তোমার শহরের ধুলো মেখে
চলছি বিপুল অন্ধকারে”
সম্ভবত ২০০৭ সালে কোন এক শুভক্ষণে কোন এক শুভ ব্যক্তির কারণে “আকাশ মেঘে ঢাকা” গানটা শুনেছিলাম। গানটার প্রপার্টিজ এ গিয়ে জানলাম ব্যান্ড এবং অ্যালবামের নাম। মেঘদল ব্যান্ডের দ্রোহে মন্ত্রে ভালবাসা আমার লাগবেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে অ্যালবামটা সংগ্রহ করে শুনেই বুঝলাম- এই তো অন্য এক জিনিস। সেই থেকে মেঘদলের সাথে সন্ধি।
বাংলা গানের অনেক রকম ধরণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন লিরিকের এবং ভিন্ন কম্পোজিশনের একটি ব্যান্ড “মেঘদল”। গান পাগলা হিসেবে দেশী বিদেশী অনেক ব্যান্ডের গান শুনলেও পিঙ্ক ফ্লয়েডের মত নাড়া দিতে পারে এইরকম একটি ব্যান্ড “মেঘদল”। হ্যাঁ মাহমুদুজ্জামান বাবু এবং উনার মৃত্তিকার স্বাদ মেঘদলের চেয়ে অন্যরকম হলেও খুব একটা কম না। তবে “মেঘদল” প্রথম পছন্দ।
২০০০ সালে শিবু, সুমন ও উজ্জ্বল তিনবন্ধু গান করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চারুকলার বিভিন্ন কনসার্টে। আজিজ সুপার মার্কেটের ৪০, গ্র্যাফিকাল ইকোতে অ্যানিমেশনের কাজও করতেন একসাথে। সেই ‘পারলৌকিক কামরা’র নাম দিয়েছিলেন ‘এথেন্স’। এথেন্সেই গিটার, হারমোনিয়াম দিয়ে চর্চা করতেন।
“ওম” কম্পোজিশনটা দিয়ে মূলত শুরু হয় মেঘদলের যাত্রা।‘ওম’ গানটার প্রাথমিক ধারণা তিন বন্ধুর, সেটার সাথে উজ্জ্বল যুক্ত করেন লিরিক। তারপর তিনজন বন্ধু মিলেই কাজটা দাঁড় করান।এরমধ্যেই তারা অনুভব করলেন, তাদের একটি গানের দল করা প্রয়োজন। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসের ২২ তারিখে চারুকলার একটি কনসার্টকে বেছে নিলেন তাদের নতুন ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হিসেবে।
ফরাসি কবি বোঁদলেয়ারের কবিতা থেকে নামটি নেয়া হয়েছে। (আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল/ কবিতা-অচেনা মানুষ; শার্ল বোঁদলেয়ার)। মেঘদল এই পর্যন্ত দুটি স্টুডিও অ্যালবাম (দ্রোহে মন্ত্রে ভালবাসা এবং শহরবন্দী) ও দুটি সিঙ্গেল (ওম এবং নেফারতিতি) রিলিজ করে।
বর্তমান সদস্যঃ
মেজবাউর রহমান সুমন--- কথা, সুর, কন্ঠ
শিবু কুমার শীল-------- কথা, সুর, কন্ঠ
রাশীদ শরিফ সোয়েব ----- গিটার, কন্ঠ
এম জি কিবরিয়া-------- বেজ
আমজাদ হোসেন------- ড্রামস
তানভির দাউদ রনি----- কী-বোর্ডস
সৌরভ সরকার (বাঁশি)
“হ্যালোজেন রোদ চিলতে বারান্দায়
ঠিকঠিকি তাই বলছে ভবিষ্যত”
শিবুদাকে যখন জিজ্ঞেস করা হল এই ধরণের ব্যান্ড করার পেছন কার প্রেরণা। তিনি বলেছেন - আমার স্কুল ছিল পোগজ স্কুল, পুরনো শহরে। আমার জীবনের এই অংশটা আমাকে অনেক কিছু ভাবতে শিখিয়েছে। গানে তার প্রভাব পড়েছে। এখন সেই চিন্তা আরও পরিশোধিত হয়েছে। তো সব মিলে একটা সমাজতাত্ত্বিক বোঝাপড়ার গানের ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছিল। আমি যেদিন কবির সুমন শুনলাম বা মহীনের ঘোড়াগুলি বা প্রতুল বা পিঙ্ক ফ্লয়েড- আমি ভেবেছি এই কথাগুলো আমারও। আমিও এই কথাগুলো বলতে চাই। আমি গাইতে পারবো এমন একটা আত্মবিশ্বাস আমার ছিল কিন্তু লিখতে পারবো সেটা ভাবি নি। সুমন আর উজ্জ্বল আমাকে সেই অনুপ্রেরণা দিলো, আমি আমার কথাই লিখলাম গানে। আর আরও বিস্তৃতভাবে দেখলে দুনিয়ার সঙ্গীত বিষয়ক তাবৎ জিনিসই আমার অনুপ্রেরণা।
যখন থেকে মেঘদলের পথচলা সেসময়ই এই দুর্বোধ্য লিরিকে এবং গম্ভীর কম্পোজিশনে গান করাটা অন্য কেউ তখন বা এখনো চিন্তা করতে পারে না। সেই দুঃসাহস খুব কম শিল্পীদেরই হয়ে থাকে। অন্যরা যখন গতানুগতিক লিরিক আর সুর নিয়ে জনপ্রিয় হতে ব্যস্ত, সেখানে মেঘদল নিয়ে আসলো সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের গান।
প্রথম অ্যালবাম এবং দ্বিতীয় অ্যালবামের লিরিকের মাঝেও অনেক পার্থক্য দেখা যায়। দ্রোহে মন্ত্রে ভালবাসাতে দ্রোহটায় বেশী ছিল, কিন্তু শহরবন্দীতে সেটা খানিকটা বেদনা বেধুর হয়ে গেল। প্রথম অ্যালবামের ক্লাস্টার ফুল, বোমারু ভগবান, পুতিন, বা জ্যাক শিরাক এই ব্যাপারগুলো দ্বিতীয় অ্যালবামে অনুপস্থিত।
তবে লিরিকের ব্যাপারে সুমন ভাইয়ের লিরিকগুলো শীবুদার লিরিকের চেয়ে সহজবোধ্য।
মেঘদলের গানের কিছু ব্যাপার আছে, যেমন ধরুন রঙ্গিন ফেরেশতা গানটা শোনার সময় নাকি নিজেকে ইঁদুর মনে করলে সহজেই লিরিক বুঝা যাবে। হাহাহা... অ্যালবাম কভারও কিন্তু প্রায় একি ইঙ্গিত দেয়।
সময়,স্থান, মানসিক চিন্তা ভাবনা মিলিয়ে নিলে হয়ত লিরিকগুলো মিলে যাবে জীবনের কিছু বাস্তবতার সাথে। কি আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিটি লাইনে ফুটিয়ে তুলেছে জীবনের কত কথা।
“শহরবন্দী মেঘ
উড়ে ঘুরে একা
আমাদের এই সুবর্ণ নগরে”
বিষাক্ত ঢাকাকে এতো সুন্দর করে কভার করেছে আপনাকে সত্যিই মুগ্ধ করবে।
জনরার ব্যাপারের শীবুদার মন্তব্য –“আমাদের গানের ফর্ম নিয়ে অনেকেই নানা কথা বলে, একটা জনারে ফেলতে চায়। আমি নিজেও এর উত্তর জানি না। আমরা একটা ব্যান্ড, আমরা দলীয়ভাবে গান করছি- কিন্তু কি করছি তাঁর ব্যাখ্যা সব সময় আমাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব না। এটা একটা প্রক্রিয়া বড়জোর”
আপনারা অনেকেই পারভেজ নামক এক শিল্পীর “কথা” শিরোনামের গানটি শুনেছেন নিশ্চয়ই। এই গানের লিরিকও “মেঘদল”-এর সম্পত্তি। সোজা কথায় – চুরি করা হয়েছে। কিভাবে সেই কাহিনী অন্য পোষ্টে জানানোর চেষ্টা করব।
লিখতে বসার আগে অনেক ভেবেও যখন কিছু পাচ্ছিলাম না, কেমনে পাবো লিরিকগুলোয় তো মাথার উপর দিয়ে যায়। তাই অনেক কিছু জোড়া তালি দিয়ে এর বেশী আগানো সম্ভব নয়। তবে এইটা আমি শিওর যে কেউ যদি চিরকুট বা জলের গানকে মেঘদলের সাথে তুলনা করতে চান তাহলে তাকে আগে “মুঠোফোন”-এর তরজমা করে দিতে হবে।
বাংলাদেশের সংগীত প্রেমীরা দুটি ব্যান্ডের অ্যালবামের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। আর্টসেল এবং মেঘদল। যদিও ইতিমধ্যে আর্টসেল “অতৃতীয়” শিরোনামে তৃতীয় অ্যালবামের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু মেঘদল সেই ২০১৩ সাল থেকেই অ্যালবাম আসবে আসবে বলে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন?
তথ্যসূত্রঃ
• শফি, কিবরিয়া ভাই এবং শীবুদার কথোপকথন।
• উইকিপেডিয়া
• মনে না থাকা আরো কিছু ওয়েবসাইট
• মেঘদলের নোট
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:২০