উৎসর্গঃ মরুভূমিতে কর্মরত সেইসব যুবকদের যারা মাসের পর মাস নারীহীন চোখে আজ নারীর অবয়ব ভুলতে বসেছেন!
দরজা ভেজানো ছিলো। রেশন খালু বাড়ি থেকে কিছু মালামাল আনায় ওখানে যেতে হয়েছিল। তাই রাতের খাবার ওখানেই খেয়েছি। যদিও রুমে রান্না হয়্। চাঙ্গা রাম, নেপালি। ২২ বছর ধরে আবুধাবি এই রান্নার কাজই করে যাচ্ছেন। তিনি সোমবার ও বৃহস্পতিবার আসেনন্।া ফিলিপিনা মেয়ে রোজি তাকে নিষেধ করে দিয়েছে। এ দুদিন আমাদের অফিস সন্ধার ১ ঘন্টা আগে শেষ হয় বলে রান্নাটা নিজেরাই করি। ওর পুরো নাম রোজি এন্থনি। সুন্দর মেয়ে, তবে জাতীয়ভাবে ওদের চোখ ছোট। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে ইন্ডিয়ান-ফিলিপিনো খাবার আলাদা হলেও এ দুদিন শুধু ইন্ডিয়ান খাবার হয়। রোজিই রান্না করে। রোজির তৈরী করা খাবার খাওয়ার কারনে দেশের একমাত্র বেগুন ভাজির স্বাদটা শুধু জিহ্বে আছে। এছাড়া আর কোন পুরনো স্বাদ নেই। রোজি যদি শুধু লবন আর গরম পানি করে তাও পেট ভরে খাওয়া যায। তাই এ দুদিন অফিস থেকে ফেরার পথে প্রত্যেকেই রোজির জন্য ছোট্ খাটো গিফট নিয়ে আসে। গিফট এর ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিলনা বলে রোজি গত সোমাবার সন্ধায় আমাকে ডেকে বলল, তুমিই ভালো, কারণ তুমিই আলাদা।
আমি নতুন বলে গতদিনের ঠাট্টাটা সাথে সাথে বুঝে উঠতে পারিনি।
আমরা যে রুমটায় থাকি সে রুমটার বর্ণনা দিয়ে নিচ্ছি। ৩০০ স্কয়ার ফিট রুম। ৮ বেড। প্রতিটি বেডে ৩টি করে সিট। আমাদের দেশে এমন কায়দা নেই বলে সিট দেখে প্রথম প্রথম খুব হাসি পাচ্ছিল। আমরা একজন সাপ্লাইয়ারের তত্ত্বাবধানে কাজ করি। উনি আমাদেরকে বিভিন্ন কোম্পানীতে বিক্রি করেন। কোম্পানীর সাথে তাদের কন্ট্রাক হয় আর আমাদের সাথে আমাদের সাপ্লাইয়ারের কন্ট্রাক্ট হয়। রুমের অন্যরা কে কোথায় কাজ করে ভালো জানাও হয়নি এখনো। আমি ড্যারা দুবায়ের রিভার ভিউ লেকের টিকেট চেকার। বোর্ডে যে লোকগুলো উঠেন তাদেরকে টিকেট দেই, দেখি, দেখে আমাদের দেশী বাস হেল্পাদের মতো টিকেটকে অর্ধেক করে পানিতে না ফেলে বোর্ডে একটা কি যন্ত্র আছে তার মধ্যে ফেলে দেই। মড়মড় শব্দে কাগজগুলো গুড়ো হয়। বাসে থাকলে বলতো বাস হেল্পার, এখানে বোর্ড বলে নিজেকে বোর্ড হেল্পার বলে ভাবি।
আমার অফিস শেষ হয় ৫ টায় । শুক্রবার রাত ৮ টা পর্যন্ত। নামাজের জন্য লেকের পাশেই বড় মসজিদ, সময় করে জামাতে নামাজ পড়ে নেই। কোম্পানী লাঞ্চের জন্য ৫০ ডেরহাম দেন। আমার কখনোই ১৫ ডেরহামের বেশি লাগেনি। তাতেই মাছ, গোস, পানীয় সব হয়।
রুমের পরিবেশ ভালোলাগেনা বলেই সব সময়ই রুমকে এড়িয়ে চলি। অফিস ৫ টায় শেষ হলেও আমি রাত ৯ টার আগে কখনো রুমে যাইনা। এসব পরে বলছি, রুমের বর্ণনা এখনো শেষ হয়নি। যে কারনে রুমকে এড়িয়ে চলা; কারণ সহজ। তবে কনটিনিউ এড়িয়ে চলা কঠিন। প্রথমে আমাকে যে বেডে শুতে হয়েছে সেখানেও তিনটি সিট। নিচ তলায় জোয়েল সিমেনি, তার উপরের সিটে রোজি এন্থনি ও সবার উপরে আমি। ছোট্ট একটি সিড়ির মত বেয়ে আমাকে তিন তলায় উঠতে হয়। রোজি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রাতে ফোনে কথা বলে। ওদের ভাষায় বলে অর্থ ধরতে পারিনা। বুঝতেও পারিনা সে কতজন বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। ধরার ইচ্ছাও থাকেনা তবে কথার কারণে ঘুমে সমস্যা হয় বলে শুনতে বাধ্য থাকি। এ ছাড়া অন্যান্য বেডের সমন্বয়ও এভাবে। যে যার মতো বেড বেছে নিয়েছে।
প্রথম প্রথম অবাক লাগতো ইউএই-তে এমন ব্যবস্থা কখনো চিন্তা করা যায়? পরিচিত বাঙ্গালিদের জিজ্ঞেস করতাম, ছেলেমেয়ে একই রুমে, থাকা-খাওয়ায় সরকারী কোন বিধি নিষেধ নেই? যারা কারণ জানতো তারা কারণ বলতো, যারা জানতো না তারা বলতো, দুবাই এমনই। এজন্যই এখানে বিদেশিদের আসা-যাওয়া খুব বেশি।
বুধবার দিন অফিস সেরে টেক্সি নিতে গিয়ে দেখি রোজিও আসছে। ভদ্রতার খাতিরেই ওর জন্য দাড়ালাম। কাছে এসে রোজি বলল, অফিস শেষ?
বললাম, শেষ।
তুমি অফিস শেষ করে রোজ কোথায় যাও? রুমেতো কখনোই ৯ টার আগে দেখিনা।
বললাম, এক আত্মীয়র বাসায়। আজ শরীর খারাপ বলে আর যাবোনা। রুমে যাবো, তুমিও যাচ্ছো?
যাবো। তার আগে একটু কাজ করতে হবে। ইন্ডিয়ান মেয়েরা একটা ড্রেস পড়েনা, শুনেছি ফতুয়া বলেওটাকে- ওটা কিনবো। আমার জানা ইন্ডিয়ান কোন মার্কেট নেই। তুমিই হেল্প করবে।
রোজি, আমার শরীর খারাপ লাগছে। তুমি গেলেই ভালো হতো।
বেশি খারাপ লাগলে চলো, তোমাকে রুমে পৌছে দিয়ে আসি।
আমি বোকার মতো টেক্সিতে উঠে পরি। রোজি আমার কপালে হাত দিয়ে বলল, জ্বর নেইতো, মন খারাপ নাকি শরীর খারাপ?
সত্যিই আমার শরীর খারাপ লাগছে। তবে নিদৃষ্ট কোন কারণ নেই। মাথা ঝিমঝিম করছে । বললাম, মথা ব্যাথা করছে। তুমি মদিনা জায়েদে নেমে যেতে পারো। আল-মায়াতে ইন্ডিয়ান ড্রেস পাবে। সব ধরনের ড্রেস। দু নম্বর গেটে ঢুকে বাম দিক্।ে আমাদের এক বাংলাদেশী দোকানী আছেন। আমার নাম বললে চিনবে। তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো।
-না, আজ কিনবোনা। তুমি সুস্থ হলে তোমাকে নিয়ে কিনবো।
এশার নামাজ পড়ে রুমের কাছাকাছি মসজিদ থেকে ফিরে এসে দেখি আমাদের কেয়ারটেকার ড্রি জিদ পাল (ইন্ডিয়ান ক্যারেলা) আমার থেকে বয়সে ছোট এক মেয়েকে নিয়ে বলল, হেলাল, তোমাদের নতুন মেম্বার।
আমি যখন বাবার সাথে রাগ করে ঘর থেকে বের হই ভাবিনি এই বের হওয়া আমাকে নুতন এক সম্ভাবনার (!) দেশে নিয়ে আসবে। যেখানে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির কারবার। অবাক হচ্ছি, ভয় পাচ্ছি, কখনো রোমান্স। কেন যেন খুব আগ্রহ নিয়ে তার কাছে গিয়ে বলি, আপনি বাঙ্গালী নাকি ইন্ডিয়ান?- হঠাৎ এমন আগ্রহের আমি কোন কারণ খুজে পাচ্ছিলাম না।
রুপালী রংয়ের ওরনায় মাথা মোড়ানো মেয়ে। হাতে চুড়ি তবে বেশি না। দুহাতে দুটো। অনেকটা ব্রেসলেটের মতো। চ্যাপটা অনেক খানি, তাতে সাদা মেঘ ও নীল রংয়ের আকাশ ছাপা। কাচের হয়তো, নয়তো হাত নাড়লেই শব্দ হবে কেন?
মেয়েটির বাম হাতে ছোট ব্যাগ। গুটি কয়েক জামা-কাপড় ছাড়া ওর মধ্যে বেশি কিছু ধরার কথা না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, বাংলা বলতে পারেন আপনি?
মুখে না বলে মাথা নাড়ল। বলল, একটু পানি খাওয়াবেন?
দেখে মনে হলো এ মেয়ে ইংরেজী জানে না। তাকে আমি হেল্প না করলেই নয়। নিজেকে আর একবার যাচাই করে নিলাম, ইংরেজী জানেনা বলেই হেল্প করতে যাচ্ছি নাকি বাঙ্গালী বলে?
ভাইয়া, একটু পানি খাওয়াবেন?
ব্যাগের মধ্যে অফিস থেকে আনা মিনারেল । দ্রুত সেটা নিতে ছুটে এসে দেখি রোজি গ্লাস নিয়ে তার দিকে যাচ্ছে। বললাম, রোজি, তুমি বুঝলে কিভাবে সে পানি চাচ্ছে?
হেসে বলল, আমি জানি ‘‘পানি’’ কি!, জল, পানি, ওয়াটার এবং টুবিগ। ট্যাগালো ভাষায় পানিকে টুবিগ বলে।
আমাকে ঘুমোতে বলে রোজি ওর জন্য কাজে লেগে গেলো। বাথরুমে দেখিয়ে দিয়ে তার জন্য ওর নিজের কেনা তোয়ালে নিয়ে ওর বেডের কাছে রাখলো। বেড বলতে তিন সিট বিশিষ্ট একটি বেডের পুরোটাই খালি তার মধ্যেরটায় নির্দিস্ট হল। খাবার ছিলনা বলে আমি ইন্ডিয়ান এক রেস্টুরেন্ট থেকে বেগুন ভাজি নিয়ে আসলাম। রোজি অল্পের মধ্যে আলু দিয়ে কি যেন বানালো, আগেইতো বলেছি সে পাকা রাধুনি। খাবার পাকে বসিয়ে রোজি নিজেই পাশের এক মার্কেট থেকে ওর জন্য টুথ ব্রাশ পেষ্ট নিয়ে এল। আন্না, আর এক মেয়ে। লম্বায় আমার সমান। আমার থেকে বেশিও হতে পারে। ও ভালো কথা, বাঙ্গালি মেয়ের নাম বলা হয়নি। সম্পা। এ নাম সে আমাকে বলেনি। রোেিজক কোন প্রসংগে বলেছে তাও শুনিনি। গোসলে ঢোকার আগে রোজি বলল, সম্পা, রুমে ভেজা কাপড় রাখার জায়গা নেই। কাপড় না ভিজিয়ে গোসল দিও।
সম্পা ভালো মন্দ না কিছু না বলে শুধু আমার দিকে একাবর তাকালো। ও লজ্জা পেতে পারে বলে আমি চোখ নামিয়ে নেই।
ইউএইতে আসার পর এই প্রথম স্বপ্ন দেখলাম। প্রথম বলতে ব্যাখ্যা করার মতো প্রথম স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকে যে সমস্যা হতো- স্¦প্ন দেখে তার অধিকাংশই সকালে ভুলে যেতাম। কখনো কখনো খুব কস্ট হতো তাতে। তাই অনার্স থেকে রাতে ঘুমোবার সময় কলম খাতা নিয়ে নিতাম। কখনো ভালো কোন কবিতার লাইন, ভালো গল্পের কাহিনী অথবা সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখলে ঘুম ভাঙ্গলেই লিখে নিতাম। আজকের স্বপ্ন ভুলিনি। আমি সম্পা রোজি বড় বিলের মধ্যে শাপলা তুলছি। আমার গায়ে জ্বর। এ জ্বর এ¤িœতে হয়নি। হিন্দি ছবির প্রতি ফিলিপিনদের আগ্রহ নেই জেনেও গত রাতে রোজিকে ঐশীর বার্ষোরে মেঘা মেঘা গানটা দেখাই। কিভাবে কিভাবে যেন সেই বৃস্টির পানিতে এই জ্বর আসা। জ্বর তখন ১০২। তাই নিয়ে হাটুজল পানিতে হাটছি আর ফুল তুলছি। একটু গভীরে ৩টা শাপলা ফুল একজোড়ায় ফুটে আছে দেখে সম্পা সেটা নিতে চাইল। পরিচিত উচ্ছাস। আর দশটা মেয়ের মতোই। আর দশটা প্রেমিকের মত আমি গলা ডুবিয়ে আনবো বলে যেতে চাইলে রোজি বলল, জ্বর নিয়ে যেওনা, আমি এনে দিচ্ছি। রোজি অল্প গভীরে যেতেই তলিয়ে যেতে লাগলো। যত গভীরে যাচ্ছে ততই অস্পস্ট হচ্ছে। এরপর একদম তলিয়ে গিয়ে মরে গেলো। সম্পাকে দেখার এক সপ্তাহের মধ্যেই এমন রোমান্টিক স্বপ্ন আসার মানে কি তাও বুঝলাম না!
অনেকদিন পর স্যাড রোমান্টিক স্বপ্ন। ভালোও লাগলো, পরে কস্টও। ঘুম ভাঙ্গলে মাথা নিচু করে মোবাইলের আলো দিয়ে দেখি রোজি গলাসমান চাদড় টেনে ঘুমিয়ে আছে।
আমি ফিলিপিনদের সহ্য করতে পারিনা। রুমমেটদের সাথে হাই-হ্যালো পর্যন্ত। এ কদিনে যতটুকু বুঝি রুমের অবস্থা ভালোনা। এ কারণেই আমার দেরি করে আসা। কিন্তু সম্পার জন্য একটু চিন্তা লাগে। বাঙ্গালি বলেই, ডেকে নিয়ে যে কিছু বলবো- তাও বলছিনা। কোথায় কি চাকরি করছে জানিনি। দুদিন দেখলাম রাত ৮ টায় ফিরে। কপাল, মুখ ঘামে চুপচুপ। ওই প্রথম দিনের পানি চাওয়াটুকু, এছাড়া এ দুসপ্তাহে আর কোন কথা নেই। প্রথম দিন যে ওড়নাটায় দেখেছি প্রতিদিন ঐ একটাই। নেই নাকি ইচ্ছে করে পড়ছেনা কে জানে। কোত্থেকে আসল, কেন আসল কিছু জানায়নি। আমার নিজ থেকে জিজ্ঞেস করাটাও ভালো লাগছেনা। তুই মেয়ে, তোর যদি সমস্যা হয় বলবি, আমি ছেলে, পারি যদি উপকার করবো, না পারলেও চেস্টা করবো। নিয়মতো এরকমই, নাকি?
রাতে দুদিন কান্নার শব্দ হয়েছে। সম্পার কান্না বুঝেও জি্েজ্ঞস করিনি। কেন করিনি তার কারণ পরিস্কার না। এই একটা সমস্যা। মাঝে মাঝে এরকম হয়। কিছু করতে গেলেই ধাক্কার মতো লাগে, ধাক্কাটা কেন লাগে তার কারণ পাইনা। আমিও এও বুঝি ঐ রাতে অবশ্যই আমার তার গিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল,-‘ সম্পা কি হয়েছো? কাঁদছো কেন? মাথা ব্যাথা নাকি পেটে ব্যাথা?’
ছোট বেলা অসুখের মধ্যে শুধু পেটে ব্যাথাটাই ছিল। নিয়ম করে সম্পাহ অন্তর অন্তর পেটে ব্যাথা হতো। ভুবন কাপানো ব্যথা! বিশেষ করে আব্বার সাথে দেশের বাড়িতে বেড়াতে আসলে বেশি হতো। এক পর্যায়ে এমন হতো- ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি শুরু হতো। বারান্দা থেকে ঘর, ঘর থেকে হাজাবু’র রুম (হাফিজা আপা, চাচতো বোন, হাজাবু ডাকি আমরা), আবার ঘর, আবার বড় চকির তল। চিৎকারে বাড়ির সব লোকজন একাকার। মা তখন চাল ভেজে কয়লা করে নিয়ে এসে এক মগ পানিতে ভিজিয়ে তিতা পানি খাওয়াতেন। ব্যস, ২ মিনিটের মধ্যে ব্যাথা শেষ। ঐ বষসে মনে হতো, এ পৃথিবীতে পেট ব্যাথা ছাড়া মানুষের কান্নার আর কোন কারণ নেই।
সম্পা এ প্রশ্নের উত্তর দিতনা তাও জানি। দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলে বলতো,’’ কান্নার শব্দে কি আপনার ঘুম ভাঙ্গছে? যান ঘুমান, আর কাঁদবোনা।’’
অবশ্য তার এ রাগের কারণ আছে। দুদিন আগে সে রোজিকে বলেছে, তার একা ঘুমোতে ভয়। তার থেকেও বেশি ভয় নতুন কোন ছেলে এসে যদি তার উপরের বেডে বা নিচের বেডে জায়গা নেয়।
রোজি অবসরে এখন আর একটা কাজ করছে। প্রতিদিন ঠিক ৫ টায় আমার অফিসের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে। গতকাল ফোন করে বলল, ‘‘একটু বের হওতো হেলাল। জরুরী। কারণ জিজ্ঞেস করার আগে ফোন কেটে দিলো। গেটে এসে দেখি কাঠের পাতানো হেলানো টুলে ফুসকা হাতে বসে আছে।’
সরি হেলাল, ছোট একটা উপকার করো। আন্না কাল ভেকেসনে যাচ্ছে। একটা পাঞ্চাবি কিনে ফিলিপিন পাঠাবো। পাঞ্চাবিটা তোমার পছন্দে কিনতে চাচ্ছি। তাছাড়া আমার জানাও নেই ছেলেরা কোন রংয়ের পাঞ্চাবি পছন্দ করে। তোমার তো নীল ভালো লাগে, না?
আমার গেরুয়া রংয়ের একটাই পাঞ্চাবি। প্রথম বিয়ে ভার্ষিকিতে ভাবি ভাইয়াকে দিয়েছিল। ভাইয়াকে না বলে পাঞ্জাবি নিয়ে আসি। শুক্রবার ওটা পড়ে নামাজে যাই। চুরি করে আনা পাঞ্চাবি পড়ে জুম্মার নামাজ হয় কি না জানা নাই আমার। বললাম, তোমাকে কে বললো আমার নীল পছন্দের?’
না কেউ বলেনি, আমিই হিসেব করে দেখলাম। দ্যাখো, তোমার টুথব্রাশ নীল, বেড সীট নীল, বালিসে কভার হালকা আকাশী। তাওতো নীল, নাকি? শুক্রবার বিকেলে যে ফতুয়াটা পড়লে তাও নীল। আচ্ছা, স্যান্ডে গেঞ্চি কি কখনো নীল হয়? মেয়েদের বিকিনির হাজার রং হয় কিন্তু আমি সাদা রংয়ের বাইরে স্যান্ডো গেঞ্চি খুব কমই দেখেছি। তোমারটা আমার ও লেভেলের ইউনিফর্মের মতো, কড়াকড়া নীল। ইভেন, তুমি যে টুথপেষ্টটা ইউজ করো, পেপসোডেন্ট, তার রংটা পর্যন্ত নীল।
মনে মনে বললাম, রোজি, তুমি যা বলছো সব সত্য না। আমার নিজের টাকা দিয়ে আমি কখনো পেপসোডেন্ট কিনিনি। কারণ টিভি এ্যাড দেখে দেখে আমার মনে এটে গেছে যে, ওটা শুধু বাচ্চাদের জন্য। পোকায় খাওয়া দাঁদের জন্য। আর এখন যেটা ব্যবহার করছি তাও পেপসোডেন্ট না, ক্লোজআপ, যুবক-যুবতীদের টুথপেষ্ট। তবে তার রং নীল সত্য।’’
আমি রোজিকে অফিসের কথা বলে সরাসরি না বলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কষ্ট পাবে; মোটেই না। শেষে বলল, ’না যাও থাক, ফুসকা খাও। তাছাড়া আমি যেহেতু দিচ্ছি আমার পছন্দেই দেওয়া উচিৎ। একটা কথা বলি হেলাল? রাতে ফোনে কথা বলায় তোমার কি কোন সমস্যা হয়?
সমস্যা মানে?
ঘুমোতে পারো? অনেকে ছোট শব্দতেও ঘুমোতে পারেনা। আমিতো অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলি, সমস্যা হাওয়ারই কথা। আজকে থেকে আর কথা বলবোনা। না ঘুমোতে ঘুমোতে তোমার চোখের নিচে দাগ পড়ে দেছে। শোন, এক কাজ করো, তুমি ঐ ইন্ডিয়ান মার্কেটের এড্রেসটা লিখে দাও। আমি জলদি জলদি কিনে আসি। ওর ফ্লাইট ৮ টায়। ’’
আমি লিখেদিয়েছিলাম।
এখন রমজান হওয়ায় লেকে তেমন ভীর নেই। মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করেই দেরি করে বের হই। অফিস রুমে গিয়ে কম্পিউটারে ব্লগ পড়ি, ফেইজবুকে কোন নোটিশ ফোটিশ থাকলে দেখে বের হই। অফিসে মিশরের এক ধবধবে আপা থাকেন। তার পোষাকে মনে হয় তার ছোট কাপড় পড়ার খুব শখ, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট এ্যারাবিয়ান হওয়ায় পারছেন না। লম্বা স্লাওয়ার কামিজ পড়তে হয়, ওড়না ভালো লাগেনা বলেই হয়তো বুকে রাখেন না। উনি এ্যাডমিনিস্টেট্রেটিভ স্ট্যাফ। তার সাথে আমার কোন দরবার থাকার কথা না। কি কারণে উনি প্রায়ই আমাকে ফোন করেন্ এখানো বুঝতে পারিনি। ফোন করে বলে, ’’ হেলাল অফিস শেষে আমার জন্য বাংলাদেশী ফুসকা নিয়ে এসোতো।’’ আমি নিয়ে গেলে উনি ব্যাগে ভরে রাখেন। বলেন, ‘‘ বাসায় গিয়ে মেয়েকে নিয়ে খাবো।’’
আমি ৮ ডেরহাম দিয়ে ফুসকা নেই, উনি আমাকে রিটার্ন করেন ৫০ ডেরহাম। প্রথম দুদিন টাকা নিতে চাইনি। পরে আর না বলিনি। ফুসকা দিয়ে পাশের টেবিলে বসে থাকি। তিনি কাজে থেকে বলেন, বসো হেলাল, এই ফুরফুরা বয়সে এরকম চুপচাপ চলার মানে কি? দুদিন পর তো মরে যাবা। বয়স থাকতে ফূর্তি করে নাও।
আমি শুধু জ্বি বলে বসে থাকি।
কতক্ষণ পরে বলেন, ফেইজবুক করোনা?, নাও, করো। কত গুলো মেয়ে বন্ধু আছে? বসো চ্যাটিং কর। আমার মেয়েকে একটা রিকোয়েস্ট পাঠাও। দেখতে আমার থেকেও সুন্দরী। তুমি ছবি দেখলেই টাসকি খেয়ে যাবে! আইডি দিচ্ছি, নাও।’’- আমার অবাক লাগে, নিজের মেয়ে নিয়ে এমন অশ্লীল কথা বলে কিভাবে? তার বাক্যে অশ্লীল কোন শব্দ নেই জানি, তারপরও তার কথা আমার ভালো লাগেনা। উনি নিজেই আইডি লিখে দেন। এরপর আর কোন খোজ নেই। আমি চেয়ার ঘুরিয়ে সামহোয়্যার ব্লগ খুলে পড়তে বসি। জিঞ্জেস করলে বলি, পাঠিয়েছি ম্যাম।’’ তাকে বলিনা, আমার ফেইজবুক ভালো লাগে না। তাছাড়া আপনার মেয়েকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে লাভ কি? সেওতো আপনার মতো; বাংলা জানেনা। বাংলা না জানা মেয়ে আমাকে চুমু দিলেও আমি টাসকি খাবোনা ম্যাম।
আমি সহ বোর্ডে ৩ জন লোক। লেকের মধ্যে এসে মেশিন অফ হয়ে গেছে। যে যার মতো বসে আছি। অন্য বোর্ডে করে যাত্রীদের পাড়ে নিতে চাইলে তারা রাজি হয়নি। বলল, বাতাসে নিয়ে যাবে। আমাদের তাড়াহুড়ো নেই।
মনে মনে বললাম, এমন বয়সে কাছাকাছি থাকতে আমারো কোন তাড়াহুড়ো ছিলনা । তারা দুজনে এক ছাতার নিচে বসে আছে। আমি পেছনে গিয়ে বসে বসে লেকের পানি দেখি।
সব জায়গায় দেখি নীলে খেলা। যেখানে যাই সবই নীল। লেকের পানিও নীল। মাথা নুইয়ে লেকের পানি হাতে নিয়ে দেখলাম, পানী নীলনা, উপরের নীল আকাশের কারনে পানি আয়না হয়ে নীল হয়ে গেছে। ঠিক এই আকাশ নীলের মত একটা শার্ট ছিল আমার। কলেজে পড়তাম তখন। শুধু আমার না, আমার ব্যাচের প্রায় সবার ছিল। এর মধ্যে মিলনের শার্টটাই দামী ছিল, ৫৪০ টাকা। বরিশালের দোয়েল দিয়ে কেনা। সেই দোয়েল নীল শার্ট বিক্রি করে করে এখন প্লাস হয়েছে। দোয়েল প্লাস। তখন হঠাৎ করে নীল শার্টের একটা চল হলো। মেয়েরা নীল শাড়ি, ছেলেরা নীল শার্ট। নবীন বড়ণে নীলের কাড়ী। আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে লম্বা মেয়ে সুলতানা নীল শাড়ি পড়বে শাড়ি পাচ্ছেনা। যা পায় তা লম্বায় হয়না। পড়লে মাটি থেকে ৮ আঙ্গুর উপরে শাড়ির পাড় উঠে যায় । এ নিয়ে কত ক্ষ্যাপানো তাকে। তোর বর তোকে নিয়ে দুনিয়ার ঝামেলায় পড়বে। তোরতো লোকাল শাড়িতে হবেনা। আলাদা শাড়ি কিনে সেলাই করে নিতে হবে। মনে কর তোকে খুব শখে একটা কালো শাড়ি দেওয়া হলো। লম্বায় না হওয়ায় তুই তোর দাদির সাদা শাড়ির পাড় কেটে কালো শাড়িতে লাগিয়ে নিলি! ব্যাস! তানা হলে আর এক পারিস। ইন্ডিয়া থেকে লম্বা নায়িকারা যেখান থেকে শাড়ি কেনে তোর বরের টাকা খরচ করে সেখান থেকে শাড়ি কিনে আনবি। তোর বর কৃপন হলে এমনো হতে পারে তোর কোনদিন আর শাড়ি পড়া হবেনা। শুধুই থ্রি পিচ আর থ্রি পিচ। ’’ সবিশেষ এ ঘর ও ঘর তন্ন করে খোজা শেষ। শেষমেষ আমাদের এক বন্ধুর মায়ের নীল শাড়ী ম্যানেজ করে তাই পড়ে আসা। লম্বা বলেই হয়তো সেদিন নীল শাড়িতে তাকে সত্যি সত্যি নায়িকাদের মতো লাগছিলো!
আচ্ছা, নীল শাড়ীতে রোজিকে ভালো লাগবে নাকি সম্পাকে? সম্পাতো শ্যামলা মেয়ে, শামলায় নীল লেগে গেলে কালো কালো লাগেনা? রোজির গায়ের রং কি মিশরী ম্যামের মত অত ফর্সা? অতটা না হলেও অনেক ফর্সা। নীলতো ফর্সাতেই মানায়। এ মাসের স্যালারী দিয়ে ওদের দুজনকে দুটো নীল শাড়ি কিনে দিলে কেমন হয়? পাশাপাশি দাড় করিয়ে পরীক্ষা করা যাবে। শাড়ীর সাথে ম্যাচ করে সব কিনবো। মেয়েদের সব পোশাকই সব রংয়ের হয়। সোমবার ৫ টায় অফিস থেকে এসে দুজনকে ৩০ মিনিটের মধ্যে তৈরী হতে বলবো। পাশাপাশি দাড় করাবো। রুমের বাকীরা থাকবে জাজ। অল্প ্ উচু টাইপের কিছুকে মঞ্চ করা হবে। আমি থাকবো উপস্থাপক। অনুষ্ঠানের আগের দিন বাংলাদেশে ফোন করে হানিফ সংকেতের কাছ থেকে কিছু টিপস নিয়ে নিবো। এরপর এক একজনকে ডাকা হবে। প্রথমে কাকে ডাকা যায়? সম্পা নাকি রোজি? সম্পা বাংলাদেশী, সম্পাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। সে চাইলে এক্সট্রা প্রসাধনী কেনার জন্য তাকে টাকাও ধার দিতে পারি । অবশ্য সে বোধহয় চাইবেনা। যে মেয়ে এখন পর্যন্ত ফোন নাম্বারটা দিলোনা সেকি আর টাকা চাইবে? সম্পা মঞ্চে আসার সাথে সাথে করতালি। এদেশে রাতে করতালি দিলে সমস্যা কিনা জানা হয়নি। এখানকার সমস্যা মানেই পুলিশ। পুলিশ মানেই ভয়ানক ব্যাপার। ওকে, তালি-টালি বাদ। সম্পাকে বিনীত ভাবে বলা হবে, ‘‘ পাঁচ মিনিটের পারফর্ম করতে হবে। তুমি কি করবে বলো? কবিতা না গান?’
সে মঞ্চে উঠে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে রইলো। এভাবেই এক মিনিট শেষ, আরো বিনয় নিয়ে উপস্থাপক বলবেন, সম্পা, ্অপশন উন্মুক্ত করা হলো। আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। নাচ জানা থাকলে নাচ, অভিনয় জানা থাকলে অভিনয়।
সম্পা মাথা তুলে দাড়ায়। ইউএই এর প্রেট্রোলিয়াম বেঁচা টাকায় তৈরী হওয়া রুইহি লাইটের ঝকঝকে আলোয় দেখি, সম্পার চোখ বেয়ে ঝর্ণার মতো পানি ঝড়ছে। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো, ‘‘ হেলাল ভাই, আমাকে নিয়ে যান, আমাকে এ দেশ থেকে নিয়ে যান। এ দেশে থাকলে আমি মরে যাবো’’।
আমাদের দুজনকে পুলিশের ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমার শহরের পুলিশি ভ্যান থেকে এ ভ্যান হাজার গুনে উন্নত। ভেতরটা ইংলীস সিনেমার নায়িকাদের বেড রুমের মতো সাজানো, তবে কোন বেড নেই। ছোট একটা গাড়ির মধ্যে এতবড় রুম কিভাবে তৈরী হলো কে জানে। রুমের সব কিছুই সাদা। আমরা দুজনে পাশাপাশি যে টুলটায় বসে আছি তার কুশনের কাভারও সাদা। পায়ের নীচে সাদা, মাথার উপর সাদা। গাড়ি চলছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। তবে চলছে। ধান শুকাতে উঠোনে যেমন মিহিন করে চাটাই বানানো হয় এ দেশের রাস্তা তেমন মিহিন। গাড়ি চললে বোঝার কায়দা নেই। এদেশের কোন গাড়িই বোধহয় দেড়শো’র নীচ টানে না।
রোজির ফোনের ঝামেলা ছিলনা। ঐ দিনের পর থেকে আর সে রাতে কথা বলেনি। তাই বিছানায় গেলেই ঘুম হতো। সেদিন হঠাৎ রাত দুটোর দিকে কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। না উঠে কান্নার স্বর চেনার চেস্টা করি। খুব কাছ থেকে আসছে বলে ভাবলাম রোজি অসুস্থ নাকি? ঘুমের ঘোড় কাটলে শব্দ আরও স্পষ্ট হয়। জলদি বেডের বাইরে মাথা ঝুলে দেখি আমার বেডের নিচে বসে সম্পা কাঁদছে।
এক ঝাটকায় উঠে বসি। জোড়েই বলে বসি, সম্পা!
কোন উত্তর নেই। আমি দ্রুত বিছানা ছেড়ে লাইট জালাতে গিয়ে লজ্জায় পড়ি। সাথে সাথে লাইট অফ করে দেই। আমি আগেই জানতাম রুমের অবস্থা ভালোনা। রুমের কার্যক্রমের সাথে আলোর কোন সম্পর্ক নেই।
দ্রুত নীচে নেমে এসে বললাম, সম্পা, কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?
কোন সাড়া শব্দ নেই। এ দেশীয় ধর্মীয় ফতোয়ার নিবীড় আশ্রয়ে লালিত এমন পৈশাচিতক নিস্তবতায় শুধু সম্পার বুকচাঁপা কান্না আমাকে সত্যিই খুব আহত করে। আমি আহত হই। সম্পা আমার এমন কেউ না যাকে ৩ বছরের দীর্ঘ মায়ায় আমার বুকের কাছাকাছি আগলে রেখেছি। যাকে আমি স্পর্শ না করেই বিশ্বস্ত বানিয়ে দাবী করেছি; ‘‘মেয়ে তুই আমার, একান্তই আমার, অলিখিত দলিলেই শূন্য হাতে তোকে চেয়ে বসলাম বলে মাইন্ড করিসনা’’- এমন কোন নাটকীয় ডায়লগের মুখোমুখি করিনি সম্পাকে। তারপরও তার এ কান্না এমাকে এতটা অসহায় বানালো যে, আমি বোকা হয়ে গেলাম।
আমি মোবাইলে আলো দিয়ে দেখি সম্পা মাথা নিচু করে বসে বসে কাঁদছে।
সম্পার মাথায় হাত রেখে বললাম, সম্পা কি হয়েছে?
সম্পা কান্না জড়ানো গলায় বললো, ‘‘ আমাকে নিয়ে যান, এ দেশ থেকে অনেক দূরে। আমাকে একটা আশ্রয় দেন। আপনার পায়ে পড়ি’’
আমি আস্তে করে রোজির বেডের নীচ থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে দ্রুত হাতে লিখি।
রোজি,
তোমার রান্না সত্যি অসাধারণ। আমার কাছে মনে হয় মেয়েদের যদি রান্নার গুন না থাকে সে মেয়ে মেয়েই না। তুমি অসাধারণ মেয়ে। আর একটা কথা। তুমি রাত জেগে ফোনে কথা বললে আমার কস্ট হয়না। ঘুমেও সমস্যা হয়না। কিন্তু এই ফোনটা যদি সম্পা করতো, সম্পার ফিসফিস আওয়াজ যদি আমার কানে আসতো আমি বোধহয় জীবনেও আর ঘুমোতে পারতাম না। সম্পা বিপদে আছে, তাই সম্পাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমার দেয়া নীল পাঞ্চাবিটা আমি পেয়েছি, পাঞ্চাবির পকেটের লেখাটাও পেয়েছি। আমার ব্যাগের যেখানে ওটা রেখেছো তার নীচে লাল রংয়ের একটা বলপেন ছিল। কিভাবে যেন সেই বলপেন থেকে কালি ধুয়ে পাঞ্চাবিতে মিশে গেছে। এখন আর ওটা নীল পাঞ্চাবি নেই, লাল-নীল নীল পাঞ্চাবী। আর একটা কথা, রান্নার মতো তোমার হাতের লেখাও খুব সুন্দর। এ লেখা দেখে কেউ বুঝবেইনা তুমি বাংলা না জানা মেয়ে। অবশ্য না ধরার মতো ছোট একটা ভুলও ছিল সে লেখায়। তুমি সর্বশেষ যে বর্ণটা লিখছো ওটা দন্ত স হবে।
রোজি, তোমার লেখা চার অক্ষরের শব্দটা আমি নিতে পারছিনা। আমাকে মাফ করে দিও্ ।
ইতি,
হেলাল।
=======================================
(গল্পটা এখানে শেষ করার কথা ছিলনা। বসের সাথে রাগ করে শেষ করা। মুলত প্রতি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে আমাকে টাইম সিট সাবমিট করতে হয়। যদিও কাটঅফ ডে ৩০ হলেও আমি ওভারটাইম, ইনসেনটিভ সব সহ জমা দিতে দিতে ২ তারিখ করে ফেলি। গল্পটা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এবারে আর একদিন লেইট হয়ে গেলো। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে করিয়ানরা রাগাগাগি বা গালাগালি করলেও ওদের নিজেদের ভাষায় করে। তাই ওগুলো আমাদের ভিতরে ঢোকেনা। তারপরও মেজাজ খারাপ হলো খুব তাই রাগের বসেই গল্পনা এখানে শেষ করি। গল্পটা যেভাবে শেষ করার ইচ্ছা ছিল তার সারমর্মটা লিখে দিচ্ছি।’’
ভোর ৫ টার মুসাফ্ফার মেইন রোড থেকে আমাদের দুজনকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল। অবশ্য তাতে খুব একটা কষ্ট পাইনি। দুজনের ছোট দুটো ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হই রাত ৩টায়। প্রথম ১ ঘন্টা একটু লজ্জা লাগছিলে। ৪ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত ১ মিনিটের জন্য কেউ কারো হাত ছাড়িনি। সম্পা ভয়ে নাকি ভালোবাসায় এমন শক্ত করে হাত ধরে ছিল আমি যেন সুখে অবশ হয়ে যাচ্ছিলাম। শহরের এমন ডুবডুবা আলোয় পুরো শহরে আকাশ ছাপা চুড়ি পড়া মেয়ের হাত ধরে হাটার সুখ পৃথবীতে আর আছে বলে আমার মনে হয়না। রাস্তায় লোক নেই, গাড়ি নেই তারপরও হাত ধরে রাস্তা পাড় হওয়া। কিছুদুর পর পর খাজুর গাছ, খাজুর পেকে নিচে পড়ে আছে, হাটছি আর খাজুর তুলছি। অল্প বাতাস, বালুর নাম গন্ধও নেই, তারপরও বালুর ভয়ে দুজনের মাথা এক করে নিচু করে বসে পড়া। প্রথম যেদিন ইউএতে আসি বালু দেখে আমার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিলো। মনেই হয়নি এমন মরুময় বালু মাখা ধুলোয় যুবকদের স্বপ্ন পূরনীয় রাত আসে।
সত্যি বলতে যেটা গল্পটা আমি এখানেও শেষ করতে চাইনি। সম্পানে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঠিক আধ ঘন্টার মধ্যে একজন বয়স্ক আরাবিয়ান এসে সম্পাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। সম্পা যাওয়ার সময় কাঁদতে কাঁদতে বলবে, ‘হেলাল ভাই, আমাকে ওরা আবার বনে নিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচান’’। -এরকম। কিন্তু আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। গল্পে সম্পা নামটা আমি আরো ব্যবহার করেছি। এজন্যই হয়তো তার প্রতি একটা মায়া জন্মেগেছে। তাই তাকে বাজে এ্যারাবিয়ানের হাতে তুলে না দিয়ে হেলালের হাতে তুলে দিলাম। হেলাল শুকনা ছেলে হলেও সম্পার জন্য একদম খারাপ হবেনা।