ভাবলাম বৃস্টির আগেই যাওয়া যাবে, তাই ছাতা টাতা নেইনি। রাস্তা সহজ হলে সমস্যা হতো না, দৌড়ে যাওয়া যেত। প্রথমে ধান ক্ষেত, তারপরে চোট চাড়, পানের বরজ, এরপর বাড়ি। বিকেলে ফোন করে বললাম, ‘‘লিটন ভাই, আমি ছুটি নেইনি। না বল্ইে আসছি। যেইভাবেই হোক আজকের মধ্যে সমাধান করে যেতে হবে। ’’
উনি আমাকে আসতে বলেছেন সন্ধার পরে, আমি আগেই চলে আসছি।
ঘরের মধ্যেও একটুকুও ভালো লাগেনা। দাদা তার রুমে শুয়ে থাকে, কারো সাথে কথা বলেনা। আব্বা মা ও চুপচাপ। না পারছেন আমাকে প্রকাশ্যে দোষ দিতে, না পারছি আমি তাদের সান্তনা দিতে। কতবার যে কান্না আসছে, কি করবো কিছুই বুঝতেছি না। ছোট বোনটারে ফোন করে বললাম, তুই, একটু বাড়িতে আয়।’’ পরে মনে পড়ল ও তো মেডিকেলে। দু তিন পর ব্চাচা হবে। ওকে বাড়িতে এনে রাখবো তারও এখন পরিবেশ নেই।
বৃস্টিতে পুরোটাই ভিজলাম। লিটন ভাইয়ের মায়ের সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয়। বললাম, খালাম্মা, চা বানায়ে দেন। শীত লাগতেছে।’ লিটন ভাই তখন তার রুমে গান শুনছেন। বর্ষা বাদলের মধ্যে এই যন্ত্রনা দেওয়াটা আমারও ভালো ঠেকতেছে না। বলি, ‘ খালাম্মা, লিটন ভাইয়ের বউ কি বাড়িতে?’’
খালাম্মা কানে একটু কম শোনেন, তাই বোধহয় শোনেন নি। উনি একটা বাটিতে করে মুড়ি দিয়ে চা বানাতে চলে গেলেন। মুড়ির বাটি হাতে নিয়ে আমি লিটন ভাইর দরজায় নক করলে উনি ভিতরে আসতে বললেন। ভাবি টাবি কেউ নেই, একা একাই শুয়ে ছিলেন।
উনি আমাকে বসতে বললেন। বললাম, ভাবি কই ভাই, বৃস্টি বাদলে ভাবিরে দুরে রাখেন ক্যান? বুড়ো হয়ে গেছেন নাকি?
লিন ভাই হাসতে হাসতে বললেন, তুই বুঝলি, কিন্তু মা তো বুঝলোনা, বললো, অনেক দিন হয় বউ বাড়ি যায়না, বর্ষার আগেই বউরে ক’দিন বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়। আমি আর গেলাম না, ওর ছোট ভাইর সাথে পাঠায়েছি। যাক, তোর কি অবস্থা?
‘‘ আর অবস্থা ভাই! মুড়ির বাটির টিভির পাশে রেখে বসলাম। লাইফে কোন পাপের শাস্তি পাইলাম কে জানে?
ধুর! শাস্তির কিছুনা, এক্সিডেন্ট একটা। তোর দাদারে কালকে ফোন দিছিলাম, ধরে নাই। কাকার ফোনও অফছিলো। কথা বলমু কইরা।
তাগো আর কোন কথা নাই ভাই। আমি যা কমু তাই-ই।
তোর কাছে কি মনে হয়, এর সমাধান কেমন হওয়া উচিৎ ?
লিটন ভাই, আমার ঘরেও বোন আছে। আমি জানি বোন বিয়ে দিতে হলে কি করতে হয়, কিভাবে করতে হয়, আপনে জানেন, জানেন না?’’
আহা, এরকম কইতিছিস ক্যান? আমিতো সমাধানের কথাই বলছি। কি করা যায়?
আমার একটাই মত। ডিভোর্স ! এরপর দাদারেসহ মা-আব্বারে আমি পরশু ঢাকা নিয়ে যাবো। ব্যাস!
হেলাল, বোকার মতো কথা কইস না। ডিভোর্স দিতে চাইলেই দেওয়া যায়না। গেলেও বিষয় থাকে। মেয়ে পক্ষতো সাইন করতে চাইতেছে না।
আমার গত ১ সপ্তাহ ধরে মাথা ঠিক নাই। একদিনও ঠিকমতো ঘুমাইতে পারিনাই।
চাইতেছে না মানে? আপনারা বাধ্য করবেন, তো আপনাদের কাছে কি জন্যে আসা?
বাচ্চাদের মতো করিসনাতো! মেয়ের মামা স্পীকারে ভাগনি বিয়ে করছে। মেয়ের বড় চাচা আমাদের চেয়ারম্যানের খুব ঘনিষ্ট মানুষ । আমি একটা বললেই হইতেছে না।
লিটন ভাই, একটা কথা কই। আমার ফ্যামিলিরতো সবই জানেন। এই বিয়েতে আমি ফার্মেসির মালিককো দিয়ে ধার টার কইরা ১ লাখ দিছি। বড় আপায় দিছে ২৩ হাজার, মুন্নি দিছে। এখন আবার আমি টাকা পামু কই? ঘর দিয়াও এখন আর কেউ সাপোর্ট দিতেছে না। বলতেছে, তারা কিছু জানেনা।
ওইটা কিছুনা। আমি মেয়ের বড় ভাইরে আসতে কই? তোরা দুইজন কথা ক?
না ভাই, আমি তার সাথে কথা কইছি। হ্যায় আমারে ভয় দেখায়, থানা পুলিশের ভয় দেখায়।
কইছে কি তোরে?
ভাবতে বলছে। তার কথার ডাট শুনলে বুঝবেন পাপটা আমরা করছি। কথার স্টাইল শুনলে তাউল্লা জ্বলে ভাই।
লিটন ভাই আঙ্গুল দেখিয়ে লুঙ্গি দেখালেন। বললেন, ভেজা প্যান্ট পাল্টে নে। শরীর খারাপ লাগবে।
আমি হাত দিয়ে প্যান্টে খানিকটা ঝেড়ে নিয়ে বললাম, সমস্যা নেই। ওষধের কাছে থাকিতো, জ্বর টর আসেনা, আসলে ফাইণালটা আসবে।
খাবি কিছু? ছিমি ভর্তা, আর পানি কচুর পাশে ইলিশ দিয়া ঝোল করছে, সেরাম হইছে। হাত ধুইয়া আয়, দুইটা খাই দুই ভাই।
হেলাল মাথা নিচু করে বসে থাকে। লিটন মাথায় হাত দিয়ে বলে, তোর সমস্যা বুঝছি। ও মেয়ে ডিভোর্স দেয়া ছাড়াও উপায় নেই আমিও বুঝি। ও মেয়ের দায়িত্ব নেয়া মানে তোরা ফকির হওয়া। সারা জীবনইতো চিকিৎসায় চিকিৎসায় যাইবে।
কি জন্যে মন খারাপ তাইলে? কি কমু ভাই, সারা বুকের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে সেলাই নেই। ২ বার হইছে ওপেন হার্ট, এ্যাপেনডিক্সে ওপারেশনের ঘাঁ এখনো সারে নি।’- হেলাল বলতে বলতে মাথা নুইয়ে দেয়। দোষ আমারই ভাই। যার বিয়া তার গরজ নাই, আমি লাফাই। শুনলাম ভাই অল্প অল্প রাজি, ওমনি মেয়ে দেখা, ২ দিনের মাথায় বিয়ে। বুইন গুলাও তখন আমার উপর কি খুশি, এখন কিছু জানেনা। ভাই, আমিতো জামা সরাইয়া বুক-পিঠ দেইখা মাইয়া চেক করতে পারিনা, পারি?
হেলাল, একটু থাম ভাই। আমি তোর দাদার কাছ থেকে সবই শুনছি। তুই আসছো শুইনাই আমি ওর ভাইরে ফোন করছিলাম। সে বিকল্প কিছু ভাবতে চাইছে না। আমি আর কথা বাড়াইনি।
লিটন ভাই, এটা ওদের বিজনেস, এরকম ধইরা টইরা বোন বিয়া দিয়া পরে ডিভোর্সের টাকা লইয়া ফাটাইয়া বিজনেস করে। হারামির জাত হারামি। আর মেয়েটাও বা কেমন, নিজের ঘেন্না লাগেনা? তুই পারবিনা তোর স্বামীরে সোহাগ দিতে, দুইটা ভাত রাধতে পারবিনা, সংসার চালানোর শখ হয় কোত্থেকে?
এইসব কইসনা হেলাল। হইছে; যেখানে হউক একটা সমস্যা হইছে। আর এক কেমন হয়, মেয়ের সাথে সরাসরি একদিন কথা কবি নাকি? তার কি মত? সেকি সাইন করতে রাজি আছে কিনা? না থাকলেও বা তার কারন কি?
আপনের হইছে মাথা খারাপ। ঐ মেয়েরে আমাদের সাথে দেখা দিতে দিবে? আর দেখা দিলেও ঐ মেয়ে সাইনের কথা মুখে আনবে? বিজনেস বলে কথা ভাই!
তুই মেয়ের সাথে কথা কইছোস?
প্রশ্নই আসেনা।
বলছোস কিনা জিগাই?
না ভাই, ঘেন্না লাগে।
ফাইলতামু করিস না। তুই ও মেয়ের কোয়ালিফিকেশন জানো?
এখনতো সবই জানি ভাই।
লিটন কমিশনার খানিকটা ভ্রু কুচকে বললেন, তুইতো বাচ্চাই আছোস হেলাল! মাথায় জিকির তুলছোস ডিভোর্সের! ব্যস, আর কোন কথা নেই। অল ফাস্ট ক্লাস, মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস ফার্স্ট! অসুস্থতার জন্য ২৮তমর রিটেন দিতে পারে নাই।
তো? ক্যারেক্টারে তো লাস্ট ক্লাস লাস্ট। নিজের দুর্বলতাকে ঢাইকা রাইখা মানুষ ঠকানোর মানেতো কোয়ালিটি সো না। যে মেয়ের এমন কোয়ালিটি তারেতো এমন বিশ্রি রচনার নায়িকায় মানায় না। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র বোধও যদি থাকতো কোনভাবেই সে এ কাজে নামতে পারতোনা। অথবা ভাই মানুষ এমনই, দৃশ্যত স্কেলে মাপা কোয়ালিটি দিয়ে মানুষ মাপা যায়না। ক্লাশের ১ রোল মানেই সে গুনে-মানে-মনুষ্যতে নাম্বার ওয়ান না। লিটন ভাই, আপনে যা ভালো বোঝেন তাই করেন।
লিটন ভ্ইা কাঁথা ছাড়লেন। হাত ধরে টেনে নিয়ে ডাইনিং এ বসিয়ে বললেন, আমি যা বলবো শুনবিতো?
হাত ধুতে ধুতে বললাম, কি, কন শুনি?
আজকে এখানে থাকবি। রাত ৮ টায় ঐ মেয়ের বাড়িতে যাবো। তুই সরাসরি কথা বলবি।
লিটন ভাই!- মাথা তুলে তার দিক তাকাতে গেলেই সে মাথা চেপে ধরে বলে, ‘‘ কোন কথা নাই, ফাইনাল্। জলদি জলদি শেষ কর। মা, কচুর লতি ভাজছিলা না, আছে একটুও?
খালা কড়াই চেক করে বললেন, ‘‘ আছে একটু, তোর বাপের জন্য রাখছিলাম। তুই নিবি?’’
না মা, হেলালের জন্য বলছিলাম।
আমি ‘‘না না’’ বলার আগেই খালা বললেন, আমি ইচ্ছা করেই ওরে দেই নাই। অল্প অল্প গলা ধরে। কি হেলাল, খাইতে পারবি? টক দিয়া নিলে বোঝা যায়না।
খালার সাথে সাথে আমিও উঠে গিয়ে খালাকে থামিয়ে বললাম, না না খালা, আমার আবার চুলকানির বাতিক আছে। দরকার নাই। মাছটা খুব ভালো হইছে।
ল্যাম্প পোস্টের আলো অনেক দুর যেতে পারেনি। থামা থামা বরষায় আলোরও যেন আলসেমি গেছে, না গেলেই বাচি টাইপের। কুয়াশার মত জাল হয়ে আছে লাইটের কাছাকাছি। আলো যা আসে তাতে মুখ চেনা যায়না। অল্প যারা আছেন তারা কেউ ছাতায় কেউবা মাথায় করে বরষা নিয়ে ফিরছেন। আকাশে আকাশে জোৎনা নেই, বাতাসে মৃদু কোন দোল নেই যাতে মন ভালোর নিয়ম থাকে, বর্ষার স্নিগ্ধ ছোঁয়া নেই যাতে ভালো লাগা আসে। অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে হেলাল। যে রিক্সা তাদের নিয়ে যাচ্ছে তাতে অল্প আলোর একটা হাড়িকেন জ্বলছে । এ গাড়ি যেখানে যাবে সেটা এখান থেকে আর এক গ্রাম পরে। দোলাই গ্রাম, হেটে যেতে ২ ঘন্টার পথ। রিক্সায় অল্পেতে হলেও বৃস্টির কারনে ১ ঘন্টার আগে হচ্ছেনা।
এ বাড়ির মেইন গেটে লেখা জোনাকির ঘর। এখানেও এক বদমায়েমি। যে মেয়ে দুদিন পরে মারা যাবে সে জোনাকি হয় কিভাবে? আলো দেয়াতো দুরের কথা জ্বলা আলো নিভিয়ে ফেলবে এ মেয়ে। হেলাল রিক্সাওয়ালাকে জোনাকির ঘরে সামনে দাড় করিয়ে ১০০ টাকার নোট দিয়ে বলবে, ১ ঘন্টা বসে থাকবেন, আবার ফিরতে হবে। রিক্সাওয়ালা বসে থাকবে কিনা সিওর না । এরপর সোজা মেইন ফটকে নক করলে কে বেড়িয়ে আসবে? বড় ভাই যিনি পুলিশের ভয় দেখিয়েছেন? নাকি মেয়ে নিজেই? হেলালের প্রত্যাশা যেনে জোনাকিই হয়। স্টেইট কিছু কথা বলে চলে আসা যাবে। আচ্ছা ওনাকে কি বলে ডাকা উচিৎ হবে? জোনাকি আপা, নাকি ভাবি? ভাবি ডাকারতো প্রশ্নই আসেনা। তাছাড়া ভাবি ডাকলে খারাপ কথা বলা যাবেনা। ওনাকে সুযোগ বুঝে কিছু খারাপ কথা বলা দরকার। এখন শব্দগুলো নির্দিষ্ট না করাই ভালো। মনে আসলে বিশ্রি লাগলে আর বলা হবেনা। উনি যদি চা বা এ জাতীয় কিছু খাওয়াতে চান খাবো? লিটন ভাইর জন্য হয়তো খেতে হবে।
হেলালের বার বার মনে হচ্ছে আজকেও কোন সমসাধান হবেনা। শোনা যাবে মেয়েকে আবার মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। এপেনডিস্কের সেলাই থেকে ইনফেকশন হয়ে ক্যান্সারের মতো হয়েছে। এরপর কোন মতে ঘাঁ চেপে টেপে সারিয়ে আবার ৫ লাখ টাকার মোহরানায় আর এক ছেলেকে ফকির বানানো হবে।
তেমনটা হয়নি। জোনাকিকেই পাওয়া গেল। তিনি যেন প্রস্তুতই ছিলেন। দরজায় নক করা মাত্র হাসি মুখে তিনি দরজা খুলে বললেন, ভেতরে তোয়ালে আছে, গা মুছে নিয়ে বসেন, আমি গরম পানি নিয়ে আসছি। ’
এরথেকে হাজার সুন্দর লাইন ও হেলালের কাছে ভালো লাগবেনা না এটা লিটন মেম্বর ভালোই জানেন। তিনি হেলালের দিকে তাকিয়ে বলেন, আয়, বোস।
জোনাকি ভেতরে চলে গেলে হেলালের হাত ধরে বললেন, দ্যাখ, কোন আবোল তাবোল কথা কবিনা। মাথা গরমের কিছু নেই। সুর্হাা একটা করেই যাবো।
হেলাল লিটন ভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার চুপ করে বসে থাকলো। না ভাই পাগল নাকি। আবোল তাবোল কি বলবো। মা-বোনতো সবারই আছে। ভাই, আমি কিন্তু কিছু খাবোনা, চা টা আনলে আমারে সাইধেন না।
আচ্ছা আচ্ছা। ভালোকথা হেলাল তোর কোন বিয়ান টিয়ান নাই। দুইটা রসের কথা টতা কইতাম।
হ আছে। মেয়ের মা’তো জোয়ানই আছে জানি। তাছাড়া হিসেব করলে আপনে কিন্তু আমার চাচা টাইপেরই হোন।
হাসাহাসি শেষ হওয়ার আগেই জোনাকি ৫-৬ বছর বয়সী পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বাচ্চাটি নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিল। আমরা হতম্বম্বেরর মত তার দরজার লক দিতে দেখে নিজেরা নিজেরা তাকাতাকি করতে লাগলাম। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে পুলিশ খবর দেয়া হয়েছে। তবে কেসটা কেমন সাজিয়েছে বোঝা যাচ্ছেনা। মেয়ে যেহেতু ব্রিলিয়ান্ট কেস মোটামুটি পোক্তই হবে। আচ্ছা, আমি ১ নম্বর আসামী নাকি দাদা? আমি হলেতো ভারী সমস্যা হয়ে যাবে। বেক্সিমকোর মতো কোম্পানী আমার জন্য ওয়েট করবেনা। তার থেকেও বড় সমস্যা ফার্মেসীর মালিকদের টাকাগুলো টিরার্ণ করবো কোত্থেকে? জোনাকী মেয়েতো ভালো ঝামেলাই বাধঅলো।
মনের অবস্থা এমনই খারাপ যে ভয়ে আর খারাপ হওয়ার মত অবস্থা নেই। জানামতে লিটন ভাইও ঝানু মেম্বর, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক থাকতে বললেন। আমি আশ্বস্থ হলাম কিনা বুঝলাম না।
এরপর জোনাকী নামের মেয়েটি তার কোলের উপর বাচ্চাটি বসিয়ে গালে আদর করতে করতে বললো, হেলাল, অর্জূন আমার প্রথম সন্তান। ওর বাবা হিন্দু ছিল, তাই ছেলের নামও ওরকম রাখলো। দেখতো লাল জুতোয় বাবুকে কেমন লাগছে?
আমি ভাই স্টুডেন্ট তেমন ভালোনা, তাই রিপ্রেজেন্টেটিভ এর চাকুরী করি। চাকুরী পার্মানেন্ট হওয়ায় একটা হোন্ডা কোম্পানীর মটর সাইকেল পাইছি, চালাই আর বিড়ি খাই। মাথায় বুদ্ধির গুড়াও নাই। জোনাকীর মত ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট এর কথা মাথায় ঢোকারও কথা না। আমি বোকার মত বলি, ‘‘ আমার জীবনে আমি এত সুন্দর বাচ্চা দেখিনি ভাবি’’।
-ভাবী ডাক শুনে আমিই চমকে উঠে লজ্জায় লিটন ভাইর দিকে তাকাই। ছাগলের মত হা করে থাকি। আর এই সামান্য ফাক টুকুতেই অর্জুর্ণের মায়ের চোখে পানির বন্যা চলে এল। কারণ খোঁজাখুজির বাড় না সয়ে বলি, আপা, পানি নেই? খাবার পানি ?-থতমত খেয়ে যাচ্ছিলাম।
জোনাকি মেয়েটা সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট সাথে অবাক করিয়ে দেয়ার ক্ষমতাও দারুণ! হাতের ডান পাশে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা টেবিল উন্মুক্ত করে দিয়ে বলেন, আগে দুটো ভাত খেয়ে নাও, পানি খেলে খেতে পারবেন না আর। মুশুরি ডালের ভরা আছে, আমার জীবনে এই একটা রান্নাই ভালো শিখেছি, শুধু ভালো বললে কম হবে, অসাধারণ! যদি ভালো না লাগে তোমার পকেটের কাগজে এখনই সাইন করে দিবো, প্রমিজ!
হেলাল মোটেই অবাক হলোনা। এই বর্ষায় এ বাড়িতে ডিভোর্স লেটার না নিয়ে চা খেতে আসার প্রশ্নই আসেনা। ভাবির বাড়িতে চা খাওয়ার মত আহলাদের দিন নেই হেলালের।
হেলাল খানিকটা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, মূলত লিটন ভাইদের বাড়ি থেকে খেয়েই এসেছি ১ ঘন্টাও হয়নি। এখন আর কোনমতেই পেটে ঢুকবেনা। ডালের ভরাটা দিতে পারেন। টেস্ট করে দেখি, কথা সত্য কিনা।
জোনাকির সাথে হেলাল এতটা গুছিয়ে কথা বলবে লিটন কমিশনার প্রত্যাশায়ই করেননি। তিনি মনে মনে ভালো কিছু প্রত্যাশা করছেন। জোনাকি নিজ থেকেই প্লেটে অল্প অল্প করে ভাত দিয়ে লিটন ভাইকে বললেন, ‘‘দাদা, আপনার সাথেতো আমার পরিচয় হয়নি। খাওয়া দাওয়া সেরে নিন, এরপর আলাপ করছি। না করবেন না প্লিজ, পেট ভরা থাকলেও এ কটা ভাতে কিছু হবেনা। ’’
লিটন কমিশনার হেলালকেও খেতে বলে খাওয়া শেষ করে বললেন, সত্যিই খুব ভাল হয়েছে। হেলালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কথা বল,্ আমি একটু আসছি।’ হেলালের উত্তরের আগেই কমিশনার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। হেলাল থামাতে গিয়ে দাড়িয়ে আবার বসে গেল। অর্জূণের মা যেন কমিশানের প্রস্থানই প্রত্যাশা করছিলেন। তিনি আবার দরজা লক করে দিতে দিতে বললেন, হেলালেরতো খুব রাগ আমার উপর। হাতে গুলি দিলেতো এখুনি গুলি করে দিবে? এরপর সোফায় এসে বসতে বসতে বললেন, আমার বাঁচার জন্য যে খুব শখ তাও কিন্তু না। অর্জূণের জন্য বাঁচাটা প্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। ভালো কথা হেলাল, আমারতো কোন বোনও নেই, বড় ভাইয়ার বউ বউ হিসেবে ভালো বাট অর্জূণের ফুপি হিসেবে ততটা ভালোনা। আমি মরে গেলে অর্জূনের কি হবে ভাবোতো?
আমি হেলাল জোনাকি আপাকে বিয়ের আগে একদিন দেখেছি, কোন কথা হয়নি। উনি ঐদিন খুব নার্ভাস ছিলেন। চোখে কান্না কান্না ছিল। মেয়েদের বিয়ের আগে এমন হয়, তাই তখন আলাদা কিছু মনে হয়নি। আমি তার কথায় খুব সহজ ভাবে বলি, মা মরে গেলে ছোট সন্তানের আর কিছু থাকেনা। আপনার মরে যাওয়াটা ভালো হবেনা।
জোনাকি আপা এবার সুন্দর করে হাসলেন। এ হাসি কমিকস পরে হাসা হাসির মতো না। তার চোখে নোনতা পানির ভীড় স্পষ্ট। তিনি তার থুতনি অর্জূণের মাথায় সাথে চেপে ধরে বলেন, ‘‘ এ জন্যই এ ক’দিনে মরে যাওয়ার ডিসিশনটি নিতে পারিনি।’’ চোখে থেকে টুপ করে পানি পড়ে গেলে তিনি লজ্জিত হন এবং মুছে ফেলে হেসে হেসে বলেন, ‘‘ আমার জন্য এ কাজটি কিন্তু সহজ ছিল হেলাল। কারণ আমাদের বাড়িতে ছাদ আছে।’’ আপা এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। মায়ের হাসি দেখে অর্জুণও খিল খিল করে হেসে উঠল। মাথা ঘুরিয়ে মা’র গলা ধরে বলল, ‘‘মা, আমি ছাদে যাবো’’।
ছেলের মুখ মুখের কাছে এনে গাল দুটো টেনে নকল গলায় বলে, ‘‘ মা, আমি ছাদে যাবো’’। এরপর মা ছেলে দুজনেই হাসে। হেলাল চুপ হয়ে ভাবে, বৃস্টিমাখা এই পৃথিবীতে বৃস্টি বাদেও অনেক সুন্দর দৃশ্য আছে। কে জানতো পকেটে ডিভোর্স লেটার নিয়ে এমন মুধর দৃশ্য হবে জোনাকির ঘরে। হেলাল একদম প্রকাশ করা আদর করতে যেয়েও থেমে গেলো। অর্জূণকে না ছুঁয়ে পারছিলোনা যেন!
ছেলে অর্জূনের গালে গাল লাগিয়ে জোনাকি বলে, হেলাল, অর্জূণকে দেখে তুমি যে অবাক হয়েছো তা কিন্তু প্রকাশ করোনি। হয়তো এখনো সুযোগ পাওনি। বিয়ে ছিলো জানতে তবে বাবুর কথাটা বোধহয় জানতে না। নাকি?
হেলাল, মাথা নাড়িয়ে শুধু কথা শুনছে।
আমি আমার দাদার নাটকটা তোমাকে বলছি। অর্জূণ আজ সকালে ওর দাদা বাড়ি থেকে এসেছে। গত ১ মাসে আমার এ সোনার টুকরোটাকে দাদাভাই জোর করে অর্জূণের দাদার বাড়িতে রেখে দিয়েছে। কিন্তু দাদা আমাকে এসবের সবই লুকিয়েছে। তোমার মা নাকি আমার অর্জুণের কথা শুনে এ বিয়েতে অমতের পরিবর্তে খুশিই হয়েছিল। যদিও আমি কি কারনে যেন বোকা হয়ে এ কথাটা বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। খুব বুদ্ধিমান মানুষও নিজের দুঃখ ঢাকতে কখনো কখনো কিসের কারনে যেন সহজ জিনিস বুঝতেও অবুঝের মতো করে। আমাকেও বোধহয় সেই রোগে ধরেছিলো।
হেলালকে পাথরের মতো চুপ থাকতে দেখে জোনাকি বলল, হেলাল কথা বলছোনা যে? বেশি রাগ হচ্ছে? গুলি দিলে বুকের উপর গুলি করবে?
এরপর আবার হেসে হেসেই বলে, আমার কিন্তু হার্টের কিচ্ছুই নেই, গুলি করবে কোথায়? অর্জূণকে কোল থেকে একটু সরিয়ে বলল, দাও হেলাল কাগজটা দাও, তোমাকে দেরি করিয়ে ফেলছি, আর আমারও।
বৃস্টি যখন বাইরে আরো জোরে নামে জোনাকি মেয়ে তখন কাগজে সাইন করছেন। অনেক অদ্ভুত ঘটনার জন্ম দেওয়া রাতে আরো একটা ঘটনা ঘটে যায়। হেলালকে অবাক করিয়ে হেলালের চোখেও পানি আসে খুব, এবং অসম্ভব কস্ট টের পায় হেলাল। হেলাল অযতেœ তার পিছনের চুলগুলো বড় করে ফেলেছিল এতদিনে। হঠাৎ করে খুব আফসোস হলো, চুল গুলো পিছনে বড় না হয়ে যদি সামনে বড় হতো, চোখের পানিটা লুকনো সহজ হত!
হেলালের কাছে এসে তার হাত ধরে জোনাকি বলল, ভাই, আজ যে তোমার সাথে দেখা করার জন্যই ওয়েট করছিলাম টিলন ভাই সেটা একদম গোপন রাখতে পারবে আমি বুঝিনি। লিটন ভাই কিন্তু চলে গেছে, তুমি একটু বসো , আমি এখনই আসছি।
দীর্ঘ আকাশ মেঘে ঢেকে গেলে দেখতে ভালো লাগে। সে আকাশে যদি চাঁদ ওঠে আরো ভালো। রাত ১১ টার শহরে এখন সে আকাশ। চাঁদের আলোর নিচে কুয়াশার মতো বৃস্টির ছায়া। আহ! ছাউনির নীচে ১০ মিনিটেও বালিকার নাওয়া হয়না টাইপের বৃস্টি এখন। অর্জূণ সম্ভবত ৮ নাম্বার বাটার কেডস পড়েছে। ওর পা অনুযায়ী জুতার সাইজ হওয়া উচিৎ ছিল ৬। তাই ভালো ভাবে হাটতে পারছেনা বলে জোনাকিই বলল, ভাই রিক্সায় ওঠা পর্যন্ত ওকে একটু কোলে নাও। বললাম যে জুতা পাল্টে দেই, তা হবেনা। তার এটাই লাগবে। এখন দ্যাখো হাটতেও পারছেনা।
হেলাল তার হাতে বড় ব্যাগ দেখে চোখ বড় করে বলল, কোথায় যাবেন?
জোনাকি হেসে ফেলে বলল, তোমাদের বাড়ি। কেন, এক্স্রটা চকি নেই, শুতে দিতে পারবেনা?’ জোনাকি হাসে। চল ভাই, তোমার রিক্সায় করেই আমাকে একটু স্ট্যান্ডে দিয়ে আসবে। আমি পাড়ার এক রিক্সাকে সকালে বলেছিলাম যদিও, বৃস্টি দেখে হয়তো বের হয়নি। একটু কস্ট কর ভাই!
হেলালের বিস্ময়ের সীমা নেই, ‘‘ এ রাতে আপনি স্ট্যান্ডে গিয়ে কি করবেন? এ বর্ষায় যাবেন কই?’’
অর্জূণকে দেখে তোমার খুব মায়া হচ্ছে জানি হেলাল। শোন, তোমার নাম্বার দাও, আমি অর্জূর্ণের বড় হওয়ার সব ঘটনা তোমাকে জানাবো। ঠিক দ্যাখে হেলাল, অর্জূণকে আমি কত বড় মানুষ বানাই! পরে কথা বলি, দাদাভাই চলে আসতে পারেন, চল।
জোনাকিকে স্ট্যান্ডে নামিয়ে গিয়ে হেলাল ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে রিক্সা ছেড়ে হাটতে থাকে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের কথা। আসমানীকে ওর ফিজিক্স পরীক্ষার রাতে ১১ টায় দিকে বর্ষার মধ্যে হেটে হেটে গিয়ে ওর বাড়িতে গিয়ে অবাক করিয়ে দিয়েছিলাম। যখন এসে দরজায় নক করি আসমানী তখন শব্দ করে পড়ছিলো। বাসার সবাই ঘুমে। দুবার নক করার পর ও পড়া থামিয়ে ছোট করে ডাকল, মা! ভাবলাম ও দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছে। ওর মোবাইলে তখন টেক্সট পাঠাই। লিখি, ফিজিক্সের প্রশ্ন আউট হয়েছে, নিবি? তাহলে দরজা খুলে বাইরে আয়, দুজনে দুমিনিট বৃস্টিতে ভিজি। ’’ এন্টার দিয়ে লাইন নিচে নামিয়ে লিখি, দরজা খোল আসমাণী, আমি তোর হেলাল!
বর্ষায় হাটতে গিয়ে হঠাৎ ৫ বছর আগের কথা মনে পড়ে হেলালের। হেলাল পকেট থেকে মোবাইল বের করে আবার ঢুকিয়ে রাখে। হঠাৎ তার এমপিথ্রি সাপের্টেড একটা সেটের অভাব লাগে। ফার্মেসির টাকাাগুলো রিটার্ণ হলেই সে গানওয়ালা একটা সেট কিনবে। অল্প টাকায় নকিয়ার সি সিরিজের একটা সেট আছে। মনে মনে সে বৃস্টির গানের লিস্ট বানাচ্ছে। হঠাৎ তার সামহোয়ারইনব্লগ এর বৃস্টির গানের কালেকশনের পোস্টটার কথা মনে পড়ে। কার যেন পোস্টটা! রাহাত না যেন কি নাম! অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা আছে গানের লিংকগুলোর আগে। সামনে অন্ধকার দেখে হেলাল মোবাইলের জন্য আবার পকেটে হাত নেয়। নকিয়া ১১০০ সেটটার সাথে জোনাকির সে সাইন করা কাগজটাও উঠে আসে। ”অদ্ভুত ইমোশনে অস্ফুট স্বরে হেলালের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘ভাবীরে! । কী ভেবে হেলাল কাগজটা ফেলে দিয়ে হঠাৎ পিছনে দৌড়ায়। ভিষন জোড়ে সে দৌড়! ১০ মিনিটের মধ্যে সে স্ট্যান্ডে ফিরে আসে। স্ট্যান্ডে কোন বাস না দেখে অর্ধেক খোলা চায়ের দোকানীকে হাপিয়ে হাপিয়ে বলে, ‘‘ ভাই, সিলিটের লাস্ট কারটা চলে গেছে। দোকানী চা নাড়তে নাড়তে বলেন, এইতো, দুমিনিট হয় গেলো!
গল্প শেষ
গত বছর তিনেক পরে আমার সেই বন্ধু হেলালের সাথে আলাপ হয়। ও রিপ্রেজেনটেটিভ এর চাকুরীরটা ছেড়ে দিয়ে পতেঙ্গার পাড়ে একটা খাবারের হোটেল দিয়েছে। ভালো ব্যবসায়। দুপুরে ও সকালে নাকি ২০ রকমের ভর্তা থাকে। প্রায় ১২ রকমের ভর্তা করে মাছ দিয়ে। বেশ ভালো আছে এখন। তো কথায় কথায় ওর সেই জোনাকি ভাবির প্রসঙ্গ এলে ও বলে, গেলে রবিবার অর্জূণের সাথে দেখা। ও এখন সেভেনে পড়ে, ফাস্ট বয়। ওদের স্কুল থেকে পতেঙ্গাতে বার্ষিক শিক্ষা সফরে আসছিলো তখন কথা হলো। দেখতে দারুন স্মার্ট, চোখে চশমা পড়ে। তো সাহস করে ও মায়ের কথা জিজ্ঞেস করায় বলে, উনিতো মোবাইল ইউস করেন না। সে সিলেট শহরের একটা প্রিক্যাডেট স্কুলের শিক্ষকতা করেন। কথার এক ফকে বললো, গেলো প্রজন্ম চত্ত্বরের আন্দোলনে নাকি সিলেট থেকে শাহবাগে আসছিলো। পরে ও ই আবার বলল, উনি ব্লগে লেখালেখি করেন। কি নামে লেখে জিজ্ঞেস করায় একটু থেমে যায়। ওয়াসরুমে যাওয়ার কথা বলে দুমিনিট পরে এসে বলে, শায়মা নামে!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৮