“সহ্য করবে না, এই জুলুম আল্লাহ সহ্য করবে না। আল্লাহর বিচার যেদিন হবে সেদিন আর উপায় থাকবে না তোদের। সেদিন বুঝবি, আল্লাহ অন্যায় সহ্য করেনা। সেদিন তোদের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ থাকবে না।”
এভাবেই সকাল থেকে রাজুর চায়ের দোকানে বসে আহাজারি করতে থাকে রেজা খাঁ। কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড তাকে ব্যথিত করে, মর্মাহত করে। রাগ যে তার বৃদ্ধ শরীরের বাঁকা মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে যাচ্ছে বেশ বোঝা যায়। হয়তো তার ডায়বেটিস আক্রান্ত রক্তেও প্রতিশোধের নেশা দৌড়াচ্ছে। সে বিকার গ্রস্থের মত অভিশাপের ঝাঁপি খুলে দিয়েছে আজ। এই বৃদ্ধ বয়সে অভিযোগ দেয়া ছাড়া আর কিই বা করতে পারে। এখন তো আর তার সেই রক্তের জোর নেই, নেই কোন জলপাই রঙয়ের পোশাকের সমর্থন। তার নিজের উপর নিজেরই রাগ হয়। তখন যদি আর একটু বেশী দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে, সমস্ত ভারতের দালালকে মেরে পুতে ফেলতে পারত তাহলে আর আজ এই অবিচার দেখতে হতনা। তার অজান্তেই তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যায়।কিন্তু সে প্রকাশ করতে পারেনা তার নতুন করে ভারতের দালালদের খতম করার অভিলাষ। তার এতবছরের জীবনে এই প্রথম সে তার অভিলাষ প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারেনা। সে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারে বাতাস অনুকূলে না। বলা যায়না, কোন দালাল টুক করে পুলিশের কাছে তার নামে কেস ঠুকে দেয়। আর রাজাকার নামে কেস হলে তো বাঁচার উপায় নেই।
“এই তোর বয়স কত?”
পাশে দাঁড়ানো সদ্য কৈশোর পেরুনো আরিফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় রেজা খাঁ। আরিফ অনেকক্ষণ থেকেই তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রেজা খাঁ তার দাদার বন্ধু। রেজা খাঁ সম্পর্কে অনেক গল্প সে শুনেছে তার দাদার কাছে, তাদের দুইজনের বন্ধুত্বের সূচনা হয় সেই একাত্তরে। সেই গল্প তার দাদা করে মজা পায়।পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে তাদের ওঠাবসার গল্প, তাদের সাথে কত তামাসাই না করেছে। আহা রে, অফিসার ছিল তারা, কী তাদের তেজ,আর কী তাদের গঠন! দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। দাদা, গল্প বলে আর হাসে।
“একদিন হয়েছে কি এক মেজর চুল কাটবে তো আমাকে বলল এক নাপিত ডেকে আনতে। আমি উর্দু বুঝি তাই আমার বুঝতে কোন সমস্যা হলনা। আর আমরা তখন খুব উর্দু কথা বলতাম। উর্দুতে কথা বলার সুখ আলাদা। ভাষাটাতে একটা ছন্দ আছে, সাধারণ কথা বার্তাও মনে হয় পদ্য। তো আমি শমসের নাপিতকে যেয়ে বললাম হুজুরের বাল কাটতে হবে, চল। সে তো ভয়েই জড়সড়। আর্মি অফিসারের কাছে কে যেতে চায় বল। আমি বললাম ভয় কী, আমি তো আছি। তুই উর্দু বলবি, হুজুর খুশী হবে। শমসের মনে সাহস নিয়ে আমার পিছুপিছু চলল। ক্যাম্পের কাছে যেয়ে তো তার পা সরে না। আমি তাকে বললাম কোন ভয় নেই, এই হুজুর খুব ভালো। আমি তাকে নিয়ে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর স্কুলের সামনের বড় শিশু গাছের ছায়ায় আরাম চেয়ারে শুয়ে আছেন। আমি সালাম দেয়াতে তিনি তাকালেন। নাপিত দেখে খুশিই হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ‘তুম বাল কাট সাক্তা হো?’ শমসের কিছুটা ভয়, কিছুটা উত্তেজনায় সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ‘ আপ প্যান্ট খোলেগা, হাম বাল কাটেগা।’ হুজুর প্যান্ট খোলার কথা শুনে তো সেই ক্ষ্যাপা। আমাকে বলে ধর ব্যাটাকে। তারপর তাকে শিশু গাছের সাথে বেঁধে রাখতে বলে। আমি অনুনয় করেও তাকে ছাড়াতে পারিনা। হুজুর তাকে বেত দিয়ে পিটায়। পরে আমি রেজা খাঁকে বলি হুজুরকে বুঝাতে যে সে আসলে চুলকে উর্দুতে যে বাল বলে তা বোঝেনি। পরে রেজা খাঁ আর আমি মিলে হুজুরকে বলে ওকে ছাড়িয়ে আনি।’ রেজা খাঁর প্রভাব ছিল অনেক বেশী। সে কোন এলাকায় কে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে, কারা পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে সব খবর ঠিকঠাক জোগাড় করে আনত। আরিফ রেজা খাঁকে সম্মান করে। রেজা খাঁর ইসলামের জন্য জীবন বাজী রাখাকে সম্মান না করে পারেনা। তার উপর আবার সে তার দাদার বন্ধু।
“আঠারো, দাদা।” – আরিফ উত্তর দেয় রেজা খাঁর প্রশ্নের। উত্তর শুনে রেজা খাঁ খুশী হয়। সে বলতে থাকে তার আশেপাশে জমা হওয়া লোকদের উদ্দেশ্য করে।
“দেখেছ। এতটুকু ছেলের বয়স আঠারো। এখন ঠিকমত দাড়ি গজায় নি। এখন যদি বলি এই ছেলে মানুষ খুন করেছে হাজার হাজার, শ’য়ে শ’য়ে নারী ধর্ষণ করেছে তাহলে তা মেনে নেয়া যায়? ধর্ষণ কী জিনিস তাই তো বোঝার কথা না তার। অথচ ধর্ষণের দায়ে, খুনের দায়ে ফাঁসি দিয়ে দিল। সহ্য করবে না , আল্লাহ সহ্য করবে না। এই জুলুম, এই অবিচার সহ্য করবে না। এটা আসলে দেশ থেকে ইসলাম দূর করার ষড়যন্ত্র। বেঁছে বেঁছে সব ইসলামের জন্য যারা কাজ করছে তাদেরকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র। আহারে, এই দেশে আর ইসলাম থাকবে না। সব হিন্দু, নাস্তিক হয়ে যাবে। আল্লাহ, তুমি এই দেশকে এই জালিদের হাত থেকে রক্ষা কর।”
উজ্জ্বল পাশের মিজান চাচার দোকানে এসেছিল এক হালি ডিম কিনতে। সে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে অনার্সে পড়ে। সে রেজা খাঁর এই আহাজারি শুনে ডিম নিয়ে ফেরার সময় রেজা খাঁকে জিজ্ঞেস করে, দাদা, আপনার ছেলে মহমুদ্দুল্লার সার্টিফিকেট বয়স কত?
রেজা খাঁ তাকিয়ে উজ্জ্বলকে দেখে। সে জানে এই ছুড়া তার ছেলের সাথেই পড়ে। সে বলে কেন, ২০ বছর। রেজা খাঁ কথাটা বলেই বুঝতে পারে সে প্যাঁচে পড়ে গেছে। তার ছেলে আর এক বছরের মাঝে অনার্স শেষ করে ফেলবে। সেই বয়স বছর তিনেক কমিয়ে দিয়েছিল সরকারী চাকরি বেশী দিন যাতে করা যায়। সে উজ্জ্বলের দিকে না তাকিয়ে শুধু গজগজ করতে করতে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। জটলার মাঝ থেকে একজন বলে ওঠে শালা, রাজাকার।