আজ সুদীর্ঘ বারো বছর পর ডাক্তার জামাল চাচা দেশে ফিরলেন।অবিরল প্রশান্তির দীপ্তিতে ভরে গেলো আমাদের মন। কিন্তু চাচাজান বাড়ী আসতে না আসতেই খবর এলো মোতালিব স্যারের ছোট ছেলে খুবই অসুস্থ,একেবারে যায় যায় অবস্থা।চাচা ,আর মুহুর্ত দেরী করলেন না,দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি মুছে গেলো নিমিষেই। বাবার কথা রীতিমত অগ্রাহ্য করে -চাচা আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন স্যারের বাড়ীর উদ্দ্যেশে।
কিন্তু গ্রামের মেঠো পথ,সেই জোনাকি আর তারার আলো দেখে দেখে হাঁটা।মাঝে মাঝে সরু বিলের আইল ধরে আমরা হাঁটছি।গ্রামে রাত অল্পতেই নিশি।তবুও জোছনা মেঘের আড়ালে মৃগনাভীর মতো মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়।
আমি বলি, চাচা,কাল সকালে আসলেই হতো।এতো পথ পাড়ি দিয়ে তুমি এলে সামান্য বিশ্রামের ও সুযোগ হলোনা।
চাচা বলেন,চল হাঁটতে হাঁটতে সুন্দর একটা গল্প বলি।তাহলে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে,আর বুঝতে পারবি,কেন আমি এতো তাড়া অনুভব করলাম।
চাচা, গল্প শুরু করেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।
ঠিক এমনি এক নির্জন গ্রামে ,সেই সুদূর স্কটল্যান্ডে অস্তমিত সূর্য্য ডুবি ডুবি করছে।দিনের উজ্ঝ্বলতা শিথীল হয়ে আসছে।নীলিমার আকাশে গুটিয়ে নিয়েছে পাখি তার ডানা।ঘরে ফিরার পালায় মহাকালে আরো একটা দিন।আরো কিছু জমিতে শষ্যের স্বপ্নে বিভোর এক দারিদ্র্য প্রান্তিক কৃষক।নিথর,নিস্তব্ধ ,প্রান্তরে ধূষর ভূমিতে তিনি একমনে স্বপ্ন বুনে চলেছেন।হঠাত কৃষক শুনতে পান গোংগানি,কী নির্মম গোংগানি,বাতাসে চাবুকের মতো চিরে চিরে কানে এসে বিঁধছে।
মুহুর্ত মাত্র দেরী না করে কৃষক হৃদয় ভাংগা গোংগানির পানে ছুটতে থাকেন।বেশী দূরে না,জলাশয়ের অল্পদূরে চোরাবালিতে আটকা পড়ে তলিয়ে যাচ্ছে এক কিশোর।একেবারে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি। মধ্যবয়সী কৃষক জীবনবাজি রেখে কিশোরকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন।
কয়েকদিন পর কৃষক তার কুঁড়েঘরের সামনে দেখেন সুন্দর ,সুবেশীত একজন পরিপাটি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি কিছুই বুঝতে পারেন না। ভদ্রলোক আঁশটে ঘামের ,কর্দমাক্ত কৃষককে বুকে জড়িয়ে ধরেন।বলেন-জনাব,আপনি আমার ছেলেকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন।চোখ থেকে অশ্রুদানা গড়িয়ে পড়ছে তার।আপনার পদযুগলে আমাকে স্থান দিন, আর বলুন,কীভাবে আপনার খেদমত করতে পারি।
কৃষক বলেন, হে মহানুভব,আপনি যে কষ্ট করে এতদূর পথে এসেছেন তাতেই আমি মুগ্ধ হয়েছি,আর কিছু চাইনা। সেদিন শুধু আমি আমার কর্তব্যটুকু পালন করেছি মাত্র ।
ইতোমধ্যে,সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে দারিদ্র্য কৃষকের অপুস্ট সন্তান।হাড়ভাংগা শরীর যেন পুরো সভ্যতাকে উপহাস করছে। ভদ্রলোক এবার বলেন,আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তবে আপনার সন্তানের শিক্ষার ভারটুকু আমাকে দিন।
দিন যায়, বছর যায়, সময় মহাসময়ে আরো স্ফীত হয়। কিন্তু, পৃথিবীর মানুষ কী জানে- স্বপ্ন, জীবনের উচ্ছ্বাস,কোথাও আলোর নিশানা শূন্যের ভিতর থেকে মেঘ খন্ডকে সরিয়ে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠছে দিনে দিনে। হ্যাঁ,তাই, সেন্ট মেরি'স হসপিটালের মেডিক্যাল স্কুল একদিন আলোকিত হয়ে ওঠে,আর সে আলো শুধু লন্ডনে না ছড়িয়ে পড়ে কুটিরে কুটিরে।পৃথিবীর বিখ্যাত সব পত্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে একটি নাম।নতুন আবিষ্কৃত "পেনিসিলিন"নিওমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর জীবন রামধুনর আভায় রাংগিয়ে দেয়।শৈশবে অপুষ্ট শরীরে যেখানে কোনোদিন সজীবতার প্রলেপ লাগেনি,দরিদ্র কৃষকের সেই ছেলেটি মানুষের জীবন সন্জিবনী প্রলেপ নিয়ে আবির্ভূত হন।
আমি বলি, চাচা কার কথা বলছো তুমি?
সেই কৃষকের ছেলে,আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, দুনিয়া ব্যাপী যিনি স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নামে পরিচিত ।
আমি একেবার চমকে ওঠি।
চাচা বলেন, আরো কথা আছে,এখনো গল্প শেষ হয়নি।
কিছুদিন পর,আবার সেই অভিজাত লোকটির ছেলে প্রচন্ড নিওমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়।জীবন আবারো বিপন্ন।কিন্তু পেনিসিলিন বাঁচিয়ে দিলো তাঁর জীবন আরেকবার।আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন দিয়ে শিক্ষার পিছনে ভদ্রলোকের দায় এভাবে পরিশোধ করে গেলেন।আর নিওমোনিয়া থেকে জীবন ফিরে পাওয়া লোকটি কে জানিস?
স্যার উইনস্টন চার্চিল, আর উনার পিতা ছিলেন লর্ড র্যান্ডলফ চার্চিল,যিনি দরিদ্র ফ্লেমিংয়ের শিক্ষার ভার গ্রহন করেছিলেন।
আমি বলি, চাচা-চার্চিল ত্রিশের দশকে প্রচন্ড রোগে ভুগেছিলেন জানি।পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয় কত সালে ১৯২৮ কিংবা ১৯২৯ সালে। কিন্তু এরকম যোগসূত্রতো আগে শুনিনি।তুমি কি আমাকে বলবে-ইতিহাসে এর সত্যতা কতুটুকু?
আমাদের গল্প শেষ হতে না হতেই আমরা মোতালেব স্যারের উঠোনে পা রাখি।যেখানে জীবনের পাশাপাশি ভ্রুকুটিল চোখে হানা পেতে আছে মৃত্যু।চাচা,স্যারকে কদমবুচি করেন, আমিও করি। ঘন্টাখানেক পরে নিস্তরংগ জীবনে মসৃন আলোর ভরসা রেখে ধীরে ধীরে আমরা বাড়ীর পথ ধরি।
চাচা বলেন, আজকে আমার জনম স্বার্থক হয়েছে,এতুটুকু ধূলিপরিমান ৃণবোধ শোধের যে কী সুখ।
জানিস,তোর মা বলেছেন কিনা জানিনা। দারিদ্র্যের সাথে প্রতিনিয়ত জীবন ঘষে ঘষে চলা ছিলো আমাদের জীবন।পড়নের ন্যাংটিও ছিলোনা,বারিষার টানা বর্ষন থেকে ঘর বাঁচাতো শনের ছাউনি।সেখানে পড়ালেখা ছিলো রীতিমত বিলাসীতা,ভাবতে এখন তোর অবাক লাগতে পারে।তখন এই মোতালেব স্যারই আমার সমস্ত পড়ালিখার খরচ যোগান দিয়েছিলেন।তাঁরও কি দারিদ্র্য কম ছিলো। সামান্য একজন প্রাইমারী শিক্ষক কত টাকাই বা পেতেন।সেদিন যদি তিনি মার্বেল আর গুলতি খেলা
সেই ছেলেকে ধরে এনে পাঠশালার বেন্চে না বসাতেন,তাহলে তোর পরনের এই জিন্স শোভা পেতোনা।আজ সুদীর্ঘ বারো বছর পর,আমার মন টানলো দেশে আসতে,আজই আসলাম।আর আমার কী সীমাহীন সৌভাগ্য দেখ,স্যারের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াতে পারলাম।শুধু সামান্য একটু ভরসা পেয়ে দেখেছিস স্যারের চোখ কেমন আনন্দে চিকচিক করছিলো।চাচার চোখে পানি দেখে আমিও অন্ধকারে মুখ লুকোই,রাতের আঁধারকে বড় বেশী আপন মনে হয়।উজ্জ্বল শফরীর মতো চাচার মন বুঝতে পারি,ভাবলাম এখন আর ইতিহাসে ফিরে গিয়ে লাভ নেই।এক অসীম অন্ধকার আকাশের নীচে এক কিশোরের বুকের নরম জমিনে চাচা জীবনের আলোর এক নতুন দানা বুনে দিয়েছেন।
রাতের নিস্তবদ্ধতা ভেংগে চাচা বলেন-পুরো পৃথিবী এক মহা শৃংখলে বাঁধা।চোখ বন্ধ করে বুকের উপর একবার হাতখানা রাখ।কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিস কি?
আহবান,আহবান,আহ্বান।
যতক্ষন এ শব্দ থাকবে ,বুঝবি কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে আছে।মুঠোভরে কিছু দিতে না পারিস,মুখভরে অকৃত্তিম হাসিটুকু দিতে ভুলিস না।সময় থেকে মহাসময়ে মানুষে মানুষে সম্পর্কের টানে আছে এক ভালোবাসার খেয়া,সেই খেয়ায় একবার ওঠতে পারলে দেখবি-কী পরম প্রশান্তি।সীমাহীন অন্ধকার মহাশূন্যেও খুঁজে পাবি চির দীপ্তিমান আলোর প্রতিসারী। একটা কথা মনে রাখিস-
People may not remember exactly what you did,or what you said,but they will always remember how you made them feel.
আর মানুষের জন্য ভালোবাসা, মানুষের জন্য কল্যান কাওকে কখনো শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয় না।মানুষ কী আর এমনি এমনি বলে-
"What goes around comes around"
আমি শুধু বুঝতে পারি ,আজকের রাত্রি আমার বুকে নক্ষত্রের এক অনুপম নদী হয়ে রইলো। পূবাকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে।চাচা আর আমি ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করি। আলতো করে দরজা খুলি,যেন কারো ঘুম ভেংগে না যায়।মা কিন্তু ঠিকই বলেন-কীরে তোরা এতোক্ষনে বাড়ি ফিরলি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২১