প্রথমেই আমার মত যারা বড় পোস্ট দেখে ভয় পান তাঁদের বলি, পোস্টের শুধু 'সশস্ত্র বিদ্রোহের শুরু ও কিছু ঘটনা' প্যারাটা পড়ে দেখেন, গ্যারান্টি ইন্টারেস্টিং লাগবে।
এবার মূল কথায় আসি। একাদেমিক সূত্রে নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহ নিয়ে কয়দিন ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছিল। স্বভাবতই ইন্টারনেটেও খুঁজেছি। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যে এই বিষয়ে নেটে সঠিক তথ্য তো দূর, তথ্যই খুব কম। তাই ঠিক করলাম রিসার্চের একটা সম্পূর্ণ সারমর্ম লেখা উচিত। সপ্তাহ দুএক লাগল, তবু লিখে ফেললাম। সামান্য গর্ব করে বলতে পারি, এই পোস্টের প্রত্যেকটা লাইনের রেফারেন্স দেয়া যাবে। দরকার অনুসারে উইকির মত করে রেফারেন্স দিয়েওছি। ভবিষ্যতে কেউ নীল চাষ সম্পর্কে জানতে চাইলে আমার এই লেখা পড়ে যদি উপকৃত হন, তবেই আনন্দ।
লেখার কপিরাইট সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। নির্বিচারে কপি-পেস্ট মারতে পারেন। উইকিপিডিয়ান কেউ থাকেন যদি, তবে একটা আবদার করব, এখান থেকে তথ্য নিয়ে বাংলা উইকিতে অ্যাড করে দেবেন দয়া করে। এবার নিন, পড়া শুরু করুন। আর হ্যাঁ, শুরুর আগে আমার প্রিয় একজন লেখক, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' বইয়ের এক স্থানে ফুটে ওঠা নীলকুঠির বর্ণনা শোনাইঃ
''সুচাঁদ বলে- বাবারা বলত, অ্যাই বড় বড় ঘোড়া, এই ঝালর দেওয়া সওয়ারি অর্থাৎ পালকি। এই সব বাংলা-ঘর, ফুল বাগিচা, বাঁধানো খেলার জায়গা, কাঠ-কাঠরার আসবাব; সে ঐশ্বর্যের কথা এক মুখে বলা যায় না। এক দিকে কাছারি গমগম করত, বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত পাইক আটপৌরেরা- মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিত। জোড়হাত করে বসে থাকত চাষি সজ্জনেরা- ভয়ে মুখ চুন। দু-দশজনাকে বেঁধে রাখত। কারুর শুধু হাতে দড়ি, কারুর বা হাত-পা দুই-ই বাঁধা। সায়েব লোক, রাঙা রাঙা মুখ, কটা কটা চোখ, গিরিমাটির মত চুল, পায়ে অ্যাই বুট জুতো- খটমট করে বেড়াত, পিঠে 'প্যাটে' জুতোসুদ্ধ লাথি বসিয়ে দিত, মুখে কটমটে হিন্দি বাত- মারডালো, লাগাও চাবুক, দেখলাও শালোলোগকো সায়েব লোকের প্যাঁচ। কখনো হুকুম হত- কয়েদ কর। কখনো হুকুম হত- ভাঙ দেও শালোলোকের ধানকো জমি। লয়তো, কাটকে লেও শালোকে জমির ধান। সে তোমার বামুন নাই, কায়েত নাই, সদগোপ নাই- সব এক হাল। 'আতে' সারি সারি বাতি জ্বলত- টুং- টাং- ক্যাঁ- কোঁ- ভ্যাঁ- পো ভ্যাঁ- পো বাজনা বাজত, সায়েব মেম বিলিতি মদ খেত, হাত ধরাধরি করে নাচত, কয়েদখানায় মানুষ চেঁচালে হাঁকিড়ে উঠত বাঘের মত- মৎ চিল্লাও। বেশি 'আত' হলে সেপাইরা বন্দুকের রজ করত- দুম- দুম- দুম- দুম। হাঁক দিত- ও- হো- ই। তফাত যাও- তফাত যাও- চোর বদমাশ হুঁশিয়ার! চোরই হোক আর সাধুই হোক এতে ওদিকে হাঁটলে অক্ষে থাকত না, দুম করে গুলি করে দিত।''
এবারে মূল লেখা-
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় নীল ব্যবসায়ী বা নীলকরদের বিরুদ্ধে একজোটে যে বিদ্রোহ করে, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ আসলে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে জমে ওঠা ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ ছিল মাত্র। প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ সালে তারা নীল চাষ করতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে অস্বীকৃতি জানায়। প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। (১)
নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। ফলে সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। এতে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালের মাঝে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে। (২)
নীল চাষের পটভূমি
প্রাচীন ও আধুনিক নীলচাষ
অতি প্রাচীন কালেও এদেশে নীল চাষ প্রচলিত ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে, অঙ্কিত পট ও চিত্রে। ইংরেজিতে নীল indigo নামে আর গ্রিক ও রোমান ভাষায় indicum নামে পরিচিত। উভয় শব্দই india শব্দের সমার্থবোধক। আবার প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তারা বাস করত সিন্ধু নদের (the indus) তীরে এবং তাই ধারণা করা হয় এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি। (৩)
এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলনের কৃতিত্ব একজন ফরাসি বণিকের, তার নাম লুই বন্ড। তিনি ১৭৭৭ আমেরিকা থেকে এদেশে নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি নিয়ে আসেন। একই বছরে হুগলী নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে সর্বপ্রথম তিনি নীলকুঠি স্থাপন করেন(৪)। কয়েক বছরের ভেতরে মালদহে, ১৮১৪ সালে বাকিপুরে, এবং তারপরে যশোরের ন'হাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা স্থাপন করেন। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করে বন্ড উপমহাদেশ ও ব্রিটেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৮২০ সালে তার মৃত্যু হয়। (৫)
বাংলায় নীলচাষের প্রসার
লুই বন্ডের এক বছর পর ক্যারল ব্লুম নামের একজন ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন(৬)। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান ও ১৭৭৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে সপারিষদ একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন(৭)। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে।
কোম্পানি লাভের সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই সমস্ত কারবার হস্তগত করে নেয় এবং অত্যন্ত লাভবান হয়। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষে যে খরচ হত, তার সবটাই কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম প্রদান করত। এতে যে নীল উৎপাদিত হত, তার সবটাই যেত ইংল্যান্ডে এবং কোম্পানি বহুগুণ বেশি লাভ করত। এই ব্যবসা এতই লাভজনক প্রমানিত হয় যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি ও রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করে। বহু দেশীয় জমিদার ও মহাজন ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথ মালিকানায় কারবার খোলে এবং দেখতে না দেখতে ১৮১৫ সালের মাঝে নদীয়া, যশোর, খুলনা, চব্বিশ পরগনা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এসব এলাকার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হবার কাহিনি সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।(৮)
নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণী নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। এছাড়া ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অয্যোধ্যা দখল করে।(৯)
সবমিলিয়ে নীলচাষ বিলেতের পার্লামেন্ট থেকে কৃষকের পর্ণকুটির পর্যন্ত সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ ৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোন পন্য নীলের মত এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নি।(১০)
নীল কুঠি ও কারবার পরিচালনা
একটি কোম্পানি একাধিক কুঠি স্থাপন করে ব্যবসা চালাত। তার মাঝে একটি কুঠিতে সমগ্র কারবার পরিচালনা করার জন্য একটি বোর্ড থাকত, এই কুঠিটিকে বলা হত সদর কুঠি বা কনসার্ণ। সদর কুঠিতে অবস্থিত পরিচালনা বোর্ড প্রতি কুঠিতে একজন ম্যানেজার বা অধ্যক্ষ নিয়োগ করত। তাঁকে বলা হত বড় সাহেব এবং তার সহকারিকে বলা হত ছোট সাহেব। এই পদ দুইটি সর্বদা শ্বেতকায় লোকদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বাকি পদগুলো ছিল দেশীয় লোকদের জন্য। ছোট সাহেবের পর যার সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ছিল, তাঁকে বলা হত দেওয়ান বা নায়েব। অনেক ক্ষেত্রে এই পদটিও একজন ইংরেজ বা শ্বেতকায় ব্যক্তি দখল করত। দেওয়ানের আবার একাধিক সহযোগী থাকত। এসব সহযোগী প্রজা ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীর সাথে সাহেবদের যোগাযোগ রক্ষা করত। তাদের প্রধান কাজ ছিল হিসাবপত্রের নানা কাজ করা। দেশীয় কর্মচারীদের মাঝে এরাই সর্বাপেক্ষা লাভবান হত। কারণ হিসাবে গরমিল, সই জালকরণ, ঘুষ গ্রহণ ও সুদের কারবারি করে এরা প্রজাদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থোপার্জন করত।(১১)
এরপর ছিল পর্যায়ক্রমে গোমস্তা, আমিন, সরকার, তহসিলদার, মাহুত, সহিস, বরকন্দাজ, ওজনদার, পেয়াদা, জমাদার, তাগিদগীর, চৌকিদার, মালি প্রভৃতি অসংখ্য নিম্নপদের কর্মচারী। এমনকি যারা পানি, জ্বালানি, দুধ, দৈ, মুরগি, মাংস, ডিম সরবরাহ করত বা সাহেবের ছাগল-ভেড়া চরাত, তারাও ছিল তকমাধারী।
বেতনের ক্ষেত্রে, দেশি দেওয়ানের বেতন ছিল মাসে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ১৭ টাকা পেত গোমস্তা। আমিনের কাজ ছিল জমির সীমানা বের করা ও মাপজোক করা। সে বেতন পেত ১৪ টাকা। সরকার ও তহসিলদারের বেতন ছিল ১১ টাকা। মাহুত ও সহিস পেত ৭ টাকা। বাকি কর্মচারীরা কোন বেতন পেত না, তবু তারা চাকরি করত এবং এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকদের মাঝে তারাই ছিল অবস্থাসম্পন্ন। কারণ তারা সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে শোষণ করত। নীল পরিমাপের জন্য ওজনদার এবং রায়তদের কাজে তাগিদ দেবার জন্য তাগিদগীর ছিল। তাগিদগীর যথাসময়ে নীলবীজ ও দাদন গ্রহনের জন্য কৃষক প্রজাদের সংবাদ পৌঁছে দিত এবং বৃষ্টির পর কোন জমিতে নীল বুনতে হবে, তা জমিতে 'দাগ' মেরে নির্দিষ্ট করে দিত(১২)। পুলিশের কাজ করত পেয়াদা। কাউকে ধরে আনা এবং শাস্তি প্রদান করা তার কাজ ছিল। সম্ভবত গোমস্তার পর পেয়াদাই সবচেয়ে জুলুমবাজ কর্মচারী ছিল(১৩)। কুলি ও মজুরদের কাজ দেখাশোনা করত জমাদার। সহরত ও ইস্তেহার ইত্যাদি জারি করত চৌকিদার। বরকন্দাজ ছিল কুঠির লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান। এরা সবাই সাধারণ মানুষের কাছে ভীষণভাবে ঘৃণ্য ছিল(১৪)(১৫)। মজার ব্যাপার হল, এসব কর্মচারির অধিকাংশই মুসলিম সমাজ থেকে আগত ছিল, যদিও তুলনামূলক উচ্চ পদগুলো ছিল হিন্দুদের দখলে।
নীলচাষের প্রাথমিক অসুবিধা ও প্রতিকার
লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক করে দেন। এরা নিজ জমিদারি সীমার মাঝে ছোটখাটো রাজা-বাদশার মত ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই, প্রজার জানমাল, এমনকি তাঁদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের মালিকও ছিল(১৬)। ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণীটিকে তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখতে পেল। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত, তবুও প্রজারা ওই ভূস্বামীদের অধীনে থাকত। ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তার করে ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন(Eighth regulation of 1819) বলবৎ করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর 'পত্তনি তালুক' দেবার সুযোগ পায় এবং কিছু দিনের মাঝেই জমিদাররা অধিক মুনাফার আশায়, আবার কোথাও অত্যাচার বা জুলুমের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। কিন্তু তবুও ইংরেজদের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় নি। কারণ পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত, বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য। তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, ধানভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে। তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেন মুৎসুদ্দি ও চাকুরেগণ। এদের মাঝে প্রসন্নকুমার ঘোষণা করেন,
'আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগন জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন। এবং ইহাই রায়তদের জন্যে কল্যাণকর।'(১৭)
এভাবে ভেতরে বাইরে চেষ্টার ফলে ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইনের(fourth regulation of 1833) দ্বারা বাংলাদেশে ইংরেজদের জমি ও জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয়। অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে, কেউবা দুর্ধর্ষ নীলকর বা ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল, তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায়নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে জব্দ করার জন্য নীলকরদের ডেকে আনত। কিন্তু পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি' কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনেদা, রানাঘাট ও যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এই বিশাল জমিদারি থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দিত মাত্র ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, যেখানে কেবল চুয়াডাঙ্গা ও রানাঘাট এলাকায় এরা ১৮ লক্ষ মূলধন খাটাত। মূলতঃ এই ভাবে ইংরেজগণ অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় জেঁকে বসে ও নীল চাষ শুরু করে।(১৮)
কুঠি স্থাপন ও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীলকুঠি
১৮১৫ সালের মাঝে সারা বাংলাদেশে প্রায় সমস্ত অঞ্চলে নীল ব্যবসা প্রসার লাভ করে ও নীলকুঠি স্থাপিত হয়। এর পেছনে তিনটি কারণ বিদ্যমান - কোম্পানির আগ্রাসী বানিজ্য নীতি, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের উদ্যোগ এবং দেশি মুৎসুদ্দিদের প্রয়াস। ১৭৯৫ সাল থেকে যেসব নীল কারবারি ও ব্যবসায়ী এদেশে কুঠি স্থাপন করে কারবারি শুরু করেন, তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন -
১৭৯৫ সালে মিঃ সি. ডব্লিউ. শেরিফ জোড়াদহে
১৭৯৬ সালে মিঃ জন রিভস ও শেরিফ যৌথ মালিকানায় সিন্দুরিয়ায়
১৭৯৬ সালে মিঃ টাপট মহম্মদশাহীতে
১৮০০ সালে মিঃ ফারগুসন ও মে সাহেব যৌথ মালিকানায় যথাক্রমে দহকোলা ও আলমপুরে
১৮০০ সালে মিঃ টেলর মহেশপুরে
১৮০১ সালে মিঃ বার্কার সাহেব চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুরে
১৮০১ সালে মিঃ অ্যান্ডারসন যশোরের বারিন্দি ও বারুই পাড়ায়(১৯)
১৮০৫ থেকে ১৮১৫ সালের মাঝে যারা নীল কুঠি স্থাপন করেন-
মিঃ টেলর ও ন্যুডশন - মিরপুরে
মিঃ রিজেট - ন'হাটায়
মার্টিন কোম্পানির ম্যানেজার মিঃ স্টিভেনসন - কুষ্টিয়ার আমবাগানে
মিঃ জেনকিনস ও ম্যাকেঞ্জি - ঝিকরগাছায়
মিঃ ওয়াটস - গোস্বামী দুর্গায়
মিঃ ডেভরেল - ঝিনেদার পার্শ্ববর্তি হাজরাপুরে(২০)
দেশি জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের মাঝে অনেকেই ইংরেজ কুঠিয়ালদের দেখাদেখি নিজ এলাকায় নীল ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ক'জন হলেন -
জমিদার অবনীমোহন বসুঃ ইনি প্রজা পীড়নের জন্য কুখ্যাত ছিলেন। তার সদর কুঠি ঘোড়াখালিতে অবস্থিত ছিল। তিনিই দেশীয় জমিদারদের মাঝে সর্বপ্রথম ইংরেজ ম্যানেজার রাখেন।
হরিচরণ সাহাঃ চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী শ্রীকোল বোয়ালিয়ার মহাজন। ইনি একটি ছোটখাটো নীলকুঠি স্থাপন করে নীলের ব্যবসা শুরু করেন এবং সেই বছরই একটি কুঠি থেকে সর্বোচ্চ নীল উৎপাদনের রেকর্ড করেন।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালিপ্রসন্ন সরকারঃ ইনি চাকরি ছেড়ে আর. এস. পাউরান-এর কাছ থেকে মদনধারী সদর কুঠি কিনে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
রাজা প্রমথভূষণঃ নলডাঙ্গার রাজা। এদেশীয় রাজাদের মাঝে সর্বপ্রথম নীলচাষ শুরু করেন তিনি। তার অত্যাচার এতই জঘন্য ছিল যে কৃষকেরা সেটা নিয়ে গানও বেঁধেছিল-
'আহা একটুখানি চাঁদেরে ভাই মাঠ করেছে আলো,
বেলে দাড়ি নীল বুনিলাম নীল হল না ভাল।
বাবুর ঘোড়া জোড়া জোড়া নীল দেখিতে যায়,
নীল দেখিতে পেয়ে বাবুর ব্যর্থ হাসি পায়।
ব্যর্থ হাসি, মুখে বাঁশি, চাঁদ খাঁর বাড়ি
চাঁদ খাঁ চাঁদ খাঁ বসে কর কি?
তোমার পুত্র মার খাচ্ছে নলডাঙ্গার কাছারি।
আর মেরো না আর মেরো না ফুলো বেতের বাড়ি,
কাল পরশু দিয়ে যাব দাদনের কড়ি,
নীল বুনিব নলে গাবো আসবো তাড়াতাড়ি।'(২১)
এছাড়া আচার্য মথুরনাথ(সাধুহাটির জমিদার), রঘুপতি মজুমদার(পথহাটির দিকপতি), শ্রীহরি রায়(চণ্ডীপুরের জমিদার), আশুতোষ গাঙ্গুলি(পোতাহাটির নায়েব) প্রভৃতি নীল চাষ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন।
এখানে বলে নেওয়া ভাল, নীল বিদ্রোহের শুরু হয় চুয়াডাঙ্গার চূর্ণী বা মাথাভাঙ্গার তীরবর্তী কতগুলো গ্রাম থেকে। কারণ এসব এলাকায় সর্বোচ্চ মানের নীল উৎপন্ন হত, তাই বেশি বেশি উৎপাদনের আশায় নীলকরেরা অত্যাচারও বেশি করত। এই কারণে এখানকার প্রধান একটি কুঠির বর্ণনা দেয়া হল।
সিন্দুরিয়া সদর কুঠিঃ
সাবেক চুয়াডাঙ্গা মহকুমাকে নীলকররা ৬টি সদর কুঠিতে ভাগ করে -
১.সিন্দুরিয়া সদর কুঠি
২.নিশ্চিন্তপুর সদর কুঠি
৩.চণ্ডীপুর সদর কুঠি
৪.খাল বোয়ালিয়া সদর কুঠি
৫.লোকনাথপুর সদর কুঠি
৬.কাঁচিকাটা সদর কুঠি
এদের মাঝে সিন্দুরিয়া সদর কুঠি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও উৎপাদনশীল ছিল। মোট ১৬ হাজার ৬শ ৫২ বিঘা জমিতে বছরে ১০০০ মণ নীল উৎপাদিত হত। চাষি ও কর্মচারীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৩শ ৬৮ জন।
সিন্দুরিয়া নীলকুঠির প্রথম মালিক ছিলেন জেমস আইভান মে। ১৭৯৩ সালে তিনি কুঠি নির্মাণে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণে তাঁকে ফিরে যেতে হয়(২২)।এর পরে মিঃ জন রিভস দায়িত্ব নেন, কিন্তু তিনিও কুঠি নির্মাণে ব্যর্থ হন(২৩)। তিনি স্থান পরিবর্তন করে কুঠিটি মর্তুজাপুর এবং হিঙ্গের পাড়া গ্রামের মাঝে নিয়ে আসেন। মিঃ শেরিফ কুঠির মালিকানার অংশীদার হন। কুঠির ম্যানেজার হিসেবে মিঃ জর্জ ম্যাকনেয়ার দায়িত্ব পান। কুঠির দক্ষিণাংশ তখন সম্পূর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ ছিল(২৪)। পরে এখানে কর্মচারীদের জন্য একটি দালানবাড়ি স্থাপন করা হয়।
সিন্দুরিয়া সদর কুঠিতে একেবারে শুরুতেই প্রজা বিদ্রোহ দেখা দেয়। উৎপাদন বন্ধ হবার উপক্রম হয়। ক্ষতির আশঙ্কা দেখে রিভস কারবার ম্যাকনেয়ার ও শেরিফের কাছে বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান। আশ্চর্যের কথা, ঠিক তখন থেকেই ম্যাকনেয়ার কারবারে লাভ করতে থাকেন। অনেকে বলেন, শেরিফ ও ম্যাকনেয়ারের ষড়যন্ত্র করে এই কুঠিতে বিদ্রোহ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তো ম্যাকনেয়ার বহুসংখ্যক কর্মচারী ছাঁটাই করেন, চাষিদের নতুন চুক্তির আওতায় আনেন, সেই সাথে পেয়াদার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। ফলে ১৮৫৮-৫৯ সালে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে তার কুঠি সর্বোচ্চ নীল উৎপাদন করে। কুঠিতে পূর্বেই ৮ কক্ষবিশিষ্ট সুরম্য প্রাসাদ, নীল হাউস, সেরেস্তার কাজ চালানোর জন্য কাছারি, নাচমহল, গোরস্থান, মৃত্যুকূপ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ এবং কর্মচারীদের বাসস্থান তৈরি করা ছিল। তিনি নতুন করে সচিবালয়(২৫), পিলখানা, গুটিপোকা চাষের জন্য দালান, হাতিশাল তৈরি করেন এবং ১৮৬৩ সালে কুঠিতে পুকুর খনন করেন।
তিনি চাষিদের কাছারি ঘরে ডেকে এনে নির্যাতন চালাতেন। প্রায়ই চাষির মেয়ে বা স্ত্রীকে ডেকে নেওয়া হত সাহেবের গুপ্তকক্ষে(২৬)। সেখানে কত কিশোরী, কত নারী যে তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। সাহেব তার লালসা মেটানোর পর তার কর্মচারীদের অনেকে গিয়ে সেই মৃতপ্রায় মেয়েটিকে আবার ধর্ষণ করত। চাষি ভাগ্যবান হলে জীবন্ত অবস্থায় তার স্ত্রীকে, তার মেয়েকে ফেরত পেত। নইলে পুরো পরিবারকে খুন করে ফেলে দেওয়া হত মৃত্যুকূপে। ম্যাকনেয়ারের মানসিকতায় বিকৃতি ছিল প্রচণ্ড(২৭)। তিনি ১৮৫২ সালে দুর্গাপুর, আটলে, খাড়াগোদা ও সিন্দুরিয়া অঞ্চলের সমস্ত খেজুর গাছ ও বাগান উৎপাটিত করে নীল আবাদের জন্য জোরপূর্বক জমি তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পাশবিক আচরণ এই অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রভাবক হয়ে ওঠে।
ব্যবসা উঠে যাবার পর ১৯১০ সালে শ্রীমতী বিশ্বাস নামক এক খৃস্টান মহিলা এই কুঠি ক্রয় করেন। তার বংশধরেরা দেশ ভাগের সময় আতাউর রহমান এবং আব্দুর রহিম এই দুই ভাইয়ের কাছে কুঠি বিক্রি করে চলে যান। বর্তমানে কুঠির প্রাসাদগুলো বিলুপ্ত, সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
পীড়ন ও বিদ্রোহের সূচনাঃ নীলচাষে শোষণ
১৮৩৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে আইনবলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যে সব কর্মচারী সেখানে রবার চাষে ক্রীতদাসদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালাতে অভ্যস্ত ছিল, তাঁদের বঙ্গদেশে এনে নীলকর বানিয়ে দেওয়া হয়। তারা এখানে এসে নীল ব্যবসায়ী, মহাজন, জমিদার এমনকি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ দখল করে। তাই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি হয়ে তারা এদেশের সাধারণ কৃষকের ওপর যে সীমাহীন অত্যাচার চালায়, তার সমতুল্য মর্মান্তিক ঘটনা আজো বিরল।
নীলকরদের সামনে প্রজারা ছিল অসহায়। আইন-আদালত তো দূরের কথা, তাঁদের সাথে নবাব-বাদশাদেরই সংস্রব ছিল না। এমতাবস্থায় তারা নিরুপায় হয়ে দাদনী চুক্তিপত্রে টিপসই দিত এবং নীল চাষ করতে বাধ্য হত।
দাদনী চুক্তিপত্র বা একরারনামা ছিল একটুকরা সাদা কাগজ, যার ওপরে প্রথমে কৃষকের টিপসই নেওয়া হত, তারপর গোমস্তাকে দিয়ে ইচ্ছেমত শর্তাদি লিখিয়ে নেয়া হত। এসম্পর্কে এক ইংরেজ লেখক বলেন,
'The cold, hard and sorbid who can plough up grain fields, kidnap recusant rayets, confine them in dark holes, beat and starve them into submission, which things have sometimes been done, can give no moral guarantee of his capability of filling up a blank paper and turning it to his precuniary profit.'(২৮)
এই চুক্তিপত্রে কৃষকের সকল উৎকৃষ্ট জমির কথা লেখা থাকত, কিন্তু সে তা জানতে পারত না। সারা বছর সার-মাটি দিয়ে, লাঙল চষে, বৈশাখ মাসে মাঠে ধানের বীজ নিয়ে গিয়ে কৃষক দেখত তার জমিতে খুঁটি গেঁড়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই জমিতে নীল চাষ করতে হবে। সন্ধ্যাবেলা তাগিদগীর এসে জানিয়ে যেত কৃষক যেন ভোরে গিয়ে নীলের বীজ ও দাদনের টাকা নিয়ে আসে। অন্যথা হলে তাঁকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত। প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে দাদনের টাকা ও বীজ দেওয়া হত, সেখানে নীল চাষে ক্ষতি কোথায়?
প্রথমতঃ, নীল ছাড়া অন্য কোন শস্য চাষ করার জন্য জমি চাষির হাতে থাকত না। দ্বিতীয়তঃ, সোজা কথায় বলা যায়, ৩৩ শতাংশ বা এক বিঘা নীল চাষ করে চাষির খরচ হত ৩ টাকা। আর আয় হত ১ টাকা। ফলাফল? প্রতি বিঘায় ক্ষতি ২ টাকা। অন্য কোন জমিতে ধান পাট চাষের জন্য অনুমতি না থাকায় কৃষক এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করতে পারত না। তাঁকে টাকা ধার করতে হত। এভাবে কৃষকের পিঠে ঋণের বোঝা ক্রমে ক্রমে আরও বাড়ত।
অন্যদিকে নীলকরের হিসাব করলে দেখা যায়, ১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রতি টাকায় ১০ আঁটি নীলের দর ছিল। ১০ বাণ্ডিলে নীল থাকত আড়াই সের। ২৩০ টাকা মণ দরে আড়াই সের নীলের দাম ছিল ১৩ টাকা ৬ আনা। চাষিকে ১ টাকা দিয়ে নীলকরের লাভ হত ১২ টাকা ৬ আনা! ১৮৪০ সালের পর তীব্র আন্দোলনের মুখে টাকায় ৪ বাণ্ডিল মূল্য নির্ধারিত হয়। এতে চাষি পেত ২ টাকা আর নীলকরের লাভ থাকত ১১ টাকা ৬ আনা, বা মণে ১৯৪ টাকা। জেমস ওয়াটস তার বইয়ে নীল ব্যবসার মুনাফা দেখিয়েছেন পুরো ১০০ শতাংশ(২৯)। 'Indian Field' পত্রিকায় প্রকাশিত এক হিসাবে দেখানো হয়, যে পরিমান নীলের জন্য চাষি পায় ২০০ টাকা, তা থেকে নীলকর পায় ১৯৫০ টাকার রং। যদি রং প্রস্তুতের জন্য আরও ২০০ টাকা খরচ হয়, তবু তার লাভ থাকে ১৭৫০ টাকা(৩০)।
বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাশলি ইডেন নীল কমিশনের কাছে তামাক ও নীলচাষের তুলনামূলক একটা হিসাব দাখিল করেন। তা থেকে দেখা যায়ঃ
নীল উৎপাদনে ব্যয়
খাজনা ০৩ টাকা
৮ মাসে লাঙলের খরচ ০৮ টাকা
সার ০১ টাকা
বীজ ১০ আনা
নিড়ানি ০৪ আনা
গাছ কাটা ০৮ আনা
----------------------------------------------
মোট খরচ ১৩ টাকা ৬ আনা
উৎপন্ন নীলের বিক্রয়মূল্য ০৪ টাকা
---------------------------------------------
অতএব, ক্ষতি ৯ টাকা ৬ আনা
একই জমিতে তামাক উৎপাদনের ব্যয়
খাজনা ০৩ টাকা
লাঙল ০৮ টাকা
নিড়ানি ০৬ টাকা
সার ০১ টাকা
সেচ ০১ টাকা
অন্যান্য ০৫ টাকা
----------------------------------------------
মোট খরচ ২৪ টাকা
উৎপন্ন তামাকের বিক্রয়মূল্য ৩৫ টাকা
----------------------------------------------
অতএব, লাভ ১১ টাকা
অ্যাশলি ইডেন তার মন্তব্যে লিখেছেন, 'রায়েত নিজের জমিতে স্বাধীনভাবে তামাক চাষ করতে পারলে সে যা লাভ করতে পারত তার সাথে নীলচাষের জন্য তার যা ক্ষতি হয়েছে, তা যদি যোগ করা হয়, তাহলেও রায়তের ক্ষতি থাকে ২০ টাকা ৬ আনা। ১৮৫৮ সালে তামাকের মূল্য ছিল ১৮ টাকা। এই মূল্য ধরলে তামাক চাষে প্রজার লাভ হতে পারত ১০১ টাকা ১৪ আনা'(৩১)।
এছাড়া আরও নানাভাবে অত্যাচার করা হত। নীলকররা কৃষকের জমি মেপে সে অনুযায়ী দাদনের টাকা দিত। কিন্তু যে মাপদণ্ড দিয়ে মাপা হত, তা প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিল। চাষির ১১ বিঘা মাপদণ্ডে দেখাত ৭ বিঘা(৩২)। চুক্তিপত্রের স্ট্যাম্পের দাম দিত কৃষক। নীলগাছ কুঠিতে পৌঁছে দেবার ভাড়া দিত কৃষক। দেরি হলে পেয়াদার দল এসে কৃষকের খাসি-মুর্গি-ছাগল ধরে নিয়ে যেত, আম-কাঁঠাল-লিচুর গাছ কেটে তছনছ করে দিত। নীলক্ষেতে যে ঘাস জন্মাত, তার ওপরেও কৃষকের কোন অধিকার ছিল না। ভুলে গরু ছাগল ছুটে ক্ষেতে গেলে পাহারাদার সেগুলো ধরে জব্দ করে ফেলত। পরে ৮ আনা ঘুষ দিয়ে তাঁদের ছুটিয়ে আনতে হত(৩৩)। সরকারও এই অত্যাচারে মদদ দেয়। ১৮৩০ সালে আইন জারি হয়, যারা নীলচুক্তি ভঙ্গ করবে, তাঁদের ফৌজদারি আইনে সোপর্দ করা যাবে ও সম্পত্তি ক্রোক করা যাবে।
এভাবে একে একে কৃষক তার সমস্ত জমি হারিয়ে, নীলচাষে লোকসান দিয়ে, অর্থকারী ফসল-গবাদিপশু-গাছপালা হারিয়ে নিরন্ন, বিবস্ত্র ও অসহায় হয়ে যেত মহাজনের কাছে। কিন্তু মহাজনের পুরো ঋণ শোধান তো দূরের কথা, সুদের টাকাও তাঁর দেবার সামর্থ্য হত না। একদিন দেখা যেত আদালতের ডিক্রিবলে মহাজন তার ভিটেমাটি, পৈতৃক জমি দখল করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পথে।
আর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাই একদিন রুখে দাঁড়ালো কৃষকেরা।
নীল বিদ্রোহের শুরু ও কয়েকটি ঘটনা
দীর্ঘদিনের ক্ষোভ অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত হয় ১৮৫৮ সালে এবং বিদ্রোহ হয়ে বেরিয়ে আসে ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মে মাসে। এর আগেও চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার। যেমন Calcutta Review পত্রিকায় বলা হয়েছে, সর্বপ্রথম ১৮৪৪ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারি নীলকুঠিতে মানুষ খেপে ওঠে এবং আগুনে কুঠিটিকে ভস্মীভূত করে(৩৪)। এভাবে যেখানেই নেতৃত্ব ও সংগঠন গড়ে ওঠে, সেখানেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বিদ্রোহ।
নীল বিদ্রোহের পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো হলঃ
ক. নীলকরদের নির্দিষ্ট উচ্চহার বা বর্ধিত খাজনা দিতে এবং জমি বন্দোবস্ত গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ
খ. সাদা কাগজের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি
গ. নীলবীজ ও দাদনের টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি
ঘ. অত্যাচার থামাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ
ঙ. সংবাদপত্র, নাটক, লোকগান, ছড়া ইত্যাদির মাধ্যমে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা ও প্রচার করা
চ. দলবেঁধে নীলচাষ বন্ধ করা
ছ. নীলগাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলে অন্য ফসল বোনা
জ. লাঠিয়াল বাহিনী সংগঠন এবং নীলকরদের পেয়াদা ও পাহারাদারদের পর্যুদস্তকরণ
ঝ. সশস্ত্র অভ্যুত্থান
ঞ. সবশেষে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই এবং নীলকরদের উচ্ছেদ
ঠিক কোথায় প্রথম বিদ্রোহের সূচনা তা নিয়ে নানা মত বিদ্যমান। অধিকাংশই মনে করেন যে, চূর্ণী নদীর তীরবর্তী চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের খাল বোয়ালিয়া ও আসাননগর কুঠিতে সর্বপ্রথম এই বিদ্রোহ শুরু হয়। কারো মতে চৌগাছা কুঠিতে এর সূত্রপাত। বাকল্যান্ড সাহেবের মতে, উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। তার মতে, আওরঙ্গবাদ মহকুমার এন্ড্রোজ কোম্পানির আঙকারা নীলকুঠির ওপরে সর্বপ্রথম আক্রমণ করার মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে বিদ্রোহ যে বাংলাদেশে শুরু হয়, তা সম্পর্কে সবাই একমত। তবে সাধারনতঃ বলা হয় যে, অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন মালদহ জেলার কৃষকগণ এবং তার পূর্ণতা সাধন করেন উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা। আর সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারির কৃষকেরা এবং পূর্ণতা সাধন করেন চুয়াডাঙ্গা এলাকার কৃষকগণ(৩৫)।
নীলবিদ্রোহের শুরুর কিছু ঘটনা উল্লেখযোগ্য। যেমন দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডলের রসিক প্রতিবাদ(৩৬), সিন্দুরিয়া নীলকুঠির গোমস্তা শীতল বিশ্বাসের হত্যা(৩৭), রব্বানি মণ্ডলের ওপরে অত্যাচার(৩৮) -এর মত ঘটনা নীল বিদ্রোহের অসহযোগ পর্যায়কে আরও বেগবান করে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই বিদ্রোহ মূলত শুরু হয় ১৮৫৯ সালে, বাস্তব রূপ পরিগ্রহন করে ১৮৬০ সালে এবং ১৮৬১ সালে প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। অসহযোগ এই আন্দোলন ঠেকাতে কুঠিয়াল ও জোতদাররা লাঠিয়াল বাহিনী নামায় ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, ফলে ১৮৫৯ সালের শেষে বা ১৮৬০ সালের শুরুতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহের কেন্দ্রে ছিল কৃষকদের লাঠিয়াল বাহিনী।
বাহিনী গঠন ও রণকৌশল
১৮৬০ সালের এপ্রিলে 'ইন্ডিয়ান ফিল্ড' নামক মাসিক পত্রিকায় দু'জন জার্মান পাদ্রি চুয়াডাঙ্গার বিপ্লবীদের লাঠিয়াল বাহিনী সম্পর্কে লেখেন,
'অপটু কৃষক যোদ্ধাগণ নিজেদের ৬টি কোম্পানিতে বিভক্ত করেছে। ১ম কোম্পানি তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত। ২য় কোম্পানি গঠন করা হয় প্রাচীনকালের ডেভিডের মত ফিঙা দিয়ে গোলোক নিক্ষেপকারীদের নিয়ে। ইটওয়ালাদের নিয়ে তৃতীয় কোম্পানি। এরা পরিধেয় লুঙ্গিতে মাটির বড় বড় ঢেলা, ইট-পাটকেল বহন করে এবং ছুঁড়ে মারে। ৪র্থ কোম্পানি গঠিত বেলওয়ালাদের নিয়ে, যাদের কাজ হল নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনির মস্তক লক্ষ করে শক্ত কাঁচা বেল ছুঁড়ে মারা। থালা-ওয়ালাদের নিয়ে ৫ম কোম্পানি। তারা ভাত খাবার কাঁসা ও পিতলের থালাগুলো আনুভূমিকভাবে চালাতে থাকে। এতে শত্রু নিধন যে ভালভাবেই হয় তাতে সন্দেহ নেই। ৬ষ্ঠ কোম্পানি মহিলাদের নিয়ে গঠিত হয়। তারা হাতে মাটির পোড়ান খণ্ড, মাটির বাসন ও রুটি বেলার বেলন নিয়ে আক্রমণ করে থাকে। প্রথমে তারা লাঠিয়ালদের দিকে মাটির খণ্ড ও বাসনকোসন ছুঁড়ে মারে। এতে লাঠিয়াল যদি ভূপাতিত হয়, তখন তাঁকে বেলনপেটা করা হয়।
আর যারা যুদ্ধে পটু, তাদের নিয়ে মূল কোম্পানি গঠিত। এরাই কৃষক লাঠিয়াল, এরা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়। এই কোম্পানির অর্ধেক বল্লমধারী, অর্ধেক লাঠিধারী। সবার সামনে থাকে বল্লমধারি, তাঁদের পর লাঠিয়ালরা, এবং তারপর বাকি পাঁচ কোম্পানি। এদের বীরত্ব কিংবদন্তিসম। একজন বল্লমধারি নাকি ১০০ জন শত্রুপক্ষীয় যোদ্ধাকে পরাজিত করতে পারে। সংখ্যায় এরা কম হলেও এতটাই দুর্ধর্ষ যে, তাঁদের ভয়ে নীলকরের লাঠিয়ালগণ পুনরায় আক্রমণ করতে সাহস করছে না'(৩৯)।
আসলে তখন কৃষকদের মূল শক্তি ছিল এই লাঠিয়াল-বল্লম বাহিনী। লাঠি চালনা শিক্ষার জন্য প্রধান ঘাঁটি ছিল বরিশাল, রংপুর ও টাঙ্গাইল। এসব স্থানে প্রচুর শিবির খোলা হয়। এখানকার ওস্তাদেরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং জায়গায় জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। প্রতিটি কৃষক-যুবক ও কিশোর লাঠিয়াল বাহিনিতে যোগ দেয়। তখন লাঠি চালনা শেখাটা ছিল গৌরবের বিষয় ও পৌরুষের প্রমাণ। কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে লাঠিয়ালরা তখন বীরদর্পে সুসজ্জিত শত্রুবাহিনীর আক্রমণ ঠেকিয়েছে এবং তাঁদের ঠেঙিয়েছে। তবে কৃষকদের অস্ত্র অঞ্চলভেদে ও বাহিনীভেদে কমত-বাড়ত। অনেক অঞ্চলে 'পলো বাহিনী' ছিল। তারা পলো ও ঝাঁকজাল কাঁধে নিয়ে এবং হাতে জুতি ও কোঁচ নিয়ে অগ্রসর হত। প্রমোদ সেনগুপ্ত বলেন, 'নানা অঞ্চলে নানা বাহিনী চালু ছিল। কোন কোন অঞ্চলে তীর, ধনুক, বন্দুক ও আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত বাহিনী ছিল। এদের মাঝে পাবনার নীল বিদ্রোহীরা সর্বপ্রথম বন্দুক ব্যবহার করে।'
এছাড়া ছিল তিতুমিরের 'হামকল বাহিনী' এবং ফরায়েজি আন্দোলনের অনুসারীদের 'দুন্দুভি বাহিনী'-র কথাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুইটি বাহিনী ও কৃষক বাহিনির বিদ্রোহের এজেন্ডা ভিন্ন হলেও এই বাহিনীত্রয়ের লক্ষ ছিল একটাই- অত্যাচারি নীলকর ও জমিদারদের ধ্বংস। তিতুমিরের হামকল বাহিনির ব্যারাক ছিল হুলিয়ামারিতে। এই হামকল বাহিনী ভারি কাঠের মুগুর ব্যবহার করত ও বাঁশ দিয়ে তৈরি নানা ধরনের যন্ত্র তৈরি করত- যা নীলকরদের কুঠি ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যেখানেই গোলাবাড়ি ও নীলকুঠি ছিল, সেখানেই এই বাহিনী তাঁদের কর্মতৎপরতা বজায় রাখত। নীল বিদ্রোহে এমন কোন লড়াই হয় নি, যেখানে হামকল বাহিনী অংশগ্রহণ করেনি(৪০)।
আর দুন্দুভি বাহিনী সম্পর্কে অনাথনাথ বসু লিখেছেন, 'নীলকরের লাঠিয়াল হইতে আত্মরক্ষার এক অপূর্ব কৌশল কৃষকগণ আবিস্কার করেন। প্রত্যেক পল্লীর প্রান্তে একটি করিয়া দুন্দুভি রাখিয়াছিল। যখন কুঠিয়ালগণের লাঠিয়ালরা গ্রাম আক্রমনের উপক্রম করিত, কৃষকগণ তখন দুন্দুভি ধ্বনি দ্বারা পরবর্তী গ্রামের রায়তগণকে বিপদের সংবাদ জ্ঞাপন করিলেই সকলে আসিয়া দলবদ্ধ হইত(৪১)। সতীশচন্দ্র লিখেছেন, 'গ্রামের সীমানায় এক স্থানে একটি ঢাক থাকিত। নীলকরের লোক অত্যাচার করিতে আসিলে কেহ সেই ঢাক বাজাইয়া দিত। অমনি শত শত গ্রাম্য কৃষক লাঠিসোঁটা লইয়া দৌড়াইয়া আসিত। নীলকরের লোকেরা প্রায়ই অক্ষত দেহে পলাইতে পারিত না। সম্মিলিত প্রজা শক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া সহজ ব্যাপার নহে'(৪২)।
সশস্ত্র বিদ্রোহের শুরু ও কিছু ঘটনা
কৃষকেরা অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে নীলচাষে অস্বীকৃতি জানিয়ে হাজার হাজার চুক্তিপত্র পুড়িয়ে ফেলে ও নীলবীজ নদীতে নিক্ষেপ করে। এতে নীলকরদের কুঠিয়ালরা শক্ত অবস্থানে চলে যায়। তারা পুলিশের সাহায্যে হাজার হাজার কৃষককে গ্রেফতার করে, তাঁদের বাড়িঘর ক্রোক করে নেয়, ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে এবং শত শত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকাল ধরে তাঁদের ওপর অত্যাচার চালান হয়। আর এটাই ছিল নীলকরদের বড় ভুল। এই অত্যাচারে কৃষক শ্রেণী ফুঁসে ওঠে, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে শীতের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয় নীলকরদের ওপর সশস্ত্র পাল্টা আক্রমণ(৪৩)।
কিন্তু সমস্যা হল, তখন না ছিল সংবাদপত্রের সংবাদ আদান প্রদানের সুব্যবস্থা, না ছিল উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। তাই কত শত খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে, তার মাঝে দু একটার খবর পত্রিকায় এসেছে। আর যারা খবর ছাপতেন, তারাও শ্রেণীস্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই ছাপতেন। তাই এই বিদ্রোহের খুঁটিনাটি বর্ণনা পাওয়া সম্ভব হয় নি। তবু কতগুলো আলোচিত ঘটনার বর্ণনা দেয়া হল।
বাংলার জোয়ান অব আর্কঃ পিয়ারি সুন্দরী
টমাস আইভান কেনি তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে সবচে বড় নীল কারবারের অধিকারি ছিল। তার কয়েকটি কুঠি ছিল আমলা সদরপুরের জমিদারনি পিয়ারি সুন্দরীর জমিদারির ভেতরে। এই কেনি ছিল অত্যন্ত জুলুমবাজ। হত্যা-ধর্ষণ এগুলো তার কাছে সামান্য ব্যাপার ছিল। তার বিরুদ্ধে ১৮৫০ সালে রায়েতগন বিদ্রোহ করে। কিন্তু কেনি শক্তহাতে তা দমন করে এবং সকল রায়েতকে উচ্ছেদ করে নতুন রায়েত বসায়। পিয়ারি এতে অসন্তুষ্ট হন। তিনি কেনিকে প্রজাদের উচ্ছেদ করার কাজে নিষেধ করেন। এতে কেনি তাঁকে গালিগালাজ করে এবং জমিদারি কেড়ে নেবার ভয় দেখায়। পিয়ারি অনন্যোপায় হয়ে মৌনব্রত পালন করেন।
কিন্তু ১৮৬০ সালে ওই উচ্ছেদকৃত রায়েতগন সংগঠিত হয়ে ফিরে আসে এবং পিয়ারি সুন্দরী তাঁদের সাথে যোগ দেন। ওই বছরই এপ্রিল মাসে তারা কেনিকে হত্যা এবং তার কুঠি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে কুঠিতে হামলা করেন। কেনি বেঁচে যায়, কিন্তু তার কারবার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই হামলা করার কারণে পিয়ারি সুন্দরী ও তার রায়েতদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করা হয়। পিয়ারি সুন্দরী সকল মামলার ব্যয়ভার নিজে বহন করেন, এতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। তার পক্ষের প্রজাদের দ্বীপান্তর, জেল, জরিমানা হয় ও পিয়ারি সহ সকলের ভূসম্পত্তি বাতিল করা হয়। পিয়ারি তার পাঁচ বছর পর যশোরের এক মুচির বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় পরিজনহীন অবস্থায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার কথা আমরা ভুলে গেছি।
কিন্তু মজার কথা কি জানেন? কেনিকে আমরা ভুলিনি। কুষ্টিয়ার কেনি রোডের নামকরন এই নরপশুর নামে করা(৪৪)।
শ্রেণী সংগ্রামের যোদ্ধাঃ বিশে ডাকাত
ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে, এবং সম্ভবত সর্বপ্রথম, ১৮০১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে স্যামুয়েল ফেডির নীলকুঠি লুণ্ঠন করেন বিশ্বনাথ সরদার ওরফে বিশে ডাকাত। এর পরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলায়। বিশ্বনাথ জাতিতে ডোম বা বাগদী ছিলেন। তিনি তিতুমিরের হামকল বাহিনীতে কিশোর বয়সে যোগ দেন। পাঁচ বছর প্রশিক্ষনের পরে তিনি নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামের একদল যুবককে তিনি নীলকুঠি দখল ও ধ্বংসের প্রশিক্ষণ দেন এবং নদীয়া জেলার কুনিয়ার জঙ্গলে ঘাঁটি স্থাপন করেন। সেখানে তার সাথে কাহাররা ও অন্যান্য ডাকাতের দল ডাকাতি ছেড়ে তার সাথে যোগ দেয়। তিনি নদীয়ার আশেপাশের বহু নীলকুঠি ও নীলের কারবার ধ্বংস করে দেন। তার এরূপ কর্মকান্ডে জেলা প্রশাসক ইলিয়ট এবং নীলকর ফেডি ভীত হয়ে পড়েন। বিশ্বনাথের মাথার জন্য হাজার টাকা পুরস্কার করা হয়। সরকার ও নীলকরেরা তার নাম তৎকালিন ব্রিটিশ ওয়ান্টেড লিস্টে 'বিশে ডাকাত' হিসেবে উঠায়।
১৮০৭ সালে, দীপাবলির রাতে বিশ্বনাথ কুঠিয়াল ফেডির বাসভবন ও কুঠি আক্রমণ করেন। ফেডির দলের প্রায় সবাই এই অকস্মাৎ আক্রমনে মৃত্যুবরণ করে বা পালায়। ফেডির স্ত্রী মাথায় কালো হাঁড়ি চাপিয়ে পুকুরে ডুব দিয়ে প্রানে বেঁচে যান। বিশ্বনাথের প্রধান সেনাপতি মেঘাই সরকার ফেডিকে বন্দি করে বাগদেবী খালের তীরে নিয়ে আসে। ফেডি বিশ্বনাথের কাছে প্রাণভিক্ষা চায়, এবং যিশুর নামে প্রতিজ্ঞা করে যে সে ব্যবসা উঠিয়ে ব্রিটেনে চলে যাবে। বিশ্বনাথ তাঁকে ছেড়ে দেন। ফেডি ছাড়া পেয়ে সেদিন দুপুরেই বিশ্বনাথকে ধরিয়ে দেয়। বিশ্বনাথ দিনাজপুর জেলে আটক হন।
কিন্তু বিশ্বনাথ জেল থেকে পালান এবং ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, পালানোর চারদিন পরেই তিনি আবার ফেডির ঘরে হানা দেন। তার কোষাগার লুণ্ঠন করে ও তার পাইক বাহিনীকে শেষ করে দিয়ে বিশ্বনাথ আবার ফেডির সামনে হাজির হন। কিন্তু এবারো ফেডি নীলচাষ তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন এবং বিশ্বনাথের ইষ্টদেবতার দোহাই দিয়ে ক্ষমা চান। বিশ্বনাথ এবারো তাঁকে খুন না করেই পালিয়ে আসেন।
ফেডি এবার বিশ্বনাথের ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লাগে। সরকারের কাছে আবেদন করে সে সেনাপতি ব্ল্যাকওয়ার ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি দলকে বিশ্বনাথের খোঁজে লাগায়। শুরু হয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম ম্যানহান্ট। তারা বিশ্বনাথের পালক পুত্র পঞ্চাননকে ধরতে সক্ষম হন। পঞ্চানন পুরস্কারের লোভে বিশ্বনাথের ঘাঁটির কথা ফাঁস করে দেয়। পরের দিন ব্ল্যাকওয়ারের সেনাবাহিনি কুনিয়ার জঙ্গল ঘিরে ফেলে, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বনাথ তার অনুচরদের বাঁচাতে নিজে ধরা দেন ও সমস্ত কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিজের ওপরে নিয়ে নেন। ফেডির মুখোমুখি হয়ে বিশ্বনাথ বলেন, 'গোরা সাহেব, আমি তোমার জুলুম থামিয়ে দিয়ে সংসারজীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি বাধ সাধলে। কিন্তু মনে রেখ, যে জীবন তুমি ভোগ করছ, তা আমার দান। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।'(৪৫)
গঙ্গার তীরভূমিতে বিশ্বনাথকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার মৃতদেহ সবাইকে দেখানোর উদ্দেশ্যে লোহার খাঁচায় ঢুকিয়ে একটা অশ্বত্থ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বিশ্বনাথের বিধবা মা তার কঙ্কালটি ভিক্ষা চান। কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি(৪৫)।
নীলকর শিবনাথঃ নায়ক, না খলনায়ক?
খুলনা জেলার ইলাইপুর তালুক পত্তনি নিয়ে রেনি নীলের কারবার শুরু করেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন একজন সৈনিক। এই রেনি তার ভয়ঙ্কর অত্যাচারের কারণে দ্রুত কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার পেয়াদা বাহিনির ভয়ে কুঠির সামনে দিয়ে দিনের বেলায়ও লোক চলাচল করত না। খুলনায় এমন প্রবাদও প্রচলিত ছিল,
শ্বশুর বাড়ি যাবার আগে
রেনি সায়েবের গাঁতা পাবে,
খড় কাটিতে হবে মাঠে
জাল হাতে দাঁড়াও ঘাটে।
রেনি এভাবে পথচারীদের ধরে কুঠির কাজ করিয়ে নিত, আর এই 'কাজ করিয়ে নেবার' সময়কাল কখনও কখনও সাত-আট দিন স্থায়ী হত। তার অত্যাচারে আশেপাশের গ্রামের রায়েতরা পালিয়ে যায়। রেনির কুঠির পাশে আরেক নব্য দেশি নীলকর শিবনাথ কুঠি স্থাপন করেন। ইনিও একজন অত্যাচারী নীলকর ছিলেন। রেনি প্রতিযোগিতা পছন্দ করতেন না, তিনি তার পাইক পেয়াদা বাহিনী পাঠিয়ে দেন শিবনাথের কুঠি পুড়িয়ে দিতে। শিবনাথ তার নিজের পাইকদের নিয়ে সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। শুরু হয় দুপক্ষের মাঝে মারামারি।
রেনির পক্ষে ছিল প্রাক্তন 'গোরা' সৈনিক এবং দেশি পেয়াদা নিয়ে পাঁচ হাজারের বেশি যোদ্ধা নিয়ে গঠিত বাহিনী। আর শিবনাথকে মানুষ প্রথমে সমর্থন করেনি, কিন্তু সময়ের সাথে মন্দের ভাল হিসেবে তাকেই মানুষ সমর্থন করা শুরু করে। তার পক্ষে আসে বিখ্যাত সব লাঠিয়াল- সরদার সাদেক মোল্লা, গহরতুল্লাহ, খান মাহমুদ, ফকির মাহমুদ, আফাজুদ্দিন, তিলকের রামচন্দ্র মিত্র, বাহিরদিয়ার চন্দ্রকান্ত দত্ত, পানিঘাটের ভৈরবচন্দ্র মিত্র ও গৌরচন্দ্র ধোপা ইত্যাদি। সাধারণ চাষি ও সহায়-সম্বলহীন কৃষকেরা তাঁকে সমর্থন করতে থাকে। শিবনাথ ও রেনির মাঝে খণ্ডযুদ্ধ লেগেই থাকত। তাঁদের যুদ্ধ নিয়ে জারিগানও গাওয়া হয়-
চন্দ্র দত্ত রণে মত্ত, শিব সেনাপতি
গহরতুল্লাহ গেলে গোলা, ছুঁড়ে মারে হাতি।
সাদেক মোল্লা লাঠিয়ে গোলা রেনির দর্প করলে চুর
বাজিল শিবনাথের ডঙ্কা ধন্য বাঙালি বাহাদুর।
খান মাহমুদ সরকি চালে যেন কামানের গুলি
দিশেহারা রেনির গোরা চক্ষুভরা ধূলি।
দুই প্রতিপক্ষের কুঠিই বারবার লুণ্ঠিত হয়, কুঠি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। রাতের বেলা রেনি শিবনাথের কুঠির গোলা ও নীলগুদাম ধ্বংস করে দিল তো পরের দিন সকালেই শিবনাথ রেনির নীলবোঝাই নৌকাবহর ডুবিয়ে দিল। এদের মারামারি থামাতে সরকার নয়াবাদ থানা ও খুলনা মহকুমা স্থাপন করে, সরকারি সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কিন্তু দুই দলের দাঙ্গাবাজি ও লাঠিবাজির মাঝে পড়ে সরকারি বাহিনী দুই মাসও টিকতে পারেনি। ১৮৫৫ সালে শিবনাথের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। শিবনাথ মারা যাবার পর তার বাহিনী শেষ মরণকামড় দেয়। এই আঘাত রেনির বাহিনী ঠেকাতে পারেনি, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই নিয়েও প্রবাদ চালু হয় - 'দেখিয়া শিবের ভঙ্গি, পলাইল দীনেশ সিঙ্গি।' আর সেই সাথে নীল চাষও খুলনা থেকে উঠে যায়(৪৭)।
সতী আরতি দেবীঃ সতীর অভিশাপ
সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য ছিলেন নীল চাষের ঘোর বিরোধী এবং এই কারণে সিন্দুরিয়া কুঠির জমিদার ম্যাকনেয়ারের পরম শত্রু। ম্যাকনেয়ার কিছুতেই আচার্যকে বাগে আনতে না পেরে তার পরিবারের ওপর শোধ তুলবার পরিকল্পনা করে। তাঁকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি। জমিদার পুত্রবধূ আরতি দেবী স্বামী অমরনাথের সাথে জমিদারি নৌকা 'ময়ূরপঙ্খি' করে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁদের সাথে ছিল দুই মাঝি তারিণী ও রোহিণী পাটনি এবং দুই বেহারা শম্ভু ও হাজারি সরদার। অকস্মাৎ ম্যাকনেয়ার তার বাহিনী নিয়ে তাঁদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ম্যাকনেয়ারের বন্দুকের গুলিতে অমরনাথ মারা যান। আরতি দেবী হুঙ্কার দিয়ে ওঠেনঃ ভয় কি শম্ভু, হাজারি? ভগবান আছেন, লাঠি চালাও! কিন্তু হাজারি একাই রুখে দাঁড়ায়, বাকিরা নদীতে ঝাঁপিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এই অসম যুদ্ধে একসময় হাজারি পরাজিত হয়। আরতি দেবীকে ম্যাকনেয়ার ধর্ষণ করে; তার নাক, কান ও স্তন কেটে নেয়। মৃত্যুর আগে আরতি দেবী অভিশাপ দিয়ে যানঃ 'এই পাপের আগুনেই যেন সবংশে পুড়ে মরিস'। পরেরদিন ভোরবেলা আরতির মৃতদেহ ম্যাকনেয়ারের কুঠি থেকে সামান্য দূরে বটতলায় বেতবনের কোলে আবিষ্কৃত হয়। আচার্যরা সম্মান ও মর্যাদার কথা ভেবে প্রচার করেন, মৃত মহিলা তাঁদের কেউ হয় না।
এই ঘটনার পর মথুরানাথ সর্বসমক্ষে বিপ্লবীদের সাথে একাত্মতাবোধ প্রকাশ করেন ও সরাসরি নীলচাষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার সাথে রইস খান, জমিদার শ্রীহরি রায় সহ আরও অনেকে যোগ দেন। ছয় মাস পরে, তারা একজোট হয়ে ম্যাকনেয়ারের কুঠিতে হামলা চালান। ম্যাকনেয়ার পালিয়ে যায়, কিন্তু কুঠিতে তার একমাত্র মেয়ে ইভা আগুনে পুড়ে মারা যায়। বারো দিন পরে, বিপ্লবী দল ম্যাকনেয়ারকে ধরতে সক্ষম হয়। মথুরানাথ ম্যাকের ঘাড়ে গুলি করেন। গুরুতর আহত ম্যাক মথুরানাথের সেই 'ময়ূরপঙ্খি' নৌকায় উঠে পালাতে চেষ্টা করে। মথুরানাথের আদেশে নৌকাসহ ম্যাকনেয়ারকে পুড়িয়ে মারা হয়।
সতী আরতি দেবীর অভিশাপে এভাবেই ম্যাকনেয়ার সবংশে পুড়ে মরে(৪৮)।
এরকম হাজার হাজার ঘটনা পুরো বাংলা জুড়েই ঘটতে থাকে। কৃষকেরা রাগে ক্ষোভে পাগল হয়ে ওঠে। সারা দেশের এমন পরিস্থিতি এবং নীলকরদের বেহাল অবস্থা দেখে অবশেষে সরকারের টনক নড়ে। বড় বড় লর্ডেরা 'বাণী' দিতে থাকেন। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্রান্ট লেখেন,
'শত সহস্র মানুষের বিক্ষোভের এই প্রকাশ যা আমরা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করছি, তাঁকে কেবল একটা রং সংক্রান্ত অতি সাধারণ বাণিজ্য-প্রশ্ন না ভেবে গভীরতম সমস্যা বলেই ভাবা উচিৎ। যারা এটি করতে ব্যর্থ, তারা সময়ের ইঙ্গিত ধরতে পারছেন না বলে আমার ধারণা।'(৪৯)
ব্রিটিশ জমিদার ও বণিক সমিতির সভাপতি ম্যাকিন্টশ ১৮৬০ সালের জুলাই মাসে ভারত সচিব চার্লস উডকে এক চিঠিতে লেখেন,
'গ্রামাঞ্চলে অবস্থা বর্তমানে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল। কৃষকেরা তাঁদের ঋণ ও চুক্তিপত্র অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মহাজন ও মালিক ইংরেজদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন করে হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার এবং সকল ঋণ রদ করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।'(৫০)
বড়লাট লর্ড ক্যানিং নীল বিদ্রোহের দুই মাস পরে ইংল্যান্ডে চিঠি লিখেন,
'নীল চাষিদের বর্তমান বিদ্রোহের ব্যাপারে প্রায় এক সপ্তাহকাল আমার এতই উৎকণ্ঠা হয়েছিল যে, দিল্লির ঘটনার (১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ) সময়ও আমি এতটা চিন্তিত হই নি। আমি সব সময় চিন্তা করেছি যে যদি কোন নির্বোধ নীলকর ভয়ে বা ক্রোধে একটি গুলিও ছোঁড়ে, তাহলে সেই মুহূর্তেই দক্ষিনবঙ্গের সমস্ত কুঠিতে আগুন জ্বলে উঠবে।'(৫১)
নিজেরা রক্ষা পেতে নীলকরেরা ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে স্মারকপত্র দেয়। সেখানে তারা জানায়,
'কৃষককুল সংগঠিতভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তাঁদের দিয়ে আর নীলের আবাদ করান সম্ভবপর হচ্ছে না। আদালতে কোন মামলা দায়ের করা যাচ্ছে না, কারণ আমাদের অভিযোগ প্রমাণের জন্য কোন সাক্ষি পাওয়া যাবে না। এমনকি আমাদের কর্মচারীরাও আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে সাহস পাচ্ছে না......রায়েতরা বর্তমানে খুবই মারমুখি। তারা ভয়ঙ্করভাবে খেপে গেছে। তারা বর্বরের মত যেকোনো দুষ্কার্য করতে এখন প্রস্তুত। প্রতিদিন তারা আমাদের কুঠি এবং বীজের গোলায় আগুন দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের প্রায় সকল কর্মচারী ও চাকরেরা কুঠি ত্যাগ করে চলে গেছে। কারণ প্রজারা তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া বা খুন করার ভয় দেখাচ্ছে। যে দুই একজন আছে, তারাও খুব শীঘ্র চলে যেতে বাধ্য হবে। কারণ পার্শ্ববর্তী বাজারেও তারা খাদ্যদ্রব্য কিনতে যেতে পারছে না। সকল জেলাতেই বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে।'(৫২)
নীলচাষের অন্তিমকালঃ ইন্ডিগো কমিশন গঠন
কৃষকদের বর্বর অত্যাচারে(!) নীলকরদের গেলুম গেলুম রব শুনে সরকারের ইয়ে, অর্থাৎ 'টনক' ভাইব্রেট করে ওঠে। ১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ নীল কমিশন বা ইন্ডিগো কমিশন গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন বঙ্গীয় সরকারের সেক্রেটারি M.W.S. Seaton Carr। কমিশনের একজন বাদে সবাই ছিলেন ইংরেজ। বাকি ওই একজন ছিলেন জমিদার সমিতির এক সদস্য। কমিশনের প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৬০ সালের ১৮ মে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। কমিশন তিন মাসে ১৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। সাক্ষীদের মাঝে ১৫ জন সরকারি কর্মচারী, ২১ জন নীলকর, ৮ জন মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৯ জন নীলচাষি(৫৩)। ভয় নাই সবার সাক্ষ্য শোনাব না। দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে কমিশন রিপোর্ট দেয়, 'The whole system is vicious in theory, injurious in practice and radically unsound.'(৫৪)
কমিশনের রিপোর্ট ও ছোটলাটের স্বীকৃতি সত্ত্বেও সরকার রায় দেয় নীলকরদের দিকেই। সরকার নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে, কিন্তু নীলকরদের নিরাপত্তার জন্য পূর্বের সকল দমনমূলক আইন বজায় রাখা হয়; নতুন নতুন থানা ও মহকুমা স্থাপন করে পুলিশের শক্তি বাড়ানো হয়, যাতে সহজে বিদ্রোহ দমন করা যায়(৫৫)। সেই সাথে কৃষকদের সান্ত্বনা দিতে কয়েকটি অর্থহীন ইশতেহার জারি করা হয়-
১. সরকার নীলচাষ করার বিষয়ে নিরপেক্ষ।
২. আইন অমান্য করলে বিদ্রোহী প্রজা বা নীলকর কেউই শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।
৩. অন্য শস্যের মত নীল চাষ করা বা না করা প্রজার ইচ্ছাধীন।
সরকারের এ প্রতারণা কৃষকেরা বুঝতে পারে। নদীয়া ও যশোরের কৃষকেরা হেমন্তকালীন নীলচাষ করা এবং জমিদার ও নীলকরদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ধ্বংসাত্মক কর্মতৎপরতা থামাতে সরকার দুই জেলায় দুই দল সৈন্য রণতরী যোগে পাঠায়। দুই দলের অধিনায়কদের সাথে কৃষক জনতা আলোচনায় বসে। প্রজারা বলে, 'খাজনা দিতে আপত্তি নেই, তবে নীলকর ও জমিদারদের নির্যাতন হতে প্রজাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে(৫৬)'। অধিনায়ক দুজন ফিরে গিয়ে এই বিষয়ে রিপোর্ট দাখিল করেন।
রিপোর্ট পেয়ে বাংলার ছোটলাট গ্রান্ট স্বচক্ষে অবস্থা দেখতে স্টিমারে করে গোপনে ১৮৬০ সালের অগাস্ট মাসে ৭০ মাইল দীর্ঘ জলপথ পরিভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর পর কোনভাবে প্রজারা জেনে ফেলে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ স্টিমার তীরে ভেড়াবার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁদের হাতে ঝাঁকিজাল ও কোঁচ। গ্রান্ট ভীত-সন্ত্রন্ত হয়ে নদীর মাঝ দিয়ে স্টিমার চালাবার আদেশ দেন। কিন্তু পথ কোথায়? নদী মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ। গ্রান্ট ভয় পেয়ে যান। কিন্তু জনতা তাঁকে অভয় দেয়, তিনি অতিথি, তার জীবনের কোন ভয় নাই। স্টিমার তীরে ভেড়ান হল। গ্রান্ট সবাইকে পাবনা যেতে বললেন। বললেন, সেখানে জনসভায় তিনি নীল চাষ তুলে দেবার ঘোষণা দেবেন। এবারে স্টিমার চলল পাবনা। জন পিটার গ্রান্ট নিজেই এ অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। বলেছেন, প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে ৬০-৭০ মাইল পথ ভ্রমণকালে তিনি নদীর উভয় পার্শ্বে লক্ষ লক্ষ জনতার ভিড় দেখেছেন। এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আর কোন রাজকর্মচারীর হয়নি(৫৭)।
পাবনায় গিয়ে জনসভায় গ্রান্ট বলেন, 'অতি শীঘ্রই নীল চাষ বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাষির ইচ্ছা ব্যতীত, কাউকে জোর করে নীল চাষ করান যাবে না। কেউ জোর করে নীল চাষ করালে আইন কঠোর হাতে তাঁকে দমন করবে'। কিন্তু গ্রান্ট তার কথা রাখতে পারেননি। নীলকররা তাঁদের সমিতি Indigo Planters Association এর ক্ষমতার জোর খাটিয়ে নীল চাষ বন্ধের যে আইন প্রণীত হবার কথা ছিল, তা রদ করে দেয়। এমনকি নীলকর সমিতি তাঁকে কঠোর অবস্থানের জন্য গালাগালি করতে থাকে। বিক্ষুব্ধ গ্রান্ট বিবৃতি দেন, 'আইনের বিপক্ষে, নীলচাষের সপক্ষে পৃথিবীর কোন শক্তিই আর বেশিদিন এ ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে পারবে না। ন্যায়ের পথ উপেক্ষা করে যদি সরকার চলতে থাকে, তবে আরও বিপুল কৃষক অভ্যুত্থান ও বিপ্লব সরকারের শাস্তি বিধান করবে। সেই অভ্যুত্থান ভারতে ইউরোপীয় ও অন্যান্য মূলধনের পক্ষে যে সাংঘাতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে তা সাধারণ মানুষের হিসাবের বাইরে।'(৫৮)
ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম পরবর্তীতে লিখেছিলেন, 'বিভিন্ন তথ্য থেকে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা ভয়ঙ্কর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি...আমাকে বিভিন্ন জেলা-মহকুমার রিপোর্ট দেখানো হয়, সেগুলোতে বারবার বিপ্লবের কথা, দরিদ্র মানুষের কথা এসেছে...তারা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে, অত্যাচারে-অনাচারে তাঁদের মৃত্যু অনিবার্য। মরবার পূর্বে তাই তারা একটা কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।...এ একটা কিছুর অর্থ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটা ব্যাপক অভ্যুত্থান শুরু হবে, এবং সেটা কৃষকদের মাঝে থেমে থাকবে না(৫৯)।'
এদের কথা সত্যি হয়ে দেখা দেয় ক'বছরের মাঝেই। যারা জুলুমবাজ নীলকর ছিল, বিপ্লবের মুখে তারা ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়, নইলে কৃষকদের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারায়। শুধুমাত্র যারা প্রজাদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে শিখেছিল, তাঁদের কুঠিই টিকে থাকে। এসব কুঠিয়াল টিকে থাকার জন্য নানা জনহিতকর কাজ করতে শুরু করে। নতুন রাস্তাঘাট করে দেয়, মজা পুকুর সংস্কার করতে সাহায্য করে। নতুন মন্দির বানিয়ে দেয়। আবার এদের মাঝে ব্যতিক্রম ছিল সিন্দুরিয়া কুঠির ম্যানেজার ড্যাম্বেল পিটারস। সে এই বিদ্রোহে খেপে গিয়ে আরও বেশি অত্যাচার চালাতে শুরু করে। ওই স্থানে পুলিশের সংখ্যা বেশি ছিল বলে কৃষকদের প্রতিবাদ করতে গেলেই বিপদে পড়তে হত। এরই ফল হিসাবে ১৮৮৯ সালে সিন্দুরিয়ায় সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ হয়। ফলস্বরূপ নীল চাষ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যায়। এই বিদ্রোহে সর্বপ্রথম অভিজাত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কৃষকদের সমর্থন করেন।
সিন্দুরিয়ার বিদ্রোহ ছিল সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ। এর পরে বাংলায় আর বিদ্রোহ হয়নি, করার দরকারও হয়নি। কারণ কৃষকদের এমন বিদ্রোহে প্রাণ বাজি রেখে নীল চাষ করতে নীলকররা আর আগ্রহী হতে পারেনি। তাছাড়া জার্মানিতে কৃত্রিম রং আবিষ্কৃত হয়, এতে নীলকরদের লাভ পঞ্চাশ ভাগ কমে যায়। ফলে সব মিলিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে নীল চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার কৃষক মুক্তি পায় ঘৃণ্য নীলকরদের হাত থেকে।
সবটুকু পড়ে আপনি বলতে পারেন, নীল বিদ্রোহ সফল হল কেন? যেখানে কাছাকাছি সময়ে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ ও সিপাহি বিদ্রোহ দাঁড়াতেই পারেনি, সেখানে নীল বিদ্রোহের সাফল্যের পেছনে কারণ কি?
কারণ তিনটি। প্রথমতঃ, নীল বিদ্রোহের সম্পূর্ণ উৎপত্তি কৃষক অর্থাৎ উৎপাদক শ্রেণীর হাতে। এই বিদ্রোহে গ্রাম সমবায় আরও মহৎ হয়ে শ্রেণী সমবায়ে পরিণত হয়। একজন নেতা হারালে আক্ষরিক অর্থেই একশ জন এসে সে খালি স্থান পূরণে সক্ষম ছিল। সুতরাং নেতৃত্ব পরিচালনায় কখনো ছেদ পড়ে নি।
দ্বিতীয়তঃ, তখন নব্বই শতাংশ লোক কৃষিকাজ করত। এরা যেকোনো বিদ্রোহের বেস হিসেবে কাজ করে। বেস-ই যখন বিদ্রোহ করে, সে বিদ্রোহ থামানোর সাধ্য কার?
তৃতীয়তঃ, কৃষকদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে কোন বিভ্রান্তি ছিল না। রুখে দাঁড়াতে হবে, নইলে না খেয়ে মরব - এতটাই সরল ছিল তাঁদের ভাবনা।
আর এই কারনেই বাংলার সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ - নীল বিদ্রোহ।
টীকা
১. মাধ্যমিক সামাজিক বিজ্ঞান (শিক্ষাবর্ষ ২০১০), পৃঃ ৪৭-৪৮
২. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৯৩
৩. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ১৭
৪. C.E. Buckland: Bengal under the Lieutenant Governors
৫. Major Smith: Report on the Maldah
৬. শ ম শওকত আলিঃ কুষ্টিয়ার ইতিহাস
৭. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
৮. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ১৯
৯. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
১০. W.W. Hunter: Imperial Gazetteer of India
১১. প্রমোদ সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাঙ্গালি সমাজ
১২. তৎকালীন সময়ে কোন জমিতে যদি তাগিদগীর প্রায় একহাত লম্বা একটি খুঁটি গেড়ে তার মাথায় দড়ি বেঁধে দিত, তাহলে কৃষক বুঝতে পারত যে এই জমিতে নীল চাষ করতে হবে। এটাই 'দাগ মারা'।
১৩. যার জন্য পেয়াদার নামের সাথে ব্যঙ্গার্থে 'সম্বুন্ধি' শব্দটি যোগ করা হত এবং তখন থেকে এটি গালি হিসেবে প্রচলিত হয়।
১৪. এজন্য সমাজে তাদের নাম বিকৃতভাবে ধরা হত - রামা ভেড়ি, জমরে মাহুত, আহাদে মালি, বিশে মুর্গি, স্যাকরা বরকন্দাজ, হরে পেয়াদা ইত্যাদি।
১৫. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'ভুলে যাওয়া নীলঃ রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব', পৃঃ ২৯
১৬. ব্রিটিশ সরকার এই ভূস্বামীদের এক থেকে সাতটি খুন করার অধিকার পর্যন্ত দিয়েছিল। এই বিষয় থেকেই 'সাতখুন মাপ' কথার উৎপত্তি।
১৭. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ২৪
১৮. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'ভুলে যাওয়া নীলঃ রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব', পৃঃ ৪২
১৯. বারুই পাড়া থেকে এত বেশি নীল রপ্তানি হত যে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হয় নীলগঞ্জ।
২০. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ২৫
২১. তাজুল ইসলামঃ 'চুয়াডাঙ্গার করুণ কথা'
২২. সিন্দুরিয়া কুঠি স্থাপনের জন্য মে সাহেব প্রথমে মরতুজাপুর গ্রামের কাছে পাঁচপীরতলায় আসেন। সেখানে এক বিরাট শ্যাওড়া গাছ ছিল। তার সংলগ্ন দুইটি উঁচু ঢিবি-ও ছিল। কিংবদন্তিতে আছে, এই স্থানে কুতুব উদ্দিন শাহ এবং হজরত অলি নেয়ামত শাহ নামক দুই ইসলাম প্রচারক বুজুর্গের সমাধি ছিল এবং আরেক বিখ্যাত পীর ওলি দেওয়ান শাহ এখানেই শিক্ষা প্রদান করতেন। মে সাহেব সে গাছ কেটে কুঠি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলে গ্রামবাসী তার প্রতিবাদ করে এবং সকল কুলি মজুর কাজে অনীহা জানায়। এমনকি সাহেবের প্রধান কাঠুরিয়া কালিচরণ সরকার সরদার বাগদীও সরাসরি হুকুম অমান্য করে। এতে সাহেবের পুত্র, টমাস আইজ্যাক মে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেই কুঠার হাতে সরাসরি গাছের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্ত মাত্রের ঘটনা! উত্তেজনা কাটতেই দেখা গেল তার কুঠারাঘাত গাছে না লেগে তার তলপেটের বাম পাশ ভেদ করে গেছে! কলকাতায় নিয়ে যাবার পথে তার মৃত্যু হয়। মে সাহেব পরের সপ্তাহেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
২৩. রিভস সেই শ্যাওড়া গাছ এবং তার সংলগ্ন উঁচু ঢিবি বাইরে রেখে নতুন দালানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু এবার নতুন উৎপাত শুরু হয়। সারাদিন সে দেয়াল এবং দালান স্থাপিত হত, রাতে কে বা কারা এসে তা নিকটাবর্তী নবগঙ্গার জলে নিক্ষেপ করত। প্রথমে পাহারাদার এবং পরে হিন্দু পেয়াদা রেখেও এই ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে রিভস তার অংশীদারদের পরামর্শে এখানকার অর্ধনির্মিত কুঠি ত্যাগ করে দোলাই খালের একাংশ মাটি ভর্তি করে সেখানে কুঠি নির্মাণ করেন।
২৪. ইঞ্জিনিয়ার মিঃ বোরিক কুঠির নির্মাণকালে এখানে তাবু খাটিয়ে বাস করতেন বলে স্থানটি আজ অবধি 'বোরিক পোল' নামে অভিহিত।
২৫. সিন্দুরিয়া নীলকুঠির সচিবালয় বাংলাদেশের মাঝে সর্ববৃহৎ ছিল।
২৬. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৩১
২৭. কথিত আছে, ম্যাকনেয়ার সারাদিন যাদের ওপর অত্যাচার চালাতেন, তাঁদেরকে রাতে নাচমহলে ডেকে সারারাত ভাল ভাল খাবার খাওয়াতেন, আপ্যায়ন করতেন। বেচারা কৃষক খুশি হত, ভাবত সাহেব আর মারবেন না। কিন্তু সকাল হলেই কাছারি ঘরে ডেকে আবার তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়ে যেত।
২৮. Calcutta review. Vol. 36, p. 40
২৯. James Watts: Dictionary of Economy Products of India.
৩০. প্রমোদ সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাঙ্গালি সমাজ
৩১. Indigo Comission Report, Evidence, p. 32
৩২. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
৩৩. নীল কমিশনের সামনে তারাচাঁদ মণ্ডলের স্বীকারোক্তি
৩৪. Calcutta Review, Nov. 1860
৩৫. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৪৮
৩৬. দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডল অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন। তিনি নীলবীজ বাড়িতে এনে বপন না করে নষ্ট করে ফেলেন। কুঠিয়াল তাঁকে তলব করে এর কারণ জানতে চায়। তিনি উত্তর দেন, 'হুজুর, ভুলক্রমে ছেলেপিলে নীলবীজকে তিল ভেবে ভেজে খেয়ে ফেলেছে। এবারের মত মাফ চাই।' কুঠিয়াল তার কথা শুনে আবার তাঁকে নীলবীজ দেন। এবারে তিনি বীজগুলো ভেজে তারপর বপন করেন, যাতে নীলের উৎপাদন না হয়। তার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে হাজার হাজার বিঘার নীল আবাদ নষ্ট করে ফেলে।
৩৭. কুঠির প্রজাদেরকে দুই আনা বৃদ্ধি করে কবুলিয়াতি দেয়ার আদেশ করা হয়। প্রজারা প্রতিবাদ করলে শীতল বিশ্বাস উৎপীড়ন শুরু করে। প্রজারা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার কাছারিঘর লুটপাট ও ভস্মীভূত করে এবং নিকটাবর্তী বিলের কাছে তাঁকে ঘেরাও করে। তর্ক বিতর্কের সময় প্রজাদের একজন বলে, নাক কান কেটে দাও, হত্যা কর না। এই কথা শুনে গোমস্তা রেগে গিয়ে বলে, 'নাক-কান কেটে দিয়ে ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে দোব।' ফলে উত্তেজিত জনতা তাঁকে সেখানেই হত্যা করে বিলের পাড়ে পুঁতে রাখে।
৩৮. ঘোলদাড়ি গ্রামের কৃষক রব্বানি চুক্তিপত্রে কখনো টিপসই দেননি। কুঠিয়াল ব্রুমফিল্ড তাঁকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেন, এমনকি এক পর্যায়ে রব্বানির বামহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ নেবার জন্য আঙ্গুলটি কেটে নেয়। তবু তিনি হার মানেন নি, বরঞ্চ পালিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী বাহিনিতে যোগ দেন।
৩৯. Indian Field, April, 1860
৪০. Hindu Patriot, February, 1860
৪১. অনাথনাথ বসুঃ 'মহাত্মা শিশিরকুমার'
৪২. সতীশচন্দ্র মিত্রঃ 'যশোর খুলনার ইতিহাস'
৪৩. সুপ্রকাশ রায়ঃ প্রাগূক্ত
৪৪. শ.ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৪৫. শ্রী মোহিত রায়ঃ কুখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩/১০/৬১
৪৬. শ্রী বিমলেন্দু করনিঃ 'বিশে ডাকাত' প্রবন্ধ
৪৭. শ. ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৪৮. যোগেশচন্দ্র বাগলঃ Peasant revolution in Bengal.
৪৯. Parliamentary Papers, Vol.45, p. 75
৫০. Hindu Patriot, August, 1860
৫১. Buckland: Bengal under the Lt. Governors
৫২. Hindu Patriot: 17th march, 1860
৫৩. Indigo Comission Report, Evidence, p. 13
৫৪. Indigo Comission Report, Evidence, p. 03
৫৫. শ.ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৫৬. এম. এ. বারিঃ চুয়াডাঙ্গা গ্যাজেটিয়ার
৫৭. Buckland: Bengal under the Lt. Governors, Vol.1, p. 96
৫৮. Parliamentary Papers, Vol. 45, p. 96
৫৯. Sir William Wedderburn: Allan Octovian Hume, Father of Indian National Congress
*কিছু লিংক
Click This Link
https://en.wikipedia.org/wiki/Ashley_Eden
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Indigo_revolt
http://www.banglapedia.org/HT/I_0054.HTM
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
*আর একটা কথা। আমি ছোটগল্প পড়তে ভালবাসি। তাই ব্লগে যারা ভাল গল্প লেখেন বলে আপনার মনে হয়, তাঁদের নাম কমেন্টে দিলে খুশি হতাম।