মাঝে দুই একটা বস থাকে, অইগুলা মারতে পারলে পয়েন্ট আছে। এইটুকুই।'
জিনিসটা রশিদ সাহেবের কাছে ভীষণ ইন্টারেস্টিং লাগে। তিনি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আসেন, গেম খেলা দেখতে থাকেন। স্ক্রিনে একটা পুরানো হ্যাট পড়া যুবক লাফিয়ে লাফিয়ে বিশাল বিশাল খানাখন্দ পার হয়ে যাচ্ছে, পেছন থেকে শত্রুর গলা ছুরি দিয়ে ফাঁক করে দিচ্ছে, টারজানের মত দড়ি ঝুলে ঝুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে- এসব জিনিস তাঁর কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। হঠাৎ ছেলে টাকরায় জিভ লাগিয়ে টকটক শব্দ করে ওঠে। হ্যাট পড়া যুবক অনেকগুলো শত্রুর সামনে পড়ে গেছে। হাতে ছুরি বাদে কোন অস্ত্র নেই। যেকোন সময়ে শত্রুর বিষাক্ত তীর ছুটে আসবে। মৃত্যু নিশ্চিত! রশিদ সাহেব টেনশনে পড়ে যান।
হঠাৎ হ্যাট পড়া যুবক সামনে এক লাথি ছোঁড়ে, অদৃশ্য কাউকে তিন-চারবার ঘুষি মারে, তারপর ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। ক্যামেরা স্থির হতেই রশিদ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, যুবকের একহাতে তলোয়ার, আরেক হাতে একটা চারকোণা শিল্ড। শত্রুর তীরগুলো সে শিল্ড দিয়ে প্রতিহত করে, তারপর তলোয়ার দিয়ে তাঁদের কচুকাটা করতে থাকে। একটা সময় সবগুলো শত্রুকে শেষ করে ফেলে যুবক টকাটক পিরামিড বেয়ে উঠে প্রাইজ ছিনিয়ে নেয়। স্ক্রিনে লেখা ভেসে ওঠে, লেভেল ক্লিয়ার!
রশিদ সাহেব অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন ছেলেকে, 'কি করলি বাপ?'
-'কি আব্বা?'
'ঐ যে, তর হাতে তো কিছু ছিল না, হঠাৎ অস্ত্রপাতি পাইলি কোথায়?'
ছেলে বাপের অজ্ঞতায় হাসে, 'ও, অইটা? চিটকোড ইউজ করসি আব্বা। আপ-আপ-আপ, ডাবল স্পেস, তারপরে ডাউন-আপ-ডাউন - এইটা দিলে তোমার শিল্ড আর সর্ড আসে। আরও চিটকোড আছে; লাইফ বাড়ান যায়, লম্বা লম্বা লাফ দেওয়া যায়- দেখবা?'
রশিদ সাহেব মাথা নাড়েন। ছেলে আবার গেম স্টার্ট করে তাকে দেখাতে থাকে বিভিন্ন খুঁটিনাটি। 'এই যে, দেখছ আব্বা, কত্ত বড় লাফ দিল? সেইরকম না? আবার পয়েন্ট বাড়ানোর একটা চিটকোড আছে। একটানে থাউজেন্ড পয়েন্ট আইসা পড়ে। অবশ্য এই চিটকোডে একটু সমস্যা আছে, পাঁচ-ছয়বারের বেশি ইউজ করলে গেমস আটকায়া আটকায়া যায়। তখন পুরা গেম ডিলিট কইরা আবার ইন্সটল দেওয়া লাগে। তাই এইটা কম ইউজ করি....'
সামান্য একটা গেমকে কেন্দ্র করে বাপ ছেলের দূরত্ব অদ্ভুতভাবে কমে যেতে থাকে। ছেলে মন খুলে চোখেমুখে কথা বলে, রশিদ সাহেব আগ্রহ নিয়ে শোনেন। বেশ কিছুক্ষণ পর খাবার জন্য ডাক এল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুজনে উঠে পড়লেন। সেদিন ঘুমোতে যাবার আগে, কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই রশিদ সাহেব মনস্থির করে ফেলেন। কাল থেকে ব্যায়াম-জগিং শুরু করতে হবে।
পরের দিন বন্ধু মিজানের সাথে রশিদ সাহেব পরামর্শ করলেন। মিজান পান চাবাতে চাবাতে বলল, 'ব্যায়াম করবি? আইচ্ছা, আমি সিস্টেম কৈরা দিমুনে। আমার ভাইগ্নার একটা জিম আছে, ওইটায় ভরতি হইয়া যা। আর প্রত্যেকদিন সকালে উইঠা পার্কে দৌড় পারবি। হেহেহে।' জগিংরত রশিদ সাহেবের থলথলে ভুঁড়ির কাপাকাপি কল্পনা করে মিজানের হঠাৎ হাসি পেয়ে যায়। রশিদ সাহেব মিজানের মুখনিঃসৃত উড়ন্ত পানের পিককে গুরুত্ব না দিয়ে মাথা চুলকান, 'দূরো! এতকিছু করতে পারুম না, আইলসামি লাগে। বাড়ির ভিতরে সিস্টেম করন যাব না?' মিজান হাসতে হাসতেই তাকে আশ্বাস দেয়, 'যাঃ, কৈরা দিমুনে। তুই শালা আসলেও আইলসা।'
বিকালেই জিনিসপাতি পৌঁছে যায় রশিদ সাহেবের বাড়িতে। আলাদা একটা রুমে সবকিছু সেট করে দেওয়া হয়। তিনি রুমে ঢুকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কতকিছু পাঠিয়েছে মিজান! সবুজ রঙের ডাম্বেল, সাইকেলের মত একটা যন্ত্র, একটা নীল ম্যাট, হ্যান্ডেল ধরে দৌড়ান যায় এমন একটা যন্ত্র - উফ! দেখেই তাঁর কেমন ক্লান্তি লাগতে থাকে। সবুজ ম্যাটের ওপরে অনেকগুলো বই রাখা। তিনি উপর থেকে চারটে বই খাবলা দিয়ে ধরে শোয়ার ঘরে নিয়ে আসেন। তারপর বিছানায় চিৎ হয়ে বইয়ের নাম দেখতে থাকেন, 'যোগব্যায়ামের ১০১টি আসন', 'হাউ টু কিপ ফিট'- দূরো! ইংলিশ বই ক্যান- 'ব্যায়ামের বিভিন্ন প্রণালী', 'প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যকলার বিবর্তন'। শেষের বিসদৃশ বইটাতে ঘাগরি পড়া এক মহিলার ছবি দেখে রশিদ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। তিনি বইটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেন কিছুক্ষণ। মোটা আছে। শেষ পৃষ্ঠা ১৪৭। একটা বিশাল হাই তুলে তিনি বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টার খোলেন। শিরোনাম - 'পাথরযুগঃ নাচের সূত্রপাত?'।
রশিদ সাহেব ধারণা করেছিলেন আট-নয় পৃষ্ঠা পড়েই তিনি ক্ষান্ত দেবেন। তা ক্ষান্ত তিনি দিলেনও, কিন্তু ঝাড়া সাড়ে তিন ঘণ্টা পর। ছাত্রজীবন তো দূর, জীবনে কখনো এতোটা একাগ্রতা নিয়ে তিনি কোন কিছু পড়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁর চোখ টিপটিপ করছে, ঘাড় নড়াতে পারছেন না- কিন্তু তাঁর বুকের মাঝে অস্থির একটা আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। সম্পূর্ণ অচেনা একটা অনুভূতি। মনে হচ্ছে বইয়ের শব্দগুলো সারা শরীরে ভাগবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, সাথে সাথে ছড়িয়ে দিচ্ছে ছোট ছোট আনন্দ-কণা। একটা কিছুকে জাগিয়ে তুলছে। রশিদ সাহেব কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন বিছানায়। তাঁর মাথার ভেতরে সদ্যসংগৃহীত তথ্যগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে।
হৃদপিণ্ডের ধুকপুক কিছুটা স্থিরগতির হলে তিনি ব্যায়ামের রুমটায় আরেকবার যান। সবুজ ম্যাটের ওপর রাখা বাকি বইগুলো ঘেঁটে দেখেন। উঁহু, নাচের ওপর আর কোন বই নেই। সব অমুক ব্যায়াম তমুক ব্যায়াম নিয়ে। ধুরো! রশিদ সাহেবের মেজাজ মাটি থেকে হঠাৎ করেই টঙে উঠে যায়। ঘরের মাঝে অস্থির হয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন তিনি। তারপর অস্থির হয়ে কল দেন মিজানকে, 'মিজান, ঐ বইগুলা কিনছস কই থিকা?'
মিজান সম্ভবতঃ ভাত খাচ্ছিল। সে গাঁউগাঁউ করে জবাব দেয়, 'কুন বই?'
-'অই যে, আইজকা আমায় বাসায় পাঠাইসস যেগুলা।'
'ও, ওইগুলা তো আমি কিনি নাই, নতুন ক্যাশিয়াররে দিয়া কিনাইছি। ওই যে, আসাদ নাম।'
রশিদ সাহেবের কণ্ঠে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়, 'অর নাম্বার দে।'
মিজান হাসে, 'হে হে। নাইক্কা! কইলাম না, নতুন ক্যাশিয়ার? কাইলকা মিলে আয়, তখন যা কওয়ার কইবি, ঠিকাছে? আর হালার পো, ভাত খাওয়ার সময় কল দেস ক্যা? তর ভা...'
রশিদ সাহেব লাইন কেটে দেন। রাতের খাবারের জন্য স্ত্রীর ডাক শুনতে পান তিনি, 'সিফাতের বাপ--- খাইতে আসেন', কিন্তু জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন আবার। প্রচণ্ড রাগে তাঁর সারা শরীর জ্বালা করে উঠছে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে রশিদ সাহেব আরও বদমেজাজি হয়ে উঠতে থাকেন, পাল্টে যেতে থাকেন। প্রথমে ঐ ক্যাশিয়ারকে দিয়ে নাচের ওপরে অনেকগুলো বই আনান তিনি, কিন্তু পছন্দমত বই না পেয়ে হঠাৎ করেই রেগে যান।। মেজাজ খারাপ করে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন ছোকরাকে। তারপর নিজেই বইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরে বই সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। মিলে যাওয়া-টাওয়া সব বাদ। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘোরেন, তারপর বাড়িতে এসে ব্যায়ামের ঘরটায় ঢুকে আটকে দেন দরজা। এই সময়ে তিনি পারতপক্ষে কারো সাথে কথা বলেন না। রাতে মাঝে মাঝে তাঁর ঘর থেকে দুপদুপ আওয়াজ পাওয়া যায়। আবার সকালে উঠে চলে যান বাইরে। সাথে সাথে নতুন এক স্বভাব হয়েছে- নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন পুতুল সংগ্রহ করা। ঘরের অর্ধেকটা বই, আর বাকি অর্ধেকটা তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুতুলে ভরে ফেলেছেন।
এরকম পরিবর্তন মিজান বা রশিদ সাহেবের স্ত্রী- কারুরই নজর এড়ায় না। দুজনেই তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু রশিদ সাহেবের সাথে কথা বলে তেমন লাভ হল না। তাঁকে জোর করে বসিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, রাগ দেখান। আবার শান্তভাবে কিছু বললে মোটেই মনোযোগ দেন না, কিংবা ভুরূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি মানবজাতির এই সদস্যটির ভাষা বুঝতেই পারছেন না।
অগত্যা একদিন সকালে বাড়ির বাইরে মিজান চেপে ধরে তাকে, 'অই শালা, কি হইসে তর? এইরকম করতাসস ক্যান? ক আমারে। ঝগড়া হইছে ভাবির লগে?'
বরাবরের মতই রশিদ সাহেব উদাস মুখে তাকিয়ে থাকেন, জবাব দেন না কোন।
এবারে মিজান সত্যিই রেগে যায়, রশিদ সাহেবের কলার ঝাঁকিয়ে বলে, 'ক'বি না আমারে? হালার পো, আমি কি মজা করতাসি তর লগে? ভাবির সাথে কথা কস না, বাড়িতে খাস না- আবার মিলেও আহস না। কি করস তুই? ভাবির সাথে ঝগড়া কৈরা এখন বইপত্র পড়ো- বৈরাগি হয়া গেছ? বৈরাগি? আমি জীবনে তরে আউটবই পড়তে দেখলাম না আর তুই বৈরাগি ভাব ধরস আমার সাথে, অ্যাঁ? ক, কই থাকোস সারাদিন- নটিবাড়ি যাস?'
রশিদ সাহেব বিরক্ত হয়ে কলার ছাড়িয়ে নেন, 'তর ভাবির সাথে কোন ঝগড়া হয় নাই। নটিবাড়িও যাই না।'
-'কই যাস তাইলে? আইজকা আমিও যামু তর সাথে। মানা করলে ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিমু একেবারে।'
মিজানের বিধ্বংসী আচরণে বাধ্য হয়ে রশিদ সাহেব তাঁকে নিয়েই একটা বইয়ের দোকানে ঢোকেন। দোকানি নিয়মিত ক্রেতাকে দেখে খুশি হয়ে ওঠে। রশিদ সাহেব ঘুরে ঘুরে বই দেখতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ব্যালে ড্যান্সের ওপরে একটা বই নিয়ে বেরিয়ে আসেন। তারপর যান আরেক দোকানে। এভাবে এক-দু' ঘণ্টা কাটার পরে মিজান ক্লান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'তুই সারাদিন এম্নে কৈরা দোকানে দোকানে ঘুরবি?'
-'হ!', রশিদ সাহেবকে আশ্চর্য দেখায়, 'তাই তো করি প্রত্যেকদিন। ক্যান?'
মিজান মাথার কাছে আঙ্গুল নিয়ে ঘোরানোর ভঙ্গি করে, 'তর মাথার স্ক্রু ঢিলা হইয়া গেছে।'
ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারা একটা ছোটখাটো দোকানে ঢোকেন। অন্ধকার একটা খুপরি। এইটুকু জায়গায় এতগুলো বই এবং দোকানদারটি কিভাবে এঁটে গেছে সেটা একটা বিস্ময়। রশিদ সাহেবের ফরমায়েশে লোকটা একটা ছোট্ট বই বের করে দেয়। মিজান উঁকি মেরে দেখে, বইটার নাম- 'কন্দ্যন নৃত্যের অবতারেরা'। এরকম আরও বই আছে কি না, প্রশ্ন করলে লোকটা তরল কণ্ঠে জবাব দেয়, 'আমার কাছে আর নাই। পাগল বুইড়ার কাছে থাকবার পারে।'
পাগলা বুইড়া! এই ব্যক্তিটি কে এই প্রশ্নের উত্তরে দোকানদার জবাব দেয়, 'এক বুইড়া ব্যাটা, অইমুড়া কলেজ রোডে লাল রঙের বাড়িডায় থাকে। মাথায় মনে অয় ডিস্টাব আছে, একা একা থাকে, আর খালি বই পড়ে। এম্নে বই হ্যাঁর বাসায় শ'য়ে শ'য়ে পইড়া রইছে।'
কিছুক্ষণ পর রশিদ সাহেবকে দেখা যায় লাল বাড়িটার দরজায় নক করতে, মিজান তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে বিরক্তমুখে মাথা নাড়ছে। ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে, চুলে-দাড়িতে মেহেদি মাখানো শীর্ণ একজন বৃদ্ধ দরজা অর্ধেক খুলে মাথা বের করলেন, 'কি চাই?'
রশিদ সাহেব হাতের বইটা তুলে দেখালেন, 'জি, আমার নাম আব্দুর রশিদ। মানে...আমরা এইরকম কয়েকটা বই খুঁজতাছিলাম, নাচের ওপরে আরকি। একজন লাইব্রেরিয়ানের কাছে আপনের কথা শুনলাম...তাই ...' রশিদ সাহেব বাক্য শেষ না করেই থেমে গেলেন।
বইটা দেখে বৃদ্ধের চোখেমুখে তাচ্ছিল্য ফুটল, 'কি, নৃত্যশাস্ত্র পড়ান নাকি কলেজ-টলেজে? কিছু নতুন ফ্যাক্ট শুনিয়ে অবাক করিয়ে দেবেন ছাত্রদের, এই ইচ্ছা?'
- 'না, মানে...'
'তাহলে, নাচের টিচার নিশ্চয়ই? বা উদয়শঙ্কর-শিবলীর ভক্ত, হ্যাঁ? ওসব নিয়ে আমি কিছু জানি না। অন্য কোথাও খুঁজে দেখেন।', এই বলে বৃদ্ধ দরজা লাগিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। রশিদ সাহেব এবারে মরিয়া হয়ে বলে উঠলেন, 'ওইসব কিছু না...আমি আসলে নাচ সম্পর্কে জানবার চাই। মানুষ ক্যান নাচে? আনন্দ পায় ক্যান? নাচ শুরু হইল কিভাবে- এইসব।'
বৃদ্ধ থেমে গিয়ে প্রশ্ন করেন, 'কেন জানতে চান? কি হবে জেনে?'
-'কি জানি! আমার এই সম্পর্কে ক্যান জানি পড়তে ভালো লাগে। মনে হয় শব্দগুলা রক্তের মধ্যে যায়া একটা কিছু করতাসে, খুব আনন্দ লাগে।'
এবারে বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকান রশিদ সাহেবের দিকে, এই প্রথম ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন তাঁকে। তারপর পিছু হটে দরজা খুলে দেন, 'আচ্ছা, আপনি ভেতরে আসুন। পিছনেরটি কে, আপনার বন্ধু? আচ্ছা, উনাকেও আসতে বলুন।' রশিদ সাহেব আর মিজান ঢুকে পড়েন ভিতরে। দোকানি ঠিকই বলেছিল, চারপাশে খালি বই আর বই। ঘরের কোণায় একটা খাট, পাশে একটা চেয়ার- এই দুটো বাদে আর কোন ফার্নিচার নেই বললেই চলে। দেয়াল জুড়ে কাঠের শেলফে থরে থরে বই সাজানো, আরেক কোণায় বিশাল বিশাল তিনটে বুকশেলফ- বইয়ে ভর্তি, এমনকি খাটের মাথার কাছেও সারি করে বই রাখা। দুজনে খাটের ওপরে বসেন। বৃদ্ধ বুকশেলফ থেকে হাতে একটা বই নিয়ে চেয়ারে বসে জেরা করতে শুরু করেন রশিদ সাহেবকে, 'আপনি কখনো নাচের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন?'
-'না।'
'টিভিতে নাচ দেখেছেন কখনো? ভালো লেগেছে ওসব?'
-'দেখছি মাঝে মধ্যে, কিন্তু ভাল লাগে নাই খুব একটা।'
'তাহলে নাচ নিয়ে এতোটা আগ্রহের কারণ কি?'
রশিদ সাহেব এবার কিছুটা বিরক্ত হন, 'আমি জানি না তো! এর আগে আমি এইসব বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কয় সপ্তা আগে আমার বন্ধু- এই যে মিজান- ও কয়টা বই পাঠাইছিল। তাঁর মধ্যে একটা আছিল 'প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যকলার বিবর্তন'। এই বইটা পইড়া আমার সারা শরীরে একটা ঝাঁকির মত লাগল, মনে হইল অন্যরকম একটা আনন্দ পাইতাছি...'
-'অনেকটা যৌনমিলনের মত?' প্রশ্নটা শুনে মিজান হাসি চাপার চেষ্টা করে, রশিদ সাহেব তাঁর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, তারপর ইতস্ততঃ ভঙ্গিতে উত্তর দেন, 'হ...ওইরকম অনেকটা। কিন্তু আরও...মানে...গভীর একটা কিছু...'
এবারে বৃদ্ধ হাতের বইটার একটা জায়গা বের করে এগিয়ে দেন রশিদ সাহেবের কাছে, ' বামপাশে নিচের প্যারাটা পড়ে দেখুন।'
রশিদ সাহেব হাতে নিয়ে চোখ বোলান। ওখানে লেখা-
'যাহারা মুক্ত, এবং যুক্ত,
ময়ূখ খুঁজিয়া ফিরে
নকুল কহিছে, উহারা পাহিছে
পূর্ণ মিলনানন্দ ধীরে।'
তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাতেই বৃদ্ধ বলতে শুরু করলেন, 'এই অংশটুকুতে নাচের অবতারদের কথা বলা হয়েছে। মিল দেখুন- আপনি সকল নাচসংক্রান্ত বিষয় থেকে মুক্ত, কিন্তু বই পড়ে এরকম আনন্দ পাচ্ছেন- সুতরাং অন্য কোন ভাবে যুক্ত। ময়ূখ খুঁজিয়া ফেরে- এটা একটা মেটাফর- মানে নিজেকে খুঁজে ফেরে। আপনি এই আনন্দের কারণ খুঁজে ফিরছেন, স্থূলভাবে কি একে বলা যায় না যে নিজেকে খুঁজে ফিরছেন? নকুল হচ্ছে শিবের আরেকটা নাম- তিনি বলছেন এসব গুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা নাচের সংস্পর্শে মিলনের মত আনন্দ পাবেন। ধরতে পেরেছেন ব্যাপারটা?'
রশিদ সাহেব একটু বিহ্বলভাবে প্রশ্ন করলেন, 'বইটা কিসের? এই নাচের অবতার কি জিনিস?'
-'এটা 'নাট্যশাস্ত্র' এর বাংলা অনুবাদ। খুবই দুর্লভ বই। বলা হয় আসল নাট্যশাস্ত্র স্বয়ং মহাদেব শিব দ্বারা ত্রেতা যুগে রচিত হয়। পরবর্তীতে তিনি নারদ মুনিকে দিয়ে এই বিদ্যা পৃথিবীতে প্রেরণ করেন, এর পর থেকেই পৃথিবীতে নাচের আবির্ভাব। কথা সেটা না, এর মানে হচ্ছে আপনি নাচের অবতারদের মাঝে..'
এবারে মিজান বাধা দিয়ে বলে, 'তাইলে এইটাই কাহিনি? রশিদ, শুনছস তো? এইটাই কাহিনি। ওকে, আপনেরে ধন্যবাদ, এইবার আমরা উঠি।' এমন কথায় বৃদ্ধ এবং রশিদ সাহেব দুজনেই চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। মিজান কোন কথা না বলে উসখুস করে আবার বসে পড়ে। বৃদ্ধ বলতে থাকেন, 'প্লিজ কথা বলার সময় ইন্টারফিয়ার করবেন না। যা বলছিলাম, নাট্যশাস্ত্র বলছে আপনি নাচের অবতারদের মাঝে একজন। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন?'
-'তাতে লাভ কি? অবতার হলে কি হয়?'
বৃদ্ধের চোখ চকচক করতে থাকে, 'ইউ ডোন্ট নো হাও লাকি ইউ আর! আচ্ছা, শুরু থেকে বুঝিয়ে দিচ্ছি ব্যাপারটা। দেখুন, আমরা সৃষ্টিজগতে স্পেশাল কেন? কারণ অন্য প্রাণীদের একটা জিনিস নেই যা আমাদের আছে। জিনিসটা হচ্ছে আত্মা, সোল বা রূহ- যাই বলেন। চীনারা একে বলে চি, অর্থাৎ পার্টস অফ গড। চিন্তা করতে পারেন বিষয়টা? আমরা, নিতান্তই মাটির মানুষেরা নিজেদের মাঝে স্রষ্টার অংশ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি! সবকিছু ধ্বংস করা সম্ভব, কিন্তু এই আত্মা এতোটা শক্তিশালী যে কখনো ধ্বংস হয় না। এখন চিন্তা করুন কোনোভাবে যদি এই আত্মার শক্তিকে কাজে লাগানো যেত। ইউ কুড ডু এনিথিং অ্যান্ড এভরিথিং! ইউ কুড ইজিলি বেন্ড দ্য রুলস অফ দিস ইউনিভার্স! কিন্তু একটা কথা আছে। সবাই এটা পারে না।'
রশিদ সাহেব এবারে বুঝতে পারেন, 'শুধুমাত্র নাচের অবতারেরা পারে, ঠিক?'
বৃদ্ধ হাসেন, 'ঠিক। যারা এটা পারে, তাদেরই নাট্যশাস্ত্র বইয়ে নাচের অবতার বলা হয়েছে। কিন্তু এর একটা ক্ষতিকর দিকও আছে। সব ধর্মই বলছে আত্মাটা হচ্ছে স্রষ্টার উপহার, একটা ডিভাইন গিফট, রাইট? কিন্তু কোন লৌকিক উদ্দেশ্যে এই গিফটকে ইউজ করা মানে কি? মানে হচ্ছে আপনি উপহারের অপব্যবহার করলেন, চিট করলেন। সোজা কথায়, মানুষের আত্মার দুটো অপশন থাকে, স্বর্গ বা নরক - কিন্তু আত্মাকে যদি আপনি ব্যবহার করেন দুনিয়াবি কাজে, তাহলে না নরক না স্বর্গ- কোনটাতেই আপনার জায়গা হবে না। ইউ উইল ট্রুলি বি ড্যামড। আবার জাপানি মিথলজি বলছে- আত্মার এমন ব্যবহার বাটারফ্লাই ইফেক্টের মত একটা কোন অভাবনীয় দুর্ঘটনা ডেকে আনতে পারে। অবশ্য এসব মিথলজি যদি বিশ্বাস না করেন তাহলে অন্য কথা'
মিজান এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবারে প্রশ্ন করল, 'তাইলে ধরলাম রশিদ একটা 'অবতার', কিন্তু ও ক্ষমতা কাজে লাগাইব কেম্নে? নাইচা নাইচা? ও তো জানেই না কিছু।'
-'গুড কোয়েশ্চেন। দেখুন, নাচের অবতার একটা উপাধি মাত্র। এর মানে এই নয় যে ক্ষমতা কাজে লাগাতে গেলে নাচতে হবে বা তেমন কিছু। নির্দিষ্ট কিছু শব্দ উচ্চারণ করা, বা হাত বা পায়ের বিশেষ কোন ভঙ্গি এই ক্ষমতার ট্রিগার হিসেবে কাজ করতে পারে। আমি এসব নিয়েই জীবন-যৌবনের প্রায় পুরোটা কাটিয়ে দিয়েছি। অভিয়াসলি এই বিষয়ে আমার দুই একটা থিউরি আছে। যেমন এটা ধরুন', বৃদ্ধ একটা গোল করে পাকানো কাগজ তুলে দেন রশিদের হাতে, 'এখানে নর্স মিথলজি থেকে এক্সট্রাক্ট করা কিছু বিশেষ শব্দ আছে, প্রথমে সেগুলো উচ্চারণ করতে হবে। সমস্যা হবে না, বাংলায় উচ্চারণ লেখা আছে। তারপর গৌতম বুদ্ধ যে ভঙ্গিমায় বসে বোধি লাভ করেছিলেন সেই ভঙ্গিমায় বসতে হবে। সেটাও আঁকা আছে এখানে। এই দুটো কাজ করলেই অস্বাভাবিক একটা কিছু হবার কথা।'
মিজান আবারো জিজ্ঞেস করে, 'অস্বাভাবিক মানে?'
-'বুঝতে পারছেন না? আপনি আত্মার শক্তি ব্যবহার করছেন, কে জানে কি হবে? এন্ডলেস পসিবিলিটিস। হয়তো প্রকৃতির উপাদানগুলো কন্ট্রোল করতে পারবেন, কিং সলেমনের মত পশু-পাখি-গাছপালার সাথে কথা বলতে পারবেন। কিংবা অতিমানবীয় কোন ক্ষমতা পাবেন, হয়তো অমর হয়ে যাবেন। হয়তো নতুন কোন বিশ্বই সৃষ্টি করে ফেলবেন- কে জানে? জানতেই তো আনন্দ, তাই না? প্লিজ, এটা করে দেখবেন। তারপর যোগাযোগ করবেন আমার সাথে। ঠিক আছে?'
এতক্ষণ রশিদ সাহেব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন কথা, প্রশ্ন করছিলেন, এখন তাঁরও মনে সন্দেহ জাগতে থাকে। লোকটা আসলেই পাগল না তো! প্রায় অপরিচিত একটা লোকের সাথে এখান ওখান থেকে অনবরত রেফারেন্স টেনে বকে যাচ্ছে, এর মাঝে সুস্থ মানুষের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? তিনি কোনোমতে হু হু করে সায় দিয়ে বেরিয়ে আসেন বাইরে। মিজান অনেকক্ষণ ধরে কথা চেপে রেখেছিল, বাড়ির বাইরে আসতেই তাঁর মুখ দিয়ে হড়বড়িয়ে গালাগাল বেরিয়ে আসে, 'কি বালছালের পাল্লায় পড়ছিলাম বাবা রে! কি দিয়া কি কইল অর্ধেকই বুঝলাম না, তার মধ্যে হালায় নাচুইনা দেবতা লইয়া আইছে। আবার কিছু কইলেই খেইপা যায়! সুজা পাবনায় পাঠানের কাম বুইড়ারে।' এরপর সে রশিদ সাহেবকে নিয়ে পড়ে, 'হুন হালার পো, এইসব নিয়া যদি আরও টাইম নষ্ট করস আল্লার কসম তরে আমি দাও দিয়া কুবামু। কাইলকা থিকা ভদ্রলোকের পুলার মত মিলে আইবি, এইসব বালছাল বাদ দিবি- ঠিকাছে?'
রশিদ সাহেব সায় দেন। হুম, লোকটা যে পাগলাটে তাতে কোন সন্দেহ নেই, কি না কি দেখিয়ে হুড়মুড়িয়ে তাঁকে অবতার পর্যন্ত বানিয়ে ফেলল! সত্যিই এই ক'দিনে অযথা একটা বিষয় নিয়ে পড়ে ছিলেন তিনি। নিজের ওপরেই রাগ হতে থাকে তাঁর। ইস, পাগলের মত এত দৌড়াদৌড়ি, ঘোরাঘুরি- সব বিনা কারণে। রশিদ সাহেব মনে মনে নিজেকে শাপশাপান্ত করতে করতে বাড়িমুখো হন।
*
সেদিন রাতে প্রায় চার সপ্তাহ পর রশিদ সাহেব বাড়িতে রাতের খাবার খেলেন।
তাঁর স্ত্রী স্বামীকে স্বাভাবিক হতে দেখে বেজায় খুশি, লাইট নিভিয়ে শোয়ার আগে তিনি ইংগিতপূর্ণ চোখে রশিদ সাহেবের দিকে তাকালেন। অন্য কোন দিন হলে রশিদ সাহেব এমন সুযোগ লুফে নিতেন, কিন্তু আজকে এই প্রস্তাবে তাঁর ভেতরে কি যেন নিভে গেল। তিনি না দেখার ভান করে স্ত্রীর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। তাঁর মাথার ভেতরে চারটে লাইন ঘুরে বেড়াচ্ছে বারবার- 'যাহারা মুক্ত, এবং যুক্ত/ ময়ূখ খুঁজিয়া ফিরে/ নকুল কহিছে, উহারা পাহিছে/ পূর্ণ মিলনানন্দ ধীরে....পূর্ণ মিলনানন্দ ধীরে....'
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, স্ত্রীর নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসার আওয়াজ পেয়ে রশিদ সাহেব চোখ খুললেন। মানবজাতির সবচে প্রাচীন সঙ্গী- কৌতূহল- তাকে পাগল করে দিচ্ছে। বুড়ো হয়তো পাগল, কিন্তু তাঁর থিউরি টেস্ট করে দেখলে দোষ কি? বুড়োর যুক্তি যতই অসংলগ্ন হোক, তবু তো একটা 'যদি' থেকে যায়। যদি বুড়ো ঠিক হয়ে থাকে? রশিদ সাহেব একমুহূর্ত ভাবলেন, তারপর ঠিক করলেন কাজটা ছাদে করলেই ভালো হয়। ঘরের ভেতরে যদি ধরা পড়ে যান, তাহলে 'বিশেষ ভঙ্গিমায় বসে জোরে জোরে ভিনদেশি শব্দ উচ্চারণ করা'র কারণ ব্যাখ্যা করা খুব একটা সহজ হবে না। তিনি ব্যায়ামের ঘর থেকে চুপিচুপি একটা টর্চ, সবুজ ম্যাট আর বুড়োর দেওয়া কাগজটা নেন, তারপর নিঃশব্দে ছাদে উঠে আসেন।
বাইরে ধবধবে জ্যোৎস্না, বিশাল একটা চাঁদ ঝুলছে আকাশে। ম্যাট-টা বিছিয়ে রশিদ সাহেব কাগজটা পড়া শুরু করেন। লেখা আছে দুই হাঁটু, দুই কনুই আর থুতনি- এই পাঁচটি বিন্দু মাটিতে ঠেকাতে হবে, কিন্তু অন্য কোন অঙ্গ মাটিতে রাখা যাবে না। তারপর পাঁচবার জোরে জোরে বলতে হবে- 'দল বটাক এমিআ'। রশিদ সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই ভঙ্গিতে বসে কেউ বোধিপ্রাপ্ত হয় কিভাবে? আর ভাষাটাও কি বিটকেল! তিনি দুতিন বার চেষ্টা করে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসলেন। তারপর বলতে লাগলেন,
দল বটাক এমিআ
দল ব...দল বটাক এমিআ
দল বটাক এমিআ
দল বটাক এমিআ
দল বটাক এমিআ--আউ!
পাঁচবারের বার রশিদ সাহেবের হাঁটু দুটো পিছলে গেল, তিনি শক্ত মেঝের ওপরে বুক দিয়ে ধুপ করে পড়ে গেলেন। আশ্চর্যভাবে, 'আউ'-এর পরপরই তাঁর মাথার কাছে একটা পুরনো মাটির পাতিলের আবির্ভাব ঘটল। রশিদ সাহেব চোখ মিট মিট করে আরেকবার তাকালেন। হ্যাঁ, ঠিকই তো, আসলেই একটা পাতিল দেখা যাচ্ছে। রশিদ সাহেব কিরা কেটে বলতে পারেন একটু আগেও এখানে কিছু ছিল না, কিন্তু এখন আছে- এটা। জিনিসটা কিভাবে এলো এখানে? কিছুক্ষণ ভাবতেই রশিদ সাহেবের দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল- এটা কি এই বিটকেল মন্ত্র আর আসনের ফলাফল?
রশিদ সাহেব ভয়ে ভয়ে মাটির পাতিলটা হাতে নিলেন, নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর কি ভেবে ওটাকে উল্টো করে মাটিতে রাখলেন। সাথে সাথে ঝনঝন শব্দ হতে লাগল। ভীষণ চমকে গিয়ে তিনি ওই অবস্থাতেই তুলে নিলেন পাতিলটাকে। যা দেখলেন, নিজের চোখকে তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। সোনার মোহর! পাতিল থেকে ঝর্ণার মত সোনার মোহর গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে! ইতিমধ্যেই ছোটখাটো একটা স্তুপ হয়ে গেছে। রশিদ সাহেব পাতিলটা সোজা করে মেঝেতে রাখলেন, তারপর ভেতরে টর্চ মেরে দেখলেন। মোহরের স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে, ভেতরটা খালি! এবারে আবার উল্টে দেখলেন তিনি, আবারো মোহর পড়তে লাগল ঝরঝরিয়ে। ব্যাপারটা এবার বুঝতে পারলেন তিনি। পাতিলটা উল্টে দিলে মোহর বেরোয়, আর সোজা করলে মোহরের স্রোত বন্ধ হয়ে যায়। একটা আনন্দের হুংকার দিয়ে তিনি মোহরে হাত বুলোতে লাগলেন। বুড়ো তাহলে ঠিক ছিল! আত্মার বিনিময়ে রশিদ সাহেব একটা অফুরন্ত সোনার খনি পেয়ে গেছেন!
ঠিক তখনি যদি তিনি আকাশে তাকাতেন, তবে রশিদ সাহেব দেখতে পেতেন চাঁদের অর্ধেকটা হাওয়া হয়ে গেছে, আর তার ঠিক নিচ দিয়ে একদল মুণ্ডহীন হাতি স্বচ্ছন্দে উড়ে যাচ্ছে।
*
সিফাত বজ্রাহত হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
আজকে সারাদিন অনেক চেষ্টা করে সে গেমটার লাস্ট লেভেলে উঠেছিল। কিন্তু শেষ করতে পারেনি। রাতে শুয়ে পড়ার পর তাঁর ঘুম হচ্ছিল না, বারবার এপাশ ওপাশ করছিল। তখনি সে দরজা খোলার শব্দ পায়। নিজের রুম থেকে সে উঁকি মেরে দেখে আব্বা হাতে অনেক কিছু নিয়ে বাইরে যাচ্ছে। এই সুযোগ! চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে কম্পিউটারে গেম স্টার্ট করে সিফাত, লাস্ট লেভেলটা খেলা শুরু করে। খুব কঠিন বলে মাঝে মাঝে তাকে চিটকোড ইউজ করতে হচ্ছিল। কিন্তু খেলায় সে এতোটা মত্ত হয়ে গেছিল যে খেয়ালই করেনি- পয়েন্ট বাড়ানোর কোডটা সে সাতবারের মত ব্যবহার করে ফেলেছে। বেশি চিটকোড ইউজ করায় কিছুক্ষণ পরেই গেমসে গ্লিচ দেখা দিতে থাকে, অদ্ভুত-অসম্ভব সব কাণ্ড ঘটা শুরু করে। তারপর তো পুরো স্ক্রিনটাই কালো হয়ে গেল। ধুত! এখন এই করাপ্টেড গেম ডিলিট কর, তারপর আবার ইন্সটল কর- কত্ত ঝামেলা! সিফাত আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে কালো স্ক্রিনের দিকে, তারপর ঠিক করে এসব এখন করে লাভ নেই, কাল সকালে করা যাবে। একটা হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে উঠে পড়ে।
তারপর একটানে পাওয়ার প্লাগ খুলে নিভিয়ে দেয় লাইটটা ।