মিডিয়া ও মালিকানা
বর্তমান এই তথ্য বিষ্ফোরণের যুগে গণমাধ্যমের সহজ ও ব্যাপক বিস্তার এবং প্রযুুক্তিগত উন্নতির ফলে গণমাধ্যম আজ আমাদের কাছে অনেক বেশি স্বাভাবিক একাটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আজ এমন একটি অবস্থানে আমরা আছি যেখানে গণমাধ্যম থাকা না থাকার প্রশ্নটি অচল। বাস্তব সত্য এই যে, গণমাধ্যম ছাড়া আমাদের জীবন অসম্ভব অর্থাৎ বলা চলে এটি আমাদের জীবনকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করছে।
গণমাধ্যম যেমন নিয়ন্ত্রণ করছে গণমানুষের জীবন যাপন তেমনি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে এর মালিক। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর জন্য এই কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। এমনকি সরকারি টেলিভিশন তো বটেই বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও আজ নিয়ন্ত্রিত হয় মালিকের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায়। এসব জায়গায় এমন কোন সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় না যা তার মালিকের বিপক্ষে যায়। এমনকি সাংবাদিকদেরও কাজ করতে হয় মালিকের চোখের ইশারায় যা রুদ্ধ করে দেয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পথ অন্যকথায় তা হরণ করে গণমানুষের তথ্য অধিকার।
মিডিয়া ও মালিকানা:
মিডিয়া এর বাংলা হল গণমাধ্যম। অর্থাৎ যাবতীয় সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনসহ সকল ধরনের মাধ্যম যা গণমানুষকে তথ্য জানানোর কাজ নেয়। আর সবকিছুর যেমন একজন মালিক থাকে তেমনি মিডিয়ারও মালিক থাকে। তবে মিডিয়ার মালিক আর অন্যান্য মালিকদের সাথে পার্থক্য হল মিডিয়া মালিকদের পাওয়ার বেশি। তারা মূলত মিডিয়াকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থকে হাসিলের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে। মিডিয়ার মালিকানাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক্স ব্যক্তি মালিকানা
ক্স অংশীদারী মলিকানা
ক্স আইনগত মালিকানা
ক্স দলগত মালিকানা
ক্স কর্মচারী মালিকানা
ক্স উলম্ব মালিকানা
ক্স যৌথ মালিকানা
আমাদের দেশে মিডিয়ার মালিকানা পূর্বে ছিল ব্যক্তি মালিকানায় তবে বর্তমানে এই ধারার অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে বেশিরভাগ মিডিয়া অংশীদারী মালিকানা বা যৌথ মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে তাদের মধ্য থেকেই হচ্ছে সম্পাদক, চেয়ারম্যান, বা এমডি। ফলে আগে তাদের কতৃত্ব ছিল তার চেয়ে এখন আরো বেড়ে গেছে, সেই সাথে বেড়ে গেছে ব্যবসায়িক সূলভ মনোভাব। ফলে দিন দিন তারা হয়ে পড়ছে স্বার্থবাদী আর জনবিচ্ছন্ন একটি মাধ্যমে । তাদের মধ্যে থাকছে না কোন দায়িত্ববোধ এতে সাধারণ জনগন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মিডিয়া মালিকানার তাত্ত্বিক পটভূমি:
‘লিবারেল প্লুরালিস্ট’ বা ‘উদার বহুত্ববাদীরা’ মনে করেন, ওপর সমাজে বহুমত প্রকাশের সুযোগ করে দেয়, মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটায়, গণমাধ্যমের অন্যতম কাজ তাই রাষ্ট্রে মত প্রকাশের স্বাধনতা নিশ্চিত করা। এই ঘরানার তাত্ত্বিককেরা ওপরকে দেখাতে চান এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে যা স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম; যার আছে নিজস্ব পরিচালন-পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি একটি পর্যয় পর্যন্ত স্বায়ত্বশাসন ভোগ করে। মিডিয়া প্রফেশনাল বা ওপর পেশাজীবীরা, এখানে ধরে নেয়া হয়, উদারভাবেই তাদের কাজ ও ভাবের প্রকাশ বা উপস্থাপন ঘটাতে পারেন। মিডিয়া প্রফেশনাল আর অডিয়েন্সের সম্পর্ক এখানে নির্ধারিত হয় একই সমতলে। ধরে নেয়া হয়, প্রফেশনালদের মতো গণমাধ্যমের অডিয়েন্সও স্বাধীন- নির্দিষ্ট কোন মিডিয়া নির্বাচন বা নির্দিষ্ট কোন মিডিয়ার নির্দিষ্ট কোন আধেয় /অনুষ্ঠান নির্বাচন করার ক্ষেত্রে।
বিপরীতে ওপর বিষয়ে বিষয়ে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকগণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ‘ক্রিটিক্যাল ’ বা ‘র্যাডিক্যাল’ হিসাবে চিহ্নিত। সমাজের ওপর কী ভূমিকা রাখে- এর উত্তরে ক্লাসিক্যাল মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকগণ মনে করেন, ওপর সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী আধিপত্যকেই টিকিয়ে রাখতে চায়; সমাজের ‘তথাকথিত স্ট্যাটাস কৌ’ বা ‘বিরাজমান অবস্থাকে’ই জারি রাখতে চায় এবং সে লক্ষ্যেই সমস্ত আয়োজন সম্পন করে চলে। ওপর সম্পর্কিত মার্ক্সিস্ট চিন্তার ভিত্তিভূমি হচ্ছে শ্রেণী-অধিপত্য। মার্ক্সিস্টরা মনে করেন, গণমাধ্যমে যে সংবাদ আর মতামত প্রকাশিত হয়, চূড়ান্ত বিচারে তা আসলে সমাজের আধিপত্যশীল শ্রেণীর মতাদর্শকেই প্রতিফলিত করে; ওপরকে যেহেতু বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠমোর মধ্যে থেকে আধেয় নির্মাণ করতে হয়, ফলে তারা এমনভাবে সংবাদ/অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন প্রকারান্তরে যা ওই রাষ্ট্রকাঠামোকেই সমর্থন করে; রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি বা অর্থব্যবস্থা হিসাবে রাষ্ট্র যে দর্শনকে গ্রহণ করে, সংবাদপত্র তাতে সমর্থন জোগায়। ওপর আধিপত্যশীল শ্রেণীর মতাদর্শ, বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠামো, সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা- এসব মৌল বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলে না। আর মিডিয়া প্রফেশনালরাও চেতনে বা অবচেতনে সমাজে বিরাজমান ওই আধিপত্যশীল শ্রেণীর মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হন এবং একে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জেনে বা না জেনে কাজ করে চলেন। কারণ তাদের সামাজিকিকরণ, অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা বা সাংবাদিকতায় তাদের প্রশিক্ষণ সবই নির্মিত হয় আধিপত্যশীল মতাদর্শের অদলে, কোন অবস্থাতেই তাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে। সমালোচনা, ভিন্ন বা পাল্টা মতামত যে গণমাধ্যমে থাকে না, তা কিন্তু নয়, অবশ্যই থাকে, ওপর বিতর্ক বা ভিন্নমতকে উৎসাহিতও করে,তবে সবই হয় বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর বড় বড় ওই ক্যানভ্যাসের আওতায়। ওই ক্যানভ্যাসের ভেতরেই সংবাদ মাধ্যম ‘নতুন বাস্তসতা’ তৈরি করে এবং তৈরি করা বাস্তবতাকে অডিয়েন্সের সামনে সামনে উপাদেয় খাদ্য হিসেবে পরিবেশন করে; আর অডিয়েন্সও যেহেতু আধিপত্যশীল মতোদর্শের ছাঁচে গড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী, তাই মিডিয়াতে যেসব মতাদর্শিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়, তা নিয়ে কোন প্রশ্ন অডিয়েন্স সাধারণত তোলে না। ওপর যে অনুষ্ঠান/সংবাদ অডিয়েন্সের সামনে তুলে ধরে বেশিরভাগ অডিয়েন্স তা মেনে নেয় তবে মনেও নেয়; এবং এক সময় তা নিটশের ব্যাখ্যায়, স্বাভাবিক হয়ে ওঠে অডিয়েন্সের তরফ থেকে কোন প্রতিরোধ তৈরি হয় না কার্যকর প্রতিরোধ তো নয়ই।
ক্লাসিক্যাল মার্ক্সিস্ট যাদের মূল বিবেচনা ‘ইকোনমিজম’ তারা মনে করেন, সমাজের ভিত্তিকাঠামো যেহেতু অর্থনীতি, তাই একটি সমাজে অর্থনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারাই উপরিকাঠামো বা সমাজের বাকি সব বিষয় যেমন রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করেন। গণমাধ্যমের মালিক যেহেতু প্রতিষ্ঠানের বেস বা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন, তাই সুপারস্ট্রাকচার বা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণমাধ্যমের পলিসি কী হবে মালিকই তা মালিকই তা ঠিক করে দেন। এই পলিসির ভেতরেই নির্ধরিত হয় কোন ধরনের সংবাদ বা অনুষ্ঠান নির্মাণ হবে, কোন ধরনের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শকে ওপর প্রতিফলিত করবে সেই বিষয়টি; যুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালাবে না বিপক্ষে, ইসলামী জঙ্গিবাদের সমর্থন করবে না বিরোধিতা করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমগুলো কীভাবে কাজ করছে, এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা ‘সিস্টেমেটিক প্রোপাগান্ডা’ মডেল বের করেন। তারা বলেছেন ওপর এলিটদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে। তবে মার্ক্সিস্টরা গণমাধ্যমের ভূমিকাকে যেভাবে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী বিশ্বের সংগঠিত প্রচারণা হিসাবে দেখেন-হারমেন ও চমস্কি এ রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাতিল করে দিয়েছেন। তাদের প্রোপাগান্ডা মডেলে পাঁচটি ফিল্টার তারা চিহ্নিত করেছেন, যা আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করে কেন ও কীভাবে মূলধারার মার্কিন মিডিয়া এলিটদের স্বার্থে কাজ করে চলে এবং তাদের পক্ষে নিরন্তর সম্মতি উৎপাদন করে চলে। প্রথম ছাঁকনটি হল মিডিয়ার মালিকানা- মার্কিন মুল্লুকে গুটিকয়েক কর্পোরেশন প্রায় সমস্ত মিডিয়ার মালিক। এসব কর্পোরেশনের আছে বিভিন্ন শিল্প-ব্যবসা। মিডিয়ার আধেয়ে এমন কোন বিষয় থকতে পারবে না যা তাদের কর্পোরেট স্বার্থকে ক্ষুণœ করে। বাংলাদেশ থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। গণমাধ্যমের সমালোচনা করে মাইকেল প্যারেন্টির অনুবাদ দৈনিক যুগান্তরে ধারাবহিকভাবে প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রথম কিস্তি ছ্পাা হওয়ার পরেই পত্রিকার সহ-সম্পাদক সেই লেখার অনুবাদককে বলে দেন যে, তিনি আর লেখাটি ছাপতে পারবেন না। তিনি হাউজের ভেতর থেকে চাপ অনুভব করছেন। কাজেই বলা চলে যে আর মালিকানা মিডিয়া একই পথে একই গতিতে চলে আসছে সেই প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত।
বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন ও তার মালিকানা:
টেলিভিশনের যাত্রা শুরুর সময়টি খুব বেশি দিনের নয়। ১৯২৬ সালে জন বেয়ার্ডের টেলিভিশন আবিষ্কারের পরে ১৯৩০ সালে ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং করপোরেশন এবং বৃটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন যথাক্রমে নিউইয়র্ক এবং লন্ডনে টিভি স্টেশন স্থাপনের মধ্য দিয়ে টেলিভিশনের পথচলা শুরু হয়। ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসে বিবিসি আলেকজান্দ্রা প্রসাদ থেকে সর্বসাধারণের জন্য সম্প্রচার শুরু করে। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম সার্থক টেলিভিশন স¤প্রচার।
বাংলাদেশে প্রথম টেলিভিশন স¤প্রচার শুরু হয় ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে। তবে তার আগে ওই বছরের ১ এপ্রিল অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জামিল চৌধুরি। টিভির প্রথম অফিস ছিল অধ্যক্ষের কামরায় পরে তা ডিআইটি ভবনে স্থাতন্তরিত হয়। তখন সম্বল ছিল একটি স্টুডিও, দুটি ক্যামেরা, দুটি ফিল্ম টিভি প্রজেকটর আর ৩০০ ওয়টের একটি ক্ষুদ্র ট্রান্সমিটার, যার ক্ষমতা ছিল মাত্র ১০ মাইল। এরপর ১৯৬৮ সালে ১৪ এপ্রিল রামপুরায় টেলিভিশন ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৯৭৫ সলে। ১৭ ডিসেম্বর থেকে এটি ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ নামে যাত্রা শুরু করে এবং ২১ ডিসেম্বর থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশে নব্বই এর দশকে স্যাটালাইট আসার পর ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেল। এক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, এ যাবতকাল ২৭ টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এসেছে । তবে বর্তমানে যে গুলো চালু আছে তারমধ্যে রয়েছে-
১) এটিএন বাংলা
২) চ্যানেল আই
৩) একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)
৪) এন টিভি
৫) আর টিভি
৬) বাংলা ভিশন
৭) বৈশাখী টিভি
৮) চ্যানেল ওয়ান
৯) সিএসবি (সদ্য বন্ধ)
১০) দিগন্ত টিভি
১১) দেশ টিভি (পরীক্ষামূলক)
১২) রূপসী বাংলা টিভি (পরীক্ষামূলক)
১৩) ইসলামিক টিভি
এখান থেকে সবগুলো চ্যানেল নিয়ে আলোচনা না করে প্রধান প্রধান কয়েকটি নিয়ে এখন আলোচনা করব।
এটিএন বাংলা:
“অবিরাম বাংলার মুখ” শ্লোগান নিয়ে এটিএন বাংলা ১৫ জুলাই ১৯৯৭ প্রথম বেসরকারি চ্যানেল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে । তবে এতে সংবাদ প্রচার করা শুরু হয় ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট থেকে। চ্যানেলটি মূলত ৪ জন বোর্ড ডিরেক্টরর মালিকানাধীন। এর প্রধানের পদবি একইসাথে চেয়ারম্যান ও পরিচালক। বর্তমানে এর পরিচালক হচ্ছেন জনাব মাহফুজুর রহমান। প্রায় ৫০ ভাগ শেয়ারও তার দখলে আর বাকি তিনজন বোর্ড অব ডিরেক্টরের। তারা হলেন-
১) নাসির আহমেদ
২) মাকসুদুর রহমান
৩) মাহবুবুল আলম।
চ্যানেল আই:
১৯৯৯ সালে ১ অক্টোবর প্রথম ডিজিটাল চ্যানেল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে চ্যানেল আই। এর শ্লোগান হল “হৃদয়ে বাংলাদেশ”। এটি ইমপ্রেস টেলিফিল্মের একটি প্রতিষ্ঠান। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম গ্র“পের চেয়ারম্যান আবদুর রশীদ মজুমদার। চ্যানেল আই এর অনুষ্ঠান ও অর্থয়ন বিভাগের পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান শায়খ সিরাজ। তাছাড়া ছয় জন সদস্য নিয়ে একটি পরিচালনা বোর্ড রয়েছে।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি):
“পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ” এই শ্লোগান নিয়ে ৮ মার্চ ২০০০ সালে পরীক্ষামূলক ভাবে একুশে টিভি তার যাত্র শুরু করে। এরপর ১৪ এপ্রিল ২০০০ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। একুশে টেলিভিশনের মূল উদ্যেক্তা ছিলেন ইটিভির সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মাহমুদ। একুশে টেলিভিশনের ৭০ ভাগ মালিকানা টেলিভিশনটির বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের। বাকী ৩০ ভাগের মালিকানা আগের ১৩ জন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৬ জনের ৫ ভাগ করে। তারা হচ্ছেন রউফ চৌধুরি (র্যাংগস গ্র“প), এমরান মাহমুদ (মেট্রোওয়েভ), অঞ্জন চৌধুরি (স্কায়ার), আব্দুস সালাম (সারাইটেক্স), লিয়কত হোসেন (এম এ এস স্কায়ার গ্র“প), তপন চৌধুরি, নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরি, আজম চৌধুরি, রুমি হোসেন, এ কে সালেক।
এন টিভি:
২০০৩ সালে ৩ জুলাই “সময়ের সাথে আগামীর পথে” শ্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করে এন টিভি। চ্যানেলটির মোট ১৩ জন মালিক রয়েছেন। মোসাদ্দেক আলী ফালু হচ্ছেন চেয়ারম্যান এবং এনায়েতুর রহমান বাপ্পী এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাকী ১১ জন পরিচালক।
আর টিভি:
আর টিভির যাত্রা পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় ১ ডিসেম্বর ২০০৫, এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তা চালু হয় ২৬ ডিসেম্বর ২০০৬। এই টিভির শ্লোগান হচ্ছে “ আজ ও আগামীর”। এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মোসাদ্দেক আলী ফালু। তবে বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ম. হামিদ। সূচনা লগ্নে আর টিভিতে যুবক ফোনের শেয়ার ছিল। বর্তমানে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার আছে।
বাংলা ভিশন:
“দৃষ্টিজুড়ে দেশ” নিয়ে যে চ্যানেল ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করে তা হল বাংলা ভিশন। এটি ৩১ মার্চ ২০০৬ থেকে আনুষ্ঠানিক স¤প্রচারে যায়। শ্যামল বাংলা লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান। মালিক সংখ্যা ১০ জন। এই ১০জনের সম্মতিতে নির্বচিত হন চেয়ারম্যান। বর্তমানে এর চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল হক। প্রধান নির্বহী পরিচালক জনাব মুস্তাফিজুর রহমান।
বৈশাখী টিভি:
বৈশাখী টিভির পরীক্ষামূলক স¤প্রচার শুরু হয় ২৭ ডিসেম্বর২০০৫। এরপর ১৪ এপ্রিল ২০০৬ এ এটি পূর্ণ প্রচারে যায়। বৈশাখী টিভির অর্থয়নে রয়েছেন তিনজন। তারা হলেন বেঙ্গল গ্র“পের প্রধান মোরশেদ আলম, এম এন এইচ বুলু, এবং কে এম শহীদুল্লাহ।
চ্যানেল ওয়ান:
চ্যানেল ওয়ান “সম্ভাবনার কথা বলে,নতুন কিছু দেখতে, নতুন কিছু দেখাতে” এই শ্লেগান নিয়ে তার পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করে ১৭ জানুয়রি ২০০৬। তারপর একই বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে এটি আনুষ্ঠানিক ভাবে পথচলা শুরু করে। এই টিভি সাতজন পরিচালক দ্বারা পরিচালিত। এর চেয়ারম্যান হচ্ছেন এম. এ. এইচ সেলিম। মালিকানার মধ্যে ওয়ান গ্র“প, এস আলম, বসুন্ধরা গ্র“প এবং কোহিনুর কোম্পানি রয়েছে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, (ভারপ্রপ্ত পরিচালক হচ্ছেন প্রফেসর মাজেদুল ইসলাম)।
সিএসবি:
ফোকাস মাল্টমিডিয়া গ্র“প এবং সিটি গ্র“প এর অর্থয়নে ২০০৭ এ বাংলাদেশের প্রথশ ২৪ ঘণ্টাব্যাপী সংবাদ চ্যনেল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে সিএসবি। এতে ফোকাস মাল্টমিডিয়া গ্র“প ৪০ ভাগ এবং সিটি গ্র“পের ৬০ ভাগ শেয়ার আছে। সিএসবি তে প্রাথমিক ভাবে খরচ হয় ৯০ কোটি টাকা। এর চেয়ারম্যান ছিলেন জনাব ফজলুর রহমান এবং এর এমডি ছিলেন জনাব ফজলুর কাদের চৌধুরি। তবে ২০০৭ সলের আগস্ট মাসে যে ছাত্র বিক্ষোপ হয় তা সংবাদ প্রচার করে সরকারের বিরাগ ভাজন হয় ফলে সরকার বিভিন্ন অজুহাত তুলে এটি বন্ধ করে দেয়।
দিগন্ত টিভি:
দিগন্ত টিভি “ সত্য ও সুন্দরের পক্ষে” এই শ্লোগান নিয়ে ৭ অক্টোবর ২০০৮ এ যাত্রা শুরু করেছে। এতে ২৩ জন মালিকের যৌথ অংশদারিত্ব রয়েছে। দেগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশন, ফেমাস গ্র“প, শাহজালাল ব্যাংক, বিআরবি ক্যাবল, ইবনে সিনা এগুলো উল্লেখ্যযোগ্য । এর মূল কমিটির প্রধান হলেন আতাউর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলী।
দেশ টিভি:
২০০৮ সালের প্রথম দিকে দেশ টিভি তার পরীক্ষামূলক স¤প্রচার শুরু করে এবং এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরু করেনি। এর অর্থয়নে রয়েছেন সাবের হোসেন চৌধুরি। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান নূর (অসমর্থিত সূত্রে)।
ইসলামিক টিভি:
১০ এপ্রিল ২০০৭ থেকে ইসলামিক টিভি চালু হয় । তবে একে পূর্ণ টিভি চ্যানেল হিসাবে মেনে নিতে অনেকে রাজি নন। এর মালিকানা ব্রডকাস্ট ইসলামিক ওয়াল্ড লিমিটেড। মোট অংশীদার আছে ছয়জন। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর (অবঃ) সাঈদ ইস্কান্দার।
মিডিয়া মালিকানার কর্তৃত্ব : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের মিডিয়া মূলত ধনিক অভিমুখীন, এলিট অভিমুখীন ও পুরুষ অভিমুখীন। বাংলাদেশে মূলধারার সকল মিডিয়া মুক্তবাজার অর্থনীতিকে মতাদর্শ হিসাবে মেনে নিয়েছে; বাংলাদেশে একটি কর্পোরেট সংস্কৃতি গড়ে তোলার পক্ষে তাদের ওকালাতি। বাংলাদেশে মূলধারার টিভিগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠি, নারী, অন্য ধর্মাবলম্বী আর আদিবাসীদের অবস্থান কেন প্রান্তিক এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে টিভিগুলোর চরিত্র আর তার মালিকানা বিশ্লেষণ করলেই। সরকারি বা বেসরকারি কোন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নাটকে নায়ক/নায়িকা বা অন্য কোন ভূমিকায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান চরিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে না কোন আদিবাসী চরিত্র। কারণ মিডিয়া মালিকানা তাদের হাতে নেই। গণমাধ্যমের অনুষ্ঠানে নারীর যে বিকৃত আর বিক্রিত ইমেজ প্রতিফলিত হয় তার কারণ পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়া মালিকানা, নারীর হাতে মিডিয়া মালিকানা নেই। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের কথা এখানে আসে না আসে শহুরে ধনিক আর এলিট শ্রেণীর কথকতা কারণ মাকিানা তাদের হাতে। তাই অনেকে বর্তমান বাংলাদেশের মিডিয়াকে ‘ম্যাস মিডিয়া’ না বলে ‘ক্লাস মিডিয়া’ বলেন আবার অনেকে বলেন ‘মেল মিডিয়া’।
বাংলাদেশে গত এক দশকে গণমাধ্যমের মালিকানা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন আর কোন ব্যক্তি বা একক সংস্থা নয়, রেডিও টিভির মালিক হচ্ছেন কোন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা গ্র“প অব কোম্পানিজ। পশ্চিমের মতো একই হাউজ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, আর টিভি চ্যানেল বের হচ্ছে। ‘মহান’ পেশায় অবদান রাখা বা সমাজে উন্নয়নের চিন্তা নয় বরং মুনাফা অর্জন, রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ কিংবা কোম্পানির অন্য ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এখন কাগজ বেরুচ্ছে, টিভির চ্যানেল গজাচ্ছে। মিডিয়া পরিণত হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিতে। তবে যে বিষয়টি দুঃখজনক তা হলো আমরা দেখছি, মিডিয়ার মালিকানা চলে যাচ্ছে মাস্তান, দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক আর দুষ্ট লোকদের হাতে। নষ্ট রাজনীতিক আর দুষ্টু ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক আর রাজনৈতিক স্বার্থে সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলের মালিক হচ্ছেন।
১/১১ এর পর অন্তত এক ডজন মিডিয়া মালিক ,যাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে একসময় চারদিক কাঁপত, দুর্নীতির অভিযোগে তারা এখন কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সাংসদ, যার বিরুদ্ধে কারচুপি ভোটে সাংসদ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে,সেই মোসাদ্দেক আলী ফালুর মালিকানাতেই আছে তিনটি মিডিয়া এনটিভি, আরটিভি, দৈনিক আমার দেশ। চ্যানেল ওয়ানের গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, বৈশাখীর মালিক মির্জা আব্বাস, দৈনিক যুগান্তরের মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল, ফাল্গুন মিউজিকের কর্ণধার ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা, দৈনিক জনকন্ঠের মালিক আতিকুল্লা খান মাসুদ। এরা সবাই ছিলেন কারাগারে। এসব মিডিয়ার মালিকরা স্বাধীন বা সাহসিকতার জন্য জেলে যাননি এদের বিরুদ্ধে রয়েছে অবৈধভাবে বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলার অভিযোগ, অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতা অপব্যবহারের, অভিযোগ রয়েছে জোর খাটিয়ে অপরের সম্পত্তি দখলের। এ ছাড়া ১৫ মার্চ ২০০৭ তথ্য মন্ত্রনালয়ের অনুমতি না নিয়ে অনুষ্ঠান নির্মান করায় ৭টি টিভি চ্যানেল সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর ২০০৭ সালে এপ্রিলে রূপসী বাংলা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হায়দারকে প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
তাহলে আমরা বুঝতে পারছি যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মালিকদের যে কীর্তি তা যে তারা তাদের চ্যানেলের মাধ্যমে লাঘব করে দেশের মানুষের কাছে সাধু সাজতে চায়। একটি টিভি চ্যানেল থাকলে সেই চ্যানেল অন্তত তার পক্ষে প্রচারণা চালাবে এটাই স্বাভাবিক । কাজেই এই চ্যানেল গুলোকে তারা ব্যবহার করেছে তাদের রক্ষাকবচ হিসাবে। চ্যানেলের কোন ব্যক্তিই এই মালিকানার বাইরে কথা বলতে পারে না। বাংলাদেশের মিডিয় মালিকানার এই হচ্ছে হাল-হকিকত।
মিডিয়া মালিকানা কেমন হওয়া উচিত : কিছু সুপারিশ
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মিডিয়ার কাজ সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চোখে চোখে রাখা, তাদের ভুলচুক-ত্র“টিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। মানুষ প্রত্যাশা করে সরকারি, বেসরকারি, বহুজাতিক বা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান- যাদের কাজের সঙ্গে জনগনের স্বার্থ জড়িত মিডিয়া তাদের কাজের উপর নজরদারি রাখাবে, জনবিরোধী বা কোন অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতি হলে সেসবের সমালোচনা করবে। মিডিয়াকে তাই ‘আই অব গভর্নমেন্ট’ বলা হয় আবার অনেকে বলেন ‘ওয়াচ ডগ’। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা এর উল্টো। এখানে মিডিয়া মালিকের জন্য, মালিকের পক্ষে, এবং শুধুমাত্র সরকারের কথা বলে।
বলা হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন পঁচে গেছে তেমনি পঁচে গেছে মিডিয়া মালিকানা। তাই মালিকানাতে আনতে হবে গুণগত পরিবর্তন। কালো টাকার মালিক, নষ্ট ব্যবসায়ী আর দুষ্টু রাজনীতিবিদদের হাত খপ্পর থেকে বাঁচাতে হবে বেসরকারি চ্যানেল আর সরকারের রোষানল থেকে বাঁচাতে হবে দেশের সরকারি মিডিয়াকে।
জনগনের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্টের তথ্যপ্রবাহ এমন হবে যেখানে ‘যেখানে সরকার চাহিবামাত্র মালিকগণ জনগনকে তথ্য জানাতে বাধ্য থাকবে’। গণমাধ্যম হবে গণমুখী, এক্ষেত্রে এলিটদের স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে সাধারণ জনগনের দিকে নজর দিতে হবে । টিভিতে আপামর জনসাধারণের কথা আসতে হবে এবং তাদের চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে অনুষ্ঠান তৈরি করতে হবে। দর্শকদের শুধু গৌণ বিবেচনা করা যাবে না তাদের উপকার হয় এমন সব অনুষ্ঠান তৈরি করতে হবে এবং প্রচার করতে হবে। কমিউনিটি রেডিওর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি:
আগেই বলা হয়েছে বাংলাদেশের মিডিয়া মূলত ধনিক অভিমূখীন, শহর অভিমূখীন, এলিট ও পুরুষ অভিমূখীন; এবং এর কারণ মিডিয়া মালিকদের শ্রেণীচরিত্র, তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও লিঙ্গগত অবস্থান। এদের কাছে মুনাফা অর্জন, দ্রুত ব্যবসায়িক উন্নতি লাভ, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল, আর কর্পোরেট স্বার্থ তাদের কাছে মুখ্য আর জনস্বার্থের বিষয়টি তাদের কাছ গৌণ। কাজেই র্তৃণমূল মানুষের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় এরা কাজ করবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আমাদের দেশের টিভিগুলোতে খুব সামান্য পরিমান সময় বরাদ্দ করা হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য। তাও আবার উপস্থাপন করা হয় প্রাণহীনভাবে। নারীর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যাতে কোন ক্লাইমেক্স/সেন্সেশন নেই তা কখনো সংবাদ হয় না। দেশের ৯৯ ভাগ নারীর সংগ্রামী আর বঞ্চিত জীবনে যেহেতু সেন্সেশন নেই তাই তার সংবাদ কখনো টিভিতে আসেনা। কিন্তু হতদরিদ্র কুমারিটি মা হলে, সংগ্রামী নারী ধর্ষনের স্বীকার হলে, কারো মুখ এসিডে ঝলসে গেলে। মুনাফালোভী চ্যানেলগুলো এই নারীদের চিত্র দিয়ে সংবাদের কাটতি বাড়ায়। দু-একটা ভাল কাজ যে এরা করে না তা নয় কিন্তু তার পেছনেও থাকে স্বার্থবাদী চিন্তা বা নির্বচনী চিন্তার সূক্ষ্ম কারসাজি। তৃণমূল নারী-পুরুষ কতটা আর কিভাবে আসছে বিবেচনার বিষয় কিন্তু শুধু সেটা নয়। দেখতে হবে গণমাধ্যমে সাধারণ মানুষের বাস্তব প্রবেশাধিকার আসলে কতটুকু ?
কতজন মানুষ এদেশে খররের কাগজ পড়তে পারে, কতজন পত্রিকা পড়ে বুঝতে পারে, কতজনের সামর্থ আছে পত্রিকা কিনে পড়ার, দেশের কতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ আছে, কোন কোন জায়গায় ক্যাবল টিভি দেখার সুযোগ আছে, কতজনের সামর্থ আছে তা কিনে দেখার,আর রেডিও-টিভির অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের, সব মিলিয়ে মিডিয়ার ওপর জনগনের নিয়ন্ত্রণ আসলে কতখানি-গণমাধ্যমে জনগনের সত্যিকারের প্রবেশাধিকারের আলোচনায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। আর এর চেয়েও জরুরি যে প্রশ্ন তা হল গণমাধ্যমের পরিচালনা বা মালিকানায় জনগনের কোন অংশভাগ/অংশগ্রহণ আছে কিনা।
বলা খুব সহজে যে, নষ্ট রাজনীতিক, দুষ্টু ব্যবসায়িক আর দায়িত্বহীন সরকারের মালিকানা থেকে বাংলদেশের মিডিয়া জগতকে মুক্ত করা না গেলে জন-মানুষের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা সম্ভব না, কিন্তু এদের খপ্পর থেকে মিডিয়াকে মুক্ত করা খুবই কঠিন । তাই তৃণমূল মানুুষের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের বিকল্পের সন্ধান করতে হবে। মূলধারার মিডিয়া জগৎ তা করতে পারবে বলে আশা করাও দুরাশা।
তবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো মতো যদি আবার সকল মালিকানা সরকারের হাতে চলে যায় তবে আবারও আগের চেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দিবে কারণ তখন নিজের দেশের সংবাদ পাবার জন্য অন্যদেশের মিডিয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে। তাই মালিকানা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার । তাহলে প্রশ্ন হল মিডিয়ার মালিক কে হবে। মালিক হবে জনগন। জনগন যদি মিডিয়ার মালিক হয় তাহলে তারা তাদের সমস্যা ভালভবে বের করতে পারবে এবং তার সমাধান করতে পারবে। সমাজের সত্যিকার সত্যগুলো বের হয়ে আসবে,বের হয়ে আসবে তৃণমূল মানুষের কথা এবং দরিদ্র মানুষের বঞ্চনার কাহিনী।
শেষের কথা:
পৌলোমী সেনগুপ্ত তার ‘টিভি মন্থনে বিষ ও অমৃত’ নিবন্ধে বলেন, “এইভাবে এক অমোঘ জাদুকাঠির ছোঁয়ায় পাল্টে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, পরিচিত পরিমণ্ডল। এই মাধ্যমটি হাতে কলমে খুলে দিয়েছিল বিশ্বের বাতায়ন, পৃথিবীকে অতিথি করে এনেছিল সবার ঘরে, দূরকে এনে দিয়েছিল কাছে। জানা আর অজানাকে মিলিয়ে দিয়েছিল কাছে এক অদ্ভুত বুঝতে শেখার আলোয়।” এ কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বর্তমান দিনে টেলিভিশনের যে গুরুত্ব তা অপরিসীম আর তাই টেলিভিশনের মালিকানা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তবে মিডিয়া মালিকরা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতা পছন্দ করে না। স্বতঃপ্রবর্তিত হয়ে মালিকরা কোনদিনই তথ্য নিশ্চিত করবে না। তারা চায়, সবকিছুই তাদের কারো না কারো নিয়ন্ত্রণে থাকুক । তাই জনগনকেই এবিষয়ে সতর্ক হতে হবে। তথ্য অধিকার তাদেরকে আদায় করে নিতে হবে। তথ্য গোপন করা হলে জনগনের কর্মদক্ষতা কমে যায় এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গুণগত বিবেচনার অভাব দেখা দেয়,দুর্নীতি বেড়ে যায়। তাই দেশের উন্নয়নের জন্য দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার জন্য মালিকানার ধরন পরিবর্তন করার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে দেশকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হবে।