কিছু বই আছে যার ভাষাশৈলী পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। কিছু বইয়ের কথা একান্ত নিজের। লেখকের রোমান্টিকতাকে নিজের প্রতিচ্ছবি বলে মনে হয়, মনে হয় পূর্বজন্মে আমি এই লেখক ছিলাম। কিন্তু কিছু বই আছে যার কথা পাঠকের মনের কথা নয়, যার ভাষা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার বদলে অনবরত চাবুক মারতে থাকে । পাঠক টানা পড়ে যেতে পারে না; কিছুক্ষণ পর পর তার বিশ্রাম নিতে হয়; তার মস্তিস্ক বেশি আঘাত সহ্য করতে পারেনা। কিছুটা ধাতস্ত হয়ে সে আবার সেই বইয়ের কাছে ফেরত যায়। তার সুকুমার বৃত্তি রক্তাক্ত হয়, সে তার একান্ত ভাবনার জগৎ তার রোমান্টিকতা ভুলে বাস্তব জগতকে দেখে। তার আশেপাশের কুৎসিত সমাজ নজরে পড়ায় রাগে, দুঃখে অভিমানে কুঁকড়ে যায়; অমানবিক,নষ্ট, পচে যাওয়া অকৃতজ্ঞ সমাজকে এতদিন মাথায় তুলে নাচত বলে একটা অপরাধবোধে আক্রান্ত হয় এবং ধিক্কার দিতে থাকে তার এবং তার পূর্বপুরুষদের বীর্যহীনতায়।
নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটির সাদাসিধে ভাষা পাঠককে আঘাত করে। একান্ত আটপৌরে ভাষায় লেখা এই বইটি টানা পড়ে যাওয়া কঠিন। বইটির যেকোন পৃষ্ঠা আপনাকে বেদানাহত করবে, কাঁদাবে এবং প্রতিটি সময়ে আপনার দিকে আঙ্গুল তুলে জানাবে আপনি অকৃতজ্ঞ। বইটি অনেকদিন চোখের সামনে ছিল কিন্তু পড়া হয়ে ওঠেনি। কেন পড়িনি জানি না। শুধু নামটায় জানা ছিল, কখনো ভিতরে প্রবেশ করিনি। আমার এক বন্ধুর অনুরোধে আমি বইটা পড়তে শুরু করি। কিন্তু এই বইটা পড়া শুরু করে আমি অন্যকিছুতে মনঃস্থির করতে পারিনি। কিছুদূর পড়েছি, মস্তিস্কে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক শক খেয়েছি, কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকেছি। তারপর আবার পড়তে শুরু করেছি। পাকিস্তানি ও এইদেশের কিছু জারজ সন্তানদের দ্বারা নির্যাতিত হতভাগা লাখো মেয়েদের মাঝে কয়েকজন মেয়ের নির্যাতন এবং পরবর্তীতে এই নির্বীর্য সমাজের মানুষের দ্বারা প্রতিক্ষণে মানসিক ভাবে ধর্ষিত হওয়ার মর্মস্পর্শী আত্মকথা নিয়েই এই বই রচিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাওয়া যেকোন উপাধি গর্বের। আর তাই বীরশ্রেষ্ঠ থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা, সব উপাধি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় এবং ব্যবহৃত হয় নামের সাথেই। কিন্তু একটা উপাধি রয়ে গেছে অব্যক্ত। যদিও তার গালভরা নামটি বেশ লাগে শুনতে; বীরাঙ্গনা- বীর অঙ্গ যে রমণীর। যদিও বাঙালি এখন এই শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে ফেলেছে। অন্য যেকোন উপাধি যেমন অলংকার, এই উপাধিটি তেমন গলার কাঁটা। এই পচে যাওয়া সমাজ আর কিছু পারুক কি না পারুক প্রথম থেকেই উলটে দিয়েছে এই শব্দের অর্থ। এখন বীরাঙ্গনা উচ্চারণের সময় বীর অঙ্গের কথা বাঙালি ভাবে না, ভাবে বারাঙ্গনার কথা। মাসের পর মাস পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচার সহ্য করার পর বেঁচে যাওয়া এইসব লক্ষ লক্ষ নারীর সামনে আমাদের নতজানু হওয়ার কথা থাকলেও আমরা তা হয়নি বরং গালি দিয়েছি ‘বেবুশ্যে মাগী’ বলে, সামনে আড়ালে সর্বত্র। পাকিস্তানি ও এই দেশের দালালদের দ্বারা মাসের পর মাস অত্যাচার সহ্য করেও ইনারা পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি; পেয়েছেন সামাজিক ধিক্কার, ঘৃণা।
নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি থেকে আমরা দেখতে পাই একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী নির্মমতা। কারো ভাইকে খুঁজতে এসে না পেয়ে তুলে নিয়েছে বোনকে, কেউ সন্তানকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেয়ে আর ফিরতে পারেননি, আটকে গেছেন হায়েনাদের জালে, কেউ ছোট ভাইকে নিয়ে পালাতে যেয়ে, কেউ থানায় বাবাকে খুঁজতে যেয়ে নরপশুদের লালসার শিকার হয়েছেন। তারপর মাসের পর মাস থাকতে হয়েছে অন্ধকার ঘরে, চলেছে পালাক্রমে ধর্ষন। অনেকদিন পরপর হায়েনাদের প্রয়োজনে গোসল করতে দেয়া হয়েছে। খাদ্য হিসেবে দেয়া হয়েছে রুটি আর ঘ্যাট। দিনের পর দিন একই রুটিন চলেছে। কখনো বা এক ক্যাম্প থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে আরেক ক্যাম্পে কিন্তু পরিবর্তন হয়নি ভাগ্যের। কেউ যদি এর মাঝে গর্ভধারন করতেন তাঁকে বাঁচিয়ে দেয়া হত এই নির্মম অত্যাচার থেকে এই পৃথিবীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে। সবার জবানবন্দীতে একই জিনিস ঘুরে ফিরে আসে। স্থান কাল পাত্র আলাদা হলেও ভাগ্যের কোন হেরফের হয়না।
“উনি বেশিরভাগ সময়ই একা একা উপরের দিকে থাকিয়ে থাকতেন। মনে হতো যেন বাইরের আলো দেখবার জন্য ছিদ্র খুঁজছেন। ক’দিন পর আপা অসুস্থ হলো। শুয়ে থাকত। ওকে শাড়ি পরিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তার দেখাবার জন্য। আপা আর ফিরলো না। ভাবলাম আপা বুঝি মুক্তি পেয়েছেন, অথবা হাসপাতালে আছেন। কিন্তু না, আমাদের এখানে এক বুড়ি মত জমাদারনী ছিল, বলল, আপা গর্ভবতী হয়েছিল তাই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে।”
এরপর দেশ স্বাধীন হল। এইসব মায়েরা সুর্যস্নান করলেন কিন্তু আবিষ্কার করলেন সমাজের সবচেয়ে অন্ধকার রূপ। তাঁদের পতিতা মনে করা হল। বাবা মা ভাই আত্মীয় স্বজন তাঁদের জায়গা দিলেন না। তাঁরা অস্পৃশ্য হয়ে গেলেন। বীরাঙ্গনাদের জায়গা দিলে সমাজে মান থাকে না। অথচ তাঁদের রক্ষা করার জন্য কেউ কিছু করেনি। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে রাজাকার সবাই তাঁদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। অথচ তাঁরা জানেন না তাদের অপরাধ কী। স্বাধীন দেশ সবার, শুধু সবচেয়ে অত্যাচার সহ্য করা এইসব রমণীদের নয়। যদিবা কেউ পরিবারে জায়গা পেয়েছেন, তাঁর বাবা মাকে দেখতে হয়েছে সমাজিক জীবের ঘৃণা ভরা দৃষ্টি। যেখানে ভালোবেসে বরণ করার কথা ছিল সেখানে পরিবারে আশ্রয় পেয়েও সমাজের হীনমন্যতার কারণে তাঁদের ঘর ছাড়তে হয়েছে।
“ময়না কিছু বুঝবার বা জানবার আগেই আম্মা ছুটে এসে তার দু’গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন। রাগে কথা বলতে পারছে না, চিবিয়ে বললো, ফিরে এলি কেন? যে নরকে গিয়েছিলি সেখানেই থাকতে পারলি না? ওরা এতো লোক মেরেছে তোকে চোখে দেখলো না? কোন সাহস নিয়ে এই পাপদেহ নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছিস বল? বল………….
আমার সমস্ত দেহটা জ্বলে যাচ্ছে। আঘাতের দুঃখে নয়, অকারণ অপমানে। আমি তো আব্বার জন্যই থানায় গয়েছিলাম। আব্বা ছাড়া পেলেন আমি বন্দি হলাম। আর সে কারণে আম্মা আমাকে মরতে বলছেন। অথচ আমি ফিরে এলে ওরা যে খুশই হয়েছিলেন তাও তো মিথ্যে নয়। ”
হ্যা, এই নষ্ট সমাজ এঁদের রক্ষা করতে পারেনি পাকিস্তানি জারজদের হাত থেকে, বরং তুলে দিয়েছে তাদের হাতে কিন্তু যখন তাঁরা ফেরত এসেছেন, দেয়া হয়নি সমাজে জায়গা। মা-বাবা অপমানিত হয়েছেন। অপমানিত হয়েছে ভাই বোন।
না, সবার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। কেউ কেউ পরিবার পেয়েছিলেন। বেশীর ভাগই পাননি। এই বইয়ে সমস্ত বীরাঙ্গনা মায়ের হদিস মেলে না। গুটিকয়েকের হদিস মেলে যারা প্রায় সবাই লেখাপড়া জানা মেয়ে। তাঁরা সমাজের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। কেউ আবার পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে, তাঁর সব দিয়ে পাওয়া এই স্বাধীন বাংলাকে আমাদের জন্য রেখে। বিদেশে মান সম্মান, বৈষয়িক সুখ সুবিধে পেলেও মনের প্রশান্তি মেলেনি। চেয়েছেন গায়ে মাখতে এদেশের মাটি, চেয়েছেন নিশ্বাস নিতে প্রাণ ভরে এদেশের হাওয়ায়। কিন্তু স্বাধীনতার এতোটা বছর পরও মানসিকতার কোন উৎকর্ষ হয়নি এই জাতির। তাই তাঁরা ফিরতে পারেন নি দেশে তাদের মর্যাদা নিয়ে। বরং রাজাকারেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সাংসদ-মন্ত্রী হয়েছে, গাড়িতে উঠেছে লাল-সবুজ পতাকা। আমরা আমাদের স্পর্ধা, তেজ হারিয়েছি, এই মায়েরা কষ্ট পেয়েছেন, আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন আমাদের নিস্কৃয়তা, আমাদের শক্তিহীনতাকে।
“ পুরুষেরা মনে হয় আরও বীর্যহীন পৌরুষহীন হয়ে পড়েছে, নইলে রাজাকার, আলবদর মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী?”
বীরাঙ্গনা মায়েরা দেশের কাছ থেকে কিছুই আর চাননা । আর কিইবা চাওয়ার আছে। দেশ কিইবা দিতে পারে তাঁদের। তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান সময় তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন দেশের জন্য। যা ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা নেই এই দেশের। এতো ত্যাগ স্বীকার করা মানুষকে কিছু দিতে চাওয়ার মত স্পর্ধা নেই এ জাতির। তাঁরা তাই বুড়িয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধ প্রজম্নের কাছে কিছুই আশা করেন না। তাঁরা আশা করেন মুক্তিযুদ্ধ উত্তর কোন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে তাঁদের স্মরণ করবে শ্রদ্ধা ভরে। তাঁদের স্থান দেবে একজন হৃদয়ের মাঝে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এই ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের দেশটিকে তাদের দান করার জন্য।
“ একটা জিনিস, একটি মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ বা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা, আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কণ্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহুর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো।”