"ডিসেম্বরে ৪০০-র কোটা পার করল মাসুদ রানা সিরিজ। বিশ্বসাহিত্যে এরকম অনেক চরিত্র থাকলেও, আমাদের দেশে এটি প্রথম। যেভাবে মাসুদ রানা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি পাঠকদের মন কেড়েছে, অন্য কোনো চরিত্রই তা পারেনি। 'মাসুদ রানা'র ৪০০ সংখ্যা পূর্তি উপলক্ষে স্পটলাইটের এই বিশেষ আয়োজন।
কাজী আনোয়ার হোসেন:
১৯৬৫ সালের গোড়ার দিকে আমার প্রতিবেশী ও বন্ধু, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী (প্রয়াত) জাহিদুর রহিম আমাকে বললেন, 'চল, শিকার-পাগল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, তোর ভালো লাগবে।' হাতে জরুরি কোনো কাজ ছিল না, গান-বাজনার পাশাপাশি ছোট্ট একটা প্রেস চালাই; ফাঁকে ফাঁকে লিখি। বললাম, 'চল, যাই।' ভদ্রলোকের নাম মাহবুব আমিন, জিন্নাহ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু) এভিনিউয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের এক রেডিও প্রস্তুতকারক আরজিএ কোম্পানির সেলস ম্যানেজার ছিলেন তখন। আমার হোন্ডা ফিফটিতে চেপে তার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। ব্যস, ঠিক যেন প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম দুজন দুজনার। যাওয়া-আসা শুরু হলো ঘন ঘন, প্রায় প্রতিদিন।
আমি তখন বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে 'কুয়াশা' সিরিজের তিনটি বই লিখে চতুর্থটিতে সবে হাত দিয়েছি। সেটি আর লেখা হলো না কোনো দিন। কিছুদিন পর আমার বই তিনটি পড়ে তিনি বললেন, 'ভালোই হয়েছে। তবে বোঝা গেল দুনিয়ার প্রথম সারির থ্রিলার-সাহিত্য সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। এই বলে 'ডক্টর নো' বইটি উপহার দিলেন আমাকে। ওই একটি বই পড়েই বদলে গেল আমার ধ্যান-ধারণা, লজ্জা হলো।
জীবনে ওই প্রথম প্রথমশ্রেণীর স্পাই থ্রিলারের সংস্পর্শে এসে উপলব্ধি করেছিলাম, বাংলা সাহিত্যে থ্রিলার রচনায় আমাদের সত্যিকার দুঃখজনক অবস্থান। সে সময় আমার জ্ঞানের দৌড় ছিল তৎকালীন ভারতীয় গোয়েন্দা কাহিনী এবং বড়জোর এক-আধটা আগাথা ক্রিস্টি পর্যন্ত।
এই মাহবুব আমিনেরই অনুপ্রেরণায় হাত দিলাম মাসুদ রানার প্রথম কাহিনী 'ধ্বংস-পাহাড়ে'। জেমস বন্ড দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সত্যিই কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু ওই চরিত্রটি ষোলো আনাই ইংরেজ, হুবহু অনুকরণ করা যায় না। লাইসেন্সপ্রাপ্ত কিলারের কনসেপ্টও আমার ভালো লাগেনি; তাই ধরনটা মোটামুটি ঠিক রেখে তৈরি করলাম এক বাঙালি নায়কের চরিত্র।
লেখার আগেই নামটা স্থির করে নিয়েছিলাম আমার গৃহিণীর সঙ্গে আলাপ করে। তিনি তখন ফুটফুটে সুন্দর মিষ্টি এক তরুণী: প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন। আমাদের দুজনেরই বন্ধু স্বনামধন্য গীতিকার মাসুদ করিমের 'মাসুদ' আর আমার ছেলেবেলার হিরো ইতিহাসে পড়া মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে 'রানা' নিয়ে নাম হলো মাসুদ রানা। রানার চেহারা স্পষ্ট করে বর্ণনার ব্যাপারে বরাবরই আমার কিছুটা রিজার্ভেশন ছিল_আমি চেয়েছিলাম চেহারাটা আবছা থাকুক, পাঠক নিজেকেই আমার উপন্যাসের নায়ক মনে করুক। তাই ওর চেহারার সামান্য আভাস দিয়েছি আমি, বাকিটুকু পাঠকের সৃষ্টি। আমার মাসুদ রানা মনেপ্রাণে একজন বাঙালি দেশপ্রেমিক। কয়েকটি বই লিখতেই এবং সেই সঙ্গে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, ডেসমন্ড ব্যাগলি, হ্যামন্ড ইনস, ফ্রেডেরিক ফোরসাইথ, পিটার বেঞ্চলি, কেন ফোলেট, ক্লাইভ কাসলার, এডওয়ার্ড এস আরনস, কলিন ফর্বস, জেরার্ড ডি ভিলিয়ার্স, জ্যাক হিগিন্স, এ জে কুইনেল, জিওফ্রি জেনকিনস, উইলবার স্মিথ_ এ রকম অনেক বড় বড় থ্রিলার রাইটারের বই পড়তে পড়তে রানার চরিত্র ক্রমেই আলাদা হয়ে গেল আরো।
ধ্বংস-পাহাড়ের জন্ম ঢাকার সেগুনবাগিচায়, এই বাড়িরই দোতলায় বসে। আমার নিজের জন্মও এখানেই। আট-নয় মাসের মতো লেগেছে লিখতে। প্রথমে খসড়া একটা প্লট সাজালাম: 'কুয়াশা' টাইপের এক প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক কাপ্তাই শহরের কাছে একটা পাহাড়ের ভেতর অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি নিয়ে গোপন গবেষণা করছিল। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে বিশাল লেকের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল পাকিস্তানের কোনো শত্রু দেশের সাপ্লাই দেয়া শক্তিশালী ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেবে বাঁধটা। আর সেটা ঠেকাবে আমাদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট মাসুদ রানা।
ছক তো তৈরি হলো, কিন্তু এ ধরনের রচনায় কল্পনার ভেলায় ভেসে এক যে ছিল রাজা স্টাইলে লিখলে চলবে না, বাস্তবের শক্ত জমিতে ফেলতে হবে প্রতিটি পদক্ষেপ, অর্জন করতে হবে বিশ্বাসযোগ্যতা, কার্যকারণ হতে হবে যুুক্তিযুক্ত, স্পষ্ট। সে জন্য কেবল লেখার হাত থাকলেই চলবে না, চাই সঠিক তথ্য, বাস্তব অভিজ্ঞতা ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। সেসব সংগ্রহ করতেই লেগে গেল মেলা সময়, ঘুরেফিরে নিজ চোখে দেখে এলাম চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কাপ্তাই, কক্সবাজার।
লেখা নিয়েও সমস্যা। এরকম লেখার চল ছিল না বাংলা ভাষায়, থ্রিলার ধারণ করার উপযোগী ভাষা ঠেকে ঠেকে শিখতে হলো, তৈরি করে নিতে হলো নিজস্ব একটা স্টাইল। একবার লিখলাম, কাটাকাটি করলাম; দ্বিতীয়বার লিখলাম, আবার কেটেছেঁটে পাণ্ডুলিপির বারোটা বাজিয়ে দিলাম। তারপর ফ্রেশ করে লিখলাম তৃতীয়বার এবং অসন্তুষ্টি নিয়েই ছাপার জন্য প্রেসে দিলাম। প্রুফেও এডিট করলাম মেলা। বই যখন বের হলো, তখনো আমি খুশি নই। তবে দেখলাম: আমি সন্তুষ্ট না হলে কী হবে, পাঠক লুফে নিল বইটা সাগ্রহে।"
সোর্স