ইতিহাস বিখ্যাত পারস্য কবি আবদুর রহমান ইবনে আহমদ মোল্লা জামী (রহঃ)। তিনি নুরুদ্দিন বা আবুল বারাকাত নামে পরিচিত ছিলেন। ৮১৭ হিজরী সালে তিনি খোরাসানে জন্ম গ্রহণ করেন এবং মৃত্যবরণ করেন ৯১৬ সালে। জাম নামক স্থানে অবস্থান করতেন বলে তাকে জামী নামে ডাকা হয়। খাজা আলী সমরকন্দি, জুনদ উছুলীসহ নিজ পিতা থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। কবিতার প্রতি ছিল আর চরম আশক্তি। কবিতা লেখা, আবৃত্তি করা তার খুব পছন্দনীয় কাজ ছিল। পারসী কবিদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল প্রায় শীর্ষে। একবার মক্কায় হজ করতে গিয়ে তিনি নবীজি (সাঃ) এর শানে কিছু কবিতা লেখেন এবং নবীজির রওজায় গিয়ে কবিতাগুলো পাঠ করবেন বলে মনস্থির করেন। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি রওয়ানা দিলেন। তার কবিতাগুলো এতটাই আবেগী ছিল যে নবী (সা তৎকালীন বাদশাহ কে স্বপ্নযোগে তাকে মদিনায় আসতে দিতে বারণ করেন। নবীজি বলেন সে যদি এই কবিতা আমার রওজার পাশে দাঁড়িয়ে পাঠ করে তাহলে তার সাথে আমার হাত বের করে মুসাফা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। জামি খবরটি শুনে লুকিয়ে মদিনার পথে চলতে থাকেন। বাদশা অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে তাকে উটের পেটের নীচে খাবার রাখার চটের যে থলি থাকে তা থেকে বের করে কয়েদখানায় আবদ্ধ করেন। অতপর নবীজি আবার স্বপ্নযোগে তাঁকে কয়েদখানা থেকে ছেড়ে দিতে বললে বাদশাহ তাকে ছেড়ে দেন। তিনি আবার রওয়ানা দিলে তাকে আবার আবদ্ধ করা হয়।
তার সেই প্রসিদ্ধ কবিতাগুলো হুবহু অনুবাদ করার ক্ষমতা আমার নাই। নবী প্রেমের সে পরিমাণ আবেগও নাই। তবু যতটুকু বুঝেছি তা অনুবাদ করে দিলাম।
১. আপনার অনুপুস্থিতিতে খন্ড খন্ড হয়ে জগতের প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে
ওগো নবীজি রহমত করুন-দয়া করে একটু দয়া করুন।
২. নিঃস্বন্দেহে আপনি জগতের জন্য রহমত স্বরূপ
অথচ আমাদের রহমত থেকে বঞ্চিত করে
আপনি কিভাবে আনমনা হয়ে ঘুমিয়ে আছেন
৩. হে মুক্তার ঝলক
আপনার ধবধবে আলোক রৌশ্মি দ্বারা
জগতকে উপকৃত করুন
নারগিস ফুলেল ঘুম থেকে জেগে
আলোকিত করুণ হেদায়াত প্রার্থী আমাদের এ মনকে
৪. ইয়ামানি চাদরে আবৃত কাফন থেকে আপনার শির মোবারক একটু বের করুন
কেননা আপনার দর্শন যেন আমাদের জীবনের সকাল বেলা
৫.আপনার বিরহ ব্যথায় আমাদের দিনগুলো যখন রাত হয়ে যায়
তখন আপনার সৌন্দর্য্য পেলে অস্ত যাওয়ার আগেই
আবার লাগাতার সুর্য উদয় হতে থাকে
৬. আপনার পবিত্র শরীর মেস্কাম্বরের পোষাকে আচ্ছাদিত
আর শির মোবারক আবৃত যেন সাদা পাগড়ী দ্বারা
৭. সুগন্ধিযুক্ত পাগড়িখানা মাথা থেকে একটু ঝুলিয়ে দিন
যেন তার ছায়ার বরকতে আমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হই
৮.সমস্ত জগতকে আপনার মনোবৃত্তির চাদর করে বিছানো হয়েছে
এমতাবস্থায় জমিন আপনার বিছানো চাদরে কদমবুচির গৌরব অর্জন করতে চায়
৯. তায়েফের প্রসিদ্ধ সেই রক্তাক্ত দু’টি জুতা পরিধান করুন
এবং নতুন করে আমাদেরকে আপনার নিকটাত্মীয় বানিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিন
১০. যেমন করে সবুজ গম্বুজ থেকে বের হতেন, সেভাবেই বের হয়ে আসুন মসজিদে হারামের বারান্দায়। আপনার অনুসারীগণ যে পথে চলে-সেখানে একটু কদম রাখুন, আমি সেই পবিত্র কদেমর ধুলোয় চুমু খেতে চাই
১১. অক্ষমের বিনয়ী দরখাস্তখানা অবিবেচনাপূর্বক কবুল করুন
ভালবাসা দিন প্রকৃত প্রেমিকের মনের জ্বালা মিটাতে
১২. যদিও আমরা অপরাধের সাগরে মাথা পরিমাণ ডুবন্ত
তবুও আপনার রাস্তায় পিপাসার্ত শুকনো দুটি ঠোট নিয়ে লেপ্টে আছি
১৩. আপনি রহমতের মেঘ, উন্মুক্ত দাতা (সাধারণ দান অর্থে)
পিপাসার্ত শুকনো দুটি ঠোটে এক ফোটা করুণার বৃষ্টি ঢেলে দিন
১৪. আমাদের জন্য কতইনা ভাল হত যদি আমরা কোনভাবে আপনার খেদমতে
পৌঁছাতে পারতাম এবং আপনার পবিত্র রওজার মাটি দিয়ে চোখের শুরমা বানাতাম
১৫ . বারবার কৃতজ্ঞতা জানাই মসজিদে নববীর। কৃতজ্ঞতার সেজদা এবং আপনার পবিত্র রওজার আলোক রৌশ্মি যদি আমার প্রাণের দুঃখবোধের ডানা হত আর আমি উড়ে যেত পারতাম আপনার রওজায়।
১৬. হে প্রিয় নবী আপনার পবিত্র রওজা এবং সবুজ গম্বুজ আমাকে এতটাই দগ্ধ করে যে, প্রেমের আগুনে পুড়ে আমার কলিজা টুকরো টুকরো হয়ে চালনীর ছিদ্রাকার ধারণ করেছে। আমার অদৃষ্টেই চোখের মেঘ থেকে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে আপনার রওজায় এবং থেমে থেমে আসছে মাতমের রোল
১৭. কখনো হেরেম শরীফের বারান্দায় ঝাড়ু– দিয়ে
কখনোবা চারপাশ ঘাসমুক্ত করার সৌভাগ্য অর্জন করতে চাই
১৮. কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে গেছে, আপনার নুরের আলো হবে আমার দৃষ্টি
এবং আমার এই অন্ধত্বই বিরহভাঙ্গা মনের স্মৃতি বহন করবে
১৯. ঐ মিম্বরে যেতে ইচ্ছে করে যেখানে আপনি কদম রাখতেন
আমার ভালবাসাভুক্ত দুই চোয়াল সেখানে ডলে ডলে মনকে একটু শান্ত করতে চাই
২০. যে মেহরাব এবং যে মুসল্লায় আপনি সালাত আদায় করতেন সেখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে মনের তৃপ্তি মিটাতে চাই। মুসল্লার যে স্থানে আপনার ‘পা’ মোবারক রাখতেন, ভালবাসার রক্ত দিয়ে তা যদি ধুয়ে দিতে চাই
২১. আপনার মসজিদের মিম্বরের পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে
দু’জন সত্যবাদীকে স্বাক্ষি রেখে আমি দরখাস্ত পেশ করছি
২৩. আপনার ভালবাসায় আমার মনে যখমের যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে
তা ক্রমেই চুড়ান্ত রূপ ধারণ করছে এবং আলোকিত করছে আমার আশা
২৪. আল্লাহর কাছে লাখো কৃতজ্ঞতা যে, আমার শরীর যদিও মসজিদে হারামে নেই
কিন্তু আমার বিদগ্ধ আত্মাখানা পড়ে আছে আপনার রওজায়
২৫ আমি আমার আমিত্ম এবং নফসে আম্মারার জালে কঠিনভাবে আটকে পড়েছি।
এমন অক্ষমের দিকে একটু দয়াকের-করুণার দৃষ্টি দিন
২৬. যদি আপনার করুনার দৃষ্টি এবং সাহায্য না পাই তবেতো আমি পঙ্গু হয়ে যাব
অক্ষম হয়ে পড়বো কোন কাজ থেকে
২৭. প্রতিনিয়ত অহংকার এবং অকৃতজ্ঞতা আমাদের আল্লাহর পথ ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে, দয়া করে আল্লাহর কাছে একটু দোয়া করুন
২৮. প্রথমত দোয়া করবেন আল্লাহ যেন আমাদের বিশ্বাসযোগ্য ঈমান, দৃশ্যমান ই'তেকাদের জাকজমকপূর্ন জীবন দেন। আরো দোয়া করবেন শিশাঢালা প্রাচীরের মত পরিপূর্নভাবে দ্বীনের ওপর যেন অটল থাকতে পারি
২৯. যখন কিয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরী হবে
দোয়া করবেন সেদিনের মালিক যেন জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে আমাদের ইজ্জত রক্ষা করেন
৩০. আমাদের অন্ধদৃষ্টি, অদেখা ছোটবড় অপরাধগুলো মার্জনাপূর্বক আপনাকে শাফায়াত করার যেন অনুমতি দেন কারণ তার অনুমতি ছাড়া সেদিন কারোরই সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকেব না
৩১. আমাদের অপরাধের লজ্জায় আপনি মাথা ঝোঁকানো কোন ব্যক্তি মত (ইয়া নাফসী ইয়া নাফসী) না বলে রবের কাছে ইয়া উম্মাতী উম্মাতী বলে আরজু পেশ করবেন
৩২. দোয়া করবেন আপনার দয়ার ডানার ভেতর আলগে থেকে অন্য নেককার বান্দাদের সাথে হয়ত এই গুনাগার জামি’রও মুক্তি মিলে যেতে পারে