আমরা লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম ৩০শে মার্চ ২০০৭। আফ্রিকা থেকে প্রথমে গেলাম ইটালির মিলান শহরে,সেখানে সকালে পৌঁছালাম। ৮ ঘন্টা এদিক সেদিক একটু যা পারি ঘুরাঘুরি করে আবার রওনা দিলাম লন্ডনের পথে,সন্ধ্যায় যেয়ে নামলাম (Heathrow Airport) লন্ডনে। আমাদেরকে নেয়ার জন্য একজন বন্ধু এসেছিলেন সেখানে। আমরা তার বাসাতেই উঠেছিলাম। যে কয়দিন ছিলাম বেচারা অনেক ভালভাবে খাতির করেছিলেন আমাদের।এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পথেই উনি অনেক কিছু দেখালেন আমাদেরকে। বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে কিভাবে ঘুরে দেখব সব কিছু। আমরা যখন গেলাম তখন ভালই ঠান্ডা ছিল, ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল তাপমাত্রা।আর গরমের দেশ আফ্রিকা থেকে হঠাৎ করে ঠান্ডায় যাওয়াতে বেশ ঠান্ডাই লাগছিল আমাদের। সেদিন বাসায় যেয়ে খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন থেকে আমাদের অভিযান শুরু করলাম (লন্ডন অভিযান)...
প্রথমদিন বন্ধুটি আমাদেরকে রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে গেলেন,উনাদের বাসার একদম কাছে ছিল (Goodmayes) স্টেশনটা। সেখানে সব কিছু ভালভাবে দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দিলেন, এরপর আমরা নিজেরাই ঘুরে বেড়ালাম। আমরা প্রথমে দেখতে গেলাম (London Bridge) সবসময় টিভিতে আর মুভিতে দেখা এই ব্রিজ চোখের সামনে দেখে বেশ অন্যরকম ভাল লাগছিল। যখন কোন বড় জাহাজ পানি দিয়ে আসে তখন ব্রিজের রাস্তাটা দুভাগ হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়,সেটা দেখতে ভালই মজা পেয়েছিলাম... ব্রিজের উপরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহঁটি করলাম, ছবি তুললাম। তারপরে একটু লন্ডনের রাস্তায় এদিক সেদিক ঘুরলাম(অনুভূতিটাই ছিল অন্যরকম...আমি লন্ডনের রাস্তায় হাঁটছি,যা কোনদিন কল্পনাও করিনি)... পরে ট্রেন ধরে বাসায়।
পরেরদিন আমরা গেলাম (London Eye) দেখতে। ওরে বাবা সেখানে যেয়ে মানুষের ভীড় দেখে জান শেষ। যদিও উপরে উঠার ইচ্ছা শেষ হয়ে গেছিল এত লম্বা লাইন দেখে,কিন্তু তারপরেও না উঠে পারলাম না...কি করবো মন যে মানে না। মনে হচ্ছিল না জানি কি দেখা বাদ পড়ে যাবে, লন্ডন আই তে না উঠলে... যাইহোক উপরে উঠে মনে হচ্ছিল টাইমই যাচ্ছে না,এত আস্তে ঘুরছিল সেটা যে বোরিং লাগছিল। হাজার হোক সবাই এত টাকা দিয়ে টিকিট কিনেছে কিছুক্ষন উপরে না থাকলে কেমন করে হবে তাই না... উপর থেকে লন্ডনের বেশ অনেক কিছুই চোখে পড়লো, মোটামুটি ভালই লেগেছিল... মাঝখান দিয়ে টিকিট কাটার সময় আমি জেমস বন্ডের সাথে কিছু ছবি তুলে নিয়েছিলাম... (Statue of Mr. Bond 007) লন্ডন আই থেকে নেমে সামনে একটা পার্কের মত ছিল বাচ্চাদের,সেখানে যেয়ে কিছুক্ষণ বসেছিলাম...মানে বাতাস খেলাম... তারপরে ট্রেনে করে বাসায় চলে গেলাম।
পরের অভিযান ছিল আমাদের (Madame Tussaud Museum)... এই মিউজিয়ামটার কথা অনেক শুনেছিলাম। সেখানে আমার স্বপ্নের অনেক মানুষের মূর্তি আছে... আরও শুনেছিলাম শাহরুখ খানের স্ট্যাচুও রাখা হচ্ছে সেখানে,আমার তো আর সহ্য হচ্ছিল না,কবে যাব দেখতে... তো অনেক প্রতিক্ষার পরে আমরা ৩রা এপ্রিল ২০০৭ গেলাম সেখানে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অবস্থা খারাপ,কিন্তু তার পরেও মন এতটাই উদগ্রীব ছিল ভেতরে যাওয়ার জন্য যে সেই কষ্টটা গায়েই লাগছিল না... ১ঘন্টারও বেশী সময় লাইনে থেকে অবশেষে ভেতরে ঢুকতে পারলাম। লিফটে করে যখন উপরে যাচ্ছি,সেখানকার একজন সিকিউরিটি গার্ড ছিল আমাদের সাথে,সে আমাদের কে হঠাৎ করে বলে উঠলো...গতকালকে শাহরুখ খান এসেছিল এখানে তার স্ট্যাচু উদ্ভোদন করতে.... শুনে আমার এত খারাপ লেগেছিল, যে মনে হচ্ছিল আমরা কেন কালকে আসিনি... মনটা এতই খারাপ হয়ে গেছিল সেটা আপনাদের কে বলে বোঝাতে পারবো না... ভেতরে যেয়ে দেখি এত স্ট্যাচু এদিক সেদিক বিভিন্ন ভাবে রাখা আছে যে বোঝাই যাচ্ছিলা না কোনটা সত্যিকারের মানুষ আর কোনটা স্ট্যাচু... আমি তো শাহরুখ,অমিতাভ আর ঐশ্বরিয়া কে খুঁজতে ব্যস্ত...হঠাৎ এ্যানাউন্সমেন্ট হলো যে গতকালকে শাহরুখ খানের স্ট্যাচু উদ্ভোদন হয়েছে সেজন্য ইন্ডিয়া থেকে একটা টিম এসেছে তারা শাহরুখের কিছু ছবির নাচ গান করে দেখাবে তার স্ট্যাচুর সামনে....সব মানুষ সেখানে ভীড় করে দেখছে। দারুন পারফরমেন্স ছিল তাদের...আমি অনেক অনেক ছবি তুললাম আর অবশ্যই ভিডিও করলাম অনেকক্ষণ ধরে। মনের যত শখ ছিল মিটিয়ে শাহরুখের সাথে ছবি তুললাম...যেন সত্যিকারের তাকে সামনে দেখছি... আর অমিতাভ ও ঐশ্বরিয়ার স্ট্যাচু সেদিন তারা সরিয়ে ফেলেছিল রিপেয়ারিং এর জন্য,তাই তাদের সাথে আমার দেখা হয়নি... এছাড়াও আরও অনেক অনেক সেলিব্রেটিদের স্ট্যাচুর সাথে ছবি তুলেছিলাম....নিকোলেস কেজ, মুহাম্মদ আলী, রানী এলিজাবেথ, স্পাইডারম্যান আরো অনেক অনেক নাম যা বলে শেষ হবে না। মোম দিয়ে এত নিখুঁত করে যে কিভাবে তারা এই মূর্তি বানিয়েছে !!! ...আমি অবাক,মানুষ চাইলে কি না পারে... অনেকক্ষণ মিউজিয়ামটার ভেতরে ছিলাম আমরা,তারপরে আবার নিজেদের গন্তব্যে ফেরত।
এরপরের দিন আমরা (Buckingham Palace) দেখার জন্য গেলাম। প্রথমে দেখলাম (Green Park) তার ভেতর দিয়ে গেলাম প্যালেস এ। আমরা ভেতরের মিউজিয়ামে যেতে পারিনি,সেসময়ে বন্ধ ছিল। বাইরে থেকে দেখে বেশ ভাল লেগেছিল...গার্ডদের ডিউটি চেন্জ হওয়ার দৃশ্যটাও দেখলাম। সেটা দেখার জন্য অনেক মানুষ ভীড় করে ছিল।সেখান থেকে গেলাম (Queen's Gallery) সেখানে বিভিন্ন দেশের আর্টিস্টদের পেইন্টিং ছিল। যারা পেইন্টিং পছন্দ করেন তাদের খুবই ভাল লাগার কথা। আমিও অনেক পছন্দ করি,অনেক ভাল লেগেছিল এত বড় বড় মানুষের সব পেইন্টিং গুলো দেখতে। তারপরে রওনা দিলাম (Big Ben) দেখার উদ্দেশ্যে। সেখানে যাওয়ার পথে পড়লো একটা বড় গির্জা (Church) তার ভেতরে ঢুকলাম,বিশাল বড় একটা চার্চ সেটা। অনেক রাজা রানী আর বড় বড় মানুষদের কবর ছিল তার ভেতরে। কেমন যেন গা ছমছম করা নিরবতা ছিল সেখানে...আর অনেক ঠান্ডা লাগছিল তার ভেতরে। আমার তেমন একটা ভাল লাগেনি...মনে হচ্ছিল মাথা ভার হয়ে যাচ্ছে... সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা গেলাম বিগ বেনের কাছে...আহা,এতদিন টিভি আর মুভিতে দেখা সেই বিগ বেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি... অনুভূতটাই অদ্ভুত ছিল আমার। অনেক অনেক ভাল লাগলো আমার সেই স্বর্ণালী ঘড়িটা,বেশ কিছু ছবি তুললাম,ভিডিও হলো। তারপরে চললাম (Trafalgar Square) দেখতে...অনেক মানুষ গিজ গিজ করছে সেখানে। বড় বড় সিংহের সামনে ছবিও তোলা হলো অনেক। খোলামেলা ছিল জায়গাটা ভালই। সামনে ছিল (National Gallery) প্রচুর মানুষ ঢুকছিল সেখানে,ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সেখানে ঢুকা হয়নি। কারণ সেদিন এত জায়গা ঘুরে আমাদের চলনশক্তি (Energy) শেষ হয়ে গেছিল... কাছাকাছি ছিল সব দেখার মত জায়গা সেজন্য একদিনেই বেশ কিছু জায়গা দেখে নিয়েছিলাম।
হাতে ছিল আরও দুইদিন সময়...এই দুদিনে আমরা গেলাম (The tower of london) লন্ডন ক্যাসেল পুরাটা কে মিউজিয়াম বানানো হয়েছে। খুবই সুন্দর একটা জায়গা। হাজার হাজার বছর আগের পুরানো সব জিনিষ। আমার এর ভেতরে দেখার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যেটা ছিল সেটা হলো (Jewel House) সেখানে কোহিনূর হীরার মুকুট দেখলাম... আরও কত কত হীরা, মণি মুক্তা,সোনাদানা দিয়ে তৈরী জিনিষ দেখলাম...এখনো ভাবলে চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠে আমার... ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধের সব সরঞ্জাম দেখলাম। কিভাবে তারা মানুষদের কে শাস্তি দিত,কিভাবে যুদ্ধ করতো অনেক কিছুই দেখলাম,অনেক ভাল লেগেছিল। সেদিন এই মিউজিয়ামটা দেখতে দেখতে দিন শেষ হয়ে গেছিল,বাসায় চলে গেছিলাম।
শেষ দিন গেছিলাম আমরা (Natural history Museum) দেখতে...ইয়া বিশাল মিউজিয়ামটা। বড় বড় ডাইনোসোর,জীবজন্তু দিয়ে ভরা সেটা...অনেক কিছুই জানলাম,দেখলাম। সমুদ্রের নীচের অনেক কিছু,মানুষের দেহের ভেতরের অনেক কিছু জানা হলো। মোটামুটি ভাল ছিল মিউজিয়ামটা।
লন্ডন শহরটা মোটামুটি দেখে আমরা ৮ই এপ্রিল ফ্রান্স শহর দেখার জন্য ট্রেনে করে রওনা দিয়েছিলাম। ফ্রান্স নিয়ে আরেকটা পোষ্ট পরেরবার দিব। এইটাই অনেক বড় হয়ে গেছে...তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আর বেশ অনেক দিন আগে গেছিলাম লন্ডনে সেজন্য ঝাপসা যেসব স্মৃতি মনে আছে তাই লিখলাম...কিছু ভুল দেখলে জানাবেন,আমি ঠিক করে নিব অবশ্যই। কিছু ছবি শেয়ার করলাম ...