প্রিয় হুমায়ুন স্যার,
সালাম ও শ্রদ্ধা নিয়েন। আমি জানিনা আপনি কেমন আছেন। তবে কোনভাবেই মনে হয়না আপনি ভালো আছেন; থাকার কথাও না স্যার। আপনি যেখানে ঘুমানো তার থেকে দূরে, অথবা কিছু দুরে, আপনার শহরেই গেল সপ্তাহে একজনকে হাটবারের কেজি দরে বিক্রি করা গরুর সিনার মাংসের মত কুপিয়ে মারা হয়েছে। বিশ্বাস হয় স্যার? আপনি ফুটেজ দেখতে চান? খোদার কসম স্যার! আমাদের টিভিতে জিরজির ছবি হওয়ায় ওর শার্টের রং বোঝা যায়নি। অফিস থেকে এসেই টিভি দেখাতো’ প্রথমে মনে হলো সবুজ শার্ট, তার উপর লাল রক্ত। ঐ যে অনেক বছর আগে বছর বছর বেঁচে থাকার আশায়, আপনাদের সুখে বাচিয়ে রাখার আশায় লক্ষ লক্ষ লোক বোকার মত মরে গিয়ে একটা কেমন রংয়ের কাপড় দিয়ে গিয়েছিল না, ওরকম। আমিতো ওটাকে স্বাধীনতাই জানতাম, হঠাৎ ক্যালেন্ডার দেখে মনে হলো ডিসেম্বর মাসে এ কাপড়তো ওমন করে গড়িয়ে পরে নষ্ট হওয়ার কথা না! তাই ভাবলাম, ওর শার্টটা বোধহয় সবুজ ছিলনা। জিরজির করা টিভির কারনে হয়তো রং পাল্টে এমন হয়েছে।
স্যার একটা সত্যি কথা জিজ্ঞেস করি? রাগ করবেন না বলেন? ঐ যে আপনার জোৎ¯œা জননীর গল্পর কালই ভালো ছিলনা? যারা খারাপ, তারা খারাপ, যারা ভালো তারা ভালো, কত সুন্দর। যারা বারুদ বানায় তারাই মানুষ মারে, যারা ভাষনে গুলি করার কথা বলে তারাই গুলি করে, কথায় দুনম্বরি নেই। স্যার, জোৎ¯œা জননীর কালে বিশ্বজিত মারা গেলে আমাদের কষ্ট ছিলনা, ওরও কস্ট ছিলনা স্যার। ও দোকান বন্ধের আগেই মাকে ফোন করতো, মা, নানুর পান বাটুনির ছিচুনি আমিই ভাঙ্গছি, নানুরে বলেন যেন সে বদদোয়া তুলে নেয়। বাবাকে বলতো, ‘‘আব্বা, আপনের পকেট থেকে অনেক সময় না বলে টাকা নিয়েছে, মাফ করে দিয়েন। ছোট বোনকে বলতো, খবরদার বাইরে বের হবিনা, মুক্তি আসলে মোচড়া ভর্তা খাওয়াবি, হালকা ধুনে পাতা দিবি, খাবার শেষে হাত মুছতে ট্রাংকের সাদা তোয়ালেটা দিবি, খেয়াল রাখবি কোন ধরনের অমর্যাদা না হয় যেন। যদি প্রিয় কেউ থাকতো বলতো, ‘ আসমানী, ফের যদি দেখা না হয় মান করে ভাত না খেয়া থাকিস না, অল্প জ্বরেই নাপা খাবিনা কোনদিন, মনে থাকবে? ’’। মানে স্যার, পথে মরে গেলেও কথা শেষ করে মরতে পারতো। কে জানতো স্যার আমাদের অভিভাবকরা এই বিজয়ের মাসেও বিশ্বজিতকে নিয়ে দুনম্বরি করবে, কথা শেষ করতে দিবেনা! ভাষনে অল্প দামে বাসের টিকেট কিনে বাড়ি পাঠাবার কথা বলে কাঠের ওমন শক্ত বাক্সে ভরে বাড়ি পাঠাবে! আপনি আমাদেরকে দেখাশোনার জন্য যাদের রেখে গেছেন তারা ভালো না স্যার, একটুও ভালোনা, দুনিয়ার শয়তান!
স্যার, পারলে বলেনতো আমি এসব কোথায় বসে লিখছি? আমি কোথায় আছি, কী সাফ করি এখন?
আপনারে জানানো হয়নি আমি বিদেশে আসছি স্যার। উনারা আমাকে খাওয়াবেনা বলে এখানে চলে আসছি। কস্ট লাগে কিসে জানেন স্যার? দেশতো বাপই, না স্যার? বাপ যখন হইছো ছেলেরে মোটা পারস চিকন পারস দুইটা ভাততো দিবি, কাপড় দিবি, থাকনের একটা জায়গা দিবি, এটাতো দায়িত্বরে বাপ তোর! আপনের দেশ কি করছে শোনেন স্যার, খাবার দিবেনা দিবেইনা, একটু ভালো ব্যবহার পর্যন্ত করে নাই। তোর দেশে তুই রাখবিনা ওকে, বিদেশে পাঠানোর কালে একটু হেল্পতো করতে পারোস। ওরা কি করছে বলবো স্যার? শুনলেতো মাথা খারাপ হয়ে যাবে আপনের! পশ্চিম ধারের যে দুই বিঘা জমিতে আব্বা ধান দিতেন ঐ টা নিছে, জিতু মনির জন্য একটা দুধ ওয়ালা গরু কিনছিলামনা, ঐটা নিছে, রাসেলের দু চাক্কার সাইকেলটা পর্যন্ত নিছে। বেইমানের বেইমান স্যার, বলছে, ১ ডলার বেতন দিবে, এখন দেয় ৬০ সেন্ট। দুনিয়ার মিথ্যুক স্যার, হারামির হারামি, আস্তা হারামি স্যার।
এতকিছুর পর আমাকে এখানে এনে কি করায় জানেন স্যার? বিদেশিরা প্রেসসাব পায়খানা করে, আমারে দিয়ে সাফ করায়। কিছু করার নাই দেখে চুপচাপ গান গাই আর সাফ করি। গাই ‘‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার .... এরপর আর গাইনা। ওইটা কত সুন্দর একটা শব্দ! ওটাকে বাংলার সাথে মিশিয়ে নস্ট করে লাভ কি? মিথ্যে মিথ্যে ওটাকে টানাহেচরার কি দরকার! চুপচাপ গু সাফ করি, চোখে পানি আসলে পরিস্কার চকচকা বেসিনে গিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলি। বিশ্বাস করেন, এখানে কোন বেইমানি নেই স্যার, ওরা খাওয়াবার কথা বলে ঠিক ঠাক খাওয়ায়, ঘুমের জন্য কম্বল দেয়, সাদা চাদর দেয়, বালিশ দেয়। আপনার কি বালিশ লাগবে স্যার?
মন খুব খারাপ স্যার। তারউপর সারাদিন কাজ করার পর চোখ ভাইঙ্গা ঘুম আসছে স্যার। ফজরের আগে আগে অফিসে যেতে হবে। তাই আর বেশি কিছু লিখবোনা। একটা কথা স্যার, বিশ্বজিত আমার বয়সীতো, তাই ওর মৃত্যুতে খুব কস্ট পাইছি। এজন্য রাগে কস্টে আপনার সাথে হয়তো দু একটা বেয়াদোবি কথাও বলছি, অভিভাবকদের নিয়ে ফায়েসা কথা বলছি। অন্যায় হলে মাফ করে দিয়েন। আমার প্রতি কোনরকম কস্ট রাখবেন না স্যার।
ইতি
অনির্বাণ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৫২