"হ্যালো?"
"কি রে, ঘুমাচ্ছিস?"
"ক্যানো?"
"যাবি না জানাযায়......"
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকি। বললাম,
"না", কেটে দিলাম কলটা এরপর। ফাঁকা ফ্ল্যাটে বসে থাকি একা, মন প্রচন্ড খারাপ। সিগারেট ধরিয়ে আপনমনে ভাবলাম, সাব্বিরের দোষ নেই। না বলব এটা ভাবে নাই সে একেবারেই। আমার প্রিয় কবির জানাযা আজ, আমি যাবো না এটা ভাবা ওর জন্যে বেশ কঠিন।
আজকে চারবছর ঘুরে এলো তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৭ই আগষ্ট। মনে পড়ায় দ্রুত লিখে ফেলছি এই পোষ্ট...
ইনাকে চিনেছিলাম ছোটবেলায়, ঘুণে ধরা বুকশেলফের কোনায়, "রাজনৈতিক কবিতার সংকলন" কিংবা "দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে" দিয়ে। তখনও বাবা মায়ের তরুণ জীবনের খানিক চিহ্ন খুঁজে পেতাম সেসব আশির দশকের কবিতার বইগুলোতে। তাঁরা বাধা দেননি কখনো কবিতা পড়তে। প্রচন্ড প্রভাবিত হয়েছিলাম তখন, ৭১ খুব বেশি পরিচিত নয়, ৫২ এর চেতনা মগজে গেঁড়ে বসেনি ঠিকমত বয়েসের কারণে, স্বৈরাচার কি বুঝতামও না। তারপরও "উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ" কিংবা "মেষরে মেষ, তুই আছিস বেশ..." নাড়া দিয়েছিলো খানিক।
কৈশোরের শুরুতে পরিচিত হয়েছিলাম "বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা" কিংবা "স্বাধীনতা তুমি"-র সাথে। চমৎকার পরিচয় ছিল সেটা। "ইকারুসের আকাশ" কিংবা "বন্দী শিবির থেকে" ওলটপালট করে দিয়েছিল অনেক কিছুই। কবিতাগুলো কেনো জানি সহজ পেতাম, ধারালো পেতাম, অলংকরণের আধিক্যে জর্জরিত হই নি। একিলিসের গোড়ালী প্রথম চিনেছিলাম একটা কবিতাতে, মজার তাই না! কিংবা কবিদের দুঃখ দিতে নেই...
দুঃখ দিলে কবিরা হাওয়ায় হাওয়ায় নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর। কবি প্রজাতিটাকে কাছ থেকে দেখবার ইচ্ছে জেগেছিলো অনেক তখন। নাগরিক কবি, উনাকে দেখতাম নাগরিক কবি বলে সবাই। নগরে বাস করে আপন করে নিয়েছিলেন শহটাকে ভালোভাবেই, লেখায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত সেসব।
ভালো লেগেছিলো "এক ফোঁটা কেমন অনল "।
এযুগের একজন তরুণ হয়ে শামসুর রাহমান প্রিয় কবি বলাটা জানিনা কতটুকু স্মার্ট। জীবনানন্দ বললে মানাতো হয়ত,
এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
"কবিতা আমার জীবনের একটা প্রধান জিনিস। খারাপ লিখি ভালো লিখি আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি, অন্যদের কবিতা পড়ি, যে কালকে লিখছে তারও কবিতা পড়ি, পেলে আর কি। কবিতাকে ভালোবাসি।"
একারণে আমিও এখন ভালোবাসি কাব্য, ভালো না লাগলেও ভালোবাসি, এমনকী না বুঝলেও। এখনো আমাদের চশমা আঁটা উত্তরাধুনিকেরা পিছু ছাড়েন নি তাঁর। তাঁর লেখালেখির গুরত্ব নিয়ে কাঁটাছেড়া চলে অনেক। ৭১ এ যুদ্ধে যাননি কেনো এ প্রশ্ন উঠেছে বহুবার। আমরা সাধারণ পাঠকেরা সেসব রাজকীয় হংসকূলের কেউ নই, উনার কবিতা পড়েছি, ভালো লেগেছে।
ব্যাস, এটুকুই। হয়তো নব্বইয়ের পরে কবি খানিক ধারগুলো হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাতে কি! স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন পুরোটা সময়। কতটা সময় ধরে তাঁর কবিতাগুলো প্রতিনিধিত্ব করেছে বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের!
সাহিত্যবোদ্ধারা ছিদ্রান্বেষ করতে থাকুন, ৭১-বিরোধী চেতনা ধারণকারীরা "নির্ধার্মিক" দোষে তাঁকে অশ্রদ্ধা জানাতে থাকো... কিন্তু আমরা সাধারণেরা তাঁকে ভালোবেসে যাবো, তাঁর কবিতা পড়ে যাবো। আমরা সহজ এবং সুন্দরে বিশ্বাস করে যাবো। মৃদুভাষী এই কবি প্রিয় থাকবেন সবসময়...
অনেকবার প্রশ্ন শুনেছি আমার সংক্ষিপ্ত ব্লগিংকালে, "এই নিকে লিখবার কারণ কি?" কিংবা শুনেছি "নিকটা খুব অদ্ভুত!" জবাবও দিয়েছি কয়েকবার, নিকটা প্রিয় কবির একটা কবিতার নাম।
সত্যি বলতে কি, পরিচয় নেই কিংবা খুব বেশি ইচ্ছে নেই দেখার, আধপোড়া চাঁদ, সোনালী শুরুয়ায় ভাসা একটুকরো মাছ, চাঁদকপালী গরু কিংবা বেতের মতোন টানটান যুবতীর শরীর। গলা ফাটিয়ে কারো চোখে আঙুল দিয়ে সত্য দেখানোর প্রত্যয়ও নেই আমার। হাজার হলেও আমি এই অকৃতজ্ঞ প্রজন্মের একজন। কৈশোরেই চেতনা পিচের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেছে, এখন রক্তমাংসের কংকালে সময়যাপন করে যাচ্ছি নির্বোধের মত। কতছর হবে কোন কবিতার বই খুলে দেখিনি? অশুভশক্তিরা বৃষভকন্ঠে চেঁচায়ে গেলেও কানে তুলো গুঁজে নির্বিবাদী থেকেছি?
তারপরও ১০মাস ২ হপ্তা আগে যখন সামহোয়্যারইন ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করছিলাম, "বাংলায় আপনার নাম"-ঘরটাতে লেখবার সময় দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই কীবোর্ডে টাইপ করেছিলাম,
"আমি উঠে এসেছি সৎকারবিহীন"
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ৯:০৭