১.
ঠা ঠা রোদ্দুর,
বাস থেকে নেমেই টের পেলাম শহরের নিস্প্রাণ কোন এক কোণে নেমে পড়েছি। কলারের ওপরে উনুনের আঁচ টের পেলে আমার আফসোসের অন্ত রইল না আর, ঘামে শরীর সেঁটে বসা শার্টের হাতায় মুখের ঘাম মুছে নিতে গেলে মনটা বিষিয়ে উঠলো; হাঁটতে হবে বেশ কিছুদুর। বেশ অদ্ভুত একটা দৃশ্য, ফুটপাতের বাঁপাশে যতদুর চোখ যায় শুধু দেয়াল, ডানপাশে রাস্তা, শত শত যানবাহন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও শব্দ নেই বললেই চলে। প্রায় নির্জন ফুটপাতে হাঁটা শুরু হল এবার।
তখনই চোখে পড়লো ব্যাপারটা, দুটো দেয়ালের মাঝে প্রায় অস্পৃশ্য এক কোণে একটা চায়ের দোকান, চালার নিচে কৃপণ ছায়ায় একটা বেঞ্চি, ওতে বসে আছে একজন ট্রাফিক পুলিশ, আর একজন হকার। চোখের কোণ দিয়ে তাকাই, হকারের সাথে আলাপে মশগুল মাঝবয়েসী পুলিশ, ঘাড়ের উপর রাখা ডানহাত; জাঁতিতে সুপারি কাটে দোকানদার।
অনাহারে থাকা পাকস্থলী বিষিয়ে উঠছে হঠাৎ, সেটাকে দমিয়ে রাখবার প্রয়োজন বোধ হলো। এগিয়ে যাই দোকেনের দিকে। ততক্ষণে কমবয়েসী হকারের পিঠে হাত বোলানো শুরু করেছে পুলিশ, পরিষ্কার একটা হাসি ঝুলে আছে ঠোঁটে, কিশোরটার কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলল। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে মাথা আরো খানিক নামিয়ে ফেললো কিশোরটি।
"গোল্ডলীফ দেন একটা..." নোটটা এগিয়ে দেই। কাটা সুপারির টুকোরোগুলো একটা কৌটায় রেখে আমার দিকে তাকালো প্রবীণ। হ্যাঁ, ঐ বিতৃষ্ণা আমি চিনি। সিগারেটটা নিয়ে ধরাই, অসাড় জিহবায় তেতো স্বাদ পাকস্থলীতে মোচড় দেয়। অধৈর্য্য পুলিশ সশব্দে শ্বাস ছাড়ে তখন, দোকানদার বলে ওঠে,
"লাল চা দিমু?"
চা আমি চাইলাম কখন? তবুও না বলতে গিয়ে থমকে যাই। পুলিশটার কোঁচকানো ভুরুর দিকে তাকিয়ে বলি,
"চিনি কম দিয়ো।"
খানিক সরে বসে হকারটা,
অস্ফুট স্বরে খিস্তি করে ওঠে মাঝবয়েসী পুলিশ।
আল্গোছে মুচকি হাসি আমি।
২.
প্রশ্ন করলাম,
"জানাচ্ছেন ক্যানো?"
তাতে তিনি হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন, "এই যে বেঁচে আছি..."
বেঁচে আছেন? হ্যাঁ, তা তো বটেই। অস্তিত্বের জানান দেয়াটা তো সম্ভব এখনও, দ্বিতীয় সন্তানের আগমনের সংবাদে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিলো বেশ কিছুদিন ওনার, সামলে উঠেছেন এই ক'মাসে অবশ্য। আমি খানিক স্বস্তিবোধ করি, অন্যের সমস্যা শোনাটা বড় বিরক্তিকর ঠেকে। এই যে, এতসব সমস্যাতে ভুগছি আমি অথচ সেসবের গল্প ফাঁদার সুযোগ নেই। মাঝবয়েসী গৃহিণীদের হিংসে করি কদাচিৎ।
পচন ধরা কিছু আলু বাছতে বাছতে এবার জিজ্ঞেস করি, "নাম কি রাখছেন এটার, ঠিক করলেন আপনারা কিছু?"
"যন্ত্রণা!" হাতে ধরা কাগজের ব্যাগের এককোণ ছিঁড়ে গেলো হঠাৎ করেই। সামলাতে সামলাতে খেয়াল হল ওনার, "কি যেন বললেন?"
"নাহ, কিছু নয়"
আলগোছে মুচকি হাসি আমি।
৩.
নির্বাসিত তুমি কোনো অন্ধকারে?
অথচ এখানে অর্ধমৃতরা ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। পুরনো ক্ষতস্থানে পালক আঁচড়ে শব্দ বের করে আনে ক্রোধান্বিত মিথ্যেরা। সহস্র সময়ের আশ্রয় দেবে? কারণ সম্প্রতি কেউ তার পাহারাদার কিংবা রক্ষক হবার প্রস্তাব দিয়েছিলো, আমি সানন্দে প্রত্যাখ্যান করলে নখর বাড়িয়ে তেড়ে এসেছিল সে। সুতো ছিঁড়ে গেছে সেই কবে, এখন পেছনে ফিরে ছাপগুলো মুছে যাচ্ছো সম্ভবত। এদিকে আমি দু আঙুলে ক্ষীয়মান হৃৎপিন্ড চেপে ছুটছি এখনও, ফাটল ধরা মাংসপেশীতে আঁচড়ের দাগ। আমাকে দু'দণ্ড সময় দাও,
বিনিময়ে প্রার্থনা করি,
তোমার আনাচে কানাচে ছায়াঘন গলিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বেনামী লাশেরা শুভ্রতর হোক।