শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
রিক্সাওয়ালা আমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনি তো আচ্ছা লোক! এই নদীর পথ একলা একলা রওয়না দিয়েছেন! আপনাকে তো কানাভুলা ভুতে ধরেছিল! আপনাকে পথ ভুল করে অন্য রাস্তায় নিয়ে এসেছিল! ভাগ্য ভালো আপনি বিলের রাস্তায় যান নাই। বিলের রাস্তায় গেলে আপনাকে বিলের পানিতে নামিয়ে চুবিয়ে মারতো! এটাতো নীল কুঠির বিল! এই বিলের পশ্চিম পার্শ্বে পুরানো শ্মশান ঘাট আছে। বাপ দাদার কাছে গল্প শুনেছি, আগে নাকি এই বিলে গভীর রাতে ভুতেরা আলো জ্বালিয়ে ঘোরাঘুরি করতো। প্রায় অমাবশ্যা রাতেই শ্মশান ঘাট থেকে ভুতের হিহি হাহা হাসির শব্দ শোনা যেত। ভয়ে সন্ধ্যার পরে কেউ ঐ এলাকায় যেত না।
রিক্সাওয়ালার কথা শুনে ভয়ে চুপসে গেলাম। ভীতু কণ্ঠে জানার আগ্রহ নিয়ে বললাম, বিলে কি এখনো ভুত আছে ভাই?
লোকটি আমার কথা শুনে আশ্চার্য হওয়ার ভাব নিয়ে বলল, বলেন কি, ভুত আছে মানে! প্রতিবছরই তো দুই একজন লোক ওই বিলে মারা যায়! গত বছরও তো সন্ধার সময় মাছ ধরতে গিয়ে একজন পানিতে ডুব দিয়ে আর উঠতে পারলো না। সেই লাশ একদিন পর মধ্য বিলে ভেসে উঠল।
বিক্সাওয়ালার কথায় ভয়ে শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ভুতেরা কি রাতের বেলা কোন আকার ধারন করে?
রিক্সাওয়ালা বলল, আপনার তো কপাল ভাল সামনে কিছু পড়ে নাই। সন্ধার পরে কেউ ওই বিলে একা যায় না। গেলেই ঘোড়া, শুকর, বিড়াল, মানুষ, কখনওবা সাদা কাপড় পরা বিধবা সেজে সামনে এসে দাঁড়ায়। ভয় পেলেই অমনি ঘাড় মটকে রক্ত খেয়ে বিলের মাঝখানে নিয়ে পুঁতে ফেলে।
তার কথা শুনে আমার গা শিউরে উঠল। ঘোড়া, শুকুর, বিড়াল, মানুষ তো আমি নিজেও দেখেছি। শুধু তাই নয়, বিলের ভিতর কিরকম যেন অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল, সে সব শব্দ শুনেও আমি সেদিকে তাকাইনি। কথাগুলা মনে হতেই শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। রাতের ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলি মনে পড়ায় ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। না জানার করণে উপস্থিত দৃশ্য দেখে যতো না ভয় পেয়েছিলাম, রিক্সাওয়ালার কাছে শুনে তার চেয়ে বেশি ভয় পেতে লাগলাম। ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না।
আমি রিক্সাওয়ালার কাছে রাতের বিভিন্ন দৃশ্য আর আঁউ আঁউ করতে করতে চাষীর লাঙল জোয়াল ফেলে পালানোর ঘটনাগুলো বললাম না। বললে হয়তো মাতব্বরের মত নানা উপদেশ দেয়া শুরু করবে নয়তো তিরস্কার করবে। তার চেয়ে না বলে চুপ করে থাকা শ্রেয় মনে করলাম।
রিক্সায় উঠে ক্লান্ত শরীরে রাতের ভয়ংকর ভুতের ঘটনা মনে করতে করতে ঝিমুতে লাগলাম। রাতের সব ঘটনা চোখে ভাসতে লাগল। এসব কল্পনা করতে করতে কখন যে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছি বুঝতে পারিনি। রিক্সাওয়ালার কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। মনে মনে রিক্সাওয়ালাকে ধন্যবাদ দিলাম। কারণ ডবল ভাড়া নিলেও যদি রিক্সা না পেতাম, তাহলে রাত জাগা অবস্থায় ক্লান্ত, শ্রান্ত, ভয় ভীতিতে বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে এত পথ হেঁটে আসা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। এই রিক্সাওয়ালাকে না পেলে ঐ বিলের ভয়ংকর ভুতের কাহিনীও জানা হতো না।
রিক্সা থেকে নেমে ঘুম জাগা শরীরে ঢুলতে ঢুলতে যখন বাড়ি গিয়ে পৌছি তখন বেলা নয়টা বাজে। আমার রাতের কাহিনী শুনে মা আঁতকে উঠলেন। যদি দুর্ঘটনা ঘটত এই আশঙ্কায় আমাকে বকাবকি করতে করতে কেঁদে ফেললেন। মায়ের চোখের পানি দেখে আমি কাঠের পুতুলের মত নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আমার রাতের ঘটনা শুনে মা কেঁদে ফেলবে এটা কল্পনা করিনি। যদি এতটুকু অনুমান করতে পারতাম মা এই ঘটনা শুনে কাঁদবে তাহলে ভুলেও বলতাম না। মায়ের চোখের পানি আমাকে দুর্বল করে ফেলল। ভুতে আমাকে কাবু করতে না পারলেও মায়ের কাছে কাবু হয়ে গেলাম। মায়ের মনকে সান্তনা দেয়ার জন্যই ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া, টোটকা চিকিৎসা গ্রহণ করতে বাধ্য হলাম।
অন্য সময় ঢাকা থেকে আসার সাথে সাথেই মা আমাকে কিছু না কিছু খেতে দিতেন। আজকে তিনি আমাকে কিছুই খেতে দিলেন না। আমাকে ঘর থেকে বের করে এনে উঠানের মাঝখানে বড় কাঁঠালের পিঁড়ির উপর বসিয়ে রাখলেন। পিঁড়ির উপর বসিয়ে রাখা অবস্থায় দগ দগে জ্বলন্ত চুলায় লোহা পুড়ে লাল করে, সেই পোড়া লোহা পানিতে চুবিয়ে গরম গরম পানি খাইয়ে দিলেন। লোহা পোড়া পানি খাইয়েই শান্ত হলেন না, আমার খাওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত ঐ লোহা পোড়া গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিলেন। মা যাতে আর না কাঁদেন সেই কারণে বিরক্ত লাগা সত্বেও আমি তার দেয়া সমস্ত নিয়ম কানুন কাঠের পুতুলের মত পালন করে গেলাম। মা তার জানা মতে ভুতের ভয় থেকে সুস্থ্য হওয়ার জন্য সমস্ত খুঁটিনাটি টোটকা চিকিৎসা প্রয়োগ করলেন। আমার উপর ভুতের আছড় নাই মনে করে নিশ্চিত হওয়ার পর আমাকে ভাত খেতে দিলেন।
মায়ের কথামত অবৈজ্ঞানিকভাবে অনেক কিছু নিয়ম পালন করায় মাতৃস্নেহ শাসনের ভয় কেটে গেল বটে কিন্তু তখনও আমার ঘাড়ের উপরে পিতৃস্নেহ শাসনের গুরু গম্ভীর ধমক অপেক্ষা করতেছিল। ভাগ্য ভালো ঐ সময় আমার বাবা বাড়ি ছিলেন না। থাকলে তার কাছে মায়ের চেয়েও অনেক বেশি বকাবকি শুনতে হতো। কিন্তু পরে যখন এসে বাবা আমার রাতের ঘটনা শুনলেন, তখন আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়েছি। রাতের এমন ঘটনায় যদি খারাপ কিছু ঘটতো বা ভুতের কবলে পরে মারা যেতাম, এমন আশঙ্কা করে বাবা আমাকে ঘুমের মাঝেই খানিক বকাবকি করে চলে গেলেন।
ঘুমের ভান করে মনে মনে ভাবলাম, যাক বাবা বাঁচা গেল, আর হয়তো বকাবকি করবে না। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে পা ফেলতেই দেখি বাবা বারান্দায় চেয়ারের উপর বসে আছেন। আর পালাবার পথ পেলাম না। দেখা মাত্রই রাম ধমক দিয়ে বসলেন। ধমকের চোটে চোরের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। রাতে যত না ভয় পেলাম তার চেয়ে বেশি ভয় পেলাম বাপের রাম ধমকে। মনে মনে কান ধরে তওবা করলাম ভুতের কবলে পড়ে যদি কখনো মারাও যাই তরপরেও বাড়িতে এসে আর এসব ঘটনা বলা যাবে না।
(সমাপ্ত)